#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৫৩
‘তমাল বিয়েতে না বলে দিয়েছে।’
কথাটা শোনামাত্র ইলোরা লাফিয়ে উঠল। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতেই অনন্যা এসে খবর দিলো গতকাল রাত দুইটার দিকে তমালের বাবা নিজে ফোন করেছিলেন। তিনি জানিয়েছেন তমাল সিলেট চলে গেছে। সে না-কি এই বিয়েটা করতে চায় না। কিন্তু এর বিশেষ কোনো কারণ জানায়নি। ইলোরা বেশ অবাক হলো। আজ গায়ে হলুদ আর তমাল কোনো কারণ ছাড়াই বিয়ে করবে না বলে সিলেট চলে গেল! এটা কীভাবে সম্ভব? তমাল তো বলেছিল সে কোনোভাবেই বিয়েটা ভাঙতে পারবে না। তাহলে হঠাৎ করে কী এমন হলো যে এক রাতেই সব সিদ্ধান্ত পালটে ফেলল? কিন্তু এই খবরটা শুনে যেন ইলোরার বুকের ওপর থেকে ভারী পাথর নেমে গেল। ফজরের নামাজ আদায় করে সে মন ভরে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া জানাল। এরেন বলেছিল ফজরের নামাজের পরপরই ইলোরাকে নিয়ে যাবে। ইলোরা এরেনকে সুখবরটা জানানোর জন্য নামাজের পর ফোন করল। কিন্তু এরেনের ফোন বন্ধ পেল। কয়েকবার ফোন করার পরেও যখন বন্ধ পেল তখন ইলোরা কিছুটা অবাক হলো। কারণ এতক্ষণে এরেনের নিজে থেকেই ফোন করার কথা ছিল। অথচ সে ফোনটাই বন্ধ করে বসে আছে! জারিনকে ফোন করার কথা ভেবেও এত সকালে ফোন করা ঠিক হবে কি না ভেবে করল না। এরেনকে পরে জানানো যাবে ভেবে ইলোরা উৎফুল্ল মনে রুম থেকে বেরিয়ে এল। প্রথমেই পড়ল মায়ের সামনে। মাকে দেখে ইলোরা কিছুটা জড়তা অনুভব করলেও মালিহা বেগম স্বাভাবিকভাবেই বললেন,“রাতে তো ঠিকমতো খাসনি। ফ্লাক্সে চা রাখা আছে। আপাতত চা বিস্কুট খেয়ে নে।”
ইলোরা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। গতকাল রাত পর্যন্তও মাকে সে থমথমে মুখে দেখেছে। অথচ এখন মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। মালিহা বেগম তাড়া দেখিয়ে অনন্যাকে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ইলোরা বিস্ময় নিয়েই ফ্লাক্স থেকে এক কাপ চা ঢেলে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। এরইমধ্যে সাজিদ হোসেন এলেন। বাবাকে দেখেই ইলোরা মাথা নিচু করে ফেলল। বুকটা ধুকধুক শব্দ করতে লাগল। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। এরেনের সাথে সম্পর্কের কথা জানানোর পর থেকে এখনও পর্যন্ত সে তার বাবার সামনে খুব একটা পড়েনি। আর আজ তো আকস্মিকভাবে বিয়েটাও ভেঙে গেল। ইলোরাকে অবাক করে দিয়ে সাজিদ হোসেন বললেন,“আমাকে এক কাপ চা দে তো মা।”
ইলোরা চট করে মাথা তুলে তাকাল। সাজিদ হোসেন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ার টেনে আয়েশ করে বসলেন। ইলোরা চেহারায় বিস্ময় নিয়েই এক কাপ চা ঢেলে বাবার দিকে এগিয়ে দিলো। সাজিদ হোসেন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করলেন,“তোর আম্মু কোথায়?”
ইলোরার যেন হুঁশ ফিরল। সে আমতা-আমতা করে বলল,“হুঁ? আম্মু? আম্মু তো রান্নাঘরে।”
ইলোরা ভালোভাবে তাকাতেই দেখল সাজিদ হোসেন যতটা দ্রুত সম্ভব চা পান করছেন। অথচ প্রতিদিন তিনি খুব আরামসে চা পান করেন। ইলোরার মনে প্রশ্ন জাগলেও সে চুপ রইল। সাজিদ হোসেন মাত্র চার/পাঁচ মিনিটেই চা শেষ করে উচ্চস্বরে মালিহা বেগমকে ডাকলেন। ডাক শুনে মালিহা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। সাজিদ হোসেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মালিহা বেগমকে বললেন,“আমি ভাইজানকে নিয়ে বাজারে যাচ্ছি। সাকিব এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি?”
মালিহা বেগম বললেন,“না, আমি এখনই উঠতে বলছি। ভাইজান কোথায়?”
“বাইরে আছে মনে হয়। সাকিবকে তাড়াতাড়ি জাগাও। কাজ ফেলে ঘুমালেই তো হবে না।” বলতে বলতে সাজিদ হোসেন প্রস্থান করলেন। ইলোরা ভ্রুকুটি করে ভাবল, বিয়ে তো হচ্ছে না। তাহলে এত কাজ কিসের? বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে তো কেউ কিছু বলছেও না। এতক্ষণে তো হুলস্থূল কান্ড ঘটার কথা। ইলোরা গিয়ে ডালিয়াকে ব্যাপারটা বললে ডালিয়াও কিছু জানে না বলল। এরেনকে আবারও ফোন করে সেই বন্ধই পেল। ইলোরা কিছুটা বিরক্ত হলো। সকালে খাবার টেবিলেও সবাইকে স্বাভাবিকভাবেই হাসি-গল্প করতে দেখে ইলোরা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে শুধু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার বিস্ময় আরও বাড়ার কারণ হচ্ছে সবাই তার সাথে স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছে। বিয়ে ভাঙা নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথাই নেই। যেন এটা তেমন কোনো ব্যাপারই না। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সাকিব বলল,“অনু, মিথি, ডালিয়া আর তানিয়া রেডি হয়ে নে। মার্কেটে যাব।”
কথাটা বলেই সাকিব দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমে চলে গেল। ডালিয়া প্রশ্ন করল,“এতজন নিয়ে মার্কেটে যাবে কী করতে?”
অনন্যা বলল,“কেন? তোর যেতে সমস্যা আছে?”
ডালিয়া বলল,“না। কিন্তু বিয়েটা তো হবে না, তাহলে হঠাৎ মার্কেটে যাবে কেন?”
মিথিলা বলে উঠল,“আরে আপ্পি থামো তো। যেজন্যই যাক, আমরা ফ্রিতে শপিং করতে পারব। সো, মুখ বন্ধ রাখো।”
ডালিয়া ইলোরার দিকে তাকাল। ইলোরা ফ্যালফ্যাল করে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সবকিছুই তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই তার মনে আশঙ্কা জাগল, সবাই তাকে বোকা বানাচ্ছে না তো? এমন নয় তো যে বিয়ে হবে না বলে তাকে শান্ত রেখে ঠিক সময়মতো বিয়েটা হয়ে যাবে? নিজের মনের আশঙ্কা থেকেই ইলোরা অনন্যাকে প্রশ্ন করল,“কী ব্যাপার বলো তো আপ্পি? হচ্ছেটা কী এসব? বিয়েটা কি সত্যি সত্যিই ভেঙে গেছে না-কি সব মিথ্যে?”
অনন্যা হেসে বলল,“মিথ্যে কেন হবে? আমার জানামতে বিয়েটা হচ্ছে না।”
“তাহলে সবাই মিলে মার্কেটে যাওয়ার কারণ?”
“তোর ভাইয়ের ইচ্ছে।”
“কই? আমাকে তো বলল না।”
“রাগ করিস না। হয়তো এখনও তোর ওপর অভিমান করে আছে।”
অনন্যার কথাতে ইলোরা শান্ত হতে পারল না। তাকে রেখে সবাই মার্কেটে চলে গেল। আর সে বসে বসে এরেনকে ফোনের ওপর ফোন করতে লাগল।
মার্কেট থেকে ফেরার পর সবার হাতে এত এত শপিং ব্যাগ দেখে ইলোরা হা হয়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে ডালিয়াকে জিজ্ঞেস করল,“এত শপিং ভাই করেছে?”
ডালিয়া বলল,“হ্যাঁ, সবার জন্য শপিং করেছে।”
ইলোরা অবাক হয়ে বলল,“সবার জন্য! এত টাকা খরচ করতে দিলো আব্বু? কী হচ্ছে কিছুই তো বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, আমার জন্য কোনো শপিং করেনি?”
ডালিয়া মুখ কালো করে বলল,“না তো। কিন্তু কী হয়েছে জানিস?”
“কী?”
“রনি ভাইয়া আর আপ্পিকে নিয়ে ভাই আলাদা শপিং করেছে। কিন্তু কী এত শপিং করেছে আমরা দেখিনি। দেখে তো মনে হয়েছে পুরো মার্কেটই উঠিয়ে নিয়ে এসেছে।”
ইলোরার কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়ল। সে সন্দিহান কন্ঠে বলল,“আমার অগোচরে কিছু হচ্ছে না তো ডালিয়া? বিয়েটা কি হবে তাহলে?”
“কী জানি! আমিও কিছু বুঝতে পারছি না।”
ইলোরার সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল তখন, যখন বাড়িতে আরও আত্মীয়-স্বজন আসা শুরু করল। এমনকি ডেকোরেশনের লোকজনও এসে বাড়ি সাজানো শুরু করল। ইলোরা অস্থির হয়ে উঠল। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল সাকিবের খোঁজে। সাকিব তখন বাড়িতে ছিল না। তাই সে অনন্যার কাছে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল,“আপ্পি, তুমি না বলেছিলে বিয়ে ভেঙে গেছে? তাহলে এসব কী? তোমরা মিথ্যা কথা বলে আমাকে আটকে রেখেছ?”
অনন্যা দায়সারাভাবে জবাব দিলো,“তোর ভাইকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে।”
ইলোরা তেতে উঠে বলল,“মানে কী? তোমার বলতে সমস্যা কী? আমি তো বলেই দিয়েছি আমি বিয়ে করব না। তাহলে সবাই আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে আমাকে আটকে রেখে বিয়ে দেয়ার চিন্তায় আছে?”
“ইলো, আমি কাজ করছি। এখন বিরক্ত করিস না। যা প্রশ্ন করার তোর ভাইকে কর।”
ইলোরা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,“ভাই বাড়িতে নেই। তুমি জানো না ভাই আর আব্বু কী করেছে?”
অনন্যার থেকে আর কোনো জবাব না পেয়ে ইলোরা হতাশ হয়ে মায়ের কাছে গেল। কিন্তু মাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস জুগিয়ে উঠতে পারল না। মামিকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি কড়া গলায় বললেন,“বাড়ি ভর্তি মেহমান। এমন ছুটোছুটি করছিস কোন আক্কেলে? চুপচাপ রুমে গিয়ে বসে থাক। বারবার বের হবি না।”
অগত্যা ইলোরা রুমে যেতে বাধ্য হলো। তার ফুফাতো বোনের পিচ্চি মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,“বাবু, তোমরা আজ আমাদের বাড়িতে কেন এসেছ জানো?”
পিচ্চিটা গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে বলল,“হ্যাঁ। তোমার না আজকে গায়ে হলুদ? আম্মু বলেছে আজ সন্ধ্যায় আমাকে হলুদ শাড়ি পরিয়ে দিবে।”
“আচ্ছা, যাও তুমি।” কথাটা বলেই ইলোরা গলা উঁচিয়ে মিথিলাকে ডাকল। মিথিলা নাচতে নাচতে রুমে এসে বলল,“আপ্পি, কিছু বলবে?”
ইলোরা দৌড়ে গিয়ে মিথিলার হাত ধরে বলল,“মিথি, তুইও সবার মতো চুপ থাকবি?”
মিথিলা জোরপূর্বক হেসে বলল,“তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন আপ্পি? এত চিন্তা কোরো না। আমাকে আম্মু ডাকছে।”
মিথিলা একপ্রকার পালিয়ে গেল। ইলোরার বুকটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। চোখের কোণে চিকচিকে পানি নিয়ে সে আবার এরেনের নাম্বারে ডায়াল করল। নাহ্, সেই বন্ধই বলছে। ইলোরা অধৈর্য হয়ে জারিনকে ফোন করল। প্রথমবার রিং হয়ে কেটে গেল। পরেরবার জারিন রিসিভ করল। কিন্তু ইলোরা কিছু বলার আগেই জারিন গড়গড় করে বলল,“আমি একটু ব্যস্ত আছি ভাবি। ফ্রি হয়ে তোমাকে কল করছি। কিছু মনে কোরো না প্লিজ।”
জারিন ফোন কেটে দিলো। ইলোরা দিশাহারা হয়ে তখনই বাড়ি থেকে পালানোর সুযোগ খুঁজতে লাগল। কিন্তু তার মামাতো, চাচাতো বোনেরা এসে তার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। তাদের জন্য ইলোরা রুম থেকে বেরোনোর সুযোগই পেল না। দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। কিন্তু পুরো সময়ে ইলোরার রুমে কেউ না কেউ এসে বসে ছিল। বেচারি না কিছু বলতে পারল, আর না সইতে। মাঝে মাঝে শুধু কান্না করেই সময় কাটাল। ডালিয়া করুণ চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারল না। ইলোরা এখনও সাকিবের দেখা পায়নি। শুধু সাকিব না, বড়োরা কেউই তার সামনে আসছে না। তার ধারণা তার বাবা সবাইকে দিয়ে তাকে পাহারায় রাখছে। বিকেল পাঁচটায় ইলোরার বন্ধুরা সবাই চলে এল। তাদের দেখেই ইলোরা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলল। বান্ধবীরা সবাই মিলে তাকে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল। তা দেখে ডালিয়া অবাক হয়ে বলল,“তোরা ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস কী মনে করে? আরে ও তো ঐ লোকটাকে বিয়ে করতে পারবে না। আর তোরা সবাই তো গতকাল ওকে পালাতে হেল্প করলি। তাহলে এখন সুর পালটাচ্ছিস কেন?”
তাহসিন বলল,“এরপরও যে আমরা এ বাড়িতে এসেছি এটাই বেশি। আন্টি, আঙ্কেল আর সাকিব ভাই কী ভেবেছে আল্লাহই জানে। ওনাদের সামনে পড়তেই তো লজ্জা লাগছে আমার।”
ডালিয়া বলল,“এক কাজ করি চল। ইলোকে কোনোভাবে আবার পালাতে হেল্প করি।”
অরিশা আঁতকে উঠে বলল,“একদম না। এমনিতেই আমি আম্মুর থেকে একগাদা বকা শুনেছি। আব্বু তো আমাকে আজ এখানে আসতেই দিতে চায়নি। অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি। আবার একই কাজ করলে আমার খবর আছে।”
ইলোরা করুণ কন্ঠে বলল,“তাহসিন, তুই একটু খোঁজ নিয়ে দেখ না ওর কী হয়েছে? আমার মনে হয় ওর জ্বরটা আরও বেড়েছে। জারিন আপুও ফোন তুলছে না।”
তাহসিন মন খারাপ করে বলল,“আমি কীভাবে খোঁজ নিব বল? আমি তো আর এই মুহূর্তে ভাইয়ের বাসায় যেতে পারব না।”
ইলোরার কান্নার তোড় আরও বেড়ে গেল। আত্মীয়-স্বজনরা ভাবল বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার দুঃখে মেয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছে। সন্ধ্যার পর সাকিবের দেখা মিলল। সে কয়েকটা শপিং ব্যাগ নিয়ে রুমে ঢুকল। সেগুলো ডালিয়ার হাতে দিয়ে বলল,“তাড়াতাড়ি রেডি করবি। বেশি সময় যেন না লাগে। বাইরে সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে গেছে। হলুদের অনুষ্ঠান ছাদে হবে।”
ইলোরা সাকিবকে দেখেই হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,“সারাদিন তুমি আমার সামনে এলে না কেন ভাই? তোমাকে আমি কত খুঁজেছি জানো? তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
সাকিব তাড়া দেখিয়ে বলল,“যা বলার পরে বলিস। আগে রেডি হয়ে নে। আমি ছাদে যাচ্ছি।”
ইলোরাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সাকিব দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল। ইলোরা পিছু ডেকেও হতাশ হলো। তাহসিনও সাকিবের পেছন পেছন চলে গেল। ইলোরার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে একপ্রকার ধরে বেঁধেই সবাই মিলে শাড়ি পরিয়ে দিলো। আত্মীয়-স্বজনদের কথার ভয়ে ইলোরা বেশি বাড়াবাড়িও করতে পারল না। ইলোরার কান্নার কারণে বেশি সাজানো সম্ভব হলো না। হলুদ শাড়ি পরিয়ে, হালকা সাজিয়ে, তাজা ফুলের গহনা পড়িয়ে দিলো।
সারাবাড়ি ডেকোরেশন করা হয়ে গেছে। আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি ভর্তি হয়ে গেছে। একেকজনের চেঁচামেচিতে কানে তালা লাগানোর মতো অবস্থা। অথচ ইলোরা যেন অনুভূতিশূন্য। এরেনের চিন্তায় তার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। মানুষটার সাথে কাটানো একেকটা মুহূর্তের কথা মনে করে ইলোরা শিউরে উঠল। মানুষটার প্রত্যেকটা স্পর্শ এখনও তার শরীরে লেগে আছে। আর সে কি না অন্য এক লোকের জন্য গায়ে হলুদ মাখাবে! কোনোভাবেই এটা সম্ভব না তার পক্ষে। এমনই বিভিন্ন চিন্তার পরে যখন ইলোরাকে সবাই ছাদে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল, তখন সে গোঁ ধরে বসল। সে কোনোভাবেই শরীরে হলুদ ছোঁয়াবে না, আর এই বিয়েও করবে না। বান্ধবীরা ইলোরাকে ছাদে নিতে ব্যর্থ হয়ে সাকিবকে ডেকে আনল। সাকিব আসতেই ইলোরা সাকিবের এক হাত মুঠোয় চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল,“ভাই, তুমি তো সব জানো। তবু এমন কাজ কীভাবে করছো? এই বিয়ে জায়েজ হবে না। এমন কোরো না ভাই। আমি তোমার পায়ে পড়ছি।”
কথাগুলো বলতে বলতে ইলোরা নিচু হয়ে সাকিবের পা ছুঁতে যেতেই সাকিব খপ করে ইলোরাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারপর গম্ভীর মুখে ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেট থেকে ফোন বের করল। ফোনটা ইলোরার দিকে এগিয়ে ধরতেই ইলোরা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সাকিব বলল,“বেলকনিতে যা।”
ইলোরা ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই এক ঝটকা খেল। দ্রুত পায়ে বেলকনিতে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। তারপর ফোনটা সামনে ধরে সে উত্তেজিত হয়ে বলল,“তুমি কোথায়? ফোন বন্ধ কেন তোমার? ঠিক আছো তো তুমি? জ্বর আরও বেড়ে গেছে? জানো আমি তোমাকে সারাদিন ধরে ফোন করেছি? সবাই আমাকে মিথ্যে বলে আটকে রেখেছে। ঐ লোকটার সাথেই আমার বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। প্লিজ আমাকে নিয়ে যাও না। আমি আর থাকতে পারছি না এখানে। দেখো আমাকে জোর করে গায়ে হলুদের জন্য সাজিয়েছে। আমি হলুদ ছোঁয়াবো না।”
সঙ্গে সঙ্গে এরেন চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,“হলুদ ছোঁয়াবে না মানে? দেখো, আমাকে হলুদ মাখিয়ে সবাই ভূত বানিয়ে ছেড়েছে। তোমাকেও হলুদ মাখতেই হবে। আমার একার অত্যাচার আমি মানব না।”
ইলোরা এতক্ষণে খেয়াল করল এরেনের সারা শরীর হলুদে মাখামাখি। মুখে বোধ হয় পানির ছিটা দিয়েছে তাই চেহারাটা দেখে চেনা যাচ্ছে। ইলোরা অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এরেনের কথার আগামাথা তার মাথায় ঢুকল না। এরেন ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,“এভাবে তাকিয়ে আছো কেন ইলোনি? তুমি জানো হলুদের সাজে তোমাকে কতটা সুন্দর লাগছে? ইচ্ছে করছে এখনই গিয়ে আমার বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে।”
ইলোরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,“তুমি হাসছো? এমন পরিস্থিতিতে! আমাকে নিয়ে যাবে কখন?”
“আরও পাঁচ মাস পর।”
এরেনের এমন উত্তরে ইলোরা শিউরে উঠে কিছুটা জোরে বলে উঠল,“মানে? ততদিনে ওই লোকটার সাথে আমার বিয়ে হয়ে বাচ্চাও হয়ে যাবে।”
“তো?”
এরেনের দায়সারা কথায় ইলোরা ভাঙা গলায় বলল,“তো মানে? তুমি ঠিক আছো তো? এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলছো কীভাবে?”
“এতক্ষণ ঠিকই ছিলাম। কিন্তু এখন দুঃখে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আমার বউ কি না আমাকে বিয়ে করতে চাইছে না! কার জন্য আমি এভাবে হলুদ মেখে ভূত হলাম?”
ইলোরা থমকে গেল। বিস্মিত কাঁপা গলায় বলল,“তার মানে?”
এরেন মৃদু হাসল। তারপর গলা ঝাড়া দিয়ে স্বাভাবিকভাবে বলল,“আমি জানি তুমি সারাদিন অনেক কষ্ট পেয়েছ। সেজন্য আমি সরি ইলোনি। সকাল থেকে তোমার সাথে যা যা হয়েছে, এ সবকিছুই সাকিব আর আমার প্ল্যান ছিল। গতকাল বিকেলে সাকিব আবার আমার কাছে এসেছিল। আমাকে বলেছিল, ও শুধু তোমাকে ভালো রাখতে চায়। তোমার ভালোর জন্য হলেও বিয়েটা আটকাতে চায়। সন্ধ্যায় তমালকে ডেকে আমাকে নিয়ে ও বৈঠকে বসেছিল। সেখানে ও নিজেই তমালকে সবটা বুঝিয়ে বলেছিল। আমাদের বিয়ের কথাও গোপন করেনি। সব কথা খুলে বলার পর এটাও বলেছিল যে আমাদের বিয়ের কথা যেন তমাল আর কাউকে না জানায়। সাকিব নিজের মুখে সবটা বলায় তমালের বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। বেচারার মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিল। তুমি ম্যারিড আর তোমার হাসবেন্ড স্বয়ং ওর সামনে, এটুকুই ওর মন পালটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল। কিছুটা রেগেও গিয়েছিল, কিন্তু আমরা মানিয়ে নিয়েছি। অনেক কষ্টে ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বলেছি ও যেন নিজে থেকেই বিয়েটা ভেঙে দেয়। তারপর সিলেট চলে যাওয়ার প্ল্যানটা ওর নিজেরই ছিল। তবে ছেলেটা যে আমাদের পরিস্থিতি বুঝে কাউকে সত্যিটা জানায়নি, এর জন্য ওর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। তারপর কাল রাতেই সাকিব তোমার আব্বুকে নিয়ে আমার বাবার সাথে কথা বলেছিল। বাবা তো নারাজ ছিল। তাকে রাজি করাতে অনেক কসরত করতে হয়েছে। এতে অবশ্য জারিনের ভূমিকা বেশি ছিল। তবে আমাদের আগের বিয়ের কথা জানানো হয়নি। কাল রাতেই কথাবার্তা বলে ঠিক করা হয়েছিল, এখন আপাতত বিয়ে পড়িয়ে রাখা হবে। আমাদের এক্সাম শেষ হলে তারপর তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসা হবে। তার আগ পর্যন্ত তুমি তোমার বাড়িতেই থাকবে। আর তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যই পরের প্ল্যানগুলো সাকিব আর আমি মিলে করেছিলাম। আসলে, ডালিয়া ছাড়া বাকি সবাই এ ব্যাপারে সবকিছু জানে। কিন্তু তোমাকে বলতে বারণ করা হয়েছিল বলে কেউ মুখ খোলেনি। আমার সিম কার্ডটাও সাকিব খুলে রেখে দিয়েছে। তারপর নতুন সিম কার্ড নিয়েছি। কিন্তু তুমি যে কেঁদেকেটে সাগর বানিয়েছ এসব খবর আমাকে কেউ দেয়নি। কিছুক্ষণ আগে তাহসিন জানিয়েছে। দেখো, প্ল্যানটা কিন্তু তোমার ভাই-ই আমার মাথায় ঢুকিয়েছে। সো আমার একার দোষ নেই।”
ইলোরা পাথুরে মুর্তির ন্যায় অবাক দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকিয়ে আছে। এরেনের কথাগুলো শোনার পরও তার যেন বিশ্বাস হতে চাইছে না এই মানুষটার সাথেই আবার তার বিয়ে হতে চলেছে। অন্য কারও সাথে তার বিয়ে হচ্ছে না। উত্তেজনায় ইলোরা হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কান্নার তোড়ে সে কোনো কথাই বলতে পারল না। ইলোরার কান্না দেখে এরেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। হন্তদন্ত হয়ে বলল,“ইলোনি, তোমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি, না? আমি সরি। প্লিজ কেঁদো না। আর কোনোদিনও আমি এভাবে কষ্ট দিবো না তোমাকে, প্রমিস করছি।”
ইলোরার কান্না একটুও থামল না। এরেন হতাশ হয়ে বলল,“সরি বললাম তো বাবা। তোমাকে কিন্তু এখনও হলুদ ছোঁয়ানো হয়নি। তার আগেই কেঁদেকেটে সাজ নষ্ট করে ফেলছো। আজ সারাদিন তোমার সাথে কথা বলিনি তো? আচ্ছা, আজ সারারাত তোমার সাথে অনেক কথা বলব। ওকে? তবু কান্না থামাও ইলোনি।”
এটুকু বলার পরই হঠাৎ ইলোরা ফট করে ফোনটা কেটে দিলো। পরপর আবার এরেনের ফোন আসার পরও ধরল না। মিনিট দুয়েক পর নিজেকে সামলে চোখের পানি মুছে ফেলল। হাসির বদলে একরাশ অভিমান এসে ভর করল তার চোখে-মুখে। এই অভিমান কাউকে ভাঙাতে দিবে না সে। মনের মধ্যে পুষে রেখে বুঝিয়ে দিবে সে ঠিক কতটা কষ্ট পেয়েছে।
চলবে…………..….……🌸~১