#সুপ্ত_ভালোবাসা
#পর্ব_৩৪
#Tahmina_Akther
হঠাৎ করেই শরীর কেমন যেন ভার হয়ে এলো।মনে হলো কেউ আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হুট করে চোখে খুলে তাকালাম না, কেউ তাকিয়ে নেই আমার দিকে।
সোফায় নজর গেলো, অভিক শুয়ে আছে উপুড় হয়ে।
তাহলে মহাশয় আমার দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো যেই না আমি চোখ খুললাম ওমনি তিনি সুবোধ বালকের ন্যায় ঘুমানোর ভান ধরে পড়ে রইলেন।
মুচকি হেঁসে এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করে ধীরে খাট থেকে নেমে এলাম। জানালা কাছে গিয়ে পর্দা টেনে দিতেই দিনের প্রথম প্রহরের এক ফালি রোদ্দুর ছেঁয়ে গেলো পুরো রুম জুড়ে। বিছানা গুছিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
হিয়া ওয়াশরুমে ঢুকতেই অভিক উঠে বসলো।উফফ, আরেকটু হলে ধরা পড়ে যেতাম।
নোভার বাচ্চা শুধুমাত্র তোর জন্য আজ আমার এই অবস্থা। ছয় মাস আমার বৌ’টাকে দেখি না এখন দেশে এসে তোর ষড়যন্ত্রের রোষানলে পড়ে আমার মিষ্টি বৌয়ের সঙ্গে রাগ করে বসে আছি।কিন্তু, রাগ করে কি লাভ হলো আমার বৌ’টা তো একবারও আমার রাগ ভাঙাতে এলো না।
মনে মনে কথাগুলো বলছে আর আফসোস করছে অভিক।
এরইমাঝে ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো হিয়া। সোফায় বসে থাকা অভিকের দিকে এক পলক তাকিয়ে রুমে থেকে বেরিয়ে গেলো।
অভিক হিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো কারন ওর গোসলের প্রয়োজন।
———————-
রান্নাঘরে আজ হরেক পদের খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে। কারণ বাড়ির ছেলে আজ কতদিন পর ফিরে এলো।রান্নাঘরের দরজা সামনে দাঁড়িয়ে হিয়া তার মা আর শ্বাশুড়ি দিকে তাকিয়ে আছে। কি যে তাড়াহুড়ো করে সব কিছু করছে তারা!
-ছোট আম্মু?
হিয়ার ডাক শুনে অভিকের মা ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
-কি রে মা কিছু লাগবে? আর অভিক ঘুম থেকে উঠেছে?
-না আমার কিছু লাগবে না। আর মহাশয় ঘুম থেকে জেগেছে আমার আগে। কিন্তু কেন যেন ঘুমের ভান ধরে পড়ে আছে?
হিয়ার শেষের কথাগুলো শুনে হিয়ার মা এবং শাশুড়ী হেঁসে ফেললেন।
-আমি কি এমন কথা বললাম যে এভাবে হাঁসছো তোমরা? হাসি থামিয়ে বলো, কি কাজ করবো?
-না থাক তোর কিছু করা লাগবে না। তুই এইগুলো
খেয়ে শেষ কর তাহলে আমাদের কাজ হয়ে যাবে।
হিয়ার দিকে আঙুরের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললো হিয়ার মা। হিয়া প্রথমে না করলেও পরে
উনাদের জোড়াজুড়িতে খেতে বাধ্য হলো।কিছু আঙুর খাওয়া হলে হিয়া প্লেট নিয়ে ড্রইংরুমে চলে আসে। এসে দেখে আগে থেকেই সেখানে অভিক আর সাদাফ বসে কি যেন ফুসুরফাসুর করছে। হিয়া আর ওখানে না বসে রুমে চলে গেলো।
এইদিকে,
অভিক সাদাফের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে হিয়ার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলো।হিয়া এই ছয়মাসে বেশ পরিবর্তন হয়েছে গাল দুটো আগের থেকে বেশ ফোলা ফোলা, চোখ দুটো আগের থেকে আরো নজরকারা হয়েছে,আগের থেকে স্বাস্থ্য একটু উন্নত হয়েছে,চুলগুলো কোমড় ছাড়িয়ে গেছে।
হিয়া চলে যেতেই অভিক সাদাফকে বললো,
-এই তুই না বলেছিস তোর বোন আমার বিরহে কেঁদে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকতো!এখন তো দেখছি সে দিব্যি ভালো আছে। আগের থেকে তোর বোন আরো সুন্দরী হয়ে গেছে।
-ভাইয়া শোনো আমার আপু আগে থেকেই সুন্দর বুঝলে।তোমার তো কপাল ভালো আমার বোনের মতো আলাভোলা বৌ পেয়েছো নয়তো অন্য কেউ হলে তোমার আর জেনিফারের কিসিং মোমেন্ট না ডেথ মোমেন্ট বানিয়ে ফেলতো।
-ভাই তোদের বললে তো বিশ্বাস করবি না। ওই নিঝুমের ফিয়ন্সে ওর মতোই হ্যাংলা টাইপ। কথা বলার ফাঁকে শরীরের উপর ঢলে পড়ে। একদিন আমি বসে ছিলাম গার্ডেনে আর ওমনি কোত্থেকে এসে আমার হামলে পড়ে গালে ইয়ে দিয়ে বসলো।আর নোভার বাচ্চা সেটার পিক তুলে ফুলের কাছে পাঠিয়ে দিলো।সব ওই নোভার বাচ্চার ষড়যন্ত্র তোর বোনের সাথে আমার ঝগড়া বাঁধানোর।এখন দেখ এতদিন পর এলাম তোর বোন একটি বার আমায় জিজ্ঞেসও করলো না আমি কেমন আছি?
-তুই জিজ্ঞেস করেছিস ও কেমন আছে?যে কর্ম করেছিস ও এখন তোর সাথে যে ব্যবহার করছে তা স্বাভাবিক।
রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে কথাগুলো বললেন অভিকের মা।
-মা, বাইরের কান্ট্রির লোকেরা এইসব ব্যাপারকে খোলামেলা ভাবে দেখে। তারপরও, সেদিন জেনিফারের ওরকম বিহেবিয়ারের পর ওর সাথে আমার বেশ বড় ধরনের ঝগড়া হয়েছে।পরে নিঝুম ভাইয়া এই ব্যাপারটাকে সামলেছে।
-সবই বুঝলাম। কিন্তু, তোর ফুলকে মানাবি কিভাবে? ও কিন্তু অনেক কষ্ট পেয়েছে গত পরশু রাত থেকে ওর কান্না শুরু হয়েছে আর থেমেছে তুই আসার পরে ।
-ও তো বেশি বুঝে। ও কি জানে না ওর অভিক ওকে ছাড়া আর দ্বিতীয় কাউকে চায় না। আর সে আমাকে ছাড়া ভাল আছে। একা একাই খেয়ে নিচ্ছে আমি নামক একটা মানুষ যে এতদিন পর এলাম কি করছি? কি খাচ্ছি?কোনো খবর রাখছে সে?
অভিমানী কন্ঠে কথাগুলো বলছে অভিক।
ছেলের অভিযোগ শুনে মিটিমিটি হাসছেন অভিকের মা।
-অভিক একটা কথা শুনবি?
-হুম বলো, মা।
——————-
ইদানিং সকালের প্রথম মিষ্টি রোদ গায়ে লাগলে বেশ আরাম অনুভূত হয় হিয়ার। বারান্দায় পাতানো চেয়ারে বসে বসে আঙুর খাচ্ছে আর অভিকের কথা ভাবছে।
-কি ভাবে পারলো সে তার গালে পেতে দিতে ওই জেনিফারের সামনে!এখন আবার রাগ দেখানো হচ্ছে আমার সাথে সে থাকুক তার রাগ নিয়ে।
হিয়া যখন ভাবনার সাগরে ডুবে ডুবে অভিযোগ করছিলো অভিকের ঠিক তখনি ওর পাশের চেয়ারটায় কে যেন ধপ করে বসে পড়লো।হিয়া ভয়ে পেয়ে লাফিয়ে উঠলো।
-কি হয়েছে? ভয় পেয়েছো?
-ভয় পাবো না তো কি করবো। এভাবে কেউ হুট করে চলে আসে!
-আসবো না তো কি করবো।তুমি কি ভাবে পারলে আমার থেকে এত বড় কথা লুকিয়ে রাখতে,ফুল?
বলেই হিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো অভিক। এরপর, ওর পেটে চুমু দিলো অনেক সময় নিয়ে। কিছু মনে পড়তেই হিয়া হেসে ফেললো অভিকের কান্ড দেখে। অভিক উঠে দাঁড়ানোর আগে মুখটাকে আবারও গম্ভীর করে ফেললো।
অভিক উঠে দাঁড়িয়ে হিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো পলকহীন চোখে।হিয়া এক কি দু’বার অভিকের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। কারন,ওই চোখে যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না!চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
কপালে ভেজা কিছু টের পেতেই হিয়া চোখ তুলে তাকালো। অভিক ওর কপালে চুমু দিয়ে জরিয়ে ধরলো বেশ শক্ত করে।
এই জড়িয়ে ধরাতে কি যেন আছে! এতদিনের সব জমানো রাগ, অভিমানের বরফ গলে শীতল পানিতে পরিণত হয়ে গেছে।
-পৃথিবীর সবচেয়ে সুখের অনুভূতি কি জানো?কেউ একজন আমাদের শরীরের একাংশ হয়ে এই পৃথিবীতে আসবে তার আগমণ বার্তা জানা। তার আগমনে যে আমাদের নতুন করে জন্ম হবে কারণ আমরা মা-বাবা হবো যে।
তুমি কেন জানাও নি আমায় ফুল আমি বাবা হবো?মায়ের কাছ থেকে এই মাত্র আমি জানলাম। এই দেখো খুশিতে আমার সারা শরীর কিভাবে কাঁপছে?
হিয়া দেখলো আসলেই অভিকের সারা শরীর কাঁপছে।
-আমি চেয়েছিলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে। কিন্তু গতকালের ইন্সিডেন্টে সব নষ্ট হয়ে গেলো।
মন খারাপের সুরে বললো হিয়া।
-এত বড় সারপ্রাইজ আমি নিতে পারছি না।আমি বাবা হবো ও মাই গড। ইট’স আনবিলিভএভেল!
কবে আসবে আমার পাখিটা আমার তো আর সহ্য হচ্ছে না?
হিয়াকে ঘুরিয়ে ওর পিঠ অভিকের বুকে লাগিয়ে নিলো। এরপর, ওর পেটে হাত রেখে, কাঁধে মুখ গুজে বললো অভিক।
-সে আসবে আরো তিন মাস পর।
-তারমানে তুমি সিক্স মান্থ প্রেগনেন্ট রাইট!
অভিক অবাক সুরে বলে উঠলো।
হিয়া মাথা নাড়িয়ে হু বললো।
-এইজন্যই তো আমি বলছিলাম, তোমাকে আগের থেকে এত মোটা মোটা লাগছে কেন?এদিকে যে আমার পাখিটা এখানে ঘাপটি মেরে আছে কে জানতো!
ফুল আজ এত খুশি খুশি লাগছে কেন আমার বলতে পারো?
#চলবে