সিন্ধু ইগল – (২২)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
সময়টা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। রাতের আকাশটা একটা মিনিট দেখারও সুযোগ হয়নি জায়িনের। কারণ, সমুদ্রের খুব গভীরে চলে যেতে বেশি সময়ের অপচয় হয়নি৷ হুইলচেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা একটি মানুষ নিশ্চয়ই কোনোভাবে ভেসে উঠতে পারবে না। মৃত্যু যে তার অবধারিত। গোয়েন্দা বিভাগে যুক্ত হওয়ার পর ট্রেনিং এ কত কষ্টই না হয়েছে, কত বড়ো বড়ো মিশনে যেতে হয়েছে। কিন্তু তখন মৃত্যুভয় বলে শরীরের লোম খাঁড়া হয়ে যাওয়া এই ভয়ানক অনুভূতি হয়নি। ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাস শুধু৷ বিপদ সামনে এলেও বিভিন্নভাবে সাহায্য প্রার্থনা করতে পেরেছে তখন। কিন্তু এই মুহূর্ত চিৎকার করে কারও থেকে সাহায্য চাওয়ারও উপায় নেই। শ্বাস আটকে আসা অবস্থা, নাক, কান, সব কিছুর ভেতরে পানি প্রবেশ করতে করতে খুব স্বল্প মুহূর্তের মাঝেই জানটা বেরিয়ে যাবার অপেক্ষা শুধু। নিঃশ্বাস বেরিয়ে যাবার পূর্বকালীন মুহূর্তটা কতটা কষ্টের, তা একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটি ছাড়া কারও অনুভব করার ক্ষমতা নেই। এই সময়টাতে কি জীবনের সব থেকে ভালো মুহূর্তগুলো, ভালোবাসার মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে? না কি জীবনে করা অন্যায়গুলোর কথা মনে পড়ে অনুতপ্ত বোধ হয়? জানা নেই এর উত্তর৷ তবে জায়িনের আত্মাটা ভীষণ ছটফট করছে বড়ো ভাই, আব্বা আর আম্মাকে বলতে, ‘আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখো তোমরা। আমাকে কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে বহুদূর। আমি যে ফিরে আসতে পারব না আর সেখান থেকে।’ আল্লাহ পাককেও স্মরণ করছে এই নিদারুণ কষ্ট কমিয়ে দেওয়ার জন্য। বড়ো ভাই, আব্বা, আম্মা তার আত্মার আকুল আবেদন না শুনতে পেলেও মহান আল্লাহ পাক ঠিকই শুনলেন৷ ঝাপসা দৃষ্টি ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে গেল তার, চোখজোড়া আপনা আপনি বুজে গেল, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার কষ্টটাও একেবারে বিলীন হয়ে গেল।
—————-
হঠাৎ করেই জায়িন নিখোঁজ হয়ে গেছে। সারা কোনোভাবেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। যে হোটেলে থাকত জায়িন, সেখানে দু’দিন গিয়েছিল সে খোঁজ নিতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারে, জায়িন তার সাথে দেখা করার দিন থেকেই লাপাত্তা। ফিরে আসেনি আর হোটেলে। তার সমস্ত জিনিস আপাতত রেখে দিয়েছে তারা।
এক সপ্তাহ হয়ে গেছে জায়িনের গায়েব হয়ে যাওয়ার। এই ব্যাপারটা নিয়ে সারা ভীষণ মন খারাপ করে আছে ইদানীং। আয়মান বা জাইমা কেউ-ই তাকে জায়িনের ব্যাপারে কিছু জানায়নি। কারণ, আয়মানের বিষয়ে সারা অনেক কিছুই জানে না। তার মতোই একজন সাধারণ মেয়ে বলে জানে সে আয়মানকে।
জায়িনকে আটকে রাখার খবর যেদিন এহসান আর নিশাকে জানায় আয়মান, সেদিনই নিশা আয়মানকে জানানোর সাহস পায় তাদের সঙ্গে জায়িন কী কী করেছে। আর এখন জায়িনের মৃত্যুর খবর শুনে তাদের তিনজনের মাঝে আনন্দের সীমা নেই। নিশা আর এহসানও মুম্বাই ফিরে আসছে আজ বাংলাদেশ থেকে। বাস্তবিকপক্ষে আয়মান জায়িনের হাত থেকে মুক্তি পেলেও আসল বিপদ থেকেই মুক্তি মিলছে না তার৷ টেরোরিস্টদের মূল হোতা তাকে লন্ডন ফিরে আসার জন্য বারবার মেইল করছে। কিন্তু আয়মান মন থেকে আর সায় পাচ্ছে না ওই দলটিতে ফিরে যেতে। বাংলাদেশ যাবার পর থেকে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন ঘটেছে তার মাঝে। বিনা অপরাধে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে বিবেকে নাড়া দিচ্ছে তাকে। যে আক্রোশ, রাগ আর জিদ থেকে সে এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিল, সেই রাগ, ক্ষোভ, জিদ তার মাঝে আর ফিরে পাচ্ছে না সে। মনুষ্যত্ব, দেশের প্রতি টান, নিরপরাধ মানুষগুলোর প্রতি মায়া অনুভব করছে সে এখন। এই তো দু’দিন আগেও তাকে আমেরিকার এক শিল্পপতিকে খুন করে আসতে হলো নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে। একজন ভালো মানুষ হিসেবে তাকে কেউ না চিনলেও সিরিয়ার কিলার হিসেবে তার পরিচিতি আছে বিশেষ বিশেষ কিছু মানুষদের কাছে। সব থেকে বড়ো আফসোস তার একটাই, সে চাইলেও এখন আর টেররিজম থেকে বিরত থাকতে পারবে না। চাইলেও পারবে না পেশাদার খুনির পরিচয়টা মুছে ফেলতে। বাংলাদেশ না গেলেই হয়তো ভালো হতো তার জন্য। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের জন্য সে কোনোভাবেই পূর্বের ব্যক্তিত্বে ফিরতে পারছে না। এই অপরাধমূলক কাজগুলো থেকে তার রেহাই পেতে হলে এক মাত্র উপায় হিসেবে মেনে নিতে হবে মৃত্যুকে। আলিয়ার চিন্তাটাও তার মাথা থেকে একবারে সরে যায়নি। সে চাইলেই বাংলাদেশ ফিরে আলিয়াকে খুঁজে আনতে পারে। কিন্তু ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা মানেই মানসিক অশান্তি আবার। আজ অবধি দু’জন এক সঙ্গে থাকলে বিবাদ, একে অপরকে আঘাত, রাগের শিকার হতেই হবে। এর থেকে দু’জন দূরে দূরে থাকায় শ্রেয়। তার বিশ্বাস, আলিয়া খুব দ্রুতই নিজেকে মুক্ত করবে। এখন তো আর জায়িন নেই।
—————–
-‘আপনার পরিচয় দিতে হবে না। অ্যাটলিস্ট এটা বলুন, ওকে এভাবে মারতে চেয়েছিল কে? দেখুন আপনি যেহেতু জানতেন যে, ওকে কোথায় কীভাবে খুন করার চেষ্টা করা হবে তাহলে আপনি এটাও নিশ্চয়ই জানেন কে বা কারা ওকে মারতে চায়? আপনি তাদের পরিচয় না জানালে ওকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হবে না। আপনি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই আমি কী বলতে চাইছি? কারণ, ওকে হয়তো আবার অ্যাটাক করবে ওরা, বা কোনোভাবে আবার মারার চেষ্টা করবে।’
-‘না, আপনার ভাইকে আর মারতে চাইবে না। কারণ ওরা জানবেই না আপনার ভাই বেঁচে আছে। ওদের এত সময় নেই আপনার ভাইয়ের মরা বাঁচার সলিড খবর সম্পর্কে সন্ধান রাখার। ওদের বিশ্বাস, আপনার ভাই মারা গেছে। তাই সেভাবেই রাখুন আপনার ভাইকে, যাতে ওদের চোখে আর না পড়ে সে। খেয়াল রাখবেন ওনার। প্রার্থনা করি, জলদি ওনার জ্ঞান ফিরুক।’
কথাগুলো শেষ হতেই ওপাশ থেকে কলটা কেটে গেল। কপাল কুঁচকানো চিন্তিত চেহারায় জাকির ফোনটার দিকে চেয়ে রইল তখন। রেজা উদ্বিগ্নতা নিয়ে এগিয়ে এল তার কাছে, ‘কী বলল সে?’
-‘যা বলল তা আমার কিছুই বোধগম্য হলো না। যে বা যারা জায়িনকে খুন করতে চেয়েছিল তারা নাকি দ্বিতীয়বার আর ওর ওপর হামলা করবে না। তারা নাকি জানতেই পারবে না ও বেঁচে আছে। কারা ওকে মারতে চাইছিল তাদের কথাও বলল না। আমি বুঝতে পারছি না কে এই মানুষটি।’
রেজা চিন্তিত চেহারায় থুঁতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবতে থাকল, সে আর জাকির ছাড়া আর কেউ জানে না এই মুহূর্তে জায়িন অস্ট্রেলিয়াতে অবস্থান করছে। নিশা বা এহসান এমন চাপে ছিল যে, ওদেরও সাহস হবার কথা না জায়িন অস্ট্রেলিয়া এসেছে সে খবর আয়মানকে জানানোর। তাহলে কে এভাবে জায়িনকে মারতে চাইতে পারে? তার ত্রিশ বছরের অর্জিত জ্ঞানে গোয়েন্দা মনটা সন্দেহ করছে আয়মানকেই। আয়মানের ব্যাপারে যেসব তথ্য সে পেয়েছিল লন্ডন থেকে, তাতে জায়িনকে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা সে রাখে। কিন্তু এত নিখুঁত পরিকল্পন করে এসেছিল তার স্যার, তারপরও কীভাবে ধরা পড়ে যেতে পারে সে? জায়িনের জ্ঞান না ফেরা অবধি কিছুই বোঝা যাবে না৷ আর যে মানুষটি জাকিরকে কল করে জায়িনের হদিস জানাল, সে-ই বা কে? যে অবস্থাতে জায়িনকে সমুদ্রে ফেলা হয়েছিল তাতে মরণ নিশ্চিত। মাত্র দুই এক মিনিটের ব্যবধানেই মরে যেত জায়িন। যদি না ডুবে যাওয়ার চার পাঁচ মিনিটের মাঝেই ওই চার জন ডুবুরি জায়িনকে খুঁজে উদ্ধার না করত। যার অর্থ, যে লোকটি ডুবুরির সাহায্যে জায়িনকে উদ্ধার করেছে সে নিশ্চয়ই জানত আয়মানের পরিকল্পনা সম্পর্কে। সমস্তটা ভাবলে যুক্তিতে এটাই আসে, সে আয়মানের বোটের আশেপাশেই কোনো বোট নিয়ে অবস্থান করছিল আগেভাগে৷ তবে কি জায়িন নিজেই কোনোভাবে কাউকে তার এই বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য অবহিত করে রেখেছিল? কিন্তু কাউকে জানানোর সুযোগ পেলে তাকে বা জাকিরকে কেন জানায়নি জায়িন?
ব্যাপারগুলো নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। এভাবে ভেবে কোনো কিছুর উত্তর মিলবে না। আইসিইউ-র দরজার গ্লাসের মাঝ দিয়ে একবার তাকাল রেজা, অক্সিজেন মাস্ক পরে চেতনাশূন্য হয়ে পড়ে আছে জায়িন। তিনদিন আগে জাকিরের ফোনকল পেয়ে ছুটে আসে সে। মাহতাব শেখ, জান্নাতি, জাহিদ, কেউ-ই এখনো জায়িনের অবস্থা সম্পর্কে জানে না। জানানো হয়নি তাদের। এখানে আসার পর সরাসরি হসপিটালে এসে জাকিরকে সে কান্নাকাটি করা অবস্থায় দেখতে পায়। জায়িনকে হাসপাতাল অ্যাডমিট করার পর বেঁচে থাকার কোনো আশঙ্কায় নাকি ছিল না। যাওবা সেই আশঙ্কা মুক্ত হয়৷ কিন্তু দুশ্চিন্তাতে পড়ে জায়িনের জ্ঞান না ফেরার কথা শুনে। ডাক্তারের ধারণা, বোট থেকে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে কোনোভাবে শক্ত কিছুতে মাথায় আঘাত পেয়েছিল সে। কী হবে জায়িনের সঙ্গে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না।
_____________
এরপর আর লিখতে মন চাইল না। চেষ্টা করব আগামীকাল সারপ্রাইজ দেওয়ার।