সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-১৮

0
747

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ১৮

শীতের সকালের মিষ্টি রোদের আলোক ছটা জানালা দিয়ে এসে মুখে পড়তেই ঘুম ছুটে গেল ইলোরার। পিটপিট করে চোখ খুলে দেখল মিথিলা জানালা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। ইলোরা আড়মোড়া ভেঙে গায়ে কম্বল পেঁচিয়ে উঠে বসে ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,“শুক্রবারেও একটু শান্তিতে ঘুমাতে দিবি না?”

মিথিলা বলল,“কয়টা বাজে খবর আছে তোমার?”

ইলোরা হাই তুলতে তুলতে বলল,“কয়টা?”

মিথিলা জানালার পাশ থেকে সরে এসে বলল,“দশটা ছয় বাজে। তাড়াতাড়ি ওঠো, ভাই ডাকছে তোমাকে।”

“কেন?”

“জানি না। আমাকে বলল তোমাকে ডাকতে।”

“ওহ্।”

ইলোরা গা থেকে কম্বল সরাতেই দেখল পাশে ডালিয়া বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ইলোরা ভ্রু কুঁচকে বলল,“ডালিয়া এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় কবে থেকে?”

মিথিলা বলল,“আপ্পির না-কি শরীর ভালো লাগছে না আজকে। সেজন্যই ঘুমাচ্ছে।”

ইলোরা ডালিয়ার কপালে আর গলায় হাত রেখে চিন্তিত কন্ঠে বলল,“ওর তো মনে হয় জ্বর আসছে।”

মিথিলা বলল,“এটা তো বলল না। আচ্ছা আমি গিয়ে আম্মুকে বলছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো।”

মিথিলা এক ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ইলোরা বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল মালিহা বেগম চিন্তিত মুখে ডালিয়ার কপালে হাত রেখে জ্বর পরীক্ষা করছেন। পাশেই মিথিলা আর সাকিব দাঁড়িয়ে আছে। মালিহা বেগম সাকিবকে বললেন,“সাকিব, যা গিয়ে ডাক্তার নিয়ে আয়। এখনও জ্বর তেমন বাড়েনি, তবে আস্তে আস্তে আরও বাড়বে।”

সাকিব মায়ের কথায় সায় দিয়ে তখনই ডাক্তার আনতে গেল। পনেরো মিনিটের মধ্যে সে ডাক্তার নিয়ে উপস্থিত হলো। ততক্ষণে ডালিয়ার ঘুম ভেঙে গেছে। ডাক্তার এসে ডালিয়ার শরীরের তাপমাত্রা মেপে বললেন,“জ্বর তেমন বেশি না। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করলে আর ঔষধ খেলে তাড়াতাড়ি সেরে যাবে।”

ডাক্তার কিছু ঔষধের নাম লিখে প্রেসক্রিপশনটা সাকিবের হাতে দিলেন। সাকিব তখনই আবার ডাক্তারের সাথেই বেরিয়ে গেল ঔষধ আনতে। ঔষধ এনে দেখল মালিহা বেগম ডালিয়াকে খাবার খাওয়াচ্ছেন। সাকিব দেখিয়ে দিলো কোন কোন ঔষধ খাওয়াতে হবে। খাবার শেষ করে ডালিয়াকে ঔষধ খাইয়ে মালিহা বেগম নিজের কাজে চলে গেলেন। সাকিব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,“খাবার খেয়ে রেডি হয়ে নে। আমরা বেরোব।”

ইলোরা প্রশ্ন করল,“কোথায় যাব?”

“আজ রনির ভাই-ভাবির ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। বাসায় ছোটোখাটো করে শুধু নিজেদের মানুষ নিয়ে আয়োজন করবে। রনি বলল তোদেরকে সাথে নিয়ে যেতে। আমি না নিলে ও ই নিতে চলে আসবে।”

মিথিলা বলল,“সেলিব্রেশন কখন হবে?”

“রাতে।”

“তাহলে এখন যাব কেন?”

“আমাদের সবাইকে আগে যেতে বলেছে। আমি বলেছিলাম সন্ধ্যায় যাওয়ার কথা। কিন্তু রনি বলল তোরা দুপুরের লাঞ্চও আমার বাসায় এসে করবি।”

ইলোরা গোমড়া মুখে বলল,“কিন্তু ডালিয়া তো অসুস্থ।”

সাকিব বলল,“আরে সমস্যা নেই। ঔষধ খেয়েছে তো, জ্বর সেরে যাবে। এমনিতেও তো বাসায় শুয়ে বসে থাকবে। ঐ বাসায় গিয়ে সবার মাঝে থাকলে মন ভালো থাকবে।”

ডালিয়া বলল,“না ভাই। তোমরা যাও, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।”

মিথিলা বলল,“কেন আপ্পি? তোমাকে একা রেখে আমরা যাব কীভাবে?”

ডালিয়া বলল,“একা কোথায়? ফুপি আছে না?”

ইলোরা গম্ভীর মুখে বলল,“তুই না গেলে আমিও যাব না।”

সাকিব ডালিয়াকে বলল,“ইচ্ছে না করলেও চল। তোদের রেখে গেলে পরে দেখবি রনি নিজে এসে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবে।”

ডালিয়া বলল,“প্লিজ ভাই, জোর কোরো না। আমার শরীর একটুও ভালো লাগছে না। অন্যের বাসায় গিয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে তা কেমন দেখাবে বলো? তোমরা যাও।”

ডালিয়াকে অনেক বুঝিয়েও রাজি করানো গেল না। শেষমেষ সাকিব ইলোরা আর মিথিলাকে বলল,“ওকে আর জোর করার দরকার নেই। তোরা খাওয়া-দাওয়া করে রেডি হ।”

কথাটা বলে সাকিব চলে গেল। ইলোরা আর মিথিলা গাল ফুলিয়ে সকালের নাস্তা সেরে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গেল। রেডি হওয়ার পর সাকিব ওদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সিএনজি ডেকে ওদেরকে নিয়ে রনির বাসার দিকে রওনা দিলো। টানা বিশ মিনিট লাগল সেখানে পৌঁছাতে। সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে বাসার সামনে গিয়ে কলিং বেল চাপতেই রনির ভাবি এসে দরজা খুলে দিলো। রনির ভাবি মিষ্টি হেসে ওদের সাথে কুশল বিনিময় করে ভেতরে নিয়ে গেল। এর আগে রনির ভাই-ভাবির বিয়েতে ইলোরা আর মিথিলা সাকিবের সাথে এসেছিল। তাই তারা দুজনই এ বাসার মানুষদের মোটামুটি চেনে। বসার ঘরে ঢুকতেই ইলোরা চমকে উঠল। বড়ো বড়ো চোখ করে সোফার দিকে তাকিয়ে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সামনের সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে এরেন ফোনের মধ্যে ডুবে আছে। সাকিবের ডাকে সে চোখ তুলে তাকাল। ইলোরার দিকে একনজর তাকিয়ে সাকিবের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রনি ভেতর থেকে এসে ইলোরাদের দেখে বেশ খুশি হলো। পাশের সোফায় ওদের বসতে বলল। ইলোরা আর মিথিলা পাশের সোফায় বসল আর সাকিব এরেনের পাশে। এরেন মিথিলাকে দেখে বলল,“ও কি তোর ছোটো বোন?”

সাকিব বলল,“হ্যাঁ।”

এরেন মুচকি হেসে মিথিলাকে বলল,“ছোটো আপু, কেমন আছো?”

মিথিলাও মুচকি হেসে উত্তর দিলো,“ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”

“ভালো। তোমার নাম?”

“মিথিলা।”

“আমাকে চেনো?”

“আপনার নাম শুনেছি। কিন্তু সামনা-সামনি আজই প্রথম দেখলাম।”

এরেন হেসে বলল,“তোমাকেও আমি আজই প্রথম দেখলাম। কোন ক্লাসে পড়ো?”

“ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার।”

“তাহলে তো তুমি একদম পিচ্চি।”

মিথিলা মুচকি হাসল। সাকিব হেসে বলল,“বয়সে পিচ্চি হলেও এনাকে একদম পিচ্চি ভাবিস না। কথায় কিন্তু ইনি বুড়ো মানুষকেও হার মানায়।”

এরেন শব্দ করে হেসে উঠল। রনি ইলোরাকে বলল,“ডালিয়া এল না?”

ইলোরা মন খারাপ করে বলল,“না ভাইয়া। ওর জ্বর এসেছে। আমরা অনেক জোরাজুরি করেছি তবু আসতে রাজি হলো না।”

রনির বড়ো ভাবি তুশি ট্রে ভর্তি খাবার নিয়ে এসে সামনে রেখে সবাইকে খেতে বলল। ইলোরা আর মিথিলা খেতে আপত্তি জানাল কারণ তারা এখানে আসার পূর্বেই খাওয়া-দাওয়া করেছে। তুশি জোর করতে নিতেই সাকিব মানা করল। এরেন, রনি আর সাকিব মিলেই খাওয়া ধরল। এরমধ্যে রনির মা এসে সবার সাথে দেখা করে গেলেন। মিথিলা ইলোরার ফোন নিয়ে গেমস খেলায় মনোযোগ দিলো। ইলোরা আড়চোখে এরেনের দিকে তাকাল। লোকটা দিব্যি হেসে হেসে গল্প করছে আর খেয়ে চলেছে। ইলোরা জানত এরেন সহজে কোথাও যায় না। সাকিব বা রনি কারোর বাসায়ই তাকে নেওয়া যায় না। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে সে কারো বাসায় যেতে পছন্দ করে না। কিন্তু আজ তো হলো তার উলটো। আজ কী মনে করে এল এই বাসায় এটা ভেবেই ইলোরা খানিক অবাক হলো। এরেন গল্প আর খাওয়ায় মগ্ন। ইলোরার দিকে তাকাচ্ছেও না। সম্ভবত সাকিব আর রনি সামনে বলেই সে তাকাচ্ছে না। এমন ভাব করছে যেন পাশের সোফায় বসা মেয়েটাকে সে নামেমাত্র চেনে। অথচ অন্যসময় হলে হা করে তাকিয়ে থাকতেও দ্বিধা বোধ করে না। খাবার শেষ করতেই রনির ভাবি তুশি রনিকে বলল কিছু জিনিস কিনতে বাজারে যেতে। রনি সাকিব আর এরেনকেও তার সাথে যাওয়ার জন্য বলল। সাকিব রাজি হলেও এরেন যেতে নারাজ। এরেনকে জোর না করে সাকিব আর রনি চলে গেল। এরেন আর মিথিলা দুজনেই গেমসের মধ্যে ডুবে আছে। ইলোরা একা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এরেনের এমন অপরিচিতর মতো হাবভাব দেখে ইলোরা অবাক না হয়ে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ পর আবার তুশি এসে উপস্থিত। তাকে দেখে ইলোরা বেশ খুশি হলো। ভাবল তার সাথে একটু কথা বলা যাবে। অথচ তার ভাবনায় এক বালতি জল ঢেলে দিয়ে তুশি মিথিলাকে প্রশ্ন করল,“এই যে পিচ্চি, শাড়ি পরতে হেল্প করতে পারবে আমাকে?”

মিথিলা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“পারব।”

“একটু এসো না প্লিজ।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিথিলা গেমস ফেলে রেখে তুশির পেছন পেছন হাঁটা ধরল। এরেন গেমস খেলতে খেলতে তুশিকে পিছু ডেকে বলল,“ভাবি, ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি কোনদিকে?”

তুশি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বলল,“ঐদিকে।”

এরেন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বলল,“থ্যাংকস।”

এরেন ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে আবার কী মনে করে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর হঠাৎ ইলোরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“ছাদে যাবে?”

ইলোরা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এরেন যে তাকেও ছাদে যাওয়ার জন্য বলবে তা সে ভাবতে পারেনি। এরেনের সাথে একা ছাদে যাওয়া মানে যেচে অস্বস্তি বাড়ানো। তাই ইলোরা না বলার জন্য মুখ খোলার আগেই তুশি বলে উঠল,“যাও। বসে থাকতে থাকতে বিরক্তি এসে যাবে। তার চেয়ে ভালো একটু হাঁটাহাঁটি করো। তা না হলে আমাদের সাথে এসো।”

এরেন ইলোরার উত্তরের আশা না করে ছাদের দিকে চলে গেল। তুশি মিথিলাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। ইলোরা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তুশির রুমের দিকে পা বাড়াল। আবার কী ভেবে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছাদের দিকে চলল। এক পা দু’পা করে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে এসে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। ছাদটা মাঝারি আকারের হলেও বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছে সাজানো। কয়েকটা গাছে ফুল ফুটেছে আর কয়েকটায় মাত্র কুঁড়ি এসেছে। ছাদের এক পাশে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এরেন সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইলোরা তার থেকে কয়েক হাত পেছনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত বোধ করতে লাগল। একবার ভাবল এরেনের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। আবার ভাবল শুধু শুধু অস্বস্তিতে পড়ে কী লাভ? তার থেকে নিচে থাকাই ভালো। কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে ইলোরা নিচে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে এক পা বাড়াতেই এরেন বলে উঠল,“এসেই যখন পড়েছ তখন আর ফিরে যাওয়ার কী দরকার?”

ইলোরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল এরেন এখনও সামনের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে তার উপস্থিতি টের পেল কীভাবে? ইলোরা এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থেকে হাত কচলাতে শুরু করল। এরেন আবার বলল,“এখানে এসো।”

অস্বস্তি লাগলেও ইলোরা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে এরেনের থেকে প্রায় তিন হাত দূরে সরে দাঁড়াল। কিন্তু সরাসরি এরেনের দিকে তাকাল না। এরেন ঘাড় ঘুরিয়ে ইলোরার দিকে তাকিয়ে বলল,“কেমন আছো?”

ইলোরা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এতক্ষণ পর এটা জিজ্ঞেস করার সময় হলো? ইলোরা সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,“ভালো আছি। আপনি?”

এরেন উত্তর দিলো না। উলটো প্রশ্ন করল,“অস্বস্তি লাগছে?”

এই প্রশ্নের কী উত্তর দিবে ইলোরা? সে তো এরেনকে দেখলেই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ইলোরা কোনো উত্তর না দিয়ে মাথাটা হালকা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এরেন তার উত্তরের আশায় মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ইলোরাকে চুপ দেখে সে মুচকি হেসে বলল,“আমি তো তোমার সামনে একটুও অস্বস্তিতে পড়ি না, তাহলে তুমি কেন পড়ো?”

ইলোরা এবারও কোনো উত্তর দিলো না। এরেন ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“দেখো, প্রায় তিন মাস হতে চলল আমাদের এক্সিডেন্টলি বিয়ের। তোমার সাথে যে আবার আমার দেখা হবে এটা আমি ভাবিইনি। যখন দেখা হলো তখন প্রথম প্রথম আমিও তোমার মতো অস্বস্তিতে পড়েছিলাম। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই সেটা কাটিয়ে উঠেছি। কিন্তু তুমি এখনও পারোনি। আই থিংক তুমি চেষ্টাই করোনি। ভার্সিটিতে যখন যেতেই হবে তখন আমার সাথে তোমার প্রতিদিন দেখা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার জন্য তোমার এই অস্বস্তিটা দেখতে ভালো লাগে না আমার। তাই বলছি, প্লিজ তুমি এভাবে অস্বস্তিতে পড়ো না। এটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করো। চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবে। কী, পারবে না?”

ইলোরা প্রশ্ন করল,“কীভাবে?”

“আমার সাথে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো। এটাই সবচেয়ে ভালো উপায়। এই যে তুমি সবসময় আমাকে দেখলেই এড়িয়ে যাও, কোনো প্রশ্ন করলে মুখ তালাবদ্ধ করে রাখো, আমার সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকো। এসব আর কখনও করবে না। এসব না করলেই দেখবে আস্তে আস্তে অস্বস্তি পুরোপুরি কেটে যাবে। বুঝেছো?”

ইলোরা উপর নিচে মাথা দোলালো। এরেনের কথাগুলো শুনতে বেশ লাগছে। এত সুন্দর করে বুঝিয়ে কম মানুষই কথা বলতে পারে। এরেন কী সুন্দর নিসঙ্কোচে কথা বলছে! ইলোরার মনে হলো এই লোকটা সারাক্ষণ কানের কাছে বকবক করলেও তার বিরক্তি আসবে না। বরং আরও শুনতে ইচ্ছে করবে। এরেন ভ্রুকুটি করে ইলোরাকে নিরীক্ষণ করে বলল,“কচু বুঝেছো। এখনও তো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকাও।”

ইলোরা সোজা হয়ে দাঁড়ালেও এরেনের দিকে তাকাল না। সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। এরেন ঠোঁট টিপে হাসল। তারপর সিরিয়াস ভাবে প্রশ্ন করল,“পারবে অস্বস্তি কাটাতে?”

ইলোরা আবার উপর নিচে মাথা দোলালো। এরেন বলল,“এভাবে বললে বিশ্বাস করব না। মুখে বলো।”

ইলোরা এবার মৃদু কন্ঠে বলল,“পারব।”

“সত্যি তো?”

“হুম।”

“আর যদি না পারো? আমার তো মনে হয় না তুমি পারবে।”

ইলোরা এবার দৃঢ় কন্ঠে বলল,“পারব।”

“ওকে, দেখা যাক। এখন থেকেই তাহলে প্রাকটিস শুরু করে দাও।”

ইলোরা এবার প্রশ্নভরা এলোমেলো দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকাল। এরেন হেসে বলল,“আরে এখন তো আমি তোমার সামনেই আছি। আর তুমি অস্বস্তির কারণে আমার সাথে ঠিকমতো কথাই বলছো না। এমন বাচালের মতো একা একা কথা বলতে কতক্ষণ ভালো লাগে বলো? সেজন্যই বলছি এখন থেকেই অস্বস্তি কাটানোর প্রাকটিস করো। মানে স্বাভাবিকভাবে কথা বলো আমার সাথে।”

ইলোরা এবার পড়ল বিপাকে। এরেনের সাথে বলার মতো কোনো কথাই তার মথায় আসছে না। কী কথা বলবে তা-ই খুঁজে পাচ্ছে না সে। এরেন ইলোরাকে লক্ষ্য করে হেসে বলল,“বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছ না?”

ইলোরা অবাক হয়ে গেল। এরেন বুঝল কীভাবে? এরেন আবার বলল,“অবাক হতে হবে না। তোমার মুখের এক্সপ্রেশন দেখেই বুঝে গেছি। যাক, তোমাকে ভাবার সময় দিলাম। ভেবে দেখো কোনো কথা খুঁজে পাও কি না। আমি তো অনেক কথাই বললাম। এবার তোমার পালা।”

ইলোরা ভাবতে লাগল কী বলা যায়। এরেন ইলোরার থেকে চোখ সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাল। ইলোরা কিছুক্ষণ ভেবে হঠাৎ বলে উঠল,“আমি তো জানতাম আপনি কারো বাসায় যেতে পছন্দ করেন না। তাহলে………….।”

ইলোরার কথার মাঝেই এরেন বলে উঠল,“আজ এই বাসায় কেন এলাম, তাই তো?”

ইলোরা ছোটো একটা শব্দ করল,“হুঁ।”

এরেন অন্যদিকে তাকিয়েই বলল,“কেন এসেছি তা ঠিক বলতে পারব না। মন বলল আজ এখানে আসতেই হবে, তাই এসেছি। মন অবশ্য কোনো বিশেষ কারণেই বলেছে। সে জানত যে আজ এখানে বিশেষ কারো সাথে দেখা হবে, কথাও হবে।”

ইলোরা বিস্মিত চোখে এরেনের দিকে তাকিয়ে রইল। বারবার মনে হলো এরেন তার কথা বুঝাতে চাইছে। কারো বাসায় যাওয়া অপছন্দ সত্ত্বেও তার জন্যই আজ এখানে এসেছে। এরেন ইলোরার দিকে না তাকিয়েই হঠাৎ বলে উঠল,“এবার ঠিক আছে। মাথা নিচু করে না থেকে এভাবেই তাকিয়ে থাকবে।”

ইলোরা ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এরেনের থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। এরেন এভাবে তাকে লজ্জায় ফেলে দিলো ভেবে ভুল করেও আর তার দিকে তাকাল না। এরেন মুচকি হাসছে। ইলোরা পুরো ছাদে চোখ বুলাতে লাগল। ফুল গাছগুলো তার খুব পছন্দ হয়েছে। এরেন প্রশ্ন করল,“ফুল গাছ ভালোবাসো?”

ইলোরা উত্তর দিলো,“হুম।”

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর হঠাৎ এরেন আবৃত্তি করতে লাগল,
“শুনছো লজ্জাবতী?
তোমার ঐ লাজে রাঙা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে
আমি হাজার জনম পার করতে চাই।
দেবে কি এই আকুলিত প্রণয়ীকে সেই সুযোগটুকু?”

ইলোরা এবার ভীষণ রকম চমকে উঠল। এরেনের মাধুর্য মেশানো আবৃত্তিটুকু ইলোরার কাছে একটু বেশিই মাধুর্যময় মনে হলো। কিন্তু আবৃত্তির প্রতিটা শব্দ ইলোরার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিলো। কেন জানি মনে হচ্ছে এরেনের আবৃত্তির প্রত্যেকটা শব্দ তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা। ইলোরা জিব দিয়ে তার শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করতে লাগল। এরেন সরু চোখে ইলোরার দিকে তাকিয়ে বলল,“হঠাৎ করে লাইনগুলো মনের কোণে উঁকি দিলো, তাই বলে ফেললাম। আবৃত্তি ভালো হয়নি?”

ইলোরা অপ্রস্তুত হেসে বলল,“ভালো হয়েছে।”

“যাক, তাহলে আমার ইনিয়ে-বিনিয়ে করা আবৃত্তি সার্থক হলো।”

ইলোরা মুচকি হাসল। আবারও দুজন নীরব। এরেন হঠাৎ কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বলল,“আমার মনে হয় আমাদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা দরকার।”

ইলোরা এরেনের কথার মানে বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল,“কী নিয়ে?”

“সম্পর্কটা নিয়ে।”

এরেনের কথাটা কর্ণগোচর হতেই ইলোরার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। বুকের ভেতর ধক করে উঠল। সেও তো চায় তাদের সম্পর্কটা নিয়ে সিরিয়াসলি আলোচনা করতে। কিন্তু এরেন কী বলবে এটা ভেবেই ইলোরার গলা শুকিয়ে গেল। যদি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে? ইলোরা শুকনো ঢোক গিলে এরেনের দিকে তাকাল। এরেন আবার কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে মিথিলা বলে উঠল,“আপ্পি, ভাই এসেছে। তোমাদের নিচে ডাকছে।”

ইলোরা আর এরেন একসঙ্গে পেছন ফিরে তাকাল‌। ইলোরা মিথিলাকে বলল,“চল।”

ইলোরা মিথিলার পেছন পেছন হাঁটা ধরল। সিঁড়িতে পা রাখতে গিয়েও হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকাল‌। সঙ্গে সঙ্গে এরেনের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। এরেন শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইলোরা চোখ সরিয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে চলে গেল। ইলোরার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে এরেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেও সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।

চলবে…………………🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here