#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৩৭
ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। সূর্য উঠতে এখনও ঢের বাকি। চারদিকে শুধু পাখিদের কিচিরমিচির ছাড়া কোনো জনমানবের সাড়া শব্দ নেই। ফজরের নামাজ আদায় করে ইলোরা বাড়ির পাশের বাগানটায় ঢুকল। ডালিয়ার লাগানো ফুল গাছগুলোর সবকটায় ফুল ফুটেছে। ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশ ফুলগুলোর সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ইলোরা মুগ্ধ হয়ে ঘুরে ঘুরে ফুলগুলো দেখছে, আবার কোনো কোনোটার ঘ্রাণ নিচ্ছে। একটা ফুল গাছের সামনে দাঁড়িয়ে সে মনোযোগ দিয়ে ফুলগুলো দেখতে লাগল। গাছটা খুব ছোটো আর ফুলগুলোও ছোটো ছোটো। ফুলগুলোর ঘ্রাণ খুব সুন্দর। কিন্তু সে এই ফুলের নামই জানে না। হঠাৎ পেছন থেকে তার কানের কাছে কেউ মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,“সুপ্রভাত মিষ্টি বউটা।”
ইলোরা কিছুটা চমকে ফিরে তাকাল। সামনে হাস্যোজ্জ্বল এরেনকে দেখে অবাক হয়ে বলল,“তুমি! সূর্য আজ কোনদিকে উঠেছে মিস্টার?”
এরেন দুহাতে ইলোরার কোমর জড়িয়ে তাকে কাছে টেনে মুচকি হেসে বলল,“তোমার কী মনে হয়? কোন দিকে উঠেছে?”
ইলোরা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,“আমার তো মনে হয় উত্তর দিকে।”
“তাহলে সেদিকেই উঠেছে।” এরেনের উত্তর শুনে ইলোরা ফিক করে হেসে উঠল। তারপর এরেনের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে তার পাঞ্জাবির বোতাম ঠিক করতে করতে বলল,“নামাজ পড়েছ না-কি?”
“হুম।”
“প্রতিদিন পড়লে কী হয়? জানো তো শুধু পড়ে পড়ে ঘুমাতে।”
“চেষ্টা করব।”
“হুম, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হবে। যখন আমরা একসাথে থাকব তখন যদি এমন পড়ে পড়ে ঘুমাও তাহলে বালতি ভর্তি পানি তোমার গায়ে ঢেলে ঘুম ভাঙাব।”
এরেন মুখটা ছোটো করে বলল,“এটা কোনো কথা? কোথায় ভাবলাম তুমি সকালে শাওয়ার নিয়ে তারপর তোমার ভেজা চুলের পানি আমার মুখে ছিটিয়ে ঘুম ভাঙাবে। অথচ তুমি ভাবছো বালতি ভর্তি পানি গায়ে ঢালার কথা! আনরোমান্টিক বউ আমার।”
ইলোরা হেসে নিজের কোমর থেকে এরেনের হাত সরানোর চেষ্টা করে বলল,“এখন তোমার রোমান্টিকতা থামাও। ছাড়ো নয়তো কেউ দেখে ফেললে ভয়ানক কান্ড ঘটবে।”
এরেন আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,“উঁহু। আমার বউ আমি জড়িয়ে ধরব, তাতে কার কী?”
ইলোরা হতাশ ভঙ্গিতে বলল,“প্লিজ।”
এরেন একটু ভেবে বলল,“ওকে, ছেড়ে দেবো। কিন্তু শর্ত আছে?”
“কী?”
“প্রথম যেদিন আমার কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলে ঠিক সেদিনের মতো আজ আবার একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরো।”
“আমি তো তোমার কাছেই আছি।”
“তাতে হবে না। শর্ত পূরণ করতে হবে।”
ইলোরা গাল ফুলিয়ে এরেনের দিকে তাকিয়ে রইল। এরেন ঠোঁট টিপে হেসে চলেছে। ছোটাছুটি করেও এরেনের হাত থেকে ছুটতে না পেরে ইলোরা দুহাতে এরেনের গলা জড়িয়ে বুকে মুখ গুঁজলো। এরেন হেসে শক্ত করে প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে কানের লতিতে আলতো করে চুমু খেল। ইলোরা বিড়বিড় করে বলল,“অসভ্য।”
এরেন হাসিমুখে বলল,“সারাজীবন এই অসভ্যর অসভ্যতামি সহ্য করতে হবে মিসেস জামান।”
ইলোরা হেসে এরেনের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে গলা ছেড়ে দিয়ে বলল,“ছাড়ো এবার।”
এরেন ইলোরাকে মুক্ত করে দিয়ে বলল,“একটু কাছে এলেই তোমার ছাড়ো ছাড়ো গানে আমি পাগল হয়ে যাই। পুরোপুরি পাগল হয়ে যেদিন কোথাও হারিয়ে যাব সেদিন আমার কাছে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠবে। কিন্তু তখন আর কোথাও আমাকে খুঁজে পাবে না।”
ইলোরার মুখটা চুপসে গেল। এত সুন্দর একটা মুহূর্তে এমন বাজে কথা মুখে না নিলে কী হত? সে উল্টো পথে হাঁটা দিয়ে থমথমে গলায় বলল,“লাগবে না তোমাকে।”
এরেন দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে ইলোরার হাত টেনে ধরল। ইলোরা হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলল,“ছাড়ো।”
এরেন ইলোরার দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হেসে বলল,“এই পাগলী, রাগ করো কেন? তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়ার সাধ্য আমার আছে না-কি? আমি তো সারাজীবন তোমাকে বুকে জড়িয়ে বেঁচে থাকতে চাই।”
ইলোরা গোমড়া মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। এরেন ইলোরার মুখোভাব দেখে মুচকি হেসে বলল,“একটা জিনিস দেখবে?”
ইলোরা এবার প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকাল। এরেন ইলোরার হাত ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করল। তারপর মিনিট খানেক ফোন ঘেঁটে তারপর ইলোরার সামনে ফোনটা ধরল। ইলোরা ফোনের স্ক্রিনে তার নিজের ছবি দেখে অবাক হয়ে এরেনের দিকে তাকাল। কারণ এটা আরও ছয়মাস আগের ছবি। ছয়মাস আগে যেদিন তাদের বিয়ে হয়েছিল সেদিন রাতে ডালিয়া আর সে শাড়ি পরে একসাথে এই বাগানের বড়ো গাছের নিচের বেঞ্চটায় বসে গল্প করছিল। কিন্তু তখনকার ছবি এরেনের ফোনে এল কীভাবে? এই ছবিটা তো সে তোলেনি। এরেন ইলোরার অবাক চেহারা দেখে হেসে বলল,“খুব অবাক হয়েছো তাই না? এটা ছয়মাস আগের ছবি। এই বাগান থেকেই তোলা। মনে পড়ে তুমি আর ডালিয়া শাড়ি পরে ঐ বেঞ্চটায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলে?”
“হ্যাঁ, আমাদের বিয়ের দিন। কিন্তু এই ছবি কে তুলল? তুমি?”
“হুম। সেদিন রাতে রুমে একা একা ভালো লাগছিল না বলে আমি বাইরে বের হয়ে এই বাগানের কাছে এসেছিলাম। তারপর হঠাৎ একটা মেয়েলি হাসির শব্দ কানে যায়। সেদিকে একটু এগিয়ে দেখি আমার সদ্য বিয়ে করা বউ পরী সেজে বসে আছে। সেদিন চাঁদের আলোয় এই পরীটার স্নিগ্ধ মুখটা দেখে আমি কিছু সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। আমার কী হয়েছিল জানি না। কিছু না ভেবেই হঠাৎ ফোন বের করে ক্লিক করে বসেছিলাম। তারপর অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু ছবিটা ফোনে থেকে গিয়েছিল। আমি মাঝে মাঝে এই ছবিটা দেখতাম। আমার মনে হয় এই ছবিটা দেখতে দেখতেই তোমার প্রতি আমার মনে দূর্বলতা তৈরি হয়েছে।”
ইলোরা এক ভ্রু উঁচিয়ে সুর টেনে বলল,“আচ্ছা! প্রথম দিনই তাহলে বউয়ের প্রেমে পড়েছিলে?”
এরেন বলল,“উঁহু, তখন প্রেমে পড়িনি। মায়ায় পড়েছিলাম। তারপর যখন আবার দেখা হয়েছিল তখন আস্তে আস্তে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।”
ইলোরা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,“বুঝলাম। প্রেমে পড়েছো, মায়ায় পড়েছো। ভালোবাসোনি?”
এরেন মৃদু হাসল। ইলোরা মুখ ভেংচি কেটে অভিমানী গলায় বলল,“যাও, লাগবে না তোমার ভালোবাসা।”
এরেন ইলোরার হাত ধরে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বলল,“দেখা যাবে।”
দুজন যখন বাড়িতে ঢুকল তখন পূর্ব আকাশে সূর্যের তীব্র আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। বাড়িতে ঢোকার আগে এরেন ইলোরার হাত ছেড়ে দিলো। ওরা বসার ঘরে ঢুকে দেখল সেখানে সাকিব, রনি, তাহসিন, মিথিলা, অরিশা আর নাদিয়া বসে আছে। রনি ওদের দুজনকে একসাথে দেখেই সরু চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“ তোরা কোথায় গিয়েছিলি?”
এরেন গিয়ে সাকিবের পাশে বসতে বসতে বলল,“বাইরে, ঘুরে দেখছিলাম একটু। ইলোরাও বাইরে ছিল তাই একসাথে ফিরলাম।”
ইলোরা চুপচাপ ওপরে চলে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেকোরেশনের লোকেরা চলে এল। সাকিব আর ডালিয়ার চাচাতো ভাই নাঈম মিলে তাদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলো কোথায় কীভাবে সাজাতে হবে। মালিহা বেগম সকালের নাস্তার জন্য সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন। তার ডাকে একে একে সবাই এসে খেতে বসল। ডেকোরেশনের লোকজন তাদের কাজে লেগে পড়েছে। তারা একটানা দুপুর পর্যন্ত কাজ করল। তারপর এ বাড়িতেই দুপুরের খাবার খেল। বিকেলের মধ্যেই আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল। ডেকোরেশনের কাজ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি দেখে সাকিব, এরেন আর রনিও কাজে লেগে পড়ল। রাতের খাবারের জন্য বাবুর্চি আনা হয়েছে। তারা এসে রান্না শুরু করে দিয়েছে। হলুদের স্টেজ করা হয়েছে ছাদে। ছাদটা খোলামেলা বলে সাকিবই ছাদে হলুদের অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যার পরপরই। এরেন আর সাকিব ছাদের ডেকোরেশন চেক করছিল। মাগরিবের কিছুক্ষণ আগে এরেন সাকিবকে বলল,“ওই সাকু, আমি নিচে যাচ্ছি। তুই আয়।”
সাকিব বলল,“আচ্ছা যা।”
এরেন দোতলার সিঁড়ি অবধি নামতেই সামনে পড়ল ইলোরা। ইলোরা তাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,“এত ঘেমেছো কীভাবে তুমি?”
এরেন বলল,“ছাদে ছিলাম। ডেকোরেশনের লোকজনের সঙ্গে একটু কাজ করেছি তাই ঘেমে গেছি।”
“ওহ্! যাও এই টি-শার্ট চেঞ্জ করো আর ঘাম মুছে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে।” ইলোরা কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে এরেন তার গায়ের ওড়না টেনে নিয়ে ঘাম মুছতে লাগল। ইলোরা দুহাতে ওড়না টেনে ধরে হন্তদন্ত হয়ে বলল,“আরে আরে কী করছো! কেউ দেখে ফেলবে।”
এরেন ঘাম মোছা শেষ করে ওরনা ছেড়ে দিয়ে বলল,“দেখলে আমার কী? আমারই তো বউ।”
ইলোরা হেসে অন্যদিকে চলে গেল। এরেন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নিতেই দেখল সিঁড়ির গোড়ায় রনি দাঁড়িয়ে সন্দিহান দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরেন তাকে দেখেও না দেখার ভান করে নিচে নেমে এল। রনি ভ্রু নাচিয়ে বলল,“কী মি. এরেন জামান? এখনও বলবেন কোনো কাহিনি নেই?”
এরেন স্বাভাবিকভাবেই বলল,“কোন কাহিনি?”
রনি কোমরে দুহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,“ঢং করার জায়গা পাও না মিয়া? আমি এইমাত্র যা দেখলাম তা কি ভুল?”
“তুই কি অন্ধ?”
“একদম না।”
“তাহলে অবশ্যই ঠিক দেখেছিস।”
“শালা, আমি তো সেটাই বলছি।”
“ইলোরাকে নিজের বোন ভাবিস তো?”
“অবশ্যই।”
“তাহলে আমি তোর শালা, তুই আমার শালা।” কথাটা বলে এরেন রনিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। রনি আহাম্মকের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিড়বিড় করে বলল,“শালা থুক্কু বন্ধু, ডুবে ডুবে জল খাও!”
সন্ধ্যার পরপর একে একে সবাই ছাদে যেতে লাগল। হলুদের সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু মেয়েদের দল এখনও রুম থেকে বেরোনোর নামও নিচ্ছে না। সাকিব বারবার নিচে গিয়ে তাড়া দিচ্ছে তবুও তারা শুধু বলছে আর পাঁচ মিনিট। অথচ তাদের পাঁচ মিনিট শেষ হতে হতে বিশ মিনিট পার হয়ে গেছে। সাকিব এবার কিছুটা রেগে গেল। তার রাগ শুনে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা সুড়সুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে এল। অনন্যাকে নিয়ে সবাই মিলে ছাদে উঠল। সব মেয়েদের পরনে হলুদ শাড়ি। অনন্যা ছাড়া সবার সাজ একইরকম। অনন্যা ফুলের গহনা পড়েছে তাই তার সাজও আলাদা লাগছে। ছেলেরা একেক জন একেক রকমের পাঞ্জাবি পড়েছে। মেয়েরা ছাদে উঠতেই সবার মাঝে কেবল একজনের দিকেই দৃষ্টি পড়ল এরেনের। তার নিজের মানুষটা। হলুদ শাড়িতে ইলোরাকে তার চোখে হলুদ পরী বলে মনে হচ্ছে। যার বিচরণ শুধু তারই রাজ্য জুড়ে। এরেনকে তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইলোরা মুচকি হাসল। অনন্যাকে নিয়ে স্টেজে বসানো হলো। সবার আগে বড়োরা অনন্যাকে হলুদ ছোঁয়াতে গেল। ফটোগ্রাফার একে একে সবার ছবি তুলছেন। মেয়েরা সবাই সেলফি তুলতে ব্যস্ত। ডালিয়া খেয়াল করল তাহসিন হা করে শুধু তাকেই দেখছে। সে সরু চোখে তাহসিনের দিকে তাকিয়ে এক ভ্রু নাচালো। যার অর্থ ‘হা করে তাকিয়ে আছিস কেন?’ তাহসিন মুচকি হেসে ডানে বায়ে মাথা দোলালো। রনি এরেনের পাশে দাঁড়িয়ে বকবক করেই চলেছে। কতদিনের সম্পর্ক? কীভাবে হলো? কেউ বুঝল না কেন? আমার কাছে স্বীকার করলি না কেন? টাইমপাস করছিস না ট্রু লাভ? সাকিব জানলে কী হবে? ইত্যাদি ইত্যাদি। এরেন বিরক্ত হয়ে ওকে দিলো এক ধমক। রনি মেয়েদের মতো মুখ বাঁকিয়ে বলল,“ভয় পাই না তোকে। তাছাড়া তোর কী ভয় করছে না? আমি যে জেনে গেলাম তোর প্রেমের খবর, এখন যদি আমি সাকিবকে বলে দেই?”
এরেন পাত্তা না দিয়ে বলল,“তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।”
রনি আরও কিছু বলার আগেই এরেন সেখান থেকে সরে গেল। বড়োদের সবার হলুদ ছোঁয়ানো শেষ হয়েছে। এখন সব ছেলে মেয়েরা একে একে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে। এরমধ্যেই তারা একেক জন একেক জনের গালে হলুদ লাগানো শুরু করেছে। ইলোরাও সবার সাথে আনন্দ করছে। হঠাৎ এরেন ডালিয়ার হাত থেকে কিছুটা হলুদ নিয়ে ইলোরার পেছনে দাঁড়িয়ে তার গালে ছোঁয়ালো। ইলোরা পেছন ফিরে তাকাতেই এরেন মুচকি হেসে অন্যান্যর দিকে ইশারা করে বলল,“আমার ইলোনিও একদিন এমন সেজেগুজে স্টেজে বসবে।”
ইলোরা লাজুক হাসল। এরেন ইলোরার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলল,“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে লজ্জাবতী। একদম হলুদ পরীর মতো। আমি ভাবছি কাল কেমন লাগবে। আমি তো হার্ট অ্যাটাক করব।”
ইলোরা হেসে বলল,“আমার বর বাবুকেও খুব হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে। এখানকার কোনো মেয়ের নজরে না পড়লেই হয়।”
“বরকে নিজের আঁচলের নিচে লুকিয়ে রেখে দিলেই পারো।”
ইলোরা এরেনের ডান গালে হলুদ মাখিয়ে বলল,“আঁচলের নিচে লুকাতে হবে না। আমার বর সারাজীবন আমারই থাকবে।”
ওদের দুজনের কথার মাঝে সেখানে রনি এসে দাঁড়াল। ইলোরা রনিকে দেখে কিছুটা ভড়কে গেল। সে একটা শুকনো ঢোক গিলে এরেনের দিকে তাকাতেই এরেন চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করল। ইলোরা দ্রুত সেখান থেকে সরে গেল। এরেন একরাশ বিরক্তি নিয়ে রনির দিকে তাকাল। রনি হতাশ ভঙ্গিতে বলল,“তোরই দিন ভাই রে।”
সবার হলুদ ছোঁয়ানো আর ফোটোগ্রাফি চলল রাত নয়টা পর্যন্ত। তারপর রাতের খাবারের জন্য সবাইকে নিচে ডাকা হলো। একে-একে সবাই ছাদ থেকে নেমে গেল। নিচে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া শুরু হলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মেয়েরা সবাই রুমে গিয়ে শাড়ি পরিবর্তন করল। নাঈম সবাইকে ডেকে নিয়ে বাড়ির উঠানে গোল করে চেয়ার পেতে আড্ডা বসালো। সিদ্ধান্ত নেয়া হলো সবাই মিলে গলা ছেড়ে গান গাইবে। সাকিব রনিকে বলল,“এসেছিস যখন গিটারটা সঙ্গে আনতে পারলি না?”
রনি মুখ গোমড়া করে বলল,“এতকিছু মনে ছিল না। তোরা মনে করিয়ে দিতে পারলি না?”
তাহসিন বলল,“থাক, যেটা নেই সেটার কথা বলে আর লাভ নেই। এক কাজ করা যায়। আমরা না হয় স্টিলের বাটি বা গামলা পিটিয়ে গান করি।”
তাহসিনের কথায় সবাই সায় দিলো। ডালিয়া গিয়ে বাড়ির ভিতর থেকে স্টিলের দুইটা গামলা আর তিনটা বাটি নিয়ে এল। এরেন আর নাঈম গামলা দুটো নিল। আর বাটি তিনটা নিল সাকিব, তাহসিন আর রনি। রনি গিয়ে উঠানের পাশ থেকে শুকনো ডাল ভেঙে নিয়ে এল। তারপরই শুরু হলো গামলা আর বাটি পিটিয়ে ননস্টপ গান। ছেলেরা গলা ফাটিয়ে গান ধরেছে আর মেয়েরাও মাঝে মাঝে সুর মিলাচ্ছে। ওদের গানের শব্দে বড়োরা কেউ কেউ বাড়ির ভিতর থেকে ডাক ছাড়লেন। তাতে ওরা গলার স্বর কিছুটা কমিয়ে দিলো কিন্তু গান থামাল না। অনন্যা আর নাদিয়া ঘুম পাচ্ছে বলে উঠে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। তারপর একে একে সবাই উঠতে লাগল। শেষে বাকি রইল শুধু এরেন, ইলোরা, ডালিয়া আর রনি। রনি ডালিয়াকে বলল,“ডালিয়া, চলো আমরাও চলে যাই। ওরা দুজন বোধ হয় আজকের রাতটা উঠানে বসেই পার করতে চায়।”
ডালিয়া হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর রনি আর সে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। ইলোরাও উঠে দাঁড়াল। এরেন পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে বলল,“আগে গেলেন না কেন মহারানি?”
ইলোরা হামি তুলে বলল,“তখন ঘুম পায়নি এখন পাচ্ছে।”
এরেন এক হাত ধরে হেঁচকা টানে ইলোরাকে নিজের কোলে বসাল। ইলোরা হন্তদন্ত হয়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতেই এরেন তার কোমর জড়িয়ে ধরল। ইলোরা বাড়ির দিকে ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল,“এখানে অন্তত এমন করো না প্লিজ। বাড়ি থেকে কেউ বেরিয়ে এমন অবস্থায় দেখে ফেললে যা তা কান্ড ঘটে যাবে।”
এরেন ডান হাতে আলতো করে ইলোরার গাল স্পর্শ করল। ইলোরা থমকে গেল। এই স্পর্শটা তার মনটাকে কাঁপিয়ে দেয়। এক মুহুর্তের জন্য ইচ্ছে করে এই মানুষটার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিতে। এরেন ইলোরার মুখটা একটু কাছে এগিয়ে নিয়ে এসে চোখে চোখ রেখে বলল,“এসবে আমার ভয় নেই ইলোনি। যে যাই ভাবুক, আমরা তো জানি আমরা একে অপরের কী। তাতেই হবে। কারো ভয়ে আমি তোমার থেকে দূরে থাকতে পারব না। আমি তো চাই সারাক্ষণ এই মেয়েটাকে নিজের বুকে আগলে রাখতে।”
ইলোরা পারল না ঐ দৃষ্টির সামনে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে। সে চোখ বন্ধ করে শক্ত করে এরেনকে জড়িয়ে ধরল। এরেন হেসে ইলোরাকে আলতো করে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখল। বেশ কিছুক্ষণ পর এরেন ইলোরার মাথায় ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল,“ভেতরে যাও। অনেক রাত হয়েছে। এখন ঘুমিয়ে পড়া উচিত।”
ইলোরা এরেনের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে প্রশ্ন করল,“তুমি যাবে না?”
এরেন বলল,“তুমি যাও, আমি আসছি।”
ইলোরা মাথা দুলিয়ে এরেনের কোল থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর আর এরেনের দিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির ভেতরে হাঁটা দিলো। এরেন ইলোরার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল।
চলবে………………..🌸