সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-১৪

0
919

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ১৪

কোনো কারণ ছাড়াই আজ ডালিয়ার মুড সুয়িং হচ্ছে। কেন জানি কিছুই ভালো লাগছে না। ভার্সিটিতেও আসতে ইচ্ছে করেনি, তবু এসেছে। এসে হতে মুখ ভার করে বসে আছে। ক্লাসেও মনোযোগ নেই। আড্ডায় বসে মুখে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই। অন্তর অনেক মজার মজার কথা বলেও ওকে হাসাতে পারেনি। ডালিয়ার গোমড়া মুখটা দেখে তাহসিনের মনটা আপনা-আপনি খারাপ হয়ে গেল। সে ভাবল যেভাবেই হোক আগে ডালিয়ার মন ভালো করতে হবে। সবাই যখন হতাশ হয়ে পড়েছে তখন তাহসিন বলল,“ওয়েট, কিছু একটা ভেবে দেখি।”

তাহসিন মনোযোগ সহকারে ভাবতে বসল। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাহসিনের দিকে তাকিয়ে রইল। তাহসিন হঠাৎ বলে উঠল,“আমরা যদি আজ কিছুক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করে তারপর কোনো একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করি, কেমন হবে?”

অরিশা এক্সাইটেড হয়ে বলল,“গ্রেট আইডিয়া! সবাই মিলে ঘোরাঘুরি করলে আর খাওয়া-দাওয়া করলে আস্তে আস্তে মন ভালো হয়ে যাবে।”

ইলোরা বলল,“দারুণ একটা আড্ডাও হয়ে যাবে।”

নাদিয়া প্রশ্ন করল,“কোথায় যাব?”

তাহসিন ডালিয়াকে প্রশ্ন করল,“কোথায় যেতে চাস?”

ডালিয়া গুমোট মুখে বলল,“জানি না। আমার ইচ্ছে নেই। তোরাই ঠিক কর।”

সবাই এবার ভাবতে বসল। টুম্পা বলল,“চল জাদুঘর ঘুরে আসি।”

তাহসিন বলল,“ধুর! এইটা জাদুঘর ঘোরার সময় হইল?”

মুনা বলল,“শিশুপার্ক?”

অন্তর মুনার মাথায় চাটি মেরে বলল,“দুইদিন পর বিয়া হইয়া যাইব, আর তুমি নিজেরে শিশু মনে করো এখনও? বিয়ার পর নিজের শিশু নিয়া যাইয়ো শিশুপার্ক ঘুরতে।”

মুনা মুখ গোমড়া করে হাতের তালুতে মাথা ঘষতে লাগল। অরিশা বলল,“রমনা…..?”

অরিশার কথার মাঝেই তাহসিন বলল,“নাহ্।”

নাদিয়া বিরক্ত হয়ে তাহসিনকে বলল,“তুই নিজেই তো ঠিক করতে পারিস।”

তাহসিন প্রশ্ন করল,“ফ্যান্টাসি কিংডম যাবি?”

টুম্পা ঠোঁট উল্টে বলল,“অ্যাহ্! সবাই কি অত টাকা নিয়ে এসেছে? ফ্যান্টাসি কিংডম গেলে রেস্টুরেন্টে আর যাওয়া হবে না। না খেয়েই বাড়ি চলে যেতে হবে। আগে থেকে প্ল্যান করা থাকলে সবাই টাকা নিয়ে আসতো। তাছাড়া আমাদের হাতে অত সময়ও নেই। সময়মত বাড়ি ফিরতে হবে।”

টুম্পার কথায় সবাই সমর্থন করল। অন্তর মাথা চুলকে বলল,“আমার মাথায় একটা দারুণ আইডিয়া এসেছে?”

সবাই আগ্রহী হয়ে জানতে চাইল কী আইডিয়া। অন্তর বলল,“চিড়িয়াখানা গিয়া এই ডালিমেরে বাঘের খাঁচার ভিতর দিয়া দিমু। তারপর দেখবি সেকেন্ডের মধ্যে ওর মন এক্কেবারে ফুরফুরা হইয়া যাইব।”

সবাই কিড়মিড় করে অন্তরের দিকে তাকিয়ে রইল। অরিশা রগত কন্ঠে বলল,“ফান বন্ধ রাখ।”

ইলোরা হঠাৎ উজ্জ্বল মুখে বলল,“পেয়েছি।”

টুম্পা প্রশ্ন করল,“কী?”

“ডালিয়া তো ফুল অনেক পছন্দ করে। গ্রামে ওর ফুলের বাগানও আছে।”

ইলোরার কথা শুনে মুনা বলল,“ফুলের মার্কেটে যাওয়ার কথা ভাবছিস না-কি?”

ইলোরা উপর নিচে মাথা দোলালো। তাহসিন বলে উঠল,“গ্রেট! চল তাহলে সেখানেই যাই। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে তারপর একসাথে লাঞ্চ করব সবাই।”

মুনা চমকে উঠল। এতক্ষণ তার খেয়ালই ছিল না যে আজ দুপুর একটায় দিহানের সাথে তার দেখা করার কথা। আড্ডায় বসে ব্যাপারটা মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। বন্ধুদের সাথে ফুলের মার্কেটে যাওয়ার ইচ্ছা তারও আছে। কিন্তু লাঞ্চ তো করতে পারবে না। দিহান তো একটার মধ্যে চলে আসবে। একদিকে বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি আর আড্ডা মিস করতে ইচ্ছে করছে না, অন্যদিকে দিহানের সাথেও দেখা করতেই হবে। এখন উপায়? মুনা ভীষণ কনফিউশনে পড়ে গেল। নখ কামড়ে ধরে চিন্তা করতে লাগল কী করা যায়। নাহ্, কোনো উপায়ই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মুনাকে অন্যমনস্ক দেখে ডালিয়া প্রশ্ন করল,“তোরও কি মুড সুয়িং হলো না-কি?”

মুনা ডানে বামে মাথা দোলালো। নাদিয়া বলল,“তাহলে?”

মুনা গাল ফুলিয়ে বলল,“আমি ফুলের মার্কেটে যেতে পারব, কিন্তু লাঞ্চ করতে পারব না তোদের সাথে।”

তাহসিন সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল,“কেন?”

“আসলে তোদেরকে বলাই হয়নি। আজ দুপুর একটায় দিহানের সাথে আমার মিট করার কথা।”

সবাই ভ্রুকুটি করে মুনার দিকে তাকাল। যার অর্থ, এই দিহান মানবটা আবার কে? মুনা সবার মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পেরে অপ্রস্তুত হেসে বলল,“যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে সেই ছেলের নাম দিহান।”

সবাই এবার একসাথে সুর তুলে বলল,“ওওও…….।”

অরিশা প্রশ্ন করল,“কোথায় দেখা করবি?”

মুনা উত্তর দিলো,“ফাস্টফুড এন্ড চাইনিজ রেস্টুরেন্টে।”

অন্তর হেসে বলল,“জামাইর লগে মিট করতে গিয়া ব্যাটার পকেট খালি করার ধান্দায় আছো? তোমারে চেনা আছে মুলা। এই চল, আজকে আমরা মুলার জামাইর লগে মিট করমু আর ও যা যা খাইব আমরাও খাইয়া আসমু। আমগো হবু দুলাভাই আইজকা ট্রিট দিব।”

মুনা রেগেমেগে অন্তরকে এক ঘা লাগিয়ে বলল,“ফালতু কথা কম বলবি শয়তান। আর তোরা মিট করতে যাবি কোন দুঃখে শুনি?”

ইলোরা দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল,“তুই আমাদের ট্রিট দিসনি, সেই দুঃখে।”

মুনা বলল,“বইন তোদের ট্রিট তোরা পেয়ে যাবি। আজকে আমার পিছু নিস না।”

নাদিয়া হেসে বলল,“ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে। আমাদের মুনা হবু জামাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে।”

তাহসিন সিরিয়াস মুড নিয়ে বলল,“আমাদের প্ল্যান যেমন ছিল তেমনই থাকবে। মুনা, তুই লাঞ্চের আগে মার্কেট থেকে চলে যাস। আর আমরা সবাই একসাথে লাঞ্চ করব।”

সবাই অন্তরের কথায় সায় দিল। ইলোরা বলল,“আমি আব্বুকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। নইলে আব্বু ভার্সিটির গেটের সামনে অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য।”

ইলোরা তার আব্বুকে ফোন করে বলে দিলো। তারপর সবাই মিলে রওনা দিলো শাহবাগ ফুলের মার্কেটে। ফুটপাত ধরে হেঁটে সবাই মিলে গল্প করতে করতে খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেল। সারি সারি ফুলের দোকান। কত রকমের ফুল! সব ফুলের নামও জানা নেই। একেক রকমের ফুলের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য! ফুলগুলো দেখলে ইচ্ছে করে সব নিয়ে নিতে। ডালিয়া এর আগে ফুলের মার্কেটে আসেনি। এত এত ফুল দেখে তার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। সবাই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল আর যার যেটা ভালো লাগে কিনে নিল। মুনা, টুম্পা আর অন্তর দল ভেঙে অন্য একটা দোকানে ঢুকল। ডালিয়া মন ভরে শুধু ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করছে। তাহসিন হঠাৎ বলল,“তোরা এখানে দেখ, আমি ওই দোকান থেকে ঘুরে আসছি।”

অরিশা বলল,“যা।”

তাহসিন চলে গেল দুটো দোকানের পরের দোকানে। ইলোরা, অরিশা, ডালিয়া আর নাদিয়া মিলে আবার ফুল দেখা শুরু করল। একেক জন ফুল দেখছে আর সেগুলো একে অপরকে দেখিয়ে হেসে হেসে কথা বলছে। নাদিয়া আর ইলোরা লোভ সামলাতে না পেরে ইতোমধ্যে অনেক ফুল কিনে ফেলেছে। অরিশা ওদের থেকে কিছু কম কিনেছে। ডালিয়া দেখতে দেখতে কেনার কথাই ভুলে গেছে‌। ইলোরার কথায় শুধু এক রকমের ফুল কিনেছে। ওরা চারজন দোকানের বাইরে এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাহসিন চলে এল। ওর ডাকে সবাই ফিরে তাকাল। নাদিয়া তাহসিনকে লক্ষ্য করে ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল,“হাত পেছনে লুকিয়ে রেখেছিস কেন?”

তাহসিন মুচকি হেসে ডালিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ডালিয়া প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। তাহসিন হঠাৎ হাত দুটো সামনে নিয়ে এল। উপস্থিত সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ডালিয়ার চোখ তো চড়কগাছ। এত গোলাপ! তাহসিনের দুহাত ভর্তি তাজা টকটকে লাল গোলাপ। ডালিয়া হা করে তাহসিনের দিকে তাকিয়ে রইল। তাহসিন মুচকি হেসে বলল,“ফর ইউ।”

ডালিয়া বিস্ময় নিয়ে বলল,“এতগুলো?”

“তোর মন ভালো করার জন্যই তো আমরা এখানে এসেছি। এখন যেকোনো উপায়ে তোর মন ভালো করার দায়িত্ব তো আমাদেরই। তাই না?”

ইলোরা ফট করে বলে উঠল,“একদম ঠিক।”

“কিন্তু আমার একার জন্য এত গোলাপ?”

ডালিয়ার কথায় অরিশা হেসে বলল,“স্পেশাল মানুষের জন্য স্পেশাল গিফট। আরে ও কি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? নিচ্ছিস না কেন? আগে নে, পরে অবাক হস।”

ডালিয়ার কেন জানি খুব লজ্জা লাগল। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। তবু সে মাথা নিচু করে বাধ্য মেয়ের মতো হাত বাড়িয়ে তাহসিনের হাত থেকে ফুলগুলো নিল। তাহসিন বেশ খুশি হলো। কিন্তু একই সময় কারো মুখে হাসি ফুটল, কারো মুখ লাজে রাঙা হলো আর কারো চোখের কোণে একফোঁটা জল চিকচিক করে উঠল। নাদিয়া চোখের কোণে জমে যাওয়া জলটুকু আড়ালে মুছে ফেলল। ততক্ষণে অন্তর, টুম্পা আর মুনাও সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। ডালিয়ার হাতে এত গোলাপ দেখে ওরাও অবাক হলো। অন্তর বলল,“কাহিনি কী রে? এইখানে কি প্রপোজ হইয়া গেল না-কি?”

অরিশা বলল,“ফুল দিলেই সেটা প্রপোজ হয়ে যায়? ডালিয়ার মন ভালো করার জন্য তাহসিন ওকে এই ফুলগুলো দিয়েছে।”

মুনা হেসে বলল,“আরে বাহ্! ফুলগুলো অনেক সুন্দর!”

ডালিয়া মুচকি হাসল। লজ্জায় সে তাহসিনের দিকে তাকাল না। টুম্পা বলল,“যাক, আমাদের প্ল্যান তাহলে কাজে লেগেছে। প্ল্যান ফুলফিল না হতেই ডালিয়ার মন ভালো হয়ে গেছে।”

তাহসিন হেসে বলল,“তা ঠিক। এখন ও খুশি মনে আমাদের সাথে খাওয়া-দাওয়া করতে পারবে আর আড্ডাও দিতে পারবে।”

ইলোরা হঠাৎ নাদিয়াকে লক্ষ্য করে বলল,“এই নাদিয়া, তোর কী হলো আবার?”

নাদিয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বলল,“কিছু না। আমি আরও কিছু ফুল কিনব।”

অরিশা বলল,“আচ্ছা চল, আমিও কিনি।”

অরিশা আর নাদিয়া আবার একটা দোকানে ঢুকল। অন্তরের হঠাৎ মনে পড়ল পাশের দোকানে টুম্পা একটা রজনীগন্ধার তোড়া কিনতে গিয়েও রেখে দিয়েছে হাতে বেশি ফুল হয়ে গেছে বলে। অন্তর দ্রুত পাশের দোকানের দিকে পা বাড়াল। তাহসিন পিছু ডেকে প্রশ্ন করল,“ওই অন্তু, তুই আবার কই যাস?”

অন্তর না তাকিয়েই উত্তর দিলো,“আসছি।”

একটা রজনীগন্ধার তোড়া কিনে হাসিমুখে অন্তর ফিরে এল সবার কাছে। নাদিয়া ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,“ওয়াও! রজনীগন্ধার তোড়াটা খুব সুন্দর অন্তু!”

অন্তর হেসে তোড়াটা টুম্পার দিকে এগিয়ে ধরে বলল,“এই নে।”

সবাই অন্তরের কান্ড দেখে মুখ টিপে হাসল। টুম্পা কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল,“এটা দিয়ে আমি কী করব?”

“একটু আগেই তো এটা কিনতে গিয়েও রেখে দিলি। তাই নিয়ে এলাম, নে।”

অন্তরের কথায় টুম্পা বিরক্ত হয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,“এই ফুল আমি পছন্দ করি না।”

“তাহলে যে তখন কিনতে লাগলি?”

“হ্যাঁ, ভালো লাগে না বলেই রেখে দিয়েছি।”

উপস্থিত সবাই বেশ বুঝতে পারল টুম্পা মিথ্যা কথা বলছে। আসলে সে অন্তরের দেয়া ফুল নিতে চাইছে না। অন্তর তবু বারকয়েক নিতে বলল। এমনকি বন্ধুরা সবাই বললেও টুম্পা নিতে নারাজ। সে কিছুতেই এই তোড়া নিবে না। অন্তর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত দৃষ্টিতে টুম্পার দিকে তাকাল। তারপর হাতের মুঠোয় থাকা রজনীগন্ধার তোড়াটা রাস্তার মাঝখানে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে তোড়াটা একটা রিকশার চাকায় পিষ্ট হয়ে গেল। মুহূর্তে সবার মুখ চুপসে গেল। সবাই অবাক চোখে অন্তরের দিকে তাকাল। বেশ বুঝতে পারল অন্তর রেগে গেছে। টুম্পাও ওর দিকে আড়চোখে তাকাল। অন্তর স্বাভাবিকভাবেই সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,“হা করে তাকিয়ে থাকার কিছু হয়নি। যার জন্য কিনেছিলাম সে নিবে না, তাই ফেলে দিলাম। এসব আমার কোনো কাজে লাগবে না। তোরা কি আরো ঘুরবি, না-কি রেস্টুরেন্টে যাবি? মাত্র নয় মিনিট পর আজান হবে। বারোটা একান্ন বেজে গেছে।”

মুনার চোখ দুটো বড়ো হয়ে গেল। দ্রুত ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল সত্যিই একটা বাজতে মাত্র নয় মিনিট বাকি। মুনা তাড়াহুড়ো করে বলল,“হায় হায়! আমাকে তো একটার মধ্যে রেস্টুরেন্টে পৌঁছাতে হবে। একদম ভুলে বসে ছিলাম।”

তাহসিন বলল,“তাই তো। একটা রিকশা নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যা।”

মুনা একটা রিকশা ডেকে উঠে পড়ল। তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। মুনা চলে যাওয়ার পর ডালিয়া টুম্পাকে বলল,“এটা ঠিক করলি না টুম্পা। ফুলের তোড়াটা তো অন্তু খুশি মনে নিয়ে এসেছিল তোর জন্য। দেখ, তাহসিনও তো আমাকে এতগুলো ফুল দিয়েছে। আমি কি ফিরিয়ে দিয়েছি? ফুলের সাথে রাগ দেখিয়ে কী লাভ?”

টুম্পা কোনো কথা বলল না। সবাই মিলে আবার ফুটপাত ধরে হাঁটা শুরু করল রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে।


মাঝপথে এসেই মুনা প্রচন্ড জ্যামে আটকে পড়ল। টানা কয়েক মিনিট জ্যামে আটকে থেকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিশ মিনিট কেটে গেল। ফাস্টফুড এন্ড চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে রিকশা থামিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল। ভাড়া মিটিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে পা বাড়াল। সে খেয়াল করল রেস্টুরেন্টের সামনে এসেই তার হৃদস্পন্দন দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। গলাটাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এখন একটু পানি খাওয়া দরকার। রেস্টুরেন্টে ঢুকে এগোতে-এগোতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু অফ-হোয়াইট কালার শার্ট পরা কাউকেই চোখে পড়ল না। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠল,“বিশ মিনিট লেট।”

মুনা দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে তার মুখটা চুপসে গেল। অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবল,“এই লোক এখানে কী করছে? লোকটার কি খেয়েদেয়ে আর কোনো কাজ নেই? সারাক্ষণ হাত-পা ধুয়ে আমার পেছনেই পড়েছে। এই রেস্টুরেন্টেই আসতে হলো? কেন রে? ঢাকা শহরে কি আর কোনো রেস্টুরেন্ট নেই? আজই কেন এখানে আসতে হলো? আর বিশ মিনিট লেট কথাটা কি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল? মনে তো হচ্ছে আমাকেই বলছে। আমার দিকেই তো তাকিয়ে আছে। এমনভাবে বলছে যেন সে আমারই অপেক্ষায় বসে ছিল। কিন্তু ইনি কেন আমার জন্য অপেক্ষা করতে যাবে? ও আল্লাহ্! এই পাজি লোক এখানে থাকলে আমি দিহানের সাথে কথা বলব কীভাবে? কী না কী ভেবে বসে থাকে কে জানে? এখন যদি আবার আমার হাসি নিয়ে কথা উঠায়? ও আল্লাহ্ দড়ি ফেলো, আমি ওপরে উঠি। অন্তর ঠিকই বলে। এই লোকের জন্য আফু ষাঁড় নামটাই পারফেক্ট।”

সামনে দাঁড়ানো লোকটা মুনার মুখের সামনে তুড়ি বাজাতেই মুনা চমকে উঠল। অপ্রস্তুত ভাবে সে আমতা-আমতা করে বলল,“আসসালামু আলাইকুম স্যার।”

আফসার স্যার গম্ভীর মুখে বললেন,“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কত মিনিট লেট করেছ?”

মুনা বুঝতে না পেরে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করল। স্যার প্রশ্ন করলেন,“এদিক-ওদিক কী দেখছো?”

“কিছু না। আপনি লাঞ্চ করতে এসেছেন স্যার?”

“মিট করতে এসেছি।”

“যার সাথে মিট করতে এসেছেন সে আসেনি এখনও?”

“এসেছে। টানা বিশ মিনিট আমাকে অপেক্ষা করিয়ে তারপর এসেছে।”

মুনা মনে মনে ভাবল তার সাথে মিলে গেছে। দিহানও হয়তো এমনটাই বলবে। কিন্তু ছেলেটা আছে কোথায়? অফ-হোয়াইট শার্ট পরা কেউই তো নেই এখানে। স্যার বললেন,“দাঁড়িয়েই কথা বলবে? চলো ওখানে বসি।”

মুনার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এ কাকে দেখছে সে? তার সাথে এত মিষ্টি করে কথা বলছে আফসার স্যার! আবার একসাথে বসে কথাও বলতে চাইছে। এটা স্বপ্ন নয় তো? কিন্তু এখন দিহানকে আগে খুঁজে বের করতে হবে। কালকে যে নাম্বার থেকে কল করেছিল সেই নাম্বারে একবার কল করতে হবে। কিন্তু তার আগে এই স্যারের সামনে থেকে সরতে হবে। মুনা নিজেকে সামলে স্বাভাবিক ভাবে বলল,“না না স্যার। আপনি বসুন, আমি এখনই চলে যাব।”

স্যার গম্ভীরভাবেই বললেন,“এসেছ কি চলে যাওয়ার জন্য? চলো।”

কথাটা বলেই আফসার স্যার পাশের একটা খালি টেবিল দখল করে বসে পড়লেন। মুনা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। স্যার আবার ডাকতেই মুনা অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগিয়ে গিয়ে স্যারের বিপরীত পাশে বসল। স্যার প্রশ্ন করল,“জ্যামে পড়েছিলে?”

মুনার চোখ শুধু দিহানকেই খুঁজে চলেছে। সে অন্য দিকে তাকিয়েই উপর নিচে মাথা দোলালো। মুনার সন্ধানী দৃষ্টির দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে স্যার প্রশ্ন করে বসলেন,“দিহানকে খুঁজছো?”

মুনার এবার আরও অবাক হওয়ার পালা। স্যার দিহানের কথা জানল কীভাবে? দিহানের সাথে কি তার কোনো সম্পর্ক আছে? হয়তো আছে। সেজন্যই হয়তো দিহান স্যারের কাছে বলেছে তাদের মিট করার কথা। মুনা অবাক হয়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল স্যারের দিকে। স্যার আবার প্রশ্ন করলেন,“কী? দিহানকে খুঁজছো তো?”

মুনা এবার দ্রুত উপর নিচে মাথা দোলালো। স্যার মুচকি হাসলেন। মুনা সেই হাসির অর্থ বুঝতে পারল না। সে আমতা-আমতা করে বলল,“স্যার, আপনি জানলেন কীভাবে?”

স্যার সোজাসুজি উত্তর দিলেন,“আমি সবই জানি।”

মুনা এবার নিশ্চিত হলো স্যারের সাথে দিহানের অবশ্যই কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে। এমনও হতে পারে দিহান স্যারকে সাথে নিয়েই এসেছে। হয়তো একা মিট করতে অস্বস্তি বোধ করেছে। মুনা গলাটা হালকা ঝাড়া দিয়ে অপ্রস্তুত ভাবে বলল,“দিহানকে দেখছি না যে? ওনার তো একটার মধ্যে এখানে থাকার কথা।”

স্যার হেসে উত্তর দিলেন,“সামনেই তো আছে।”

মুনা ভাবল দিহান এখানেই আছে। সে আবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগল। তাকে আশেপাশে দৃষ্টি বিচরণ করতে দেখে স্যার বললেন,“এদিক-ওদিক তাকাচ্ছ কেন? সোজা হয়ে বসে সামনে তাকাও।”

মুনা স্যারের কথায় সোজা হয়ে বসে সরাসরি সামনে তাকাতেই স্যারের চোখে চোখ পড়ে গেল। স্যার স্থির দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মুনা খানিক বিব্রত বোধ করে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। কিন্তু পরক্ষণেই কপাল হালকা কুঁচকে কিছু একটা ভেবে আবার তাকাল। কিন্তু এবার মুখের দিকে না, শরীরের দিকে তাকাল। মুহুর্তে মুনার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অফ-হোয়াইট কালার শার্ট! হ্যাঁ, স্যারের গায়ে অফ-হোয়াইট কালার শার্ট!। পুরো রেস্টুরেন্টে শুধু স্যারের গায়েই অফ-হোয়াইট কালার শার্ট। এর মানে কী? দিহানের সাথে কি স্যারও একরকম শার্ট পরে এসেছে? মুনাকে নিজের শার্টের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্যার ঠোঁট এলিয়ে হেসে বললেন,“পছন্দ হয়েছে? তাহলে বিয়ের পর সবসময় এই কালারের শার্টই পরব।”

মুনা চমকে উঠে চোখ দুটো বড়ো করে স্যারের দিকে তাকাল। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই স্যার আবার একইভাবে বললেন,“ভেবেছিলাম শার্ট দেখে তুমি চিনতে পারবে। কিন্তু তুমি তো এখনও চিনতে পারোনি। কাঙ্ক্ষিত মানুষ সামনে বসিয়ে রেখে এদিক-ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছ।”

কথাটা শুনেই যেন মুনা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ল। তার ঠোঁট দুটো আপনা-আপনি একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেল। গলাটা তো আগে থেকেই শুকনো মরুভূমি হয়ে ছিল। এখন তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য মুনা চোখের পলক ফেলা তো দূর, নড়াচড়া করতেও ভুলে গেল। তার নিজের কাছে মনে হলো সে কোমায় চলে গেছে। হঠাৎ তার মুখ ফসকে শুধু একটা শব্দ বের হলো,“আ-প-নি……….?”

স্যার দুহাত বুকে গুঁজে সোজা হয়ে আরাম করে বসলেন। তারপর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ঝুলিয়ে মুনার চোখে চোখ রেখেই বললেন,“আফসার চৌধুরী দিহান।”

চলবে……………………..🌸

(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here