সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-২৮

0
671

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ২৮

ঘড়ির কাঁটা চলমান হলেও সময় যেন আজ থমকে গেছে। বন্ধুত্বের বন্ধনের আটটা সুতার মধ্যে একটা সুতা আজ ছিঁড়ে গেছে। বন্ধনটা হয়তো একই রকম থেকে যাবে, কিন্তু এটাকে আলগা করার জন্য ওই একটা ছেঁড়া সুতাই যথেষ্ট। অন্তরের প্রাণহীন দেহটার সামনে অনবরত চিৎকার করে কেঁদে চলেছে তার সাতজন প্রাণপ্রিয় বন্ধু। পাশেই তার মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। অন্তরের মায়ের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে তার বৌদি। আর তার বড়ো ভাই থম মেরে বসে আছে। অদূরেই মলিন মুখে আফসার, সাকিব, এরেন আর রনি দাঁড়িয়ে। তারা কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না কারো কান্না থামাতে। কারণ এ কান্না যে এখন থামবার নয়, তা তারা ভালোভাবেই জানে। ওদের আটকানোর থেকে কিছুক্ষণ কাঁদতে দেওয়াই শ্রেয়। অন্তরকে হাসপাতাল নেওয়ার আগেই সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছে। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে তার বিচরণ এটুকুই লিখেছিলেন। ঘড়ির কাঁটা চারটা দুই এর দাগে পৌঁছেছে। অন্তরদের বাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে লোকজনে। সুইসাইড কেস বলে এরমধ্যে পুলিশও এসেছিল। এরেন আর আফসার মিলে কোনোমতে তাদের সামলে নিয়েছে। তেমন কোনো সমস্যা হয়নি কারণ অন্তর ছোট একটা কাগজে লিখে রেখে গেছে তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। পৃথিবীর প্রতি সে বিরক্ত, বিধায় স্ব-ইচ্ছায় বিদায় নিয়েছে। চোখের সামনে অন্তরের শেষকৃত্য দেখে ইলোরা, মুনা আর নাদিয়া জ্ঞান হারালো। অরিশা, ডালিয়া আর টুম্পা অসুস্থ হয়ে পড়ল। তাহসিন পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েগুলো তো কাঁদতে-কাঁদতে জ্ঞানও হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সে যে ছেলে। তার কষ্ট তো বুকের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখতে হবে। অন্তরের শেষকৃত্য সম্পন্ন হতে-হতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আফসার মুনাকে জোর করে বাড়ি নিয়ে গেছে। সাকিবও ডালিয়া আর ইলোরাকে নিয়ে গেছে। দুজনকে এই অবস্থায় একা নিয়ে যাওয়া অসম্ভব বলে তার সাথে রনি আর এরেনও গেছে। তাহসিন নিজেকে সামলে বাড়ি ফেরার আগে টুম্পার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু বলে গেল,‘আজকের পর থেকে ভুল করেও আর কোনোদিন আমার সামনে আসিস না।’ টুম্পা শুধু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছে এর উত্তরে। নাদিয়া, অরিশা আর টুম্পাকেও তাদের বাড়ির লোক এসে নিয়ে গেছে। বাড়ি ফিরেও কেউ শান্তি পেল না। টুম্পা বাড়ি ফেরার পথেই জ্ঞান হারিয়েছে। আজ সারাদিন ধরে সবাই অভুক্ত। পরিবারের লোকজন অনেক জোরাজুরি করে কারো মুখে খাবার তুলে দিয়েছে। আবার কেউ রাতেও অভুক্তই রয়ে গেছে। ইলোরা আর ডালিয়াকে ঘিরে সবাই বসার ঘরে বসে আছে। একেকজন একেক কথা বলে বুঝানোর চেষ্টা করছে। এমন একটা ঘটনায় সারাদিনে কারোর গোসল করাও হয়ে ওঠেনি। এরেন আর রনিকে বসিয়ে রেখে সাকিব গেল গোসল করতে। মালিহা বেগম ইলোরা আর ডালিয়াকে জোরপূর্বক কিছুটা খাবার খাওয়ানোর পর গেলেন বাকি সবার ডিনারের ব্যবস্থা করতে। সাজিদ হোসেন আর মিথিলা মিলে ইলোরা আর ডালিয়াকে রুমে নিয়ে গেল। এরেন আর রনি রয়ে গেল বসার ঘরে। এরেনের হঠাৎ চোখ চলে গেল পাশের সোফায় পড়ে থাকা সাকিবের ফোনের দিকে। কিছু একটা ভেবে সে তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে ফোনটা হাতে নিল। লক খুলে কন্টাক্ট নাম্বার গুলো ঘেঁটে ইলোরার নাম্বার খুঁজে বের করতে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড সময় লাগল। পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে নাম্বারটা দ্রুত তার ফোনে টুকে নিল। তারপর সাকিবের ফোনটা আবার জায়গামতো রেখে সে পুনরায় সোফায় বসে পড়ল। পুরো কান্ডটা রনি হা করে বসে-বসে দেখেছে। এরেন সোফায় এসে বসতেই রনি প্রশ্ন ছুঁড়ল,“কী চুরি করলি?”

এরেন স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,“দরকারি জিনিস।”

“সেটাই তো। জিনিসটা কী?”

“পরে বলব। এখন চুপ থাক।”

“এখন বললে কী সমস্যা? দরকারি জিনিস নিলি, তা-ও আবার সাকিবের ফোন থেকে লুকিয়ে!”

এরেন শক্ত মুখে তাকিয়ে বলল,“তোরে না চুপ থাকতে কইছি? থাব্রা খাবি?”

রনি মেয়েদের মতো মুখ বাঁকিয়ে অন্যদিকে তাকাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাকিব চলে এল। মালিহা বেগম ডাইনিংয়ে খাবার দিয়ে সবাইকে ডাকলেন। সবাই গিয়ে চুপচাপ ডিনার করে নিল। ডিনার শেষ করে রনি আর এরেন নিজেদের বাড়ি চলে গেল।


সকাল আটটা চল্লিশ। বিছানায় দুপায়ের ওপর থুতনি রেখে চুপচাপ বসে আছে মুনা। তার সামনে খাবার হাতে অসহায়ের মতো বসে আছে আফসার। প্রায় দশ মিনিট ধরে সে মুনাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। অথচ মুনা এক কথায় না করে দিয়েছে। আফসার ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে খাবার রেখে মুনাকে কাছে টেনে নিল। আলতো করে মুনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,“এভাবে না খেয়ে থাকলে তো তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে মুন। তখন আমি আম্মাকে সামলাব, না তোমাকে? এমন মুখ করে বসে থেকো না। আমার লাফিং কুইনকে এমন গোমড়া মুখে একদম মানায় না। তোমার এই অবস্থা দেখে আম্মাও মন খারাপ করে বসে আছে। প্লিজ নিজেকে সামলাও। সবাই তো চিরকাল বেঁচে থাকে না। একদিন না একদিন সবাইকেই যেতে হবে।”

আদুরে স্পর্শ পেয়ে মুনা ডুকরে কেঁদে উঠল। কিছুক্ষণ কেঁদেকেটে তারপর হেঁচকি তুলে বলল,“জানেন, অন্তু সবসময় কী বলতো? বলতো, মুলা রে, তোর কপালে যেই বেচারা আছে তার কপাল ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। গতকাল যখন ওর সাথে শেষবার কথা হয়েছে, তখনও এই কথাই বলেছে। আবার বলেছে তোকে আর স্যারকে খুব মানায়। তোরা খুব সুখী কাপল হবি। পারলে এ বছরেই আমাকে মামা বানিয়ে ফেলিস। শেষ সময়েও ও আমার সাথে সবসময়কার মতোই মজার ছলে কথা বলেছে।”

আফসার শান্ত স্বরে বলল,“ও খুব মিশুক ছেলে ছিল। আমার সাথে কত তাড়াতাড়ি মিশে গিয়েছিল। হঠাৎ
করে এমনটা করে বসল ভাবতেই পারছি না। আচ্ছা, ওর সুইসাইডের কারণ কী এক্সাক্টলি?”

“আমরা কেউই বুঝতে পারছি না। তাহসিন জানে, কিন্তু ও বলেছে পরে বলবে।”

“যাইহোক, আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার দরকার নেই। তোমার রেস্ট দরকার। আমাকে যেতে হবে। খেয়ে নাও প্লিজ।”

মুনা কোনো উত্তর দিলো না। আফসার মুনাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে কিছুটা খাবার খাওয়ালো। তারপর রেডি হলো ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য। মুনা একইভাবে বিছানায় বসে আছে। আফসার এগিয়ে গিয়ে মুচকি হেসে মুনার কপালে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল,“কাঁন্নাকাটি কোরো না আর। আম্মার কাছে গিয়ে গল্প করো, মন হালকা হবে। আসছি।”

আজ আর কেউই ভার্সিটিতে গেল না। একবার সবাই গ্রুপ কলে কথা বলেছে। তাও একজনের শূন্যতায় কান্না ছাড়া আর কোনো কথাই মুখে আসেনি। টুম্পার ফোন বন্ধ। ফোন করে তার খবর নিতে ব্যর্থ হলো সবাই। সবার সারাটা দিন কাটলো মন খারাপ আর চোখের কোণের পানি মুছে। রাতে ইলোরা একা বেলকনির দেয়াল ঘেঁষে বসে ছিল। ডালিয়া আর মিথিলা রুমে নেই। হয়তো টিভি দেখছে। ইলোরা লক্ষ্যভ্রষ্টা দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। ফোনের রিংটোনের শব্দে হুঁশ ফিরল। পাশে থাকা ফোনটার দিকে তাকিয়ে দেখল আননোন নাম্বার। তাই রিসিভ করতে ইচ্ছে করল না। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য টানে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে ফোনটা হাতে তুলল। রিসিভ করে কানে ধরে মৃদু কন্ঠে সালাম দিলো। ওপাশ থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এল,“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছো এখন?”

ইলোরা উত্তর দিলো,“ভালো।”

ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠের উত্তর,“মিথ্যে বলছো কেন?”

ইলোরা কিছুটা অবাক হলো। পরিচিত কেউ ফোন করেছে এটা বেশ বুঝতে পারছে সে। কিন্তু কে ফোন করেছে তা বুঝতে পারল না। ইলোরা পাল্টা প্রশ্ন করল,“কে আপনি?”

ওপাশ থেকে উত্তর এল,“তিনদিন আগে যে তোমার মন খারাপের কারণ হয়েছিল, সে।”

ইলোরা মুখ খুলতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে চুপ হয়ে গেল। তিনদিন আগে মন খারাপের কারণ হয়েছিল, মানে এরেন? কিন্তু এরেন তার নাম্বার পাবে কোথায়? আর সে তাকে ফোন করবেই বা কেন? কিছুক্ষণ দুদিকেই নিস্তব্ধতা। তারপর ফোনের ওপাশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের স্পষ্ট শব্দ ভেসে এল। ইলোরা কিছুটা নড়েচড়ে বসল। এই দীর্ঘশ্বাসের শব্দই তাকে জানান দিচ্ছে ওপাশের মানুষটার পরিচয়। তবু ইলোরা কিছু বলতে পারল না। এরেন কিছুটা নরম কন্ঠে বলল,“তোমার সাথে ঠান্ডা মাথায় কিছু আলোচনা করা দরকার। কিন্তু এখন তোমার মন ঠিক নেই। তাই ওসব আলোচনা পরে করব। আগে তোমার মন ঠিক হোক। আজ শুধু একটা কথা জেনে রাখো। তুমি আমাকে ভুল বুঝে নিজেই কষ্ট পেয়েছ।”

ইলোরা বুঝার চেষ্টা করে বলল,“মানে?”

“লাইব্রেরিতে সেদিন যে মেয়েটার সাথে আমাকে কথা বলতে দেখেছিলে, ও আমার মামাতো বোন বুশরা। আমার সমবয়সী। ইভেন ও আমার সাথে এক ভার্সিটিতেই পড়াশোনা করেছে। অনার্স শেষ করে ও রাজশাহী গিয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। ওখানে থেকেই পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঢাকা এসে মামা-মামির সাথে দেখা করে যায়। ওর বয়ফ্রেন্ড রাজশাহীতে জব করে। এখনও ওদের রিলেশনের কথা কেউ জানে না। মাস্টার্স শেষ করে ও বাসায় জানাবে। একমাত্র আমার সাথেই ও এই কথা শেয়ার করেছে। আমরা দুজন দুজনের সাথে খুব ফ্রি। সবসময় সবকিছু নিয়ে মজা করি। সেদিনও আমরা মজা করছিলাম। কিন্তু খেয়াল ছিল না যে তুমি এটাকে সিরিয়াসভাবে নিবে। তোমাকে জানানোর কোনো ওয়ে ছিল না। ভার্সিটিতে দেখা হলেও কথা বলার তো কোনো সুযোগই নেই। আর তোমার নাম্বারও ছিল না যে ফোন করে জানাব। শুধু শুধু তিনটা দিন আমাকে ভুল বুঝে কষ্ট পেলে।”

ইলোরা মন দিয়ে কথাগুলো শুনল। তিনটা দিন ভুল ধারণা নিয়ে সে মনে মনে ঠিকই কষ্ট পেয়েছ। এখন মনে হচ্ছে খুব বোকামি করে ফেলেছে সে। সেদিন আরেকটু সময় থেকে মেয়েটার আর এরেনের কথা শুনলেই হয়তো বুঝে যেত। নিজের বোকামির জন্য এখন তার আফসোস হচ্ছে। আবার এত খারাপ লাগার মধ্যেও এটা শুনে ভালো লাগছে যে তার ধারণা ভুল। তার মানে এরেন তাকে ছাড়তে চায় না। ইলোরার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে এরেন হঠাৎ আদুরে গলায় প্রশ্ন করল,“খুব কষ্ট দিয়েছি?”

ইলোরার বুকটা ধক করে উঠল। সে পড়ল বিপাকে। এই প্রশ্নের উত্তর সে কীভাবে দিবে? তবু কোনমতে বলল,“আমি কেন কষ্ট পাব?”

এরেন মৃদু শব্দ করে হাসল। হাসিমুখেই বলল,“আচ্ছা? কষ্ট পাওনি? তাহলে সেদিনের পর দুদিন ভার্সিটিতে যাওনি কেন?”

ইলোরা আমতা-আমতা করে বলল,“আমি তো অসুস্থ ছিলাম।”

“ওসব তো মিথ্যে ছিল। তুমি না বললেও আমি জানি সেটা। গতকাল তোমার মুখ দেখেই মনের খবর পেয়ে গেছি আমি।”

ইলোরা ভেংচি কাটলো। মুখ দেখেই মনের খবর পেয়ে যায়। ঘোড়ার ডিম পায়। এতই যদি মুখ দেখে মনে কী আছে বুঝতে পারত, তাহলে এটা কেন বোঝে না সে কী চায়? ওপাশ থেকে এরেন আবার বলল,“আশা করি এটা নিয়ে আর ভাববে না। শুধু শুধু তোমার জন্য আমিও এই দুদিন প্যারার মধ্যে ছিলাম। তোমাকে সত্যিটা জানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলাম।”

ইলোরা মনে মনে ভাবল,“ভালো হয়েছে। আমি একাই কেন প্যারা নিব? আপনিও বুঝুন কেমন প্যারা।”

ইলোরা হুট করে প্রশ্ন করল,“আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?”

এরেন স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,“সাকিবের ফোন থেকে।”

“কিহ্!”

ইলোরার চিৎকারে এরেন কান থেকে ফোন নামিয়ে নিল। পরপরই কানে ফোন নিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল,“মাই গড! এত জোরে চিৎকার করছো কেন? আমি বধির হয়ে গেলে তো পরে তোমারই ক্ষতি। সবাই বলবে তোমার জামাই বধির। কী একটা অবস্থা হবে!”

ইলোরা ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল। একে তো এমন ষাঁড়ের মতো চিৎকার দিয়ে উঠেছে, তারপর আবার এরেন নিজেকে তার জামাই দাবি করছে। সে মৃদু কন্ঠে বলল,“সরি।”

এরেন বলল,“তোমার ভাইয়ের থেকে তোমার নাম্বার চাইব কোন আক্কেলে? আজ যখন তোমার বাসায় ছিলাম, তখন সাকিব সোফায় ফোন রেখে শাওয়ার নিতে গিয়েছিল। সেই সুযোগেই ওর ফোন থেকে তোমার নাম্বার নিয়ে নিয়েছি।”

ইলোরা ছোটো একটা শব্দ করল,“ওহ্।”

তারপর দুজনেই চুপচাপ কয়েক মিনিট কাটাল। রাতের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে দুজন দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনল। তারপর নীরবতা ভেঙে এরেন প্রশ্ন করল,“কিছু খেয়েছ?”

“উঁহু।”

“কেন?”

“এমনি।”

“মন খারাপ?”

ইলোরা উত্তর দিলো না। এরেন ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“এভাবে মন খারাপ করে থেকো না। অন্তরের যতদিন আয়ু ছিল ততদিনই বেঁচে ছিল। সবার আয়ুই শেষ হবে। কাল অন্তর চলে গেছে, আজ অন্য কেউ চলে যাবে, পরশু হয়তো আমিও চলে যেতে পারি। যাওয়া-আসার ধারাবাহিকতা চলতেই থাকবে।”

ইলোরার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। কান্নারা গলা ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। বাঁ হাতে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। এরেন তার প্রেয়সীর কান্নার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল, কিন্তু বাধা দিলো না। কিছুক্ষণ কাঁদতে দিলো। যদিও এই কান্নার আওয়াজটা এসে তার বুকে তীরের মতো বিঁধছে। তবু বাঁধা দিলো না। কিছু সময় পর এরেন আদুরে কন্ঠে ডাকল,“ইলোনি।”

ইলোরা স্তব্ধ হয়ে গেল। ছেলেটা এভাবে কেন ডাকল? ডাক শুনে যে তার কম্পন ধরে গেছে তা কি বোঝে না? আর এই নাম? ইলোনি! বাহ্, সুন্দর নাম দিয়েছে তো! নতুন নামও দিয়ে দিলো। কখন দিলো? এত আবেগ মিশিয়ে প্রেয়সীকে নতুন নামে ডাকলে তার অনুভূতি কেমন হয়, তা কি সে বোঝে? ইলোরার উত্তরের আশা না করে এরেন একইভাবে বলল,“কখনও তুমি আমার সামনে কেঁদো না ইলোনি। সেটা সহ্য করার ক্ষমতা বোধ হয় নেই আমার। নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক-ফ্যাটাক করে বসতে পারি। আওয়াজটাই তো সহ্য হচ্ছে না, নিজের চোখে দেখলে সহ্য করব কীভাবে?”

ইলোরার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল,“কেন সহ্য করতে পারবেন না আমার কান্না? ভালোবাসেন আমাকে?”
কিন্তু কন্ঠনালি? সে তো এই শব্দগুলো বের হতেই দিবে না। ইলোরার কান্না পুরোপুরি থেমে গেল। এতক্ষণ যা মাঝে মাঝে হেঁচকি তুলছিল, তা-ও থেমে গেল। তখনই মায়ের ডাক পড়ল,“অমি, এদিকে আয় তো মা।”

ইলোরা নিচু স্বরে বলল,“আম্মু ডাকছে।”

এরেনের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ফোন রাখতে ইচ্ছে করল না। তবু সে বলল,“আরেকটু কথা বলা যায় না?”

ইলোরা বুঝল এরেনের আরো কিছু সময় কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ওদিকে মালিহা বেগম ডেকেই চলেছে। ইলোরা বলল,“বারবার ডাকছে।”

এরেন আর কী করবে? ফোন তো রাখতেই হবে। সে বলে উঠল,“আমি যদি তোমাকে মাঝে মাঝে ফোন করি, তুমি রিসিভ করবে?”

ইলোরা দ্বিধায় পড়ে গেল। বলতে ইচ্ছে করল,“হ্যাঁ, করব। এটা আবার জিজ্ঞেস করা লাগে না কি? মাঝে মাঝে কেন? আপনি প্রতিদিন দুবার করে ফোন করবেন। আপনি না আমার হাসবেন্ড?”
কিন্তু মুখে বলতে পারল না। এরেন ইলোরার উত্তরের অপেক্ষায় আছে। ইলোরা চুপ করে আছে বলে আবার প্রশ্ন করল,“হ্যাঁ অথবা না, যেকোনো একটা বলো।”

“হ্যাঁ।”
চোখ-মুখ খিঁচে এই শব্দটা উচ্চারণ করেই ইলোরা তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে জিবে কামড় দিলো। এরেন মুচকি হাসল। এই প্রশ্নের উত্তরে যে মেয়েটা ‘না’ বলতে পারবে না তা সে ভালোভাবেই জানে। ফোন রেখে সে আপন মনে হেসে বিড়বিড় করে বলল,“ভালোবাসি ইলোনি। কবে, কখন, কোন মুহূর্ত থেকে জানি না। কিন্তু খুব ভালোবাসি। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে তোমাকে ছাড়া আমার একদমই চলবে না।”

চলবে…………………….🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here