সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-৪

0
1013

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৪

ইলোরাকে দেখেই তার মামাতো বোন অনন্যা খুশিতে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছে। তখন থেকে সে চেঁচিয়ে মা-বাবাকে ডেকে চলেছে। ওর চেঁচামেচি শুনে আলিয়া বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বেরোতে বেরোতে বিরক্ত মুখে বললেন,“কাজের সময় বিরক্ত করছিস কেন? সারাদিন তো ফোন নিয়ে ঘরের মধ্যে বসে থাকিস। কাজ করার তো নামই নেই। তারপর আবার আমার কাজের সময়ও বিরক্ত করছিস?”

অনন্যা দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,“আরে আমি কি সাধে চেঁচিয়ে ডেকেছি না-কি? দেখো কে এসেছে।”

অনন্যা সোফার দিকে ইশারা করল‌। আলিয়া বেগম সোফার দিকে তাকিয়ে খুশি হওয়ার বদলে ভ্রু কুঁচকালেন। ইলোরা হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে বলল,“আসসালামু আলাইকুম মামি। কেমন আছো?”

আলিয়া বেগম মৃদু কন্ঠে উত্তর দিলেন,“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আমি ভালো আছি।”

পরক্ষণেই তিনি সোফায় দৃষ্টি ফিরিয়ে অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,“ছেলেটা কে?”

তার কথা শুনে এরেন হাতের ফোনটা দ্রুত পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল। দু’পা এগিয়ে এসে হাসিমুখে আলিয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলল,“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তোমাকে তো চিনলাম না। কে বাবা তুমি?”

“আমি এরেন জামান। সাকিবের খুব কাছের বন্ধু।”

“তুমি ইলোর সাথে আমাদের বাড়িতে! ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। এই ইলো, কী ব্যাপার বল তো?”

ইলোরা মুচকি হেসে বলল,“আসলে আমি ঢাকা থেকে গতকাল রাতে রওনা দিয়েছিলাম। তখন বাসে ওনার সাথে দেখা হয়। পথে আমাদের বাস নষ্ট হয়ে যায়। আর যেখানে বাস নষ্ট হয়েছে সেখানে কোনো গ্যারেজ নেই। শীতের রাত তো তাই গ্যারেজের লোক খুঁজে পেতে অনেক সময় লেগে গেছে। আর তারপর বাস ঠিক করে পৌঁছাতে পৌঁছাতে এত বেলা হয়ে গেছে।”

কথাগুলো বলে ইলোরা ভয়ে ভয়ে মামির দিকে তাকাল। মামি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার চাহনিতে ইলোরার প্রতি অবিশ্বাস স্পষ্ট। ইলোরার গলা শুকিয়ে গেল। মামি যে এত সহজে এসব কথা বিশ্বাস করার মানুষ না তা সে ভালোভাবেই জানে। আলিয়া বেগম ভ্রুকুটি করে বললেন,“বাস ঠিক করে কিশোরগঞ্জ পৌঁছাতে সকাল হয়ে গেছে? তাও আবার এত বেলা! এত সময় লেগেছে?”

ইলোরাকে আমতা-আমতা করতে দেখে এরেন আগ বাড়িয়ে উত্তর দিলো,“হ্যাঁ। আসলে শীতের রাত তো। আর ও সঠিকভাবে বলতে পারেনি। গ্যারেজের লোক পাওয়া গেছে ফজরের সময়। সেজন্যই এতো দেরি হয়েছে।”

অনন্যা প্রশ্ন করল,“সারা রাত বাসে কাটিয়েছিস তোরা?”

ইলোরা মাথা নেড়ে বলল,“হ্যাঁ।”

আলিয়া বেগম সন্দিহান কন্ঠে বললেন,“সবই বুঝলাম। কিন্তু তোমার হঠাৎ আমাদের বাড়িতে আসার কারণটা বুঝলাম না বাবা।”

এরেন মুচকি হাসল। সে স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিলো,“আমি এসেছি সাকিবের মামার কাছে। একটা জমির ব্যাপারে ওনার সাহায্য দরকার। ওনার সাথে কথা বলেই আমি চলে যাব।”

আলিয়া বেগম আরও কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু তার আগেই অনন্যা বিরক্ত হয়ে বলল,“উফ্ মা, এত প্রশ্ন করার কী আছে? করার হলে পরে কোরো। শুনলে তো ওরা সারারাত বাসে বসে ছিল। ওদের এখন রেস্ট দরকার। তুমি নিজের কাজে যাও তো।”

আলিয়া বেগম কড়া চোখে একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে হনহন করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। অনন্যা হাসিমুখে বলল,“ইলো তুই ঘরে যা। ডালিয়া ঘরেই আছে। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নে। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

ইলোরা মাথা নেড়ে ব্যাগ নিয়ে চলে গেল ভেতরে। অনন্যা এরেনকে উদ্দেশ্য করে বলল,“ভাইয়া, আপনি আমার সাথে আসুন।”

অনন্যা এরেনকে একটা ঘর দেখিয়ে দিলো। এরেনকে ফ্রেশ হতে বলে সে ছুটল খাবার আনতে। মেয়েটার আচরণ এরেনের খুব ভালো লাগল। তখন থেকে শুধু হেসেই চলেছে। মেয়েটা বোধ হয় সবসময় এমন হাসিখুশি থাকতেই পছন্দ করে। মেয়েটার সাথে তার ছোট বোন জারিনের অনেক মিল। দু’জনই খুব হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত। বোনের সাথে মিল আছে বলেই হয়তো মেয়েটাকে তার ভালো লেগেছে।

ঘরে ঢুকেই ইলোরা দেখল ডালিয়া খুব মনোযোগ দিয়ে বেলী ফুলের মালা গাঁথছে। তার এই বোনটা একটু আলাদা। অনন্যা আর ডালিয়া দুবোন হলেও ডালিয়া অনন্যার থেকে একদম অন্যরকম। অনন্যা হচ্ছে মিশুক প্রকৃতির মেয়ে। সবার সাথে সবসময় হাসি, ঠাট্টা, গল্প করতে ভালোবাসে। তাও আবার আস্তে ধীরে না, বাড়ি কাঁপিয়ে। একটু খুশি হলেই সারা বাড়ি কাঁপিয়ে হাসতে থাকে। ওর জন্য বাড়িতে সব সময় হইহুল্লোড় লেগেই থাকে। আর অসম্ভব সুন্দরীও সে। অনন্যা সাকিবের এক বছরের ছোট। সাধারণত সবাই বলে বড়ো মেয়েরা একটু চুপচাপ স্বভাবের হয়। অথচ অনন্যার ক্ষেত্রে এ কথা সম্পূর্ণ ভুল। এত বেশি চঞ্চল মেয়েটা! আর ডালিয়া অনন্যার সম্পূর্ণ বিপরীত। কারো সাথে খুব বেশি কথা বলে না, মজা করে না। সবসময় নিজের মতো থাকতে পছন্দ করে। এককথায় ওর মাঝে কোনো চঞ্চলতা নেই। কিছুটা গম্ভীর স্বভাবের মেয়ে। ওর গায়ের রং অনন্যার থেকে কিছুটা ফ্যাকাশে। তবে ওর ঠোঁটের কোণে সবসময় মুচকি হাসি লেগেই থাকে, যা ওর সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয়। এই দিক থেকে অনন্যার সাথে ওর একটা মিল আছে। তবে ইলোরাকে পেলে ও অনেকটা পাল্টে যায়। কেন জানি ও অন্য সবার থেকে ইলোরার সাথে সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে। এমনকি ও যে কথা কারোর সাথে শেয়ার করে না সেই কথাও ইলোরার সাথে শেয়ার করে। ইলোরা আর ডালিয়ার বয়সের মাঝে মাত্র এক মাসের তফাৎ। ইলোরা ডালিয়ার থেকে এক মাসের বড়ো। ইলোরাকে পেলেই মনের সব কথা উজাড় করে দেয় ডালিয়া। ওর এই ব্যাপারটা সবাই জানে। তাই ইলোরা আর ও একসাথে হলে কেউ ওদেরকে বিরক্ত করে না। ইলোরা মৃদু হেসে এগিয়ে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে ডাকল,“ডালিয়া।”

ডালিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে ইলোরাকে দেখেই মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করল,“ইলো! তুই কখন এলি?”

ইলোরা মুখ বাঁকিয়ে বলল,“তা দেখার সময় আছে না-কি তোর? অনু আপ্পি চেঁচিয়ে ডাকল সবাইকে তখন তো গেলি না।”

“এমনিতেই যাইনি। ভেবেছি যেই আসুক পরে তো দেখতেই পাব। যদি আগে থেকে জানতাম তুই আসবি তাহলে ড্রয়িংরুমে বসে থেকে অপেক্ষা করতাম।”

ইলোরা অভিমানী সুরে বলল,“ওসব জানা আছে আমার। এই মালা গাঁথার অভ্যাসটা আর গেল না তোর।”

ডালিয়া পুনরায় মালা গাঁথায় মনোযোগ দিয়ে হেসে বলল,“আমি নিজে থেকে না ছাড়লে যাবে কী করে? মালা গাঁথতে খুব ভালো লাগে আমার। তাছাড়া এটা তো একটা ভালো কাজ। অবসর সময় কাটানো যায়। ফুলগুলো ঝড়ে পড়ে যাওয়ার পর এমনিতেই তো সেগুলো পা দিয়ে মাড়িয়ে নষ্ট করে দেয় সবাই। তার থেকে ভালো কুড়িয়ে এনে মালা গেঁথে তাকে একটা কাজে লাগানো। তুই নিজেও তো এই মালা পছন্দ করিস।”

“করি, কিন্তু গাঁথতে ইচ্ছা করে না।”

“কারণ তুই অলস। আমরা সবাই জানি।”

বলেই ডালিয়া শব্দ করে হেসে ফেলল। ইলোরা মুখটাকে বাংলার পাঁচ করে বলল,“আমি মোটেও এখন আর এমন না। আগে ছিলাম। কিন্তু এখন অনেকটা পরিবর্তন হয়েছি।”

“ওসব জানা আছে। এখন বল হুট করে কিছু না জানিয়ে এলি যে?”

ইলোরা ব্যাগ থেকে একটা থ্রি-পিস বের করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,“বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এসেছি। তবে যাওয়ার সময় তোকে সাথে নিয়ে ফিরব।”

ডালিয়া অবাক চোখে তাকাল। কিন্তু কিছু বলার আর সুযোগ পেল না। তার আগেই ইলোরা ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।


দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ইলোরার হঠাৎ মনে পড়ল গতকাল রাতে সে ভাইয়ের সাথে কথা বলে ফোন সুইচ অফ করে রেখেছিল। এখনও সেই অবস্থাতেই আছে। বাড়ি থেকে তার মা অনন্যার ফোনে কল করেছিল। তখন কথা বলে আর নিজের ফোনের কথা মনেই ছিল না। ভাই নিশ্চয়ই তার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে। ইলোরা তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে ফোন অন করে সাকিবের নাম্বারে ডায়াল করল। মিজানুর রহমান এরেনকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসেছেন। এরেন ইতোমধ্যে তার খালার জমির ব্যাপারে সব কথা খুলে বলেছে তাকে। সব শুনে মিজানুর রহমান এরেনকে আস্বস্ত করে বললেন,“এসব ঘটনা সচরাচর ঘটে। তুমি ভেবো না বাবা। এসব সমস্যা মাটি দেয়ার অভ্যাস আছে আমার। জমির সব কাগজপত্রগুলো দেখা প্রয়োজন একবার।”

এরেন বিরস মুখে বলল,“ওসব তো আমার খালার কাছে। ঠিক আছে, আমি তো একটু পর চলেই যাব খালার বাড়ি। আগামীকাল না হয় সব কাগজপত্র নিয়ে আসব আপনাকে দেখাতে।”

মিজানুর রহমান মাথা নেড়ে বললেন,“তার কোনো দরকার নেই। তুমি আমার বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছ। তাই এত তাড়াতাড়ি ছাড়ছি না তোমাকে। আজ আমার বাড়িতেই থাকবে। আগামীকাল আমি নিজে তোমার সাথে গিয়ে সব কাগজপত্র দেখে ওই লোকের সাথে কথা বলব।”

এরেন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। একটা মানুষের মন এত ভালো হয়! অপরিচিত একটা ছেলেকে সাহায্য করবে বলে নিজে যাবে সমস্যা সমাধানের জন্য। অন্য মানুষ হলে রাজি হতেই তো কত সময় নিত। এমন একটা ভালো মনের মানুষের কথার ওপরে আর কোনো কথা বলার সাহস পেল না এরেন। অগত্যা রাজি হয়ে গেল সে। মিজানুর রহমান অনেক সময় নিয়ে গল্প করলেন এরেনের সাথে। এরেনের পরিবার, লেখাপড়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। এক পর্যায়ে ছেলেটাকে তার খুব ভালো লেগে গেল। বয়স্ক লোকরা বেশিরভাগ এমনই হয়। যাদের সাথে কথা বলতে বলতে গল্পের আসর জমে যায় তাদেরকে হঠাৎ করেই ভালো লেগে যায় তাদের কাছে। মিজানুর রহমান আর এরেনের ক্ষেত্রেও এরকমটাই হয়েছে। এরেনও খুব আগ্রহ নিয়ে মিজানুর রহমানের সাথে গল্প করছে। হাসিখুশি এই মজার লোকটার সাথে গল্প করে তার বেশ আনন্দ লাগছে।


রাত প্রায় সাড়ে আটটা। এরেনকে যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছে সেই ঘরের বিছানায় আধশোয়া হয়ে সে ফেসবুক স্ক্রলিং করছে। হঠাৎই তার মনে হলো এই অসময়ে ঘরে বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না। এই সময় সে বাইরে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মশগুল থাকে। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে সে ফোন রেখে দিয়ে ভাবতে লাগল কী করা যায়। মিজানুর রহমান বাড়িতে নেই। উনি থাকলে গল্প করে অনেকটা সময় কাটানো যেত। বাড়িতে আছে শুধু তার মেয়েরা আর ইলোরা। মেয়েদের সাথে বেশি কথা বলতে তার ভালো লাগে না। তাছাড়া এ বাড়িতে আসার পর খাবার টেবিলে একবার মেয়েদের সাথে দেখা হয়েছিল। তারপর আর কারোর একটু কথার শব্দও শোনা যায়নি। এরেনের হঠাৎ মনে হলো বাইরে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করে আসা যায়। যদিও অনেক শীত পড়ছে, কিন্তু চাদর গায়ে জড়িয়ে গেলে সমস্যা হবে না। এরেন দ্রুত উঠে গায়ের জ্যাকেটের উপর ভালোভাবে চাদর জড়িয়ে নিল। তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বসার ঘরে আলিয়া বেগম সামনে পড়ল। এরেনকে দেখে তিনি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,“কোথায় যাচ্ছ?”

আসার পর থেকেই এই মহিলার কথা বলার ভাব-ভঙ্গি ভালো লাগছে না এরেনের। এই মহিলা যে হঠাৎ আসা মেহমানের উপর বিরক্ত তা বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি। সবচেয়ে বড়ো কথা, ইলোরার হঠাৎ আগমনকেও এই মহিলা সহজভাবে নিতে পারেননি। কেমন যেন সবসময় খোঁচা মেরে কথা বলার চেষ্টা করেন। অথচ তার স্বামী কত ভালো একজন মানুষ। এরেন এই মহিলার সামনে থেকে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ার জন্য মুচকি হেসে বলল,“বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি। ঘরে ভালো লাগছে না।”

আলিয়া বেগমকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই এরেন তাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত বাড়ির বাইরে পা রাখল। বাইরে বেরোতেই ঠান্ডা বাতাসে গায়ে হিম ধরে গেল। হাত দুটো চাদরের মধ্যে গুটিয়ে নিল সে। আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় বাইরের দৃশ্য স্পষ্ট। এরেন ধীর পায়ে হেঁটে চারপাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে বাড়ির পাশের বাগানে চলে গেল। এদের বাগানটা বেশ বড়ো মনে হচ্ছে। বাগানের চারপাশে অসংখ্য ফুল গাছ। বেশিরভাগ গাছেই ফুল ফুটে আছে। ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশটা। এরেন মুগ্ধ হয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ কারো হাসির শব্দ কানে আসতেই সে দাঁড়িয়ে পড়ল। এমন নিরিবিলি বাগানে মেয়েদের হাসির শব্দ আসছে কোত্থেকে! ভাবতে ভাবতে আরো কয়েক পা এগিয়ে যেতেই হঠাৎ একটা দৃশ্য দেখে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার কয়েক হাত দূরেই দুজন শাড়ি পরিহিতা নারী একটা মস্ত বড়ো গাছের নিচে বেঞ্চে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর খিলখিল করে হেসে উঠছে। একজন মনে হচ্ছে মুচকি হাসছে। আরেকজন বাগান কাঁপিয়ে হেসে চলেছে। তার হাসির শব্দই কানে এসেছে এরেনের। এরেন একটা বড়ো গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকাল। একটা মেয়ের মুখ ভালোভাবে দৃশ্যমান হতেই সে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। খোপায় বেলী ফুলের মালা পেঁচানো,‌ মুখে কোনো সাজগোজ ছাড়া লাল শাড়ি পরিহিতা হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটা ইলোরা! চাঁদের আলো চোখেমুখে পড়ায় তাকে খুব স্নিগ্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে গতকাল রাতের সেই ভীতু চেহারার ইলোরা আর এখনকার হাস্যোজ্জ্বল ইলোরার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। মেয়েটা তো ভূতে ভয় পায়। গতকাল কেমন লাফিয়ে উঠেছিল ভূতের ভয়ে। আজকে যে এমন একটা বাগানের মধ্যে শুধু চাঁদের আলোয় বসে আছে, ভয় করছে না? নাকি অতি আনন্দে ভূতের ভয় ভুলে বসে আছে? গতকাল রাতে ইলোরার বলা বোকা বোকা কথা মনে পড়তেই এরেন মুচকি হাসল। শাড়িতে মেয়েটার সৌন্দর্য দেখে কেন জানি চোখ ফিরিয়ে নিতে পারল না এরেন। মুগ্ধ চোখে সে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঘোরের মধ্যে নিজের অজান্তেই একটা কাজও সে করে বসল। হুট করে হাতের ফোনটা উঠিয়ে কয়েকটা ক্লিক করে বসল। কাজটা করে সে নিজেই হতবাক হয়ে গেল। এসব কী করছে সে! সে তো মেয়েদের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয় না কখনও। তাহলে আজ হঠাৎ এমনটা কেন হলো? এই মেয়েটাকে দেখে সে মুগ্ধ হলো কেন? কেনই বা মেয়েটার থেকে দৃষ্টি ফেরাতে ইচ্ছে করছে না? আর কেনই সে এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়েটার ছবি তুলল? তার তো এই কাজের জন্য অনুশোচনা হওয়ার কথা। কই? তাও তো হচ্ছে না। আচ্ছা, সে কি সত্যি সত্যিই এই মেয়েটার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে গেছে। তার কারণ কী? মেয়েটা তার স্ত্রী বলে? স্ত্রী! সত্যিই তো, এই মেয়েটা তার স্ত্রী। কথাটা মনে হতেই এরেন চমকে উঠল। হঠাৎই তার মনে হলো চোখের সামনে শাড়ি পরিহিতা এই অসম্ভব সুন্দর মেয়েটা তার সদ্য বিয়ে করা বউ। তারা মানুক আর না মানুক, আজ ভোরবেলা তো সত্যি সত্যিই তাদের বিয়ে হয়েছে। কেউ না মানলেও বিয়েটা তো মিথ্যা হয়ে যাবে না। কিন্তু সে নিজেই তো ইলোরাকে বলেছে যে এই বিয়েটা সে মানে না। তাহলে এখন এসব ভাবার মানে কী? সে কেন এসব কথা ভাবছে? এই মেয়েটার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো অধিকার তার আছে। কিন্তু সে তা চায় না। মেয়েটা গতকালও তার অপরিচিত ছিল। আর আগামীকাল এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আবার সেই অপরিচিতই হয়ে যাবে। তাই এই ক্ষণিকের ভালো লাগার কোনো মানেই হয় না। না তার জীবনে বিয়ে নামক কোনো এক্সিডেন্ট ঘটেছে, না তার বউ নামক কেউ আছে, আর না সে এক মুহূর্তের জন্য কারো সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছে। সব কিছু ভুল, মিথ্যা, দুঃস্বপ্ন! এসব ভাবনা জোর করে নিজের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে এরেন দ্রুত পায়ে সেখান থেকে সরে গেল। আর এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়ানো ঠিক হবে না। মাত্র কয়েক মুহূর্তেই সে যা করে বসল তাতে আরও কিছুক্ষণ পর সে নির্ঘাত মেয়েটার প্রেমে পড়ে যেত। কিন্তু সে চায় না এই মেয়েটার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হতে বা তার প্রেমে পড়তে। এরেন প্রস্থান করতেই ডালিয়া হঠাৎ ইলোরাকে উদ্দেশ্য করে বলল,“মনে হচ্ছে এখানে কেউ এসেছিল।”

ইলোরা নিজের হাসি থামিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,“কোথায়?”

“হঠাৎ মনে হলো আশেপাশে কেউ ছিল।”

ইলোরা পাত্তা না দিয়ে বলল,“ধুর, ওসব তোর মনের ভুল। আচ্ছা শোন এত কথার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই বলা হয়নি।”

ডালিয়া প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“কী?”

ইলোরা মিষ্টি হেসে বলল,“তোকে আজ খুব বেশি সুন্দর লাগছে। সহজে তো শাড়ি পরিস না। আমি এলেই আমার সাথে দু একবার পরিস। শাড়িতে তোকে খুব মানায়, জানিস?”

ডালিয়া ঠোঁট উল্টে বলল,“আমার শাড়ি পরতে ভালো লাগে না। তুই এলে তো বাধ্য করিস, সেজন্যই পরি।”

ইলোরা দাঁত কেলিয়ে হাসল। ডালিয়া সত্যিই শাড়ি পরতে পছন্দ করে না। সাজগোজও করে না কখনও। ইলোরার সাথে একত্রিত হলেই ইলোরা ধরেবেঁধে শাড়ি পরায় ওকে। ডালিয়াও ইলোরার কাছে হার মেনে বাধ্য হয়ে শাড়ি পরে হালকা সাজগোজ করে। রাতে দুজন মিলে একরকম শাড়ি পরে বাইরে বসে আড্ডা দেয়। এটা তাদের অভ্যাস বলা চলে।

চলবে…………………….🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here