#সুখের_নেশায়
#লেখিকাঃআসরিফা_সুলতানা_জেবা
#পর্ব___৪১
ছাদে দাঁড়িয়ে ফানুস উড়ানো দেখছে চৈত্রিকা এক নজরে। আকাশের বুকে মিটি মিটি জ্বলছে দশ-বারোটা ফানুস বাতি। ছাঁদে ছুটাছুটি করে খেলে বেড়াচ্ছে কিছু বাচ্চা, সাথে আয়মান’ও। সিনথিয়া একটু পর পর ছেলেকে চোখ রাঙাচ্ছে,সাবধান করছে, দৌড়াতে নিষেধ করছে। তবুও নিরলস ভঙ্গিতে মায়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে আয়মান নিজের মন মতো চলছে। চৈত্রিকার অধরে হাসির রেখা প্রতীয়মান হলো। প্রচন্ড অবাক হলো ও মুহুর্তেই আয়মান নামক ছোট একটা বাচ্চা ছেলের এটিটিউড দেখে। একটা বাচ্চা মেয়ে ওদের এপার্টমেন্টেরই। মেয়েটা ওর পাশেই বসতে আয়মান উঠে সরে গিয়ে বসে। মেয়েটাকে গা পর্যন্ত ঘেঁষতে দেয় নি। এতটুকু একটা ছেলের এটিটিউড দেখে চৈত্রিকা নিজেই বিস্মিত, ফিদা। নিমেষে ওর মনে পড়ল সাফারাতের কথা। এ যেন পুরোই সাফারাতের অবিকল। কলেজ জীবন থেকেই চৈত্রিকা সাফারাতের এমন রূপের সাথে পরিচিত। সে ব্যতীত সাফারাতের সান্নিধ্যে যাওয়ার সাহস পেত না কোনো মেয়ে। সাফারাত নিজেই ভিড়তে দিত না। অনুৃমতি ছিল কেবল, কেবলই চৈত্রিকার। আয়মান হয়ত ছোট থেকে সাফারাতকে দেখে অভ্যস্ত। তাই তো ছোট এই ছেলেটা’ও সাফারাতের ব্যক্তিত্ব ধারণ করে চলেছে নিজের মাঝে।
আলো বেগমের দীর্ঘ এক বছর পর বাংলাদেশে আসা উপলক্ষে তিনি নিজেই এপার্টমেন্টের সবাইকে নিয়ে একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করেছেন। ছাদে খাওয়া দাওয়া হবে। আড্ডা হবে। পুরোই যেন একটা ফ্যামিলি পিকনিক। ভাড়াটিয়ারা পরিবারের মতই একসাথে মিলেমিশে সব করছেন। মানুষ এতো মিশুক হয় আলো বেগমকে না দেখলে তার ধারণা আজীবন হয়ত ভুলই থেকে যেত। মনে দাগ কেটে সজীব হয়ে থাকত শুধু এত বছরের ধনী মানুষদের কাছ হতে লাঞ্চিত হওয়ার সময়গুলো, স্মৃতিগুলো। সিনথিয়ার গলার আওয়াজে নড়েচড়ে দাঁড়ায় চৈত্রিকা। সিনথিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
‘ এই আয়ানের বাচ্চা আয়মান আমার কথা কানেই তুলে না। আয়ান তো এমন না। কত শান্তশিষ্ট আমার জামাই। আয়মান এত ত্যাড়া বাঁকা কেমনে হলো?নিজের মর্জিতেই চলে এতটুকু বয়সে। ‘
চৈত্রিকা স্মিত হাসল। মায়াময় কন্ঠে বললো,
‘ তোর ছেলের ত্যাড়ামি আমার খুব খুব পছন্দ হয়েছে। এরকম বিদেশি, এটিটিউডওয়ালা বাচ্চা দেখে আমি ফিদা। ‘
‘ একবার মেয়ের মা হ। আয়মান হবে তোর মেয়ের জামাই। তখন আমি দেখব তোরা মা, মেয়ে কেমন ফিদা হোস। আমার কাছে নালিশ করতে পারবি না একদম। এখনই সাবধান করে দিলাম। ‘
সিনথিয়ার কথায় হেসে কুটিকুটি চৈত্রিকা। ঠিক কতকাল পরে হাসল সে এমন করে?কি আশ্চর্য! নিজের হাসিতে সে নিজেই হতবাক, স্থবির। পাশ থেকে শোনা গেল একটা ভরাট কন্ঠ,
‘ কি হলো হাসি থামালেন কেন?’
চৈত্রিকা ঝটপট বিস্ময়কর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল পাশে। সাফারাতের চোখে মুগ্ধতা। ঠোঁটে মুচকি হাসি। সহসা ধড়াস করে উঠল চৈত্রিকার বুক। হৃদপিণ্ড স্পন্দিত হচ্ছে তড়িৎ বেগে। এই গম্ভীরমুখো লোক টাও হাসতে পারে?লোকটা কি জানে তার হাসিতে চৈত্রিকার অভ্যন্তরে ঢাক-ঢোল বাজছে?হাতুড়ি পেটা শব্দ হচ্ছে?
সাফারাত গায়ের জ্যাকেট টা খুলে চৈত্রিকার হাতে ধরিয়ে দিল। তৎপরে দৃশ্যমান হয় তার বলিষ্ঠ দু’টো বাহু। পড়নের কালো টি শার্টে ফর্সা,সুঠাম দেহ টা দ্বিগুণ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একটা চেয়ার টেনে এনে চৈত্রিকার হাত টা ধরে এনে বসিয়ে দিল। সুস্থির কন্ঠে উঠল,
‘ আপনি এত সময় ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন?এখানে খারাপ লাগলে রুমে চলে যান। আয়োজন শেষে আমি ডেকে দিব আপনাকে। ‘
সত্যিই চৈত্রিকার ভালো লাগছে না। এতক্ষণ হাসি ঠাট্টায় সময় কেটে গেলেও এখন মনে হচ্ছে নিচে গিয়ে একটু রেস্ট নিলে সুস্থ অনুভব করবে। জ্যাকেট টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাফারাতের কপালে মৃদু মৃদু ঘাম জমে আছে। দ্বিধান্বিত চাহনি নিক্ষেপ করে ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘ আপনার কি গরম লাগছে?’
‘ একটু আকটু। চলুন আপনাকে নিচে দিয়ে আসি। ‘
চৈত্রিকা অবিন্যস্ত, এলোমেলো দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকালো। সিনথিয়া আয়মানের সাথে বসে আছে। বাকি সকলে যে যার কাজে মগ্ন। সবার চক্ষু আড়ালে শাড়ির আঁচল তুলে চৈত্রিকা সাফারাতের কপালের ঘাম মুছে দেয়। হাত টা কাঁপতে থাকে অনবরত। সাফারাত ফিচেল হাসে। কানের কাছে মুখ নিয়ে গাঢ় স্বরে বলে,
‘ ধন্যবাদ বউ। ধন্যবাদ আমার চৈত্র মাস। ‘
চৈত্রিকা মাথা নুইয়ে লাজুক হাসল। মিনমিন করে বললো,
‘ আমি যেতে পারব। এদিকের কাজ শেষ হলে আমায় ডেকে দিবেন। ‘
____________
চৈত্রিকা বাসায় ঢুকে দেখে আলো বেগম ফোনে কথা বলছেন। ওকে দেখে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকল। সোফায় উনার পাশে গিয়ে বসল সে। আলো বেগম ফোন রেখে বললেন,
‘ তোমার খালুর সাথে কথা বলছিলাম। নিচে চলে এলে কেন?’
‘ মাথা ব্যাথা করছে একটু। তাই নিচে চলে এলাম। ‘
‘ আচ্ছা বসো। আমি চা করে আনি তোমার জন্য। ভালো লাগবে। ‘
চৈত্রিকা মাথা হেলিয়ে সায় জানাল। সত্যি এই মুহুর্তে এক কাপ চা ওর ভীষণ প্রয়োজন। আলো কিচেনে গেলেন চা বানাতে। কিছুক্ষণ,কিছু সময় নিরবে,নিশ্চুপে বসে থাকার পর চৈত্রিকার মাথায় একটা বিষয় উদয় হতেই ও দৌড়ে কিচেন রুমে গেল৷ আলো বেগমই পারবে ওর মস্তিষ্কে সৃষ্ট হওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে। সবকিছু স্পষ্টভাবে বলতে। আলো বেগম ওকে দেখে বললো,
‘ আর কিছু লাগবে মা?’
‘ কিছু প্রশ্নের জবাব লাগবে খালা মণি। ‘
সোজাসাপ্টা উত্তর দিল চৈত্রিকা। আলো ভ্রুঁ কুঁচকে সন্দিহান নজরে তাকালেন। কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন,
‘ কেমন প্রশ্ন? ‘
চৈত্রিকা গলায় কথাগুলো দলা পাকিয়ে এল। তবুও প্রশ্ন করল,
‘ মা’য়ের মৃ*ত্যু কিভাবে হয়েছিল খালা মণি? ‘
আলো বেগমের মুখ টা মলিন হয়ে এল। নিকষ কৃষ্ণতে ছেয়ে গেল সুন্দর মুখশ্রী টা। শান্ত অথচ ব্যথিত কন্ঠে বলে উঠলেন,
‘ সাফারাত বলে নি?’
চৈত্রিকা মাথা নাড়িয়ে বলল,’ উঁহু। ‘
‘ আমি জানতাম ছেলেটা বলবে না। তোমার কাছেও নিজের কষ্টগুলো প্রকাশ করল না?এত চাপা স্বভাবের কেমন করে হলো ছেলেটা?হয়ত ওর কষ্টগুলো তোমাকে স্পর্শ করুক তা ও চায় নি। তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারে না ছেলেটা। ‘
চৈত্রিকাকে নিয়ে ড্রইং রুমে আসলেন তিনি৷ সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করলেন,
‘ সাফারাতের নানা মানে আমার চাচা অনেক বিত্তশালী ছিলেন। কাকি মণি সিয়ার জন্মের সময় মা/রা যায়। তখন চাচা-চাচীর বিয়ের বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। চাচী মা/রা যাওয়ার পর চাচা সিয়ার দিকে চেয়ে আর বিয়ে করলেন না। নিজ হাতে বড় করেছেন সিয়া কে। চাচার অফিসে কর্মরত ফারুক মানে সাফারাতের বাবার সাথেই সিয়ার বিয়ে হয়। প্রেমের বিয়ে। ফারুক নিজের সবটা দিয়ে সবসময় সিয়াকে আগলে রাখে। সিয়ার যখন আঠারো বছর হয় তখনই চাচা ওর নামে সব সম্পত্তি লিখে দেয়। সিয়া ও ফারুকের বিয়ের কয়েক বছর পর চাচা গাড়ি এক্সিডেন্টে মা*রা যান। তখন ফারুক-ই সিয়া কে যত্ন করে আগলে রাখে। মাঝে মাঝে সিলেটে শশুর বাড়িতে যেত সিয়া। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কোনোদিনও কোনো দুঃখ, কষ্ট,অশান্তি ওদের সংসারে আসে নি। স্কুল জীবনটা ঢাকাতে পাড় করে সাফারাত জেদ ধরে সিলেট দাদুর বাড়িতে থেকে কলেজে পড়বে। সিয়ার পুরো পৃথিবী ছিল সাফারাত। আর সাফারাতের কাছে?তার কাছে মা ছিল তার আত্মা। কলেজ জীবনের অর্ধেক সমাপ্তি না হতেই হুট করে সিয়া আমার কাছে মানে জার্মানি পাঠিয়ে দেয় সাফারাতকে। কারণ জিজ্ঞেস করলে এক এক করে সবকিছু খুলে বলে। সাথে পাঠায় একটা মেয়েকে।মেয়েটা হলো সিনথিয়া। ছেলেটা আমার কাছে গিয়ে একদম চুপচাপ থাকত। মাঝে মাঝে খুব রেগে থাকত। ওর সাথে আমার আগে থেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হওয়ায় সবটা খুলে বলে আমাকে। চৈত্র নামের মেয়েটার কথা বলে। প্রত্যেক টা কথায় আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ওর আবেগি বয়সে প্রথম প্রেম ওর চৈত্র মাস। সেই সাথে উপলব্ধি করি মেয়েটার প্রতি জমে রয়েছে ওর এক আকাশ সমান অভিমান।
সাফারাতের জার্মানি আসার এক দু’য়েক মাস পর সিয়া জানায় সে প্রেগন্যান্ট। শুনে খুশি হব নাকি অবাক আমি বেশ দ্বিধাদ্বন্দে ছিলাম। কারণ সিয়া সেদিন কাঁদতে কাঁদতে জানায় সুফিয়া বেগম ব্যতীত পরিবারের সকলে নাকি ছি!ছি!করছে ওর উপর। যার একটা আঠারো বছরের ছেলে আছে এ বয়সে তার প্রেগন্যান্ট হওয়ার কি দরকার ছিল। সমাজের কথা ভাবল না। আরো নানান কটুক্তি। এসব কিছুতেই সিয়ার খারাপ লাগে নি। উল্টো ওকে ভেঙে দিয়েছে ফারুক,যা শুনে আমি মিনিট কয়েক স্তব্ধ ছিলাম। ফারুক বলেছে এবোরশন করাতে। যদি এবোরশন না করে তাহলে সে অন্য কাউকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে। সিয়ার এই বয়সে সন্তান নেওয়া ওর সহ্য হচ্ছে না। এই বাচ্চা রাখলে সিয়ার দিকে মুখ তুলেও তাকাবে না সে। এসব শুনে সিয়া কিছু বলার আগেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে ফারুক পরকীয়া করছে না তো?হ্যাঁ তা-ই সত্যি। আমার বোন টা কেঁদে কেঁদে বলে সাফারাত যেন জানে ওর মা প্রেগন্যান্ট। কিন্তু এটা যেন কখনও না জানে ওর বাবা পরকীয়া করে,নেশা করে। মানুষ টা শুরু থেকেই ভুল ছিল। সময়ের সাথে ভালোর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। কি হাস্যকর ব্যাপার না?এ বয়সে বাচ্চার বাপ হতে পারবে না কিন্তু পর নারীর সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ মুহুর্ত দিনের পর দিন সহ্য করে গিয়েছে আমার বোন। সিয়া সব খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সুফিয়া বেগমের ভাইয়ের মেয়ের সাথে ফারুকের পরকীয়ার সম্পর্ক প্রায় চারটা বছর ধরে। মেয়েটা ডিভোর্সি। একদিন নেশার ঘোরে ফারুক এটাও জানায় কেবল আধিপত্য, টাকার জন্য সে সিয়াকে বিয়ে করে। সুফিয়া বেগমের ভাইয়ের মেয়ের বিয়ের পূর্বেও দু’জনের গভীর সম্পর্ক ছিল। শুধুমাত্র উনার ভাই রাজি হয় নি বলে বিয়েটা করতে পারে নি।
সিয়া এক এক করে সব সত্য জানতে পারে। ওর সেই খারাপ সময়ের সঙ্গী ছিল সুফিয়া বেগম। মা’য়ের মতো ওর যত্ন নেয়। মাঝে মাঝে ফারুক ওকে অনেক মারধর করত বাচ্চা টা এবোরশন করে নি বলে। আমি সাফারাতকে শুধু ওর মায়ের প্রেগন্যান্টের বিষয় টা জানায়। শুনেই খুব খুশি হয় ছেলেটা। কলেজ থেকে আসার পথে প্রতিদিন অনাগত ভবিষ্যত মেহমানের জন্য গিফট কিনে আনত।তন্মধ্যে একমাস পর জানতে পারি সিয়া আর নেই। আগুনে পুড়ে ম’রে গিয়েছে আমার বোন টা।
#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)