‘সিক্ত সুভানুভব’
[৩৩]
লেখনীতে:- নূরজাহান আক্তার (আলো)
আলো ওর আম্মুর এমন কথা শুনে দুই পা পিছিয়ে গেল আলো কখনোই আশা করেনি যে এরকম একটা শক পাবে।ওর আম্মু ওকে চিনতে পারছে না? রোদ এগিয়ে গিয়ে আলোকে ধরলো, আলো কি বলবে ?আর কি বলা উচিত? সেটা ভেবে না পেয়ে তার মায়ের মুখের দিকে শুধু হা করে তাকিয়ে থাকলো। তারপর আলোর আম্মু ওই মহিলার কাছে গিয়ে কি যেন বলল?আর তারপর আবার উপরে উঠে চলে গেল। আলো ওর আম্মুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে?
–
রোদ:আলো ! নিজেকে সামলাও ? সব ঠিক হয়ে যাবে তো, আর এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না। তাকাও আমার দিকে! আমি তো আছি তোমার পাশে(আলোর মুখ উপরে তুলে )
আলো: আমার আম্মু আমাকে ভুলে গেছে? আমাকে চিনতে পারছে না? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রোদ,এতটা কষ্ট হচ্ছে মনে হচ্ছে চুরি দিয়ে বারবার কেউ আমাকে আঘাত করছে। আর কত কষ্ট সহ্য করব আমি ?আজকে আমাকে আমার আম্মুর এত কাছে থেকেও আম্মু আমাকে চিনতে পারছিনা,আর এর থেকে কষ্টেরই বা কি থাকতে পারে বলো?( কেঁদে কেঁদে)
–
রোদ আর আলো এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছে না ?ওরা চলে যাওয়া জন্য ঘুরতেই ওই মহিলাটি ওদের ডাকলো আর বলল,,,
মহিলা: তোমরা যার সাথে কথা বললে সে একজন স্মৃতিশক্তি হারা মহিলা, প্রায় তিন থেকে চার বছর আগে আমি ঢাকা থেকে বাসায় ফেরার সময় এই মেয়েটাকে পাই, জানতে পারি যে, কোন এক পাচারকারী চক্র রাবেয়াকে( আলোর আম্মুকে) কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়, আমার জানামতে রাবেয়াকে কিডনি পাচারকারী একটা গ্যাংয়ে কিডন্যাপ করছিল। তারপর রাবেয়া সুযোগ পেয়ে ওদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যায়। আর ভয় পেয়ে বড় রাস্তাতে দৌড়াতে দৌড়াতে আমার গাড়ির সামনে এসে পড়ে। অতিরিক্ত ভয় পাওয়ার কারণে, ব্রেনে বেশি চাপ নিতে পারেনি, রাস্তাতেই ব্রেন স্ট্রোক করে আর আগের স্মৃতি সব ভুলে যাই, তারপর আমি লোক লাগিয়ে এসব খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি ওর সম্পর্কে যে আসলে ওর সাথে কি ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু ওর বাড়ি কোথায় ?কি করে?বা কে কে ওর পরিবারে আছে আমি খোঁজ নিয়েছি বাট জানতে পারিনি।আর কেউ আমাকে খোঁজও দিতে পারেনি যে ওর পৃথিবীতে কেউ আছে। তারপর থেকে ও এখানেই থাকে।প্রায় দুই বছর পর এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে তবে আগের কোন কথা কিছুই মনে নেই,,,
আলো: এজন্য আম্মু আমাকে চিনতে পারছেনা, আম্মুর সাথে এত কিছু ঘটে গেছে আর আমি কিছু জানি না?( অবাক হয়ে)
মহিলা: তোমার কান্না করা দেখে , আমি বুঝেছি রাবেয়ার হয়তো চেনা পরিচিত কেউ , কিন্তু তোমার আম্মু বলে ডাকা তে আমি বুঝে গেছি রাবেয়া তোমার আম্মু। কারণ চোখের পানি কখনো মিথ্যা বলে না।এর জন্য তোমাকে বললাম তবে প্লিজ একটা রিকুয়েস্ট তুমি স্বাভাবিক থাকো, আর ওর উপরে কোন চাপ সৃষ্টি করে নাও ও সহ্য করতে পারবেনা।
রোদ: জি আন্টি! আপনি একদম ঠিক বলেছেন, এভাবে একজন অচেনা মানুষকে এইভাবে আশ্রয় দিয়েছেন এত চিকিৎসা করছেন, এত ভালবাসেছেন।সত্যি বলতে, আপনার মত কিছু মানুষের জন্য এখনো পৃথিবীটা টিকে আছে,আপনার এমন ব্যবহারে সত্যি আমরা আপনার উপরে কৃতজ্ঞ,,,,,
মহিলা: আমি একজন ডক্টর, আমার আপন বলতে কেউ নেই, রাবেয়ার মত আমারও একটা বোন ছিল নিম্নবিত্ত থাকার কারণে চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পারিনি, বোনটা আমাকে ছেড়ে চলে যায়, এই কারণে আমি বড় বোনের মত রাবেয়াকে দেখাশোনা করছি। এ ছাড়া কিছু নয়,বিয়ে-শাদী করা হয়নি যার কারণে হাসবেন্ড বা ছেলে মেয়ে কেউ নেই, তবে এখন আমি মনে করি এখন রাবেয়া আর আমি দুই বোন।
আলো: এত কিছু হওয়ার পরও আমি এখনো বলব যে, যারা ভাল মানুষ তাদের সাথে সব সময় ভালই কিছুই হয়। আমার আম্মু এতো ভালো মানুষের বোন হতে পেরেছে। আন্টি আমি আপনার কাছে সত্যিই অনেক কৃতজ্ঞ।( কৃতজ্ঞতা সুরে)
আন্টি: তবে যাই করো ভেবেচিন্তে করো কারণ তোমার আম্মু অনেক শক পেয়েছিল। প্রায় দুই বছর ও একদম স্তব্ধ হয়ে গেছিল এখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে ,এখন আমি মনে করি আগের কোন কথা জিজ্ঞাসা করে বা বলে চাপ সৃষ্টি না করাটাই বেটার হবে।
আলো: আমি তো এতদিন পর আমার আম্মুকে ফিরে পেয়েছি ।তাহলে কি আমি আম্মুকে না নিয়ে এভাবে খালি হাতে ফিরে যাব( কেঁদে কেঁদে)
আন্টি: একবার যখন তোমার আম্মুকে ফিরে পেয়েছো, আর কিছুদিন সহ্য করো ।কারণ যেহেতু তোমাকে চিনতে পারছেনা তুমি যদি জোর করে নিয়ে যাওয়াতে হিতে বিপরীত হতে পারে ।তবে আমি তোমার আম্মুর আগের সব স্মৃতি ফেরানোর জন্য আমি তোমাদেরকে আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব।
রোদ: আমার মনে হয় এটাই বেটার হবে। কারণ যেহেতু এত বড় একটা ঝড় বয়ে গেছে আম্মুর উপর দিয়ে , এখন আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
আলো: আমি কি এখন খালি হাতে ফিরে যাব( কাঁদতে কাঁদতে)
আন্টি: আমরা প্রতিটা মানুষ তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনি,এটা তুমি করো না মা।একটু সহ্য করো দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আর তোমাকে কিছু বলব না ।তবে যদি তোমার মন বলে নিয়ে গেলে ভালো হবে, তো নিয়ে যেতে পারো।
রোদ: না আন্টি! আম্মু এখানেই থাক আমরা আজকের ফ্লাইটে ঢাকা চলে যাচ্ছি ।আপনার সাথে আমাদের প্রতিনিয়ত প্রতি ঘন্টায় কন্টাক হবে , আম্মু কি করছে না করছে জানার জন্য ,আমি আম্মুর রুমে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করে দিতে চাচ্ছি, যাতে আলো আম্মুকে সব সময় দেখতে পাই।যদি আপনার আপত্তি না থাকে তো,,
আন্টি: না আমার কোন আপত্তি নেই,, আমি বুঝতে পারছি এখন আলোর মনের কষ্টটা
রোদ: অনেক অনেক ধন্যবাদ আন্টি আপনাকে,
আন্টি: ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য কিনা আমি জানিনা? তবে আমি ও কাছের মানুষ হারিয়েছি, আমিও নিম্নবিত্তই ছিলাম তো, যার কারণে আমি জানি আর বুঝিও বাস্তবতাকে।
–
রোদ সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করে দিয়ে আন্টির সাথে আরও কিছু কথা বললো। আলো আর রোদ আলোর আম্মুর সাথে দেখা করতে গেল ।আলো ওর আম্মুকে জড়িয়ে ধরে থাকল প্রায় 5 মিনিট , তারপর ওর আম্মুর কপালে একটা আদর দিয়ে আলোরা বিদায় নিল ।আলোর আম্মু কিছু বলল না আলোর দিকে তাকিয়ে ছিল।
–
ওরা গাড়িতে গিয়ে বসলো রোদ আলোর সিট বেল্ট বেঁধে দিল আর গাড়ি স্টার্ট দিল। আলো মন খারাপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, রোদ আলোর দিকে তাকিয়ে বলছে
রোদ: আমি চাইলে কিন্তু আম্মুকে নিয়ে আসতে পারতাম, আর যদি করতাম তাহলে এটা বেইমানি করা হতো।
আলো: মানে( অবাক হয়ে)
রোদ:আন্টিটা এতদিন আম্মুর সেবা করছে , বোনের মতো ভালোবেসেছে।আর আম্মুকে দেখে আমরা বুঝলাম আম্মু অনেক ভালো আছে, যদি এখন আমরা নিয়ে চলে আসতাম তাহলে আন্টি টাও একা হয়ে যেত।আর এটা ঠিক কাজ হতো না।
আলো:হুমম এজন্য আমিও কোন চাপ দিতে যাইনি,আমার আম্মু যেখানেই থাক, যার কাছেই থাক ভালো থাক।আর এটাই আমার একমাএ চাওয়া ( মন খারাপ করে)
–
রোদ আর আলো বাসের টিকিট কেটে তারপর রিসোর্টে ফিরে যায়। রোদ বাসাতে ফোন দিয়ে সবকিছু জানায় যাতে ওরা টেনশন না করে।তারপর রোদ আর আলো শাওয়ার নিয়ে লাঞ্চটা সেরে ফেললো। জামা কাপড় সব গুছিয়ে বাস স্ট্যান্ডে গেলো, চট্টগ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কারন
চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছবে এজন্য । আলোর মনের অবস্থা ভালো না এখন, তাই এত কষ্ট করে জার্নি করাটা ঠিক বলে মনে হয় নি রোদের।
–
এই কয়েকটা দিন রোদ আলোকে নিজের ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে, একটা পারফেক্ট হাজবেন্ডের মত করে। সবসময় সাথে থেকেছে,আলোকে সাপোর্ট দিয়েছে, বুঝিয়েছে।রোদ যদিও আলোকে স্বাভাবিক করার জন্য হাসানোর চেষ্টা করছে । কিন্তু আলোর মনের অবস্থা ভালো না থাকাতে রোদ বার বার ব্যর্থ হয়েও হাল ছেড়ে দেয়নি, বারবার শত চেষ্টা করছে আলোর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।এটাকেই বলে পারফেক্ট জুটি,যারা বিপদের সময় পাশে থাকে আর কষ্টটাকে ভাগ করে নেয়।রোদও একজন দায়িত্ববান হাজবেন্ডের মত করে আলোকে আগলে রেখেছে,
–
ওরা ঢাকা এসে পৌঁছালো। আর রোদদের ড্রাইভ ওদের নিতে এসেছে।আলো দুইদিন কান্না করছে,ঠিকমত খায়নি, ঘুমায়নি এজন্য আলো মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গেলেই রোদ ধরে নেয়,,,আলোকে ধরে রোদ গাড়িতে উঠালো আর রোদের কোলে মাথা দিয়ে আলোকে শুয়ে থাকতে বললো।আলোর শরীর ভালো নেই এজন্য আলোও রোদের কোলে শুয়ে পড়লো। পেছনের সিটে,,,
চলবে…!!