সিন্ধু ইগল – (২৯)
ইসরাত জাহান দ্যুতি
এক লক্ষ্যহবিহীন জীবন! তবে সেই জীবনে কৃত্রিম সুখ কেনার ক্ষমতা অপরিসীম। কেননা, অর্থের কাছে প্রকৃত সুখ বিলীন৷ কিন্তু সৃষ্টিকর্তার দানকৃত সুখ ছাড়া কৃত্রিম সুখে কি মানুষ আজীবন সুখী অনুভব করতে পারে? এই সামান্য বোধটুকু আয়মান হারিয়ে ফেলেছে। সে বিশ্বাস করে, অর্থ দ্বারাই ক্ষমতা অর্জন করা যায়। আর ক্ষমতা থাকলে প্রতিটা মানুষ তার গোলাম বনে যেতেও বাধ্য। অবশ্য এই একই ধারণা নিয়ে বহু আগে থেকেই দিন অতিবাহিত করছে আরও একটি মানুষ। জায়িন মাহতাব! যে নিজেও বিশ্বাসী এসবে। যখন একই উন্মাদ সত্তার মানুষ মুখোমুখি হয়, তখন উভয়ই নিজেদের ক্ষমতা একে অপরের কাছে জাহির করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আয়মান আর জায়িনের মাঝেও চলছে সেই যুদ্ধ। কে কীভাবে নিজেদের ক্ষমতা বোঝাবে!
বিলাসবহুল বাসাটাতে জায়িন অসংখ্য নজরদারির ব্যবস্থা করেছে। তাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে চলেছে তার চার বন্ধু। আর তার নিজস্ব ক্ষমতাবল তো রয়েছেই। আজ তার এতদিনের বৈধ অবৈধ উভয় অর্থই কাজে লাগছে। জাকিরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বাড়িতে সে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এখানেই সে কোনো ব্যবসা শুরু করে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলবে। এ কথা শোনার পর মাহতাব শেখ হাল ছেড়ে দিয়েছেন ছোটো ছেলের ব্যাপারে। আল্লাহ পাকের কাছে এই ছেলেকে হেদায়েত দানের জন্য শুধু প্রার্থনা করেন। তাছাড়া আর কিছুই বলেন না এখন জায়িনকে।
খুব সকালেই আয়মান বিছানা ছেড়ে ঘরের মেঝেতে যোগ ব্যায়াম করল কতক্ষণ। জায়িন ঘরের দরজাটা নিশ্চয় ওপাশ থেকে লক করে গেছে। তবুও সুনিশ্চিত হতে সে দরজাটার লক চেপে ধরল। হ্যাঁ, যেটা সে ভেবেছিল তা-ই। জায়িনের এই কার্যকলাপের প্রতি তার একটুও রাগ হচ্ছে না। বরং বিরক্ত হয়ে পড়ছে ওর বোকামোতে। আজ না হলেও কাল এই বন্দিদশা থেকে সে ভেগে যাবে। এ ব্যাপারটা জায়িনের স্পষ্টভাবে বোঝা উচিত। মাঝখান থেকে নিজেদের মাঝের সেই পুরোনো সুসম্পর্কটা নষ্ট হবে। শুধু শুধু শত্রুতা তৈরি করার কী প্রয়োজন? বোঝানো দরকার জায়িনকে। জায়িনের চিন্তাভাবনা সম্পর্কে পুরোটা জানা দরকার।
ব্যালকনিতে খুব একটা নিরাপত্তা নেই। কার্নিশে দাঁড়িয়ে যখন তখন নিচে ঝাঁপ দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তাতে ফায়দা নেই। সেই লনে গিয়েই পড়তে হবে৷ তার ধারণামতে, লনের চারপাশেও নিরাপত্তা বসিয়ে রেখেছে জায়িন। তা ভাবতেই কিঞ্চিৎ হাসল সে, শ্লেষাত্মক হাসি। তবে তার পালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতার হালকা একটু নমুনা জায়িনকে দেখালে মন্দ হয় না! ভেবেই মুহূর্তেই কার্নিশে উঠে পড়ল সে। এক লাফ দিয়ে নিচে পড়াটা এই মুহূর্তে বোকামো হবে। কিছুটা হলেও পায়ের ওপর জটিলভাবে প্রভাব পড়তে পারে এতে। যেহেতু এখন সে চূড়ান্তভাবে পালানোর পরিকল্পনা করছে না। তাই এইটুকুও ঝুঁকি নিয়ে খামোখা পায়ের ওপর প্রেশার দিতে চাইল না। কার্নিশ ধরে নিচে ঝুলে পড়ল সে, নিচের দিকে তাকিয়ে কোনো অবলম্বন বা পা ঠেকানোর মতো কিছু পেল না শুধু দেয়াল ছাড়া। তবে তাতেও সমস্যা নেই তার। দেয়ালে ছেঁচড়ে ওঠা নামার অভ্যাসটা ভালোই আয়ত্তে আছে তার। কিছুটা নিচে নামার পর অবশ্যই সে পা বাঁধানোর মতো অবলম্বন পাবে।
রাতের শেষভাগে কিছুটা ঘুমিয়েছিল জায়িন। অ্যালার্ম বাজতেই চোখ মেলে টেবিল ঘড়ির দিকে তাকাল। ছ’টা বেজে গেছে। বেশ দেরি হলো আজ। আরও আগে ঘুম ছেড়ে ওঠার ইচ্ছা ছিল তার। কাজ যে প্রচুর! তবে সকাল সকাল আধা ঘণ্টাও অনুশীলন না করলে সারা দিনটাই শরীর, মন কোনোটাতেই চনমনে ভাব আসবে না৷ তাই বাইরে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে যাবার পূর্বে একবার আয়মানের ঘরটাতে ঢুঁ মেরে আসার প্রয়োজনবোধ করল। করিডর ধরে হেঁটে যেতে যেতে মোবাইলের মেসেজ অপশন চেক দিতে থাকল। গতকাল রাতে রেজার সঙ্গে অনেক সময় ভিডিয়ো কনফারেন্সে ছিল। এরপর চার বন্ধুর সঙ্গেও। সারাটা রাত ল্যাপটপ নিয়েই পার করতে হয়েছে। আয়মানকে পাকাপাকিভাবে আটকে রাখার জন্য অনেক বেশিই মানসিক শ্রম ব্যয় করতে হচ্ছে৷ কয়েক মাস পূর্বেও শত ব্যস্ততা, কাজের চাপেও শরীরের খোরাক যোগাতে ভোলেনি সে। কিন্তু এবার তার সেই রেকর্ড ভাঙল আয়মান মেহরিন। বলতে গেলে চব্বিশটা ঘণ্টায় তার কাটে আয়মানকে নিজের কাছে ধরে রাখার নানানরকম পরিকল্পনাতে। এ ব্যাপারটা তার কাছে এখন ভালোবাসার পাশাপাশি একটা চ্যালেঞ্জ জেতা হিসেবেও দাঁড়িয়েছে।
ঘরের মাঝখানটাতে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয়বারের মতো চারপাশে চোখ বুলিয়েও আয়মানের উপস্থিতি টের পেল না জায়িন। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল সে। বুঝতে অসুবিধা হলো না, এই পদ্ধতিটাকেই কাজে লাগিয়েছে আয়মান৷ তবে অনুৎকণ্ঠিত সে। নিচে এসে লনের চারপাশে নজর বুলিয়ে চলে গেল বাড়ির পেছনটাতে। খুব বেশি দূর দৌঁড়াতে গেল না। কাছাকাছিই ঘণ্টার কিছু কম সময় দৌঁড়ে ফিরে এল আবার। বাড়ির পেছন দিকটাতে ছোটোখাটো একটা ঝোপঝাড়। পরিস্কার না করার ফলে তা এখন একটা জঙ্গলের রূপ নিয়েছে৷ গায়ের টিশার্টটা খুলে নিচে ফেলে দিলো। পুশ আপ করার প্রস্তুতি নিয়ে মাটিতে ঝুঁকতেই স্পষ্টভাবে কানে এল কারও পদচালনার শব্দ। সেদিকে তেমন একটা মনোযোগ দিলো না সে। স্নিগ্ধ, প্রশান্তিময় প্রকৃতিতে এই মুহূর্তের অনুশীলনটুকু সে একান্তভাবে অনুভব করতে চায় শুধু। দু’পা ওপরে তুলে মোটা গাছটার গায়ে ঠেকিয়ে মাটির দিকে ঝুঁকল আবার। এতেও মাথা, গলা, কোমর, পা সোজা এক লাইনেই আছে তার। এই পদ্ধতিতেও পুশ আপ দিতে কোনো সমস্যা হলো না। পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে পুশ আপ দিতে দিতেও সে টের পাচ্ছে কোনো একজন মানবের পদচারণ আছে এদিকটাতে। তারপর কিছুক্ষণের মাঝেই তার সেই ধারণা সত্য করে এসে দাঁড়াল আয়মান, তার থেকে বেশ কিছুটা দূরে। তৎক্ষনাৎ থেমে গেল সে। নিচে থেকে টি শার্টটা তুলে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সারা শরীরের ঘাম মুছে নিতে নিতে তাকাল আয়মানের দিকে। শীতল চাহনিতেই একে অপরকে দেখছে। তবে জায়িনের ক্ষেত্রে আয়মানের চাহনি আজ অনেকটা ভিন্ন আর অন্যরকম লাগছে৷ যেন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে তাকে। অনেক সময় দেখা যায় বাঘ তার শিকারীকে সামনে পেয়েও শান্ত ভঙ্গিমাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এর একটাই কারণ, যাতে শিকারকে এক ঝাঁপেই ধরে ফেলতে পারে। আয়মানের এই শান্ত চাহনিকে কি তবে এভাবেই বিবেচনা করবে সে? না কি এই চাহনিতে তার প্রতি প্রমত্ততা খুঁজবে সে? কিন্তু তা নিশ্চয়ই এত দ্রুত সম্ভব নয়।
গলা শুকিয়ে এসেছে। জিহ্বার ডগা দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল জায়িন আয়মানের কাছে। আশ্চর্যভাবে আয়মানের দৃষ্টি এখনো নির্নিমেষ আটকে আছে তার দিকেই। কী দেখছে আয়মান তার মাঝে? মুখোমুখি দাঁড়াতেই আয়মান পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল জায়িনের চোখে। আর জায়িন তখন ওর এই দৃষ্টির অর্থ বুঝতে ব্যস্ত। কিন্তু কোনোক্রমেই জায়িন বিশ্বাস করতে চাইছে না, আয়মান তার প্রতি মোহাবিষ্ট হয়েই চেয়ে আছে। মৃদুমন্দ সমীরণ, চেনা অচেনা পাখির কলতানের মাঝে কোমল কণ্ঠে ওকে প্রশ্ন ছুঁড়ল জায়িন, ‘কী দেখছ?’
জায়িনের কণ্ঠটা কানে বাজতেই ঠোঁটদু’টোর মাঝে কিঞ্চিৎ ফাঁক হলো তার, চোখের পলক ফেলল একবার। আর নিঃশ্বাসে অস্থিরতা লুকাতে দৃষ্টি আশেপাশে স্থির করল। সবটাই জায়িন সুক্ষ্ম নজরে দেখতে থাকল। তার প্রশ্নের পিঠে বিপরীত প্রশ্ন ছুঁড়ল আয়মান ক্ষীণ সুরে, ‘তৃষ্ণার্ত লাগছে। পানি আনোনি?’
প্রশ্নটায় একটু ঝুঁকে এল জায়িন আয়মানের মুখের কাছে। তাই দ্বিতীয়বারের মতো না চাইতেও আয়মানকে তাকাতে হলো জায়িনের দৃষ্টিতে। চিরস্থায়ী মুচকি হাসিটা আজ নেই জায়িনের ওষ্ঠদ্বারে। সারা চেহারায় যেন ওর এক অন্যরকম দাম্ভিকতা। খানিক সময় চুপ থেকে হঠাৎ অনুচ্চস্বরে বলে উঠল, ‘বুকে মরুভূমির নিয়ে নিজেই কাতর আমি। তৃষ্ণা আমি মেটাব কী, মেটাবে তো তুমি।’
কথাটুকু বলার মুহূর্তে বারবার আয়মানের দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে থাকল জায়িনের সরস ঠোঁটদু’টোর ওপর। তা জায়িনের নজর এড়াল না। শুধু চেয়ে দেখতে থাকল ওকে। প্রথমবারের মতো আজ ওর মনে হচ্ছে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির মুখ তার চোখে পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর আর পাপশূন্য। চোখের দৃষ্টিতে আজ নেই তার হিংস্রতা, কপোলের মাঝামাঝিতে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে আবছা লালিমা বর্ণ। লাজুকতা ঘিরে ধরেছে কি আয়মানকে? জায়িন তা দেখে বিমোহিত এবং আশ্চর্য হলো। বারবার তার দৃষ্টি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। কাঠিন্য চেহেরাটা এখন কোমলতায় গ্রাস করে নিয়েছে তার৷ এ এক নতুন আয়মান। কখনো কল্পনাও করেনি জায়িন। আজ এই নতুন সকালে এই হৃদয়েশ্বরীকে নতুনভাবে দেখবে সে। বুকের ভেতরটায় তার যেন তুমুল আন্দলোন জুড়েছে অনাবিল খুশি। কোনো বাক্য ব্যয় করল না৷ দেখতে চায় সে শেষ অবধি এই মুহূর্তের পরিণতি। হঠাৎ একটা সময় এসে আয়মান তার চোখে চোখ মেলে মৃদুস্বরে বলে উঠল, ‘ভীষণ অপার্থিব লাগে এই চোখজোড়া। মনে হয় সর্বক্ষণ অশ্রুতে টলমল করছে। কিন্তু তা তো না। তাও এমনটা মনে হয়। স্বচ্ছ শুভ্র আকাশে বৃষ্টির মতো। আবার বলা যায় মায়াময়। কে বলবে? এই চোখেই কত মানুষ তার মৃত্যু দেখেছে!’
-‘তুমি কী দেখতে পাও?’
মুহূর্ত ব্যয় না করে আয়মান উত্তর দিলো, ‘আমার ধ্বংস দেখি।’
-‘প্রেম মানেই তো পতন৷ তবে তুমি স্বীকার করছ ভালোবাসি তোমাকে আমি?’
-‘হুঁ।’
এই মুহূর্তটুকুর মাঝেই আয়মান সংবেশিত হয়ে পড়ল।হিপনোটাইজ করার ক্ষমতা জায়িনের থাকলেও তা সে কখনো অকারণে কাজে লাগায়নি। আজও চাইলে পারত সে। কিন্তু তার পূর্বেই আয়মানের এই সংবেশিত রূপ দেখে সে হতবাক। তার ভালোবাসার ক্ষমতা তবে এতখানি? কী হলো আজ আয়মানের। এ তার ছলনা নয় তো? এই ভাবনা থমকে গেল তার, অধরে সস্নেহ উষ্ণ স্পর্শে। খানিকক্ষণ আগেও সে চাইছিল অতর্কিতভাবে আয়মানের ঠোঁটে একটা চুমু খাবে। কিন্তু তার সেই চাওয়া পূর্ণ হলো অবশ্যই অবিশ্বাস্যভাবে। এবং তা বিস্ময়কর। আয়মানের তরফ থেকে পাওয়া অধরচুম্বন নিশ্চয়ই ভাগ্যবান পুরুষের কপালে জুটল! এই সুখকর সময়টুকু জায়িন খুব সহজে হারাতে চাইল না। আঁকড়ে ধরল দু’হাতের মাঝে আয়মানের কপোলজোড়া। গভীরভাবে ওর ওষ্ঠদ্বয়ে চুমু খেলো। চিবুক আর গলাজুড়ে ঠোঁটের তপ্ত স্পর্শে ভরিয়ে তুলতেই আচমকা ছিটকে গেল সরে গেল আয়মান জায়িনের থেকে। প্রচণ্ড ঘেমে উঠেছে সে, দু’চোখে অশ্রুনীড়ে ঝাপসা হয়ে এল তার, হঠাৎ মাথা চেপে ধরল সে। ঝিমঝিম করছে মাথা, ঘনঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে উঠল সে, ‘ও মাই গড! অস্থির লাগছে আমার। আই নিড ড্রাগস, জায়িন। আই রিয়্যালি নিড ইট।’
অবস্থা যেন শোচনীয় হয়ে পড়ছে আয়মানের। হঠাৎ করে এই অবস্থার মূল ব্যাখ্যা আবিষ্কার করতে পারল না জায়িন। এই মুহূর্তে এই নিয়ে তা ভাবারও সময় নেই। শান্ত করা জরুরি আগে আয়মানকে। জায়িন ছুটে গেল ওর কাছে, ‘রিল্যাক্স আয়মান। প্লিজ লুক ইনটু মাই আইস। তোমার মানসিক শান্তি প্রয়োজন, ড্রাগস নয়। আমার দিকে দেখো একবার।’
বলেই ওকে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে মাথাটা টেনে নিলো জোরপূর্বক, বলল, ‘জাস্ট টু মিনিটস এখানটাই থাকো। আমি নিশ্চিত করছি, তুমি শান্তি পাবে।’
কী যেন হলো আয়মানের। জায়িনের এক কথায় সে নীরব হয়ে পড়ে রইল ওর বুকের ওপর। অস্থিরতাও ধীরে ধীরে কমতে থাকল। কোমল গলায় বলতে থাকল জায়িন, ‘জগতে সব থেকে বড়ো শান্তি ভালোবাসাতে। তুমি ভালোবাসাতে শান্তি খুঁজে নাও, মান। ক্ষণিক পূর্বে তুমি কোনো ভুল করোনি। কাউকে ভালোবাসাতে ভুল নেই। বিশ্বাস করো আমার কথা। কাউকে ভালোবাসা, তার কাছে নিজেকে অর্পণ করা মানে তার দাসত্ব গ্রহণ নয়।’
নিশ্চুপই রইল আয়মান। নুইয়ে পড়তে চাইছে তার শরীর। ভীষণ অসুস্থ লাগছে তার নিজেকে। জায়িনের কথা তার মস্তিষ্ককে শান্ত করলেও মনকে অশান্ত করে তুলতে চাইছে বারবার। জায়িন টের পেল শরীরের ভার ছেড়ে দিতে চাইছে আয়মান। ওকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘অসুস্থ বোধ করছ?’
মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল আয়মান। সে বসতে চাইছে এখনি। জায়িনও তাকে নিয়ে আপাতত বসার প্রয়োজন অনুভব করল। সকালের শিশিরভেজা ঘাসে আবৃত মাটিতে ওকে ধরে বসে পড়ল সে। রীতিমতো শরীর কাঁপছে আয়মানের। হঠাৎ ওর এই অসুস্থতার কারণ পুরোটাই বুঝতে পারল না জায়িন। মাদকদ্রব্য সেবনের তাগিদ বোধ করলে নেশায় আসক্ত ব্যক্তিটি খুব অস্থির অনুভব করে। নিজেকে কোনো কিছু দ্বারাই শান্ত করতে পারে না সে। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে তার নিত্যদিনের নেশার দ্রব্য পেতে চায়। এটুকু বুঝতে জায়িনের অসুবিধা হলো না। ঠিক এ কারণেই আয়মান নিজেকে অসুস্থ ভাবছে। মানসিক অসুস্থতাকে শারীরিক অসুস্থতায় টেনে নিয়ে গেছে সে। তবে শুধু নেশার প্রয়োজন অনুভবেই তার এই অসুস্থতা নয়। সে চায় না জায়িনের প্রতি তার দুর্বলতা সৃষ্টি হোক৷ একটা সময় এই ছেলেটিকে তার আঘাত করতেই হবে। আর আঘাত করার সময় তার এই দুর্বলতা মায়াতে পরিণত হয়ে যাবে। পারবে না সে তখন ওকে আঘাত করতে। অথচ জায়িন এক প্রকার তাকে বাধ্য করে তুলছে তার মায়াতে জড়াতে। মন আর মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়াই তার অসুস্থতার প্রধান কারণ। জায়িনের কাছে উৎসর্গ করে দিতে চায় না সে নিজেকে। কোনোভাবেই চায় না। মানসিক দ্বন্দ্বের মাঝে ক্লান্তি এসে ভীড় করল তার শরীরে। জায়িনের বুক থেকে নেমে সে মাথা পেতে দিলো ওর কোলের ওপর, চোখজোড়া বুজে এল হঠাৎ। জায়িন তখন ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল। কপালে, মুখের সর্ব পাশে, গলায় ঘামের বিন্দু জমে গেছে ওর৷ হাত দিয়ে তা আলতোভাবে মুছে দিলো সে। চূড়ান্ত পরিকল্পনা সফল না করা পর্যন্ত আয়মানের চিকিৎসাও শুরু করতে পারছে না সে। ওর এই করুণ দশাও যে আর সহ্য হচ্ছে না। নিজেকে অসহায় লাগছে তার, আয়মানের এই অসুস্থতায়।
জিরিয়ে নিতে গিয়ে আয়মান ঘুমিয়ে পড়েছিল। চোখের ওপর কড়া আলোকরশ্মি টের পেয়ে ঘুম ছাড়তেই কানের কাছে চিকন সুরে গুনগুনিয়ে একটা গানের গলা শুনল সে। অতি নিকটে সেই কণ্ঠ। চোখজোড়া মেলে সাদা খণ্ড খণ্ড মেঘের বিস্তর আকাশ দেখল। কোমল এক প্রশান্তি নিয়ে আকাশপানে চেয়ে গুনগুন করা সুরটা মনোযোগ শ্রোতা হয়ে শুনতে থাকল। আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে দু’চোখে কোল ডুবে এল তান জলে৷ বহুকাল পরে বক্ষঃস্থলে বিষাদ দিনের কষ্টগুলো ঘুম থেকে জেগে উঠেছে আজ। শান্ত আকাশতলে এত করুণ সুরে জীবনের অধিকাংশ ভাগ কাটানো একাকিত্ব সময়গুলোর স্মৃতি নির্মমভাবে তার অন্তস্থল জখম করে তুলছে। আপনা আপনিই চোখের কোণ বেঁয়ে গড়িয়ে পড়ল জমে থাকা জলগুলো। জায়িন চেয়ে নেই তার দিকে৷ আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ বুজে সেই করুণ সুর বাজিয়ে চলেছে তার কণ্ঠে৷ আয়মানের মাথা বুলিয়ে দেওয়া সেই হাতটার ওপর হঠাৎ স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকাল। চেয়ে দেখল আয়মান তার মাথায় রাখা হাতটার ওপর হাত দিয়ে তাকে ডাকছে। জিজ্ঞেস করল ওকে, ‘উঠবে?’
নিঃশব্দে শুধু চোখের ইশারায় হ্যাঁ বোঝাল আয়মান। ওকে ধরে তখনি উঠে পড়ল জায়িন। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল ওরা বাড়ির দিকে। ভীষণ দুর্বল লাগছে আয়মানকে। তাই ওর হাতটা শক্ত করে ধরল জায়িন। সেই হাতটার দিকে চেয়ে আয়মান জায়িনের দিকে তাকাল তারপর। নির্লিপ্ত জায়িনের সরল দৃষ্টি তখন সামনের পথে৷ বাড়ির আঙিনাতে আসতেই জায়িন জিজ্ঞেস করল ওকে, ‘চমকে দিতে চেয়েছিলে আমাকে?’
-‘চেয়েছিলাম।’
এরপর আর কথা বলল না জায়িন। বাসার ভেতর এসে নিজের ঘরে ঢোকার পূর্বে আয়মান ওকে বলল, ‘আজ তোমার সব সময়ের অতি প্রশংসিত স্লাইট স্মাইলিং মিসিং ছিল, নক্ষত্ররাজ।’
কথাটা শুনে জায়িন আয়মানের দিকে তাকানোর পূর্বেই সে ঘরে ঢুকে গেল।
***অনেক দিন কোনো পোস্ট না করায় পেজের রিচটা হয়তো কমে গেছে। তাই সবাইকে কমেন্ট করার অনুরোধ রইল।
_____________