সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-৩৯

0
653

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৩৯

রাত নয়টার মধ্যেই এরেনরা ঢাকা পৌঁছল। তাহসিন, অরিশা আর নাদিয়া যার যার বাড়ি চলে গেল। রনি, এরেন ইলোরা আর ডালিয়া গেল ইলোরাদের বাসায়। সাকিবরা মাইক্রো নিয়ে আসায় এরেনদের আগে এসেছে। এরেনরা বাড়িতে পৌঁছে দেখল ইলোরার কাকা, কাকি আর চাচাতো বোনও চলে এসেছে। তারা হয়তো খবর পেয়েই এসেছে। মালিহা বেগম বাড়িতে এসেই ঘরের দরজা দিয়ে বসে আছেন। সাজিদ হোসেন আর মিথিলা মিলে অনেক ডাকাডাকি করেও দরজা খোলাতে পারেননি। ইলোরা এসে সেও অনেকবার দরজা ধাক্কাধাক্কি করেছে। শেষে সাজিদ হোসেন বাধা দিয়ে বললেন,“থাক, ওকে আর ডেকো না। হঠাৎ করে এমন একটা ঘটনা মেনে নিতে একটু তো সময় লাগবেই। কাল সকালেই দেখবে ঠিক হয়ে যাবে।”

কেউ আর মালিহা বেগমকে ডাকল না। এরেন আর রনিকে ডেকে সাকিব বলল,“বাইরে গিয়ে ফুল কিনে নিয়ে আয়।”

রনি সন্দিহান কন্ঠে বলল,“বাই এনি চান্স, তুই কি বাসরের কথা ভাবছিস?”

এরেনও প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে সাকিবের দিকে তাকিয়ে রইল। সাকিব বলল,“হ্যাঁ।”

এরেন আর রনি বিস্মিত কন্ঠে একসাথে বলে উঠল,“কিহ্!”

সাকিব স্বাভাবিকভাবেই বলল,“দেখ,‌ অনুর জীবনে যা ঘটেছে সেটা যে ও স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারবে না সেটা তো আমরা জানি। আজ ওর অন্য কারোর সাথে নতুন জীবন শুরু করার কথা ছিল। এটা নিয়ে ওর হয়তো অনেক স্বপ্নও ছিল। হঠাৎ করে সব পাল্টে গেছে বলে ওর স্বপ্নগুলো কেন ভেঙে যাবে? বিয়েটা আমাদের দুজনের ভাগ্যে ছিল। তাছাড়া বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তখন একদিন না একদিন তো সবকিছু গুছিয়ে নিতেই হবে আমাদের। তো সেটা এখন থেকে করলে ক্ষতি কী? অমি চাইছি ওর হাসবেন্ড পাল্টালেও পরিস্থিতি যেন না পাল্টায়। নতুন শুরুর চেষ্টা তো অন্তত করতে পারি।”

এরেন আর রনি অবাক হয়ে সাকিবের কথা শুনছিল। এবার তারা দুজনেই খুশিতে সাকিবকে জাপ্টে ধরল। এরেন আনন্দিত কন্ঠে বলল,“সাকু, আমরা তো ভেবেছিলাম এই বিয়ে মেনে নিতে তোদের অনেকটা সময় লাগবে। আমার তো খুব আনন্দ হচ্ছে এখন। এজন্যই তোকে সবাই এত ভালোবাসে।”

রনি বলল,“তুই যখন মেনে নিয়েছিস তখন দেখবি একটু বুঝালে অনন্যাও মেনে নিবে।”

এরেন রনির মাথায় জোরে একটা চাটি মেরে বলল,“অনন্যা কী? ভাবি বল।”

রনি হেসে বলল,“ও হ্যাঁ, এখন তো সম্পর্ক পাল্টে গেছে।”

সাকিব বলল,“তোরা কথা বলে সময় নষ্ট না করে কাজ কর।”

এরেন বলল,“ওরেব্বাস! সাকুর দেখছি বাসরের জন্য তর সইছে না।”

সাকিব উল্টোদিক ফিরে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,“পছন্দের মানুষ বলে কথা।”

এরেন আর রনি চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে হা করে তাকিয়ে রইল। ততক্ষণে সাকিব সেখান থেকে চলে গেছে। রনি এরেনকে কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে অবাক কন্ঠে বলল,“এটা কী বলল ও?”

এরেন দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,“জানি না।”

তারা দুজন চলে গেল ফুল আনতে। ফুল নিয়ে আবার বাড়িতে ঢুকতেই সবাই হা করে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা কারোর বিস্ময়কে পাত্তা না দিয়ে সাকিবের রুমে ঢুকে পড়ল। ইলোরা তাদের পেছন পেছন ছুটে এসে রুমে ঢুকল। অবাক কন্ঠে এরেন আর রনিকে প্রশ্ন করল,“তোমরা কী করছো এসব?”

এরেন বলল,“দেখতেই তো পাচ্ছ কী করছি। কথা না বলে হাত লাগাও আমাদের সাথে। তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে তাহলে।”

“ভাই জানে?”

ইলোরার প্রশ্নে রনি হেসে বলল,“তোমার ভাইয়ের কথাতেই এসব আয়োজন।”

ইলোরা আরও অবাক হয়ে বলল,“কিহ্! সত্যি বলছো? ভাই এত তাড়াতাড়ি মেনে নিল! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

এরেন সাজানো শুরু করতে করতে বলল,“এখন আপাতত হেল্প করো। বিশ্বাস পরে কোরো।”

ইলোরা অবাক হলেও বাসর ঘর সাজাতে এরেন আর রনিকে হেল্প করল। সাজাতে সাজাতেই এরেন আর রনি ইলোরাকে সাকিবের বলা কথাগুলো বলল। সব শুনে ইলোরা খুব খুশি হলো। সাজানো শেষ করে রনি রুম থেকে বেরোতে বেরোতে বলল,“গলা শুকিয়ে গেছে, পানি খেয়ে আসি।”

রনি চলে যাওয়ার পর এরেন ইলোরাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আফসোসের সুরে বলল,“বিয়ের ছয় মাস পার হওয়ার পরও নিজে বাসর করতে পারলাম না অথচ নিজ হাতে বন্ধুর বাসর সাজালাম। একেই বলে পোড়া কপাল!”

ইলোরা ঠোঁট টিপে হাসল। তারপর এরেনের হাত ধরে টানতে টানতে বলল,“ভালো করেছ, এখন বাইরে চলো। যাদের বাসর তাদের ঢুকতে দাও।”

ইলোরা এরেনকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে গেল। সেখানে অনন্যা, ডালিয়া আর ইলোরার চাচাতো বোন তানিয়া বসে আছে। অনন্যা এখনও থেকে থেকে কাঁদছে। ডালিয়া তাকে অনেকভাবে বুঝানোর চেষ্টা করছে। ইলোরা গিয়ে অনন্যাকে ধরে সোফা থেকে উঠিয়ে বলল,“রুমে চলো আপ্পি। শাড়ি চেঞ্জ করতে হবে।”

অনন্যা ইলোরার সাথে চলল। ডালিয়াও তাদের পেছন পেছন গেল। সাকিবের রুমের দরজা পর্যন্ত এসেই অনন্যা দাঁড়িয়ে পড়ল। ইলোরা বুঝতে পেরে বলল,“আজ থেকে এটাই তোমার রুম‌ আপ্পি। প্লিজ মেনে নেয়ার চেষ্টা করো। ভেতরে চলো।”

অনন্যা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে রুমে ঢুকল। মিথিলা একটা শাড়ি, ব্লাউজ আর পেটিকোট নিয়ে রুমে ঢুকল। ডালিয়া তা দেখে প্রশ্ন করল,“এগুলো কার?”

মিথিলা বলল,“আসার সময় মামি অনু আপ্পির জামাকাপড় প্যাকিং করে দিয়েছিল আমার কাছে। এখন এই শাড়িটাই পড়াও।”

ইলোরা এগিয়ে গিয়ে মিথিলার হাত থেকে শাড়ি নিয়ে অনন্যার হাতে দিয়ে প্রশ্ন করল,“হেল্প করতে হবে?”

অনন্যা মৃদু কন্ঠে বলল,“না।”

ইলোরা অনন্যার একহাত ধরে বলল,“আপ্পি, আর কান্নাকাটি করো না প্লিজ। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এতে তো কারোর হাত নেই। তাই সবটা মেনে নাও।”

অনন্যা কোনো কথা বলল না। ইলোরা ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“চেঞ্জ করে নাও।”

ইলোরা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার পেছন পেছন ডালিয়া আর মিথিলাও চলে গেল। অনন্যা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ওয়াশরুমে ঢুকল। ইলোরা অনন্যার রুম থেকে বেরিয়ে আশেপাশে এরেনকে খুঁজতে লাগল। একেকজন একেক জায়গায় বসে আছে অথচ এরেনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। বাড়ি ফিরে গেল না-কি? গেলে তো রনিও চলে যেত। সারা বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে ইলোরা ছাদে চলে গেল। ছাদে পা রেখেই এরেনকে দেখল রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ইলোরা গিয়ে এরেনের পাশ‌ ঘেঁষে দাঁড়াল। এরেন টের পেয়েও তাকাল না। ইলোরা সূক্ষ্ম চোখে এরেনকে নিরীক্ষণ করল। সকালের মতো এখন আবার তাকে আপসেট দেখাচ্ছে। ইলোরা বলল,“এতক্ষণ তো ঠিকঠাকই ছিলে। এখন আবার কী হলো?”

এরেন মাথা নেড়ে বলল,“কিছু না।”

ইলোরা এরেনকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,“মিথ্যা কথা বলছো কেন আমার সাথে? সকালেও তোমাকে এমন দেখাচ্ছিল। কিছু তো হয়েছেই। তুমি কি কোনোকিছু নিয়ে চিন্তিত?”

এরেন বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে উপর নিচে মাথা দোলালো। ইলোরা প্রশ্ন করল,“কী নিয়ে?”

“জারিনকে নিয়ে।”

ইলোরা ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলল,“কী হয়েছে জারিনের?”

এরেন মুখটা অন্ধকার করে বলল,“আমাদের ধারণা ভুল। রনি আর জারিনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। জারিন রনিকে খুব ভালোবাসে কিন্তু রনি ওকে নিয়ে এতকিছু ভাবে না।”

ইলোরা অবাক হয়ে বলল,“তার মানে রনি ভাইয়া এতদিন সত্যি কথাই বলছিল? কিন্তু তুমি এটা নিয়ে এত বেশি আপসেট কেন?”

“রনি অন্য কাউকে ভালোবাসে। ও অলরেডি রিলেশনে আছে তার সাথে। এসব কথা জারিন শুনলে ওকে সামলানো কঠিন হবে। জানো তো ও খুব জেদি মেয়ে।”

“রনি ভাইয়া রিলেশনে আছে! কই? কেউ তো এতদিন টেরই পায়নি। তুমি কীভাবে জানলে? আর মেয়েটা কে?”

“নাম শুনলে তুমি আরও বেশি অবাক হবে।”

“তাই না-কি? বলো না।”

“মিথিলা।”

ইলোরা চমকে উঠল। নিজের কানকেই তার বিশ্বাস হলো না। সে কিছুটা জোরেই বলে উঠল,“কিহ্! এটা কীভাবে সম্ভব? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”

এরেন বলল,“আমারও প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু এটাই সত্যি।”

“আমি এক্ষুনি জিজ্ঞেস করছি ওকে।” কথাটা বলে ইলোরা যেতে নিতেই এরেন ইলোরার হাত ধরে বাধা দিয়ে বলল,“এখন কিছু জিজ্ঞেস করো না। সময় নিয়ে পরে জিজ্ঞেস কোরো। আর তাছাড়া ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসলে সেখানে আমাদের কিছু বলার নেই। জারিনের ভালোবাসাটা একপাক্ষিক।”

“রনি ভাইয়া বা মিথির আচরণে‌ কোনোদিনও বোঝার উপায় ছিল না যে ওদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক আছে। সবার সামনে ওরা একদম স্বাভাবিক। তাছাড়া মিথির বয়স কতটুকু? আচ্ছা, তুমি জানলে কীভাবে?”

“আমি আজ সকালেই টের পেয়েছি। আমরা সবাই তখন বাইরে ছিলাম। আশেপাশে রনিকে না দেখতে পেয়ে ওকে খুঁজতে খুঁজতে রুমের দিকে গিয়েছিলাম। কিন্তু রুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে দেখি ভেতরে রনি আর মিথিলা কথা বলছে। তাতে আমার তেমন কিছু সন্দেহ হয়নি কিন্তু রনি যখন মিথিলার হাত ধরল তখনই শিওর হয়েছিলাম। আর ওদের দু একটা কথাও শুনেছিলাম। যাক, এটা নিয়ে আপাতত কোনো কথা বলো না। আমি শুধু চিন্তায় আছি জারিনকে নিয়ে। মেয়েটা খুব কষ্ট পাবে। জেদের বশে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে?”

“এসব কী ভাবছো তুমি? আপু যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে। বুঝালে অবশ্যই বুঝবে।”

এরেন ইলোরার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“বাবা জারিনকে অসম্ভব ভালোবাসে। জারিন তার দূর্বলতা বলতে পারো। ওদের কারণে আমাদের সম্পর্কটাও টানাপোড়েনে পড়তে পারে।”

ইলোরার মুখটাও শুকিয়ে গেল। চোখের কোণে একফোঁটা জলও জমে গেল। এরেন ইলোরাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,“আমি আম্মুকে জানিয়ে দিবো তোমার কথা। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমি চাই না আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে কোনোরকম ঝামেলা হোক।”


অনন্যা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল সাকিব বিছানায় বসে ফোন চাপছে। তার উপস্থিতিতে সাকিব ফোন থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকাল। অনন্যার ভীষণ অস্বস্তি লাগল। সে চুপচাপ এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল। সাকিব বলল,“ওখানে দাঁড়িয়েই রাত পার করার কথা ভাবছিস না-কি?”

অনন্যা এলোমেলো দৃষ্টিতে একবার সাকিবের দিকে তাকাল। সাকিব আবার বলল,“এখানে এসে বস।”

অনন্যা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সাকিবের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে বিছানায় উঠে বসল। সাকিব ফোনটা রেখে পাশ থেকে একটা প্লেট হাতে নিল।‌ অনন্যা এতক্ষণে খেয়াল করল সাকিবের পাশে খাবারের প্লেট ঢেকে রাখা ছিল। সাকিব প্লেটটা নিয়ে অনন্যার দিকে এগিয়ে এসে এক লোকমা ভাত তুলে অনন্যার মুখের সামনে ধরে বলল,“হা কর।”

অনন্যা অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সাকিবের দিকে তাকিয়ে রইল। সাকিব বলল,“কী? হাত ধুয়েই এসেছি। সারাদিন ধরে না খেয়ে আছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর।”

অনন্যা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,“আমি খাব না। তুই খা।”

“কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নে।”

“আমি নিজের হাতে খেতে পারব।”

“এক প্লেটই এনেছি।”

“তাহলে তুই-ই খা। আমার ক্ষুধা নেই।”

সাকিব হাত থেকে প্লেটটা রেখে বাঁ হাতে অনন্যার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে মুখে খাবার পুরে দিলো। অনন্যা অবাক হয়ে গেল। সাকিবকে দেখে মনে হচ্ছে সে এই হঠাৎ বিয়েতে একটুও আপসেট না। সাকিব এবার নিজের মুখে খাবার তুলল। অনন্যা হঠাৎ প্রশ্ন করল,“এত রাতে বিরিয়ানি রান্না করল কে?”

সাকিব আরেক লোকমা অনন্যার মুখের সামনে ধরে বলল,“বাইরে থেকে আনিয়েছি।”

অনন্যা আর কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ সাকিবের হাতে খেতে লাগল। প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে তাই কথা বাড়াতে ইচ্ছে করল না। খাওয়া শেষ করে সাকিব প্লেটটা টেবিলে রাখল। অনন্যা দুহাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। সাকিব অনন্যার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। অনন্যা চমকে নড়েচড়ে বসল। সাকিব বলল,“আমি জানি এখন তোর মনের অবস্থা কেমন। বিয়েটা যে পরিস্থিতিতে হয়েছে তাতে মেনে নেয়াটা একটু কঠিন। কিন্তু বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তখন তো আমাদের দুজনকে সেটা মেনে নিতেই হবে।”

অনন্যা গম্ভীর মুখে বলল,“এত সহজ?”

সাকিব মৃদু হেসে বলল,“চেষ্টা করলে অবশ্যই সহজ। কারণ আজ থেকে সারাজীবন আমাদের একসাথেই কাটাতে হবে। তাই এখন থেকেই মেনে নেয়া উচিত।”

অনন্যা অবাক কন্ঠে বলল,“হঠাৎ এমন করে আমাকে তোর গলায় ঝুলিয়ে দিলো আর তুই এটা এত সহজে মেনে নিলি?”

সাকিব একটু শব্দ করে শ্বাস নিয়ে বলল,“নিলাম তো।”

অনন্যা মাথা দুলিয়ে বলল,“অসম্ভব! আমি বিশ্বাস করি না। তুই আমাকে খুশি করার জন্য এসব বুঝাতে চাইছিস? নিজের মনকে জোর করে আমাকে মেনে নিতে চাইছিস?”

সাকিব একটু সিরিয়াস হয়ে বলল,“আমি সিরিয়াস অনু।”

“বিশ্বাস করি না।”

“প্রমাণ দেবো?”

অনন্যা ভ্রুকুকি করে প্রশ্ন করল,“কিসের প্রমাণ?”

সাকিব হঠাৎ অনন্যার বাঁ হাতে হেঁচকা টান দিল। অনন্যা তাল সামলাতে না পেরে সাকিবের বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সে হন্তদন্ত হয়ে সাকিবের থেকে সরে যেতে চাইতেই সাকিব তার কোমর জড়িয়ে আরও কাছে টেনে নিল। অনন্যা হতভম্ব হয়ে সাকিবের মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,“নিজের মনকে জোর করিস না সাকিব। এভাবে আমাকে খুশি করতে পারবি না।”

সাকিব এক হাত অনন্যার ঘাড়ের ওপরে পড়ে থাকা চুলে ডুবিয়ে দিলো। অনন্যা দুহাতে সাকিবকে ঠেলে দূরে সরানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,“আমার কপালে যা ছিল তাই হয়েছে সাকিব। আমি ঠিক আছি। শুধু শুধু এভাবে নিজের মনের ওপর জোর করিস না প্লিজ।”

সাকিব অবাক হয়ে বলল,“তোর এখনও মনে হচ্ছে তোর খুশির জন্য আমি নিজের মনকে জোর করছি?”

“মনে হওয়ার কিছু নেই। এটাই সত্যি।”

“যদি বলি ভালোবাসি?”

অনন্যা থমকে গেল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,“অসম্ভব! এভাবে ভালোবাসা হয় না।”

“যদি বলি এই মুহূর্ত থেকে আমি তোকে ভালোবাসি? হাসবেন্ডের অধিকার চাই। তাহলে?”

অনন্যা হতবাক হয়ে গেল। সে ছলছল চোখে সাকিবের দিকে তাকিয়ে রইল। সাকিব বলল,“একটা সম্পর্ককে আমরা যতটা জটিল ভাবি, আসলে তা অতটাও জটিল না। আমরা নিজেরাই সেটাকে জটিল করে তুলি। আবার আমাদের একটু ইচ্ছেই পারে সম্পর্কটা একদম সহজ করে তুলতে। আমি সত্যিই মেনে নিয়েছি সবকিছু। তাই আমাকে নিয়ে মনে কোনো দ্বিধা রাখিস না। শুধু এটুকু বল তুই মানতে পারবি কি না।”

অনন্যার গাল বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। কান্নার কারণে ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠল। সাকিব স্থির দৃষ্টিতে অনন্যার ঠোঁটের দিকে তাকাল। অনন্যা ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সে আবার সাকিবের থেকে সরার চেষ্টা করতেই সাকিব ঝুঁকে এসে তার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁটে ছোঁয়ালো। অনন্যার সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। তার মনে হলো যেন সে শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। সাকিব অনন্যার চুল থেকে হাত সরিয়ে গালে রেখে মৃদু হেসে বলল,“এই চঞ্চল হরিণীকে এমন পেঁচার মতো মুখে একদম মানায় না। চোখ দুটো ফুলে লাল টমেটো হয়ে গেছে। একটু হাসো তো বউ।”

অনন্যা ধরা গলায় আধো আধো স্বরে বলল,“সাকিব তুই……………।”

সাকিব অনন্যার কথা শেষ না হতেই তার মুখে আঙুল চেপে ধরে বলল,“হুঁশশ। হাসবেন্ডকে তুই তুকারি করতে হয় না বেয়াদব মেয়ে। তুমি বলতে শিখো।”

অনন্যা শুধু অবাকের ওপর অবাক হচ্ছে। এই সাকিবকে আজ তার সম্পূর্ণ অচেনা লাগছে। সাকিব অনন্যাকে মুক্ত করে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে সুইচ টিপে লাইট অফ করে দিলো। অনন্যার বুক ধুকপুক করছে। সে ভাবতেও পারেনি সাকিব এই সম্পর্কটাকে এত সহজভাবে নিবে। সাকিব বিছানায় ফিরে এসে অন্ধকারেই অনন্যাকে আবার বুকে চেপে ধরে শুয়ে পড়ল। অনন্যার গলা শুকিয়ে গেল। একটা শব্দও তার কন্ঠনালি দিয়ে বের হলো না। সাকিবকে নিয়ে সে কনফিউশনে পড়ে গেছে। ওর আচরণে মনে হচ্ছে যেন ও এমন কিছুই চাইছিল। নইলে এক্সিডেন্টলি বিয়ে হওয়ার পরও এত দ্রুত কী করে মেনে নিতে পারল? সাকিব হঠাৎ নিচু স্বরে বলল,“অনু, তুই কি মন থেকে আমাকে অধিকার দিবি? তুই না চাইলে এই মুহূর্ত থেকে আমি তোকে টাচও করব না।”

অনন্যার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু তার মুখ থেকে কথাই বের হচ্ছে না। সে বুঝে উঠতে পারছে না সাকিবের প্রশ্নের কী উত্তর দিবে। সাকিব তো এখন তার স্বামী। তার ওপর সম্পূর্ণ অধিকার আছে সাকিবের। আজ, কাল বা পরশু একদিন না একদিন তো ওকে ওর অধিকার দিতেই হবে। তাছাড়া ও যখন সম্পর্কটাকে সহজ করতে চাইছে তখন বাধা দেয়াটা ঠিক হবে না। সাকিব আবার বলল,“নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। আমি কি ধরে নেব তুই মেনে নিতে চাইছিস?”

অনন্যা এবারও চুপ। কী বলবে সে? তাকে তো অস্বস্তি আর লজ্জায় চেপে ধরেছে। হঠাৎ সাকিবের স্পর্শ গভীর হতেই অনন্যা চমকে উঠল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,“সাকিব, শেষ বারের মতো বলছি একটু সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ।”

সাকিব অনন্যার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,“ভালোবাসি অনু।”

অনন্যা সুন্দরী হওয়ার দরুন আজকের আগেও অনেক ছেলের মুখে সে এই কথাটা শুনেছে। কিন্তু এমন কম্পন ধরানো অনুভূতি তার কখনও হয়নি। অনন্যা চোখ বন্ধ করে সাকিবের শার্ট খামচে ধরল। নতুন স্পর্শ, নতুন প্রাপ্তি আর নতুন অনুভূতিতে তার চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।

চলবে……………………🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here