#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৫০
সারারাত ভারী বর্ষণ হওয়ার পর সকালটা ঝকঝকে লাগছে। আকাশে শুভ্র মেঘেদের দল ছুটে বেড়াচ্ছে। তার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরেছে সূয্যিমামা। বৃষ্টির পানির ছোঁয়ায় গাছের সবুজ পাতাগুলো চকচকে হয়ে গেছে। নানান রকম পাখিদের দল কিচিরমিচির কলরব তুলে নীর ছেড়ে বেরিয়েছে খাবারের খোঁজে। শহরের পিচ ঢালা রাস্তায় একেক জায়গায় অল্প কিছু পানি জমে আছে। সেসব ডিঙিয়ে লোকজন ছুটে চলেছে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে, কেউবা চলেছে নিজ নিজ কর্মস্থলে। গাড়িগুলো সাঁই সাঁই করে একদিক থেকে আরেকদিকে ছুটে চলেছে। চারপাশে যানবাহনের হর্নের শব্দ আর লোকজনের হট্টগোল। কিছুক্ষণ পরে স্কুলের বাচ্চাদেরও যেতে দেখা যাবে। বেলকনিতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে উদাসী দৃষ্টিতে বাইরের প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত ইলোরা। কিন্তু সেসবে তার মনোযোগ নেই। মনটা একরাশ কালো ঘন মেঘে ছেয়ে আছে। এই মেঘ সরে আদৌ তার মনের আকাশে শুভ্রতা ছড়াবে কি না সে বিষয়ে সে যথেষ্ট সন্দিহান। বাকি তো শুধু আজকের দিনটা। তারপর? সব শেষ। ‘শেষ’ শব্দটা মস্তিষ্কে কড়া নাড়লেই তার চোখ দুটো জ্বলতে শুরু করে। তারপরই ধীরে ধীরে নামে ভারী বর্ষণ। সকাল সকাল সে সাহস করে মালিহা বেগমের থেকে ফোন চেয়েছিল। কিন্তু মালিহা বেগম ফোন তো দিলেনই না, উলটো বলে দিলেন পরশু যেহেতু বিয়ে সেহেতু বিয়ের আগে আর ভার্সিটিতে যাওয়ার দরকার নেই। ইলোরা কোনো প্রতিউত্তর না করে চুপচাপ চলে এসেছে। আজ তার ভার্সিটি যাওয়াটা খুবই প্রয়োজন। এরেন বলেছে আজ সে যে করে হোক সাকিবের সাথে কথা বলবে। ইলোরার হাতের মুঠোয় থাকা ডালিয়ার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। এরেনের মেসেজ এসেছে। একটা ভয়েস রেকর্ডিং। ইলোরা রেকর্ডিংটা চালু করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এরেনের ভাঙা ভাঙা কন্ঠ শোনা গেল।
আপাতত ছুঁয়ে ফেলুক যত একাকীত্ব,
জানি তোমাকে কাছে পেলে যাবতীয় সবই তুচ্ছ,
আপাতত ঘিরে ফেলুক যত অসুখ,
জানি তুমিই কেবল সুস্থতা আমার, হে প্রিয়মুখ।
আপাতত জড়িয়ে ধরুক তীব্র যন্ত্রণা, নামুক অন্ধকার আরও,
আমি জানি, স্পর্শ পেতে ইচ্ছে হয় তোমারও।
(কবি: রায়হানূল সেজান)
ইলোরার চোখ দুটো জলে ভরে গেল। এই মুহূর্তে তার সত্যিই ইচ্ছে হচ্ছিল এরেনের একটু স্পর্শ পেতে। তার কন্ঠটা শোনার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে ছিল। এরেনের কবিতা আবৃত্তি শুনে নিজেকে আরও একা লাগতে শুরু করেছে। ইলোরা একই রেকর্ডিং বারবার শুনছে আর নীরবে চোখের পানি মুছছে। কিন্তু এরেনের কন্ঠটা তার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কেমন যেন জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠস্বর। কিছুক্ষণের মধ্যেই এরেনের ফোন এল। ইলোরা সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করে কানে ধরে হ্যালো বলল। এরেন ভাঙা গলায় বলল,“গুড মর্নিং মিসেস। আবৃত্তি ভালো লেগেছে?”
ইলোরা ধরা গলায় বলল,“সকাল সকাল আমাকে কাঁদানোর ইচ্ছে জেগেছিল তোমার?”
এরেন হালকা হেসে বলল,“এমন মনোমুগ্ধকর কবিতা শুনে তোমার মন ভালো হওয়ার বদলে কান্না পেল? ছিঁচকাদুনে বউ রে!”
“কবিতার একেকটা শব্দ খেয়াল করেছ তুমি? হৃদপিন্ড কেঁপে ওঠে।”
“সেজন্যই তো তোমাকে শুনালাম। কোথায় তুমি কবির লেখা আর আমার আবৃত্তির প্রশংসা করবে। তা না করে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছ।”
“ফাজলামি করবা না। তোমার কন্ঠ এমন লাগছে কেন?”
“ঠান্ডা লেগেছে।”
“বলেছিলাম না ঠান্ডা লাগবে? দেখলে তো?”
“কমে যাবে। ভার্সিটিতে যাবে তো?”
ইলোরা মুখ ভার করে বলল,“আম্মু বলে দিয়েছে বিয়ের আগে আর যাওয়ার দরকার নেই। কী করব আমি এখন?”
“সাকিব যাবে না?”
“না। আজই লাস্ট চান্স। কী করবে এখন আর তুমি? সব চেষ্টা ব্যর্থ।”
“বিয়ের কথা জানিয়ে দিব।”
ইলোরা চমকে উঠে বলল,“আমি নিশ্চিত সম্পর্কটা কেউ মানবে না। উলটো তোমার থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিবে। আর নয়তো এই পরিবারকেই ছাড়তে হবে আমায়। কিন্তু তারপর? এই পরিবার ছেড়ে গিয়ে তোমার কাছে উঠলে তোমার বাবা মেনে নিবে না। তুমি তার কথা অমান্য করে আমাকে রাখলে উলটো তোমার সাথে তোমার বাবার সম্পর্কে ফাটল ধরবে।”
এরেন গম্ভীর গলায় বলল,“কী চাইছো বলো তো তুমি? কখনও বলছো, আমাকে নিয়ে যাও তোমার কাছে। কখনও বলছো, পরিবার ছাড়তে পারবে না, এ মানবে না, ও মানবে না। তাহলে এক্সাক্টলি কী চাইছো তুমি? বিয়ে করবে ঐ লোকটাকে?”
ইলোরা অসহায় মুখে বলল,“রেগে যাচ্ছ কেন তুমি? আমার কাছে তো কোনো অপশন নেই।”
এরেন এবার সত্যি সত্যিই রাগত কন্ঠে বলল,“অপশন বের করলে তো পাবে। তুমি আসলে কী চাও তা তুমি নিজেই জানো না। তোমার জন্য আমিও কিছু করতে পারছি না। সাকিবের সাথে তো মনে হচ্ছে আজও আমি কথা বলতে পারব না। কী করবে তাহলে? অপশন একটাই, আমাকে ছেড়ে ঐ লোকটাকে বিয়ে করা। আর কোনো অপশনই যখন কাজে আসবে না তখন এটাই চয়েস করে নাও। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি আমার মতো থাকব। তুমি অন্য কারো সাথে সুখী হলে আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করব না।”
এরেনের প্রত্যেকটা কথার সাথে সাথে ইলোরার চোখের পানি ঝরে পড়ছে। এবার সেও কপট রাগ দেখিয়ে বলল,“সবাই মিলে কি আমাকে মেরে ফেলতে চাইছ? তোমারও মুক্তি লাগবে আমার থেকে? তাতেই হয়তো তুমি চিন্তামুক্ত হবে। কিন্তু আমি তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তোমাকে মুক্তি দিতে পারব না। মুক্তি দিলে আমি সবাইকে একসাথেই মুক্তি দিব। সবার গলায় কাঁটার মতো বিঁধে আছি তো আমি? কাঁটাটাই যদি না থাকে তাহলে সবাই তো নিশ্চিন্ত থাকবে। কাল সকালের মধ্যে যদি খবর পাও তোমার ইলোনি সবাইকে মুক্তি দিয়ে পৃথিবী ছেড়েছে, তাহলে আর কেউ না করলেও তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
এরেন কাঁপা গলায় গর্জে উঠল,“ইলোরা! মুখ সামলে কথা বলো। আমি চাই না তোমার ওপর রাগ দেখাতে।”
ইলোরা কাঁদতে কাঁদতে বলল,“আর কিছু সহ্য করার ক্ষমতা নেই আমার। আমি মরে গেলে সবাই শান্তি পাবে।”
“আবারও বলছি চুপ করো। মরার শখ জাগলে আমার সামনে এসে মরো। আর একবার এসব আজেবাজে বকলে আমি নিজে গিয়ে মেরে আসব।”
“তা-ই করো। আমি এখন এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চাই। মরতে হলে তা-ই করব।”
এরেন দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত মুখে ধমকে উঠল,“ইলোরা!”
ইলোরা তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে টেনে বলল,“বাহ্! ইলোনি হঠাৎ ইলোরা হয়ে গেল?”
এরেন একইভাবে রাগে গজগজ করতে করতে বলল,“আই সেইড, সাট আপ স্টুপিড। মরবে তো? যাও মরো। আমি কে? আমার ওপর বিশ্বাস, ভরসা রাখা যায় না-কি? মরতে না পারলে বিয়ে করে নাও। ঐ লোক তোমাকে আমার থেকেও বেশি ভালো রাখবে। তোমার ফ্যামিলির তো তা-ই ধারণা। তুমিও তাদের বধ্য মেয়ে হয়ে বিয়ে করো। আমাকে নিয়ে ভাববে না। উইশ ইউ আ হ্যাপি ম্যারিড লাইফ। গুড বাই।”
এরেন ফট করে ফোনটা কেটে দিলো। ইলোরা থমকে গেল। এতক্ষণ কী থেকে কী হলো সবকিছু মাথায় গোলমাল পাকিয়ে ফেলল। এরেন তার ওপর এতটা রাগ আজই প্রথম দেখাল। কিন্তু কেন? এমন পরিস্থিতিতে এসেই তাকে এমন আচরণটা করতে হলো? সে যে মনের কষ্টে এসব আজেবাজে বকেছে তা কি বুঝতে পারেনি? ইলোরা নিজেকে ধাতস্থ করে এরেনের নাম্বারে ডায়াল করল। পর পর কয়েকবার ফোন করার পরেও এরেন রিসিভ করল না। অভিমান আর কষ্টে ইলোরার চোখের জল বাঁধ মানল না। ডালিয়া এসে ইলোরার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই ইলোরা নিজেকে সামলে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,“তুই ভার্সিটিতে যাবি?”
ডালিয়া অলসভাবে বলল,“আমার শরীরটা ভালো লাগছে না রে। যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তোর যাওয়া দরকার।”
ইলোরা মাথা দুলিয়ে বলল,“উপায় নেই।”
তখনই ইলোরার হাতের মুঠোয় ফোনটা পুনরায় বেজে উঠল। ইলোরা এরেনকে ভেবে রিসিভ করতে গিয়ে দেখল আননোন নাম্বার। হতাশ হয়ে ডালিয়ার দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল,“দেখ তো কে ফোন করেছে।”
ডালিয়া ফোনটা হাতে নিয়ে নাম্বার দেখে বলল,“নাম্বার চিনি না।”
ডালিয়া ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে সালাম দিলো। ওপাশ থেকে সালামের জবাব দিয়ে জারিন উদ্বিগ্ন গলায় বলল,“ডালিয়া, আমি জারিন বলছি। ভাবি কোথায়?”
ডালিয়া ইলোরার দিকে তাকিয়ে বলল,“আপু, কেমন আছো? ইলো এখানেই আছে।”
ইলোরাকে নিয়ে কথা হচ্ছে বুঝতে পেরে সে ভ্রু কুঁচকে ডালিয়ার মুখের দিকে তাকাল। জারিন বলল,“ভালো আছি। ভাবির কাছে একটু দাও প্লিজ।”
ডালিয়া আচ্ছা বলে ইলোরার হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,“জারিন আপু, কথা বল।”
ইলোরা নিজেকে সামলে নিয়ে বড়ো একটা শ্বাস নিল। ফোনটা কানে ধরে বলল,“হ্যালো আপু, কেমন আছো?”
ইলোরার কথাটা এড়িয়ে গিয়ে জারিন পূর্বের ন্যায় উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,“ভাবি, ভাইয়া তোমার সাথে ইচ্ছে করে রাগ দেখায়নি। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি। ও তোমাকে মিথ্যে বলেছে। ওর শুধু ঠান্ডা লাগেনি। কাল রাতে ভিজে চুপচুপে হয়ে বাসায় ফেরার পরই হঠাৎ ভয়ানক জ্বর এসেছে। এখনও পর্যন্ত কিছু মুখেও তোলেনি। তাই মেডিসিনও খাওয়াতে পারছি না। জ্বরের কারণেই তোমার কথায় এভাবে রেগে গেছে। প্লিজ তুমিও রেগে থেকো না। আমার ভাইটা খুব কষ্ট পাচ্ছে ভাবি। শুধু মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারছে না।”
ইলোরা স্তব্ধ হয়ে গেল। মানুষটার সাথে কিছুক্ষণ আগে কথা বলেও সে বুঝতে পারেনি মানুষটার অবস্থা কী। কেমন স্ত্রী সে! ইলোরা কিছু বলতে গিয়েও কথাগুলো গলায় দলা পাকিয়ে আটকে গেল। জারিন এবার অনুরোধের সুরে বলল,“ভাবি, আমি জানি আর কোনো উপায় নেই তোমাদের কাছে। তুমি চলে আসো প্লিজ। বাবা এখন না মানলেও পরে ঠিকই মানবে। তোমার ফ্যামিলির সবাইও হয়তো পরে মেনে নিতে পারে। এত ভয় পেয়ো না। পরে দেখবে তোমার আগে আমার ভাইয়ারই কিছু একটা অঘটন ঘটে যাবে। ভাইয়াকে আমি কোনোদিন এতটা ভেঙে পড়তে দেখিনি ভাবি। আম্মুও কান্নাকাটি করছে। তোমার কাছে রিকোয়েস্ট করছি, বাড়ি ছেড়ে না এলেও একবার এসে ওকে দেখে যাও প্লিজ। আমি জানি, তোমাকে দেখলে ও অনেকটা সুস্থ হয়ে যাবে। না কোরো না ভাবি। আসবে?”
জারিন কাঁদছে। ইলোরাও নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। কিন্তু জারিনের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না সে। দিবেই বা কীভাবে? সে তো বাড়ি থেকেই বেরোতে পারবে না। জারিন বারবার অনুরোধ করে চলেছে। ইলোরা কোনোমতে শুধু এটুকু বলল যে সে চেষ্টা করে দেখবে। জারিন জানাল ইলোরা যদি যায় তবে সে নিজে এসে নিয়ে যাবে। ফোন রেখে ইলোরা ডালিয়ার কাছে এরেনের অবস্থার কথা বলল। ডালিয়া কিছুক্ষণ গভীর চিন্তা করে বলল,“আমি একটা বুদ্ধি বের করেছি। বলব?”
“বল।”
“অরি ছাড়া ওদের সবাইকে বাসায় আসতে বলি। ওরা এসে বলবে অরি খুব অসুস্থ। সবাই ওকে দেখতে যাচ্ছে। ফুপি তো অরিকে খুব ভালোভাবেই চেনে। ওর অসুস্থতার কথা শুনলে হয়তো তোকে যেতেও দিতে পারে।”
ইলোরা আগ্রহী হয়ে বলল,“তারপর?”
“সবার সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গলির মোড় পর্যন্ত যাবি। জারিন আপুকে বলবি তোর জন্য ওখানে অপেক্ষা করতে। তারপর তুই আপুর সাথে চলে যাবি আর ওরা যার যার বাড়ি চলে যাবে। ভার্সিটিতে গেলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আছে।”
“তুই কী করবি?”
“আমি কোথাও যাব না রে। এমনিতেই শরীরটা খারাপ লাগছে।”
“তাহলে আমি ফিরব কার সাথে?”
“তাহসিনকে বলে দেবো তোকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।”
ইলোরা মাথা দোলালো। ডালিয়া কিছুটা ভেবে আবার বলল,“ইলো, কালই তো গায়ে হলুদ। আজ থেকেই বাড়িতে মেহমান আসা শুরু করবে। অথচ এখন পর্যন্ত তোরা কোনো কিছুই ঠিক করতে পারলি না। এসবের মানে কী? তুই বিয়েটা করবি?”
ইলোরা চোখ বন্ধ করে হতাশ ভঙ্গিতে বলল,“জানি না।”
“ওই বাড়িতে গিয়ে আর ফিরিস না ইলো। জারিন আপুর সাথে আমিও একমত।”
ইলোরা অসহায় মুখে ডালিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,“তুইও এটা বলছিস?”
ডালিয়া মাথা দুলিয়ে বলল,“হ্যাঁ। যাকে ছেড়ে থাকতেই পারবি না, তার কাছে চলে যাওয়াই ভালো। তাছাড়া সে তোর বয়ফ্রেন্ড না, তোর হাসবেন্ড। সম্পর্কের জোরে আপাতত অন্য সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। কারণ বেশিদিন কেউই তোদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না। ভেবে দেখ ইলো। ভাইয়াকে একবার ছাড়লে আর ফিরতে পারবি না তার কাছে।”
ইলোরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চিন্তায় মাথাটা ওলোট-পালোট হয়ে গেছে। ডালিয়া বন্ধুদের সবাইকে ফোন করে সব বুঝিয়ে বলল। সবাই এক কথায় রাজি হয়ে গেল। ইলোরাও জারিনকে ফোন করে বলে দিলো সে যেন মোড়ে অপেক্ষা করে। এরেনের জন্য দুশ্চিন্তায় ইলোরা সকালের খাবারও খেল না। কেউ তাকে জোরও করল না। সাকিব আর সাজিদ হোসেন খেয়েদেয়েই বেরিয়েছেন যাদের যাদের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করবেন তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সকাল নয়টার দিকে তাহসিন, মুনা, নাদিয়া আর টুম্পা ইলোরাদের বাড়ি এল। তাদের দেখে মালিহা বেগম বেশ খুশি হলেন। কারণ তিনি ভেবেছেন এরেনের সাথে ইলোরার সম্পর্কের কথা তার বন্ধুরাও জানে না। ইলোরার বন্ধুদের সুন্দর ব্যবহারে মালিহা বেগম বরাবরই মুগ্ধ। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। সবাই এসে হাসিমুখে মালিহা বেগমের সাথে কুশল বিনিময় করতেই তিনি গলে গেলেন। অনন্যাকে নিয়ে খাবার সাজিয়ে দিলেন সবার সামনে। তারপর যখন অরিশার অসুস্থতার কথা শুনলেন তখন তার মনটাও খারাপ হয়ে গেল। অনেকক্ষণ অবধি সবাই মিলে মালিহা বেগমের মনটা দুঃখ ভারাক্রান্ত করে তারপর তুলল আসল কথা। কথার ফাঁকেই মুনা বলে বসল,“আন্টি, আমরা এখন অরিদের বাড়ি যাব। বলছি যে, বিয়ের পর ইলো ইচ্ছে করলেই সবজায়গায় যেতে পারবে কি না তার তো ঠিক নেই। তাই অরি বলছিল আজ আমাদের সাথে ইলোকে নিয়ে যেতে। কিন্তু ইলোকে ফোন করে ওর ফোন বন্ধ পেলাম। ডালিয়াকে ফোন করে জানলাম আপনি ইলোকে বিয়ের আগে বাড়ি থেকে বেরোতে না বলেছেন। তাই নিজেরাই বাসায় চলে এলাম।”
মালিহা বেগম মুখে হাসি টেনে বললেন,“হ্যাঁ। আসলে মা, বিয়ে তো পরশুদিনই। তাই এখন বেরোতে না বলেছি।”
টুম্পা বলল,“আন্টি, আমাদের সাথে ওকে নিয়ে যাই? মানে, অরি অনেক করে বলেছে তাই আরকি।”
নাদিয়াও তাল মিলিয়ে বলল,“আমরা বিকালের মধ্যেই চলে আসব আন্টি।”
মালিহা বেগম ইতস্তত করে বললেন,“কিন্তু ডালিয়ার শরীরটা তো ভালো নেই।”
তাহসিন বলল,“আন্টি, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি নিজে ইলোকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাব।”
এভাবেই নানান কথার ছলে ওরা সবাই মিলে মালিহা বেগমকে রাজি করিয়ে ছাড়ল। মালিহা বেগমের অনুমতি পেয়েই ইলোরা ঝটপট রেডি হয়ে নিল। তারপর সবাই মালিহা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। পায়ে হেঁটে গলির মোড় পর্যন্ত আসতেই জারিনকে চোখে পড়ল। জারিন আগে থেকেই একটা টেক্সি ঠিক করে রেখেছিল। ইলোরাকে দেখে সে এগিয়ে গিয়ে তাড়া দিলো। ইলোরা বন্ধুদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জারিনের সাথে টেক্সিতে চড়ে বসল। গন্তব্য তার প্রিয় মানুষটার বাড়ি। গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল সাড়ে দশটা বাজল। জাকির জামান সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাড়ি থাকেন না বলেই জারিন ইলোরাকে বাড়িতে আনার প্ল্যানটা করেছিল। বাড়িতে পা রাখতেই আন্নি হক ছুটে এলেন। ইলোরা তার পা ছুঁয়ে সালাম করল। আন্নি হক ইলোরাকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। ইলোরার চোখ দুটোও ছলছল করে উঠল। জারিন মাকে শান্ত করে ইলোরাকে নিয়ে দোতলায় নিজের রুমে চলে গেল। ইলোরা বলল,“আপু, তোমার ভাইয়ের রুম তো নিচে। তোমার রুমে নিয়ে এলে যে?”
জারিন মলিন হেসে কাবার্ড থেকে একটা প্যাকেট বের করে ইলোরার হাতে ধরিয়ে দিলো। ইলোরা কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,“কী এটা?”
“তোমার বর তোমার জন্য কিনে আমার কাছে রেখেছিল। দেয়ার সুযোগটা আর হয়ে ওঠেনি। এটার ভেতর শাড়ি আর বাকি সবকিছুই আছে। এসেছ যখন এটা পরেই ভাইয়ার সামনে যাও। দেখবে ও খুশিতেই একদম সুস্থ হয়ে যাবে। একা পরতে পারবে না-কি হেল্প লাগবে?”
ইলোরা বলল,“পারব।”
“তাহলে পরে নাও। আমি নিচে যাচ্ছি। তুমি রেডি হতে হতে চলে আসব।”
ইলোরা মাথা দোলালো। জারিন হালকা হেসে চলে গেল। ইলোরা গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। তারপর এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটা খুলে ফেলল। একটা লাল পেড়ে কালো শাড়ি, কালো ব্লাউজ, পেটিকোট, দুমুঠো লাল আর কালো কাঁচের চুড়ি, সিলভার কানের দুল, কাজল আর লাল লিপস্টিক পেল। ইলোরা বিস্ময় নিয়ে সবকিছু নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। প্রিয় মানুষের পছন্দের জিনিসগুলো পেয়ে খুশিতে চোখের কোণে পানি জমে গেল। আদৌ এটাকে খুশি বলে কি না সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়। ইলোরা যতটা দ্রুত সম্ভব শাড়ি পরে নিল। ব্লাউজটা একদম ঠিক মাপের হয়েছে। হয়তো এতে জারিনের ভূমিকা আছে। শাড়ি পরা শেষ করে ইলোরা চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিলো। কানে দুল আর দুই হাতে চুড়ি পড়ল। তারপর চুলগুলো আঁচড়ে পিঠে ছড়িয়ে দিলো। নিজেকে আয়নায় পর্যবেক্ষণ করার সময়ই দরজায় টোকা পড়ল। জারিন এসেছে। ইলোরা তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিলো। জারিন ইলোরাকে দেখে অবাক হয়ে বলল,“মা শা আল্লাহ্! তোমার প্রশংসা করলে আজ কম পড়ে যাবে ভাবি। তাই আজ আর আমি প্রশংসা করতে চাই না। সব প্রশংসা আমার ভাইয়াই করুক। কী বলো?”
জারিন দুষ্টু হাসছে। ইলোরাও মলিন হাসল। জারিন ইলোরার হাত ধরে নিচে নিয়ে এল। আন্নি হক ইলোরাকে দেখে হা করে তাকিয়ে রইলেন। হাসিমুখে ইলোরার কপালে চুমু এঁকে দিলেন। জারিন ইলোরাকে নিয়ে এরেনের রুমের দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,“ভাইয়া ঘুমাচ্ছে। তোমার সাথে কথা বলার পর ঘুমিয়ে পড়েছে, আর ওঠেনি। গিয়ে ঘুম ভাঙাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
কথাগুলো বলেই জারিন হেসে ছুটে চলে গেল। ইলোরা কিছু বলার সুযোগটুকুও পেল না। সে দরজার সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে উস-খুস করতে লাগল। এতক্ষণ অবধি মানুষটাকে এক নজর দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে ছিল। অথচ এখন লজ্জা আর অস্বস্তি লাগছে। মিনিট তিনেক একইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ইলোরা বড়ো একটা দম নিয়ে সাহস জুগিয়ে দরজার নব ঘুরাল। আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে অসুস্থ এরেনের ঘুমন্ত মলিন মুখটায় চোখ আটকে গেল। সদা হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটাকে এলোমেলো রূপে দেখে ইলোরার চোখ দুটো জ্বলতে শুরু করল। ঠোঁট দুটোও কেঁপে উঠল। ইচ্ছে করল ছুটে গিয়ে মানুষটাকে আঁকড়ে ধরতে। কিন্তু কেন জানি সে এক চুলও নড়তে পারল না। মনে হলো পা দুটো কোনোরকমে সমস্ত শরীরের ভর বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মস্তিষ্ক যেন বারবার বলে চলেছে,“এগিয়ে যা ইলো। এটাই তোর আসল গন্তব্য।”
চলবে………………🌸