#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ১৬
বিকেলের শেষভাগ। একটু পরেই চারদিক কালো করে আবছা অন্ধকার নামবে। সূর্যাস্তের শেষভাগে আকাশে লালচে রঙের আভা ছড়িয়ে পড়েছে। হালকা ঝিরঝিরে বাতাসে গাছের পাতাগুলো মৃদু দুলছে। শীতকাল হওয়ার দরুন এটুকু বাতাসেই বেশ ঠান্ডা বোধ হচ্ছে। বেলকনির একপাশে চেয়ারের উপর দুপা তুলে কোলের উপর বই নিয়ে বসে আছে এরেন। গায়ে পাতলা একটা টি-শার্ট থাকায় শীত শীত লাগছে। শীতের কাপড় পড়তে হলে রুমে যেতে হবে। কিন্তু এখন এখান থেকে ওঠার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। দারুণ অলসতা এসে ভর করেছে। তার থেকে বড়ো কথা, প্রকৃতিটা দারুণ লাগছে। এরেন বইয়ের পাতা থেকে চোখ উঠিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশের রক্তিম আভা দেখে সর্বপ্রথম যেটা মাথায় এল সেটা হচ্ছে গোলাপ। ইলোরার থেকে নিয়ে আসা গোলাপটা সে সযত্নে কাবার্ডের জামাকাপড়ের ভাঁজের মধ্যে তুলে রেখেছে। মেয়েটার লাজে রাঙা মুখটা বারবার মনে পড়ছে। এরেন ভাবল মাঝে মাঝে যদি এভাবে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে যায়, আর মেয়েটা এভাবেই লাজে রাঙা হয় তবে মন্দ হয় না। এক অছিলায় তার লজ্জাবতী রূপটা দেখা হবে। মেয়েদের লজ্জা মিশ্রিত মুখটা একটু বেশিই সুন্দর মনে হয়। এরেন মুচকি হাসল। ঐ মুহুর্তে জারিন এসে পাশে দাঁড়িয়ে গলা ঝাড়া দিয়ে গানের সুর তুলল,“এহেম এহেম। প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে…….।”
এরেন জারিনকে থামিয়ে নাকমুখ কুঁচকে বলল,“থাম বইন, থাম। ভাগ্যিস এইখানে কোনো কুত্তা নাই। থাকলে নিশ্চিত তোর গান শুইনা নাচানাচি শুরু কইরা দিত।”
জারিন হি হি করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল,“বেশ হতো। ভাবছি তোর বিয়েতে আমি গান গেয়ে কুকুর নাচাব। ব্যাপারটা ইউনিক হবে না? মানুষের মুখে মুখে রটিয়ে পড়বে, ভাইয়ের বিয়েতে তার একমাত্র বোনের গানের তালে তালে কুকুরের নৃত্য। আহা!”
কথাটা বলেই জারিন আবার হাসতে শুরু করল। এরেনও হেসে উঠল। ভাই বোনের হাসির শব্দ দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। দুজন মিলে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করে তারপর শান্ত হলো। জারিন বলল,“আজ তোর মনটা বেশ ফুরফুরে। ভাবির মুখে জাদু আছে বৈকি!”
এরেন মুচকি হাসল। জারিন আবার বলল,“তোর কী মনে হয়? ভাবি তোদের সম্পর্কটা নিয়ে কতটা ভাবে?”
“আই থিংক ও পজিটিভ চিন্তাভাবনা করে। মানে, আমার সাথে ওর ভাবনার মিল আছে।”
“কীভাবে বুঝলি?”
“ঐ যে তুই একটা গান গাস না, কী যেন?”
এরেন একটু ভেবে তারপর সুর না তুলেই বলল,“চোখ যে মনের কথা বলে।”
জারিন হেসে বলল,“বাব্বাহ্! এত তাড়াতাড়ি বউয়ের চোখ পড়তেও শিখে গেছিস?”
“শিখেছি, তবে একটু সময় লেগেছে। এতদিন বুঝতে পারিনি, আজ যেন হঠাৎ করেই বুঝে গেছি।”
“তোর ধারণা যদি ভুল হয়?”
এরেন দৃঢ়ভাবে বলল,“হবে না।”
“বাহ্! তাহলে তো এবার ওর সাথে এই ব্যাপারে কথা বলাই যায়।”
“বলব। আরেকটু সময় নিক ও। আশা করি আস্তে আস্তে ওর অস্বস্তি কমে যাবে। তখন বলব।”
“ওকে, তোর যা ইচ্ছা। আমি একদিন সময় করে যাব ওর সাথে দেখা করতে। তখন এই ব্যাপারে কথা বলব।”
“বলিস।”
জারিন ঘুরে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়াল। এরেন পিছু ডেকে প্রশ্ন করল,“চলে যাচ্ছিস?”
জারিন কোনো উত্তর না দিয়ে রুমে চলে গেল। প্রায় সাথে সাথেই আবার একটা চাদর হাতে ফিরে এল। চাদরটা এরেনের গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল,“শীতের মধ্যে এভাবে বসে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
এরেন গায়ের চাদরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ঠিক একই সময়ে অপর প্রান্তে বসে একজন তরুণী বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটার কথা ভেবে ভেবে চোখ দুটো বন্ধ করে মুচকি হাসছিল। চোখ বন্ধ অবস্থায় কাঙ্ক্ষিত মানুষটার মুখটা কল্পনা করছিল। ভাবনার মাঝে কখন যে মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এল টেরই পেল না। হুঁশ ফিরল বোনের মৃদু ধাক্কায়। চোখ মেলে তাকাতেই মিথিলা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,“মাগরিবের আজানের সময় এমন মরার মতো পড়ে আছো কেন?”
ইলোরা হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসে বলল,“আজান হচ্ছে? খেয়ালই ছিল না।”
মিথিলা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“আজকাল তোমার কিছুতেই খেয়াল থাকে না। প্রেমে-টেমে পড়লে না-কি?”
ইলোরা মিথিলার মাথায় চাটি মেরে বলল,“পাকামি করতে এসেছিস? ফাজিল মেয়ে!”
মিথিলা হঠাৎ কিছুটা আস্তে আস্তে প্রশ্ন করল,“এই আপ্পি, ডালিয়া আপ্পিকে এতগুলো গোলাপ কে দিয়েছে?”
ইলোরা ভ্রু কুঁচকাল। তারপর সহজভাবে বলল,“আমরা সবাই-ই তো আজ কত ফুল কিনেছি। তোর কেন মনে হলো ওকে অন্য কেউ কিনে দিয়েছে?”
“আমি গোলাপগুলো থেকে কয়েকটা গোলাপ চেয়েছিলাম। তখন ডালিয়া আপ্পি কী বলল জানো?”
“কী?”
“বলল বাকি সব ফুল চাইলেও দিয়ে দিবে, শুধু গোলাপ ছাড়া।”
“অ্যাঁ!”
মিথিলা চিন্তিত কন্ঠে বলল,“হ্যাঁ। আমি শিওর ওই গোলাপগুলো আপ্পি নিজে কেনেনি। নিশ্চয়ই স্পেশাল কেউ দিয়েছে। কে হতে পারে? তাহসিন ভাইয়া?”
মিথিলার অভিজ্ঞর মতো কথা শুনে ইলোরা হেসে বলল,“বড়োদের মতো এত কথা বলিস কেন? শুনলে মনে হয় সব বিষয়ে তোর খুব ভালো অভিজ্ঞতা আছে।”
মিথিলা বেশ বিরক্ত হলো বোনের কথায়। চোখেমুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,“উঠে পড়ো। নামাজ পড়বে না?”
•
সন্ধ্যা সাতটা। অন্ধকার রুমে গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে আছে মুনা। চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে আছে। দুপুর পর্যন্তও সে বন্ধুদের সাথে বেশ হাসিখুশি সময় কাটিয়েছে। তারপর থেকে শুরু হলো একের পর এক অঘটন। এজন্যই মা বলে বেশি হাসলে কপালে দুঃখ আছে। একে তো রেস্টুরেন্টে যমের সাথে দমবন্ধ হওয়া সময় কাটিয়েছে তার ওপর আবার বিকেলের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ভাবতেই মুনার চোখের পাতা বারবার ভিজে যাচ্ছে।
বিকেলে,
খাওয়া-দাওয়া শেষে একরকম জোর করেই আফসার স্যার মুনাকে বাড়ির গেইট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। তারমধ্যে সে বারকয়েক জিজ্ঞেসও করেছে মুনার কিছু বলার আছে কি না। কিন্তু মুনা তার বাবার উপর আস্বস্ত হয়ে বলে দিয়েছে তার কিছু বলার নেই। বাড়ি এসে মুনা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কলিং বেল বাজাতেই মা দরজা খুলে দিলো। বসার ঘরে পা রাখতেই এক নিমেষে মুনার সব স্বস্তি ফুটো বেলুনের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বসার ঘরে আফসার স্যারের বাবা, মা,বড়ো ভাই আর ভাবির সাথে মুনার বাবা হাসিমুখে গল্প করছেন। মুনা তা দেখে হা করে তাকিয়ে রইল। সে যেন কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলেছে। মুনার মা নাহিদা আহমেদ তাকে খোঁচা মেরে ফিসফিস করে বলল,“সালাম দে।”
মুনা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,“আসসালামু আলাইকুম।”
মুনাকে দেখে সবাই বেশ খুশি হলো। সালামের জবাব দিয়ে আফসার স্যারের মা সোফা ছেড়ে উঠে মুনার দিকে এগিয়ে এলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন,“কেমন আছো মামনি?”
মুনা জোরপূর্বক হেসে বলল,“ভালো আছি। আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। আমাদের দেখে অবাক হয়ে গেছো, তাই না?”
মুনা কোনো উত্তর দিলো না। তার তো শুধু অবাক হওয়ার পালা। সামনে দাঁড়ানো মহিলা আবার হেসে বললেন,“বাইরে থেকে এসেছো, খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। যাও আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
মহিলার কথা বলার ধরণ দেখে মুনার বেশ পছন্দ হলো মহিলাকে। এত মিষ্টি একজন মহিলার ছেলে এত তেতো কী করে হলো ভেবে পেল না সে। মুনার বাবা মাহবুব শিকদার বলে উঠলেন,“যা মা। ফ্রেশ হয়ে আয়।”
মুনা মাথা দুলিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। রুমে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ল। মাথার মধ্যে নতুন প্রশ্নের উদ্রেক হলো,“এই জনগণ হঠাৎ এখানে এসেছে কেন?” এত চিন্তা একসাথে আর ভালো লাগছে না মুনার। সে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বিছানায় পড়ে রইল। কিছুক্ষণ পর নাহিদা আহমেদ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। এসেই অবাক কন্ঠে বললেন,“এই শীতকালেও তোর এত স্পীডে ফ্যান ছাড়া লাগে! আর এভাবে শুয়ে আছিস কেন? তোকে না বললাম ফ্রেশ হতে?”
মুনা চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলল,“ডেকো না তো মা। ভালো লাগছে না। ঘুমাতে হবে কিছুক্ষণ।”
নাহিদা আহমেদের বিস্ময় যেন আরেক ধাপ বেড়ে গেল। তিনি বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন,“এ আবার কেমন কথা? শ্বশুরবাড়ির মানুষ এসেছে আর তুই ঘুমাবি?”
মুনা চোখ মেলে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে অবাক কন্ঠে বলল,“আমার বিয়ে হলো কবে?”
নাহিদা আহমেদ বিরক্ত হয়ে মুনার হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বসালেন। তারপর কড়া গলায় বললেন,“ফাজলামি করবি না। তাড়াতাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।”
মুনা অবাক হয়ে বলল,“আজব! ফাজলামি কখন করলাম? তুমি বললে বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম। আরেকটা কথা, শেষমেষ স্যারের সাথে তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করলে?”
“হ্যাঁ, তো?”
“মা, তোমরা কি পাগল হয়েছ? স্যারের সাথে বিয়ে! ভাবলেই তো আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে।”
“এক থাপ্পড় মারব। এসব কী কথা? স্যার হলে কী? ছেলেটার বয়স তো তেমন বেশি না। এ বছরই শিক্ষকতা শুরু করেছে।”
“তবুও তো সে আমার স্যার। তোমরা আমাকে আগে একথা কেন বলনি?”
“তোর বাবাই তো বলল দেখা করলেই সব জানতে পারবি। আমি কী করব? যা জিজ্ঞেস করার তোর বাবাকে করিস। আমার কাজ আছে।”
মুনার চোখ চলে গেল নাহিদা আহমেদের হাতের দিকে। দেখল তার হাতে গোলাপি রঙের একটা জামদানি শাড়ি, পেটিকোট আর ব্লাউজ। মুনা অবাক কন্ঠে বলল,“এগুলো নিয়ে ঘুরছো কেন?”
নাহিদা আহমেদ হাতের শাড়িটা মুনার সামনে রেখে বলল,“ফ্রেশ হয়ে এটা পড়ে নে। আর একটু সাজগোজ কর।”
মুনা ত্যাড়াভাবে বলল,“প্রশ্নই ওঠে না। এই শাড়ি-ফাড়ি আমি পড়তে পারব না এখন।”
“পড়বি না কেন? ওনারা সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছেন।”
“কেন?”
“বিয়ের ডেট ফিক্সড করার জন্য।”
মুনা চমকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে বলল,“কিহ্! আজই কেন?”
নাহিদা আহমেদ স্বাভাবিকভাবেই বললেন,“ওনারা চাইছেন বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। আজ সকালে হঠাৎ করেই ফোন করে বললেন ওনারা আজই বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে চান। তোর বাবাও আপত্তি করেনি। এত ভালো ছেলে ঝুলিয়ে রাখা ঠিক না।”
মুনা বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। আজই বিয়ের ডেট ফিক্সড হবে মানে কী? সে তো এই বিয়ে করতেই চায় না। মুনা শক্ত গলায় বলল,“এসবের মানে কী মা? হুট করে এভাবে বিয়ের ডেট ফিক্সড করবে কেন? এত তাড়া কিসের? আমাকে তো একবার জানালেও না।”
নাহিদা আহমেদ বললেন,“তোকে জানানোর সুযোগ পেলাম কোথায়? ওনারা হঠাৎ করে জানিয়েছেন। কাউকে আসতে বলার সুযোগটুকুও পাইনি। তাই সব রান্নাবান্না আমাকে একাই করতে হয়েছে। তাছাড়া এনগেজমেন্ট যখন হয়ে গেছে তখন আর তোকে জানিয়ে কী হবে? ডেটটাই তো ফিক্সড হবে, বিয়ে তো আর হয়ে যাচ্ছে না। আর কথা বাড়াস না তো, দেরি হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। দিহানও এসে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে।”
মুনা অবাক হয়ে বলল,“উনি যখন এখানে আসবেনই তাহলে আমাকে গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন কেন?”
“আরে তোর মতো ও নিজেও জানত না। ওর বাবা-মা ওকে না জানিয়েই এসেছে। ভেবেছিল এখানে এসে দিহানকে ফোন করে বলবে তোকে নিয়ে সোজা চলে আসতে। কিন্তু তোরা যে এত তাড়াতাড়ি ফিরবি এটা কে জানত? দিহানকে ওর মা ফোন করেছে। ও বেশিদূর যেতে পারেনি, এখনই চলে আসবে। যা রেডি হ।”
কথাগুলো বলে নাহিদা আহমেদ দরজার দিকে পা বাড়াতেই মুনা পিছু ডেকে বলল,“মা, বাবাকে একটু আসতে বলবে?”
নাহিদা আহমেদ দাঁড়িয়ে পড়লেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে মুনার দিকে তাকিয়ে বললেন,“মেহমানদের সাথে কথা বলছে দেখলি তো। কেন? কোনো প্রয়োজন?”
“বাবার সাথে একটু কথা বলার দরকার ছিল। খুব ইম্পর্ট্যান্ট। প্লিজ একটু বলো না শুনে যেতে।”
“মেহমান চলে গেলে তারপর বলিস। এখন ডাকতে পারব না।”
“আমার এখনই বলা প্রয়োজন। ডেকে দাও না।”
“কেন? তোর কি কোনো ব্যস্ততা আছে? শুধু শুধু দেরি করিস না তো। সব কথা পরে হবে। এখন তাড়াতাড়ি কর। সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
নাহিদা আহমেদ দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। মুনার এবার রাগ উঠে গেল মায়ের উপর। ডেট ফিক্সড হওয়ার পর বাবার সাথে কথা বলে আর কী হবে? বাবার সাথে এখনই কথা বলা দরকার। নইলে এই বিয়েটা ভাঙা সম্ভব হবে না। কিন্তু মা তো ডাকবেই না বাবাকে। তাহলে এখন উপায়? ধুর! এই পাজি স্যার যেমন, তার ফ্যামিলির লোকজনও তেমন। সবার মাঝে জিলাপির প্যাঁচ! আজই বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে শুনি? তা-ও আবার ছেলেকেও জানায়নি। কী অদ্ভুত মানুষ রে বাবা! বিয়েটা কি করতেই হবে তাকে? বাবার সাথে কথা বলতে না পারলে তো ডেট ফিক্সড হয়ে যাবে। আর ডেট ফিক্সড হয়ে যাওয়া মানে বিয়ে হবেই হবে। মুনার মাথায় কোনো বুদ্ধিই আসছে না। এবার তার কান্না পেয়ে গেল। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ার উপক্রম ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ নাহিদা আহমেদ আবার কোত্থেকে এসে যেন দরজায় দাঁড়ালেন। মুনা মাকে দেখেই দ্রুত চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু মুছে ফেলল। নাহিদা আহমেদ দরজায় দাঁড়িয়েই মুনার দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বললেন,“দিহান খুব ভালো ছেলে। তোর বাবা ওকে অনেক পছন্দ করেছে। ছেলেটা তোর জন্য পারফেক্ট। এমন ছেলে খুঁজে পাওয়া সহজ কথা না। বিয়ের পর তুই খুব সুখী হবি দেখিস। তোর বাবা কিন্তু এই বিয়েটা নিয়ে খুব খুশি। তাই কোনোকিছু নিয়ে মন খারাপ করিস না। তোর বাবা যা করে তোর ভালোর কথা চিন্তা করেই করে।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে নাহিদা আহমেদ যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে গেলেন। মুনা স্তব্ধ হয়ে গেল। ধপ করে বিছানায় বসে দুহাতে মাথা চেপে ধরল। এই বিয়েটা নিয়ে বাবা অনেক খুশি। কথাটা ভেবে তার সব চিন্তা ভাবনা ওলট-পালট হয়ে গেল। বাবার উপর কি তার রাগ করা উচিত? তার বাবা তো তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। নাহ্, এমন বাবার উপর রাগ করা যায় না। ছোটোবেলা থেকে বাবা তার সব আবদার পূরণ করেছেন। মুনা একমাত্র মেয়ে হওয়ায় মাত্রাতিরিক্ত ভালোবেসেছেন। মেয়ের এমন কোনো চাওয়া নেই যা সে পূরণ করেননি। আজ পর্যন্ত একটা ধমক দিয়েও কথা বলেননি। বলতে গেলে মেয়েকে মাথায় তুলে রেখেছেন। সবসময় মেয়েকে কী করে খুশি রাখা যায় সেটাই ভেবেছেন। আর আজ যখন সেই বাবা একটু খুশি হয়েছেন তখন তার এই খুশিটুকু কেড়ে নিতে মুনার বিবেকে বাঁধল। মুনা তখনই সিদ্ধান্ত নিল বাবার খুশির জন্যই সে এই বিয়েটা করবে। বাকি সব পরে ভাবা যাবে। মুনা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে তারপর ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শাড়ি পড়ল। তারপর চুলগুলো বেঁধে হালকা সাজগোজ করল। সম্পূর্ণ রেডি হয়ে সে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগল। মনে মনে বলল,“বাবা, তোমার মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্তটা না হয় তোমার খুশির উপর ভিত্তি করেই নেয়া হোক। তুমি খুশি মানে তোমার রাজকন্যাও খুশি। বাকি সব চুলোয় যাক!”
একটু পরেই নাহিদা আহমেদ রুমে এলেন। মুনাকে সম্পূর্ণ রেডি দেখে সে মুচকি হেসে মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিলেন। তারপর মাথায় আঁচল টেনে দিয়ে মুনাকে নিয়ে বসার ঘরে চলে গেলেন। বসার ঘরে আসতেই মুনার চোখ চলে গেল সোফার কোণে বসে থাকা আফসার স্যারের উপর। লোকটাকে দেখেই কেন জানি মুনার রাগ উঠে গেল। সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আফসার স্যারের মা আফরোজা বেগম হাসিমুখে মুনার হাত ধরে নিয়ে ছেলের পাশে বসিয়ে দিলেন। মুনার চোখ দুটো বড়ো হয়ে গেল। এই মহিলা এই পাজি লোকটার পাশে কেন বসাল? মুনা শুকনো একটা ঢোক গিলে স্যারের থেকে কিছুটা সরে বসল। মুনা বেশ বুঝতে পারল স্যার তার দিকে একবারও তাকায়নি। যাক, ভালোই হয়েছে। তাকালেই অস্বস্তি বাড়বে। আফসার স্যারের মা মুনার রূপের বেশ প্রশংসা করলেন। বড়োরা একের পর এক কথা বলেই চলেছে আর মুনা স্ট্যাচু হয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ বিভিন্ন কথাবার্তা বলার পর বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হলো জানুয়ারির দশ তারিখে। টানা বিশ মিনিট স্ট্যাচুর মতো বসে থেকে তারপর মুনা ছাড়া পেল। ছাড় পেয়েই সে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। মেহমান চলে যাওয়ার পর তার মা এসে কয়েকবার ডাকার পরও সে দরজা খোলেনি। মাথা ব্যথার অজুহাত দেখিয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রয়েছে।
চলবে………………..….🌸