#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#চতুর্বিংশ_পর্ব (অন্তিম খন্ডাংশ-১)
৬৯.
ডক্টরের বলা কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায় সমুদ্র। তার ভাবমূর্তি একদম স্থির হয়ে গিয়েছে। মিসেস জেবা বেগমের চোখে মুখে বেশ উৎফুল্লতার ছাপ। অতি পরিমাণ বিস্ময়তা কাটিয়ে উঠতে পুনরায় থমথমে গলায় সামনে বসে থাকা গাইনোকলজিস্টকে জিজ্ঞেস করে ওঠে সমুদ্র,
– “রিয়েলি? আপনি কি সত্যি বলছেন ডক্টর? প্রাচী কি আসলেই,,?”
– “ইয়েস মিস্টার আরহাম, আপনার ওয়াইফ মিসেস প্রাচী মা হতে চলেছে এন্ড শি ইজ প্রেগন্যান্ট ফর টু মান্থস্।”
নিজের কানকে বিশ্বাস করা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছে সমুদ্রের পক্ষে। তবুও তার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি। ডক্টরকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে; উদ্দেশ্য প্রাচীর কেবিন। কেবিনের সামনে যেতেই প্রাচীর ঘুমন্ত মুখশ্রী চোখে পড়ে তার। নিষ্পলক চাহনি তার; যেন খুব নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছে। অতি সন্তর্পণে কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে সমুদ্র। বেডের পাশে চেয়ার টেনে বসে প্রাচীর বাম হাত ধীরে ধীরে নিজের মুঠোয় নিয়ে নিতেই হালকা নড়েচড়ে ওঠে প্রাচী।
পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই নিজেকে একটা বদ্ধ কেবিনের উপর আবিষ্কার করে প্রাচী। আশপাশে চোখ বুলিয়ে নিতেই সমুদ্রের চিন্তিত মুখশ্রী চোখ এড়ায় না তার।
– “সমুদ্র, আপনি? আমি এখানে কি করছি?”
ভয়ার্ত কন্ঠে সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করে ওঠে প্রাচী।
– “কবে থেকে চলছে এসব? এত বড় কথা আমাকে একবারও জানানোর বিন্দুমাত্র প্রয়োজন মনে করো নি তুমি?”
সমুদ্রের এমন থমথমে গলায় বলা কথা শুনে চুপসে যায় প্রাচী। কি লুকিয়েছে সে সমুদ্রের কাছ থেকে? তার কি কিছু হয়েছে?
– “ক,ক্,কিসের কথা বলছেন আপনি সমুদ্র? কি জানাইনি আমি আপনাকে? আর কি হয়েছে আমার?”
– “যা লুকিয়েছ তা অনেক বড় অপরাধ; আর এর জন্য শাস্তি ও পেতে হবে তোমাকে।
তোমার ভেতর ছোট্ট একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে; আমাদের অনাগত সন্তান, আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন!”
সমুদ্রের কথা কর্ণপাত হতেই পলক ফেলতে ভুলে যায় প্রাচী। চোখ দুটো তার কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের পেট স্পর্শ করে সে। আসলেই কি সমুদ্র যা বলছে তা সত্যি? তার মাঝে কি আসলেই ছোট্ট প্রাণ বেড়ে উঠছে? কেউ তাকে মা বলে ডাকবে ভাবতেই চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে প্রাচীর।
সমুদ্র প্রাচীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলে ওঠে,
– “মেহু পাখি?”
সমুদ্রের ডাক শুনে মাথা তুলে তাকায় প্রাচী।
– “থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, মেহু পাখি! আমাকে আমার জীবনের এত বড় একটা সারপ্রাইজ দিতে। তুমি ভাবতেও পারবে না আমি কত কত খুশি হয়েছি। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।”
প্রাচী প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই রুমে হুড়মুড় করে প্রবেশ করে ইশরাক, জেবা বেগম। তখন রিসিপশনে যাওয়ায় প্রাচীর খবর পায় নি সে।
– “প্রাচী? তুই ঠিক আছিস? মা যে বললো বাইরে করিডোরে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলি?”
– “ভাইয়ু, তুই শান্ত হ! আমার তেমন কিছু হয়নি। শুধু একটু মাথা ঘুরে এসেছিল আর এখন আমি একদম ঠিক আছি তো!”
বেডে শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলে উঠে প্রাচী। ইশরাক এগিয়ে আসতেই সমুদ্র উঠে গিয়ে ইশরকাকে জড়িয়ে ধরে।
– “চিন্তা করিস না ইশরাক। তোর বোনের কিছু হতে দিব না আমি। আর তোর বোনের কিছুই হয়নি; বরং তুই মামা হতে চলেছিস!”
সমুদ্রের কথা মুহূর্তের মধ্যেই পুরো কেবিন জুড়ে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। এক খুশির খবর আসতে না আসতেই দ্বিতীয় খুশির খবর চলে আসায় উপস্থিত সবাই যেন খুশিতে উৎফুল্ল।
দুপুরের দিকে ফিহার জ্ঞান আসতেই সবাই ধীরে ধীরে ফিহার কেবিনে প্রবেশ করে। চোখ খুলেই প্রথমে ইশরাককে নজরে পড়ে ফিহার।
পাশেই দোলনায় তোয়ালে জড়ানো ছোট একটা ফুটফুটে বাচ্চা। একজন নার্স এসে বাচ্চাটাকে ফিহার কাছে এগিয়ে দিতে ফিহাও সযত্নে বাচ্চাটাকে আগলে নেয়। মুখশ্রী দেখতে অনেকটাই ইশরাকের মতোন, নরম তুলতুলে হাত, পা।
৭০.
বিকেলের পর পরই বাসায় এসে পড়ে প্রাচী, সমুদ্র। বাসায় ফিরতেই কোহিনুর চৌধুরী ব্যাতি ব্যস্ত হয়ে পড়েন প্রাচীকে নিয়ে। দুপুরের দিকে সমুদ্রের সাথে ফোনে কথা হয় তার। বাসায় পৌঁছাতেই প্রাচীর বেশ খাতির যত্ন শুরু করে দেন তিনি। এর জন্য অবশ্য বেশ কয়েকদফা সমুদ্রকে কথাও শুনিয়ে দিয়েছে প্রাচী। সমুদ্র চুপচাপ এককোণে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে যাচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে।
– “এখন থেকে তোমার সব কাজ বন্ধ, প্রাচী। তুমি শুধু এখন থেকে বেড রেস্ট নিবে আর শুধু হেলদি খাবার খাবে। আর সমুদ্র তুই প্রাচীর সবসময় খেয়াল রাখবি। যখন যা লাগবে তখন ই তা এগিয়ে দিবি।”
সমুদ্র ও ভদ্র ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।
– “কিন্তু মা এখনি এত কিছু করার কি প্রয়োজন? সবে তো দু মাস হয়েছে। এখনো তো ছয় সাত মাস বাকি। আর সারাদিন বসে থাকতে বোরিং লাগবে।”
অসহায় দৃষ্টিতে কোহিনুর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে প্রাচী।
– “নো মোর এক্সকিউজ! ইটস মাই অর্ডার।”
প্রাচীকে বুঝিয়ে দিয়ে কোহিনুর চৌধুরী এক প্লেট ভর্তি ফল প্রাচীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়েন। এদিকে কোহিনুর চৌধুরী রুম থেকে বেরিয়ে পড়তেই দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী। সমুদ্রের দিকে তেড়ে গিয়ে ঝাঁজালো কন্ঠে বলে উঠে,
– “এই, এই আপনার সমস্যা কি বলুন তো! মাকে এত তাড়াতাড়ি বলার কি দরকার ছিল? আর বলেছেন ভালো কথা, এখন আপনার জন্য সারাদিন শুয়ে বসে কাটাতে হবে; কোনো কাজ ছাড়াই। ভালো লাগে না, ধ্যাত!”
রাগে আপনমনে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে প্রাচী।
– “তো কি ভুল বলেছে মা? এখন থেকে নো কাজ। আর একদিক দিয়ে আমার ভালোই হয়েছে। সারাদিন নিজের ওয়াইফির সাথে রোম্যান্স করতে পারব, সময় কাটাতে পারব। অ্যাম আই রাইট, ওয়াইফি!”
– “আপনিইইই!”
– “মা?”
পিহুর কন্ঠস্বর ভেসে আসতেই থেমে যায় প্রাচী। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই পিহু দৌড়ে এসে প্রাচীকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেয়। পিহুও খুশিমনে প্রাচীকে জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু দিয়ে বসে।
কেটে যায় দুই মাস। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পিহুর ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত ছিল প্রাচী। গত কয়েক দিন বেশ ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটেছে তার। আকাশ আর হৃদিতার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে গতকাল। আর বিয়ে জড়িত সকল অনুষ্ঠানে এটেনডেন্ট করায় শরীর বেশ দুর্বল হয়ে এসেছে তার।
– “তুমি গিয়ে নিচে গাড়িতে গিয়ে বসো। প্রাচীকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমরা ডক্টরের কাছে যাব।”
হঠাৎ সমুদ্রের কথায় ভ্রু কুঁচকে নেয় প্রাচী।
– “ডক্টর? কিন্তু কেন সমুদ্র?”
– “আজকে ডক্টরের সাথে এপোয়েন্টমেন্ট আছে। তোমার চেকআপের জন্য।”
প্রাচীও আর কোনো কথা বাড়ায় না। চুপচাপ ব্যাগ আর পিহুকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। তবে ভেতরে কোনো এক অজানা কারণে বেশ নার্ভাস ফিল হচ্ছে। যেন কোনোকিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
পিহুকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি ইউটার্ন নিয়ে হসপিটালের দিকে যায় সমুদ্র। মিনিট চল্লিশেক পর গাড়ি এসে হসপিটালের সামনে থামে। গাড়ির সিটবেল্ট খুলতে খুলতে প্রাচীর দিকে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে নেয় সমুদ্র। উদাসী চেহারায় অন্যমনস্ক হয়ে যেন কিছু একটা ভেবে চলেছে প্রাচী।
– “প্রাচী?”
পরপর কয়েকবার ডাক দিতেই ভাবনার সুতো কাটে প্রাচীর।
– “কি হয়েছে? এনিথিং প্রবলেম? অন্যমনস্ক হয়ে কি ভাবছিলে?”
– “ক,কি,কিছুনা তো।”
– “আচ্ছা ঠিক আছে। চলো হসপিটালে এসে পড়েছি।”
সমুদ্রের কথা শুনে প্রাচীও ধীর পায়ে নেমে পড়ে গাড়ি থেকে।
৭১.
ডক্টরের কেবিনে,,
ডক্টর আয়েশা বেশ সরু দৃষ্টিতে সামনে থাকা রিপোর্ট গুলো পরখ করে যাচ্ছেন। প্রতিটি টেস্ট করা রিপোর্টের পাতা উল্টাতেই তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ছে গভীর ভাবে। চশমার আড়ালে রিপোর্ট গুলো পরখ করে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। একটু আগেই প্রাচীর প্রেগন্যান্সি নিয়ে বেশ কিছু টেস্ট করিয়েছেন তিনি।
ডক্টরকে এমন চিন্তিত হতে দেখে কিছুটা ভড়কে গেল সমুদ্র। সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? ডক্টরের মুখে এত চিন্তার ছাপ কিসের?
– “ডক্টর? ইজ এভরিথিং ওকে? প্রাচীর সব রিপোর্ট কি ঠিক আছে?”
সমুদ্রের কথায় ডক্টর আয়েশা সহ প্রাচীও মাথা তুলে তাকায়। অতিরিক্ত টেনশনে গলা শুকিয়ে আসছে প্রাচীর।
– “দেখুন মিস্টার জুনায়েদ, মিসেস প্রাচী আপনার ওয়াইফ। আর অনাগত সন্তান ও আপনাদের দুজনের। তাই বেবির এবং মায়ের হেলথ সম্পর্কে জানার অধিকার ও আপনাদের দুজনের আছে।
আমি কিছু লুকাব না আপনাদের কাছ থেকে। এসব টেস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী যা দেখছি তাতে বেবিদের অবস্থা খুব একটা ভালো ঠেকছে না।”
ডক্টর আয়েশার বলা কথা শুনে হতভম্ব হয় সমুদ্র। কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করে ওঠে,
– “বেবিদের মানে?”
– “ইয়েস, মিস্টার জুনায়েদ! আপনার ওয়াইফের গর্ভে একটা না বরং দু দুটো ভ্রূণ বেড়ে উঠছে। আর দুটো বেবি কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো বেবিদের হেল্থ নিয়ে। রিপোর্ট অনুযায়ী, মিসেস প্রাচীর প্রেগন্যান্সি তে বেশকিছু কম্প্লিকেশন রয়েছে; তার উপর তিনি দু দুটো বাচ্চা ক্যারি করছেন। এমতাবস্থায় উনার ডেলিভারিতে বেশ কিছু কম্প্লিকেশন আসতে পারে। আর যার জন্য এমনও হতে পারে আমরা মা ও বাচ্চাদের মধ্যে যেকোনো দুজনকে বাঁচাতে পারব।”
ডক্টর আয়েশার কথা শুনতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় প্রাচীর। সমুদ্র ও নিশ্চুপ। অতি পরিমাণ আশংকা আর আশ্চর্যতা তাকে একসাথে ঘিরে ধরেছে যেন।………….
#চলবে 🍂