সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-৫৪

0
734

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৫৪

সাকিবদের বাড়ির ছাদ বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে সাজানো হয়েছে। লাল, নীল, সবুজ নানা রঙের বৈদ্যুতিক বাতির দ্যুতিতে চারপাশ আলোকিত। ছাদের একপাশে স্টেজ করা হয়েছে। স্টেজ সাজানো হয়েছে তাজা রজনীগন্ধা আর গাদা ফুলে। ইতোমধ্যে বাড়ির সবাই ছাদে উপস্থিত হয়েছে। ইলোরাকে স্টেজে বসিয়ে ছোটো ছোটো বাচ্চা ছেলে মেয়েরা তাকে ঘিরে বসে আছে। মেয়েরা সবাই হলুদ শাড়ি আর ছেলেরা হলুদ পাঞ্জাবী পড়েছে। মালিহা বেগমের কড়া নির্দেশ বড়োরা হলুদ ছোঁয়ানোর পর ছোটোদের পালা। নিয়মে যেন কোনোভাবেই হেরফের না হয়। তার নির্দেশমতো এখন স্টেজের আশেপাশে শুধু বড়োদের ভীড়। তাদের হলুদ ছোঁয়ানো শেষ হওয়ার অপেক্ষায় অদূরে দাঁড়িয়ে সময় গুণছে ছোটোরা। মুনা আফসারের সাথে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আফসার মনোযোগ দিয়ে হলুদের অনুষ্ঠান উপভোগ করছে। মুনা মৃদু কন্ঠে ডাকল,“স্যার?”

আফসার মুনার দিকে না তাকিয়েই ছোটো একটা শব্দ করল,“হুঁ।”

“আমি কি এখনও ছোটো?”

মুনার প্রশ্ন শুনে আফসার ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকাল। মুনা হতাশ ভঙ্গিতে বলল,“ম্যারিড হয়েও ছোটোদের দলে জায়গা হলো আমার! এই দুঃখ কোথায় রাখি?”

“আহারে আমার পিচ্চি বউটা! তোমার কেন মনে হয় যে তুমি খুব বড়ো হয়ে গেছ?”

“মনে হওয়ার কী আছে? আমার বিয়ের ছয় মাস হয়ে গেছে। এখনও কি আমি ছোটো আছি?”

“আগামী ছয় বছরেও তুমি বড়ো হও কি না সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।”

মুনা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,“কী বললেন? আবার বলেন তো।”

আফসার গলা ঝেড়ে বলল,“না মানে, বললাম যে এখনও তুমি খুব বেশি বড়ো হওনি। তবে আগামী বছরের মধ্যে হয়ে যাবে। দুঃখ কোরো না।”

“কীভাবে?”

আফসার আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে মুনার দিকে কিছুটা ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল,“তুমিই তো বলেছিলে, অন্তর বলেছিল বিয়ে করে এ বছরই ওকে মামা বানাতে। ওর কথা সত্যি হওয়ার কথা বলছি আরকি।”

মুনা চোখ-মুখ কুঁচকে তাকাতেই আফসার হেসে বলল,“আরে এভাবে তাকাচ্ছ কেন? আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, দেখছো না?”

“হন না। বুড়ো হয়ে চামড়া ঝুলে পড়ুক, তাতে আমার কী?”

“তোমার কী মানে? আমি বাবা ডাক শুনব চুল পেকে গেলে?”

“জানি না।”

আফসার জোর গলায় বলল,“জানতেই হবে। তার আগেই যদি আমি ইন্তেকাল করি, তাহলে?”

মুনা স্টেজের দিকে তাকিয়ে বলল,“তাহলে কী আর করা? আমি আপনার চেয়ে ইয়াং কোনো হ্যান্ডসাম ছেলেকে বিয়ে করে নিব।”

আফসার মুনার এক হাত মুঠোয় চেপে ধরে শক্ত গলায় বলল,“আবার বলো।”

মুনা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,“কেন? শুনতে পাননি? কানের ডক্টর দেখান স্যার।”

আফসার দুঃখী গলায় বলল,“ধুর! আমার বউ আমাকে একটুও ভালোবাসে না।”

মুনা মুখ ফুলিয়ে আফসারের দিকে তাকিয়ে বলল,“থামবেন আপনি?”

আফসার হতাশ কন্ঠে বলল,“ব্যাস, আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে গেল!”

মুনা ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“অন্তুকে খুব মিস করছি। আজ ও থাকলে অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখত।”

আফসারের মনটাও হুট করে খারাপ হয়ে গেল। মুনার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে সে এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করল।

বড়োদের হলুদ ছোঁয়ানো শেষ হতেই তারা সবাই নিচে চলে গেল। সাজিদ হোসেন আগে থেকেই বলে দিয়েছেন, ছোটোদের মাঝে বড়োরা না থাকাই ভালো। বড়োরা না থাকায় ছোটোরা বেশ খুশি হলো। একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়ানো শুরু করল। কিন্তু ডালিয়া ছাড়া ইলোরা কারো সাথে একটা কথাও বলছে না। বান্ধবীরা অনেক চেষ্টা করেও তার মুখ থেকে কথা বের করতে পারেনি। সে একভাবেই গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সাকিব হলুদ ছোঁয়াতে যেতেই ইলোরা নড়েচড়ে বসল। ভাইয়ের অভিমান ভেঙেছে কি না সে বিষয়ে সে এখনও নিশ্চিত না। তাহসিন সেই প্রথম থেকে ফটোগ্রাফি করে চলেছে। সাকিব হলুদ ছোঁয়ানো শেষ করে উঠে যেতে নিতেই তাহসিন বলল,“আরে ভাইয়া উঠছেন কেন? আরও কয়েকটা পিক তুলতে দিন। ভাবি, আপনিও আসুন।”

তাহসিনের ডাকে অনন্যা এগিয়ে গিয়ে ইলোরার আরেকপাশে বসে পড়ল। ছবি তোলার সময় সাকিব এক হাতে ইলোরাকে আগলে ধরতেই ইলোরার হঠাৎ করেই কী হলো সে নিজেও বুঝতে পারল না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বোনকে কাঁদতে দেখে সাকিব তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,“এই ইলু, কাঁদছিস কেন বোন? আরে আমি তোর ওপর একটুও রেগে নেই। তাছাড়া এখনই তো তোকে অন্যের বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি না। এখানেই তো থাকবি। তাহলে এত কান্না করার কী আছে?”

অনন্যা ইলোরাকে সোজা করে বসিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,“আরে তুই পাঁচ মাস পর্যন্ত এ বাড়িতেই থাকবি। কেঁদে সাজ নষ্ট করিস না তো। এখনও অনেক ছবি তোলা বাকি আছে।”

তাহসিন হতাশ গলায় বলল,“দিলো আমার ফটোগ্রাফির বারোটা বাজিয়ে।”

সাকিব স্টেজ থেকে নেমে তাহসিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে হেসে বলল,“এবার তুমি রেস্ট নাও, আমি করছি।”

তাহসিন যেন এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। সাকিব বলতেই সে হাতের ক্যামেরাটা সাকিবের হাতে দিয়ে দিলো। তখনই সেখানে রনি উপস্থিত হলো। সে এসেই দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,“কী কপাল রে বাবা! একদিনে দু বাড়ির হলুদ সন্ধ্যায় আমি উপস্থিত।”

সাকিব হেসে বলল,“ও বাড়ি থেকে এসেছিস?”

“হুঁ। হলুদ ছোঁড়া-ছুঁড়ি চলছে তাই চলে এসেছি।”

“হ্যাঁ, তোরই কপাল রে মামা! বন্ধুর বিয়ে নিয়ে এত প্ল্যান ছিল, অথচ আমার গুণধর বন্ধু হয়ে গেল বোনের জামাই। দিলো আমার সব প্ল্যান ভেস্তে!”

রনি সাকিবের বাহু চাপড়ে বলল,“থাক মামা, দুঃখ করিস না।”

“হুম। যাক, ও যা করেছে তো করেছেই। তুই তো এখনও বাকি আছিস।”

রনি মেকি হেসে মাথা নেড়ে বলল,“হ্যাঁ হ্যাঁ, এখন তুই ফটোগ্রাফিতে মনোযোগ দে ভাই।”

সাকিবের সামনে থেকে তাড়াতাড়ি সরে রনি চারপাশে সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাল। কাঙ্ক্ষিত মুখটা চোখে পড়তেই তার মুখে হাসি ফুটল। মিথিলা একটা হলুদের বাটি হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে পেছন থেকে একে-ওকে হলুদ লাগিয়ে পালাচ্ছিল। কেউ একজনকে হলুদ লাগিয়ে ছাদের অপরপাশের ফাঁকা জায়গাটায় পালাতে যেতেই হঠাৎ রনি এসে তার সামনে দাঁড়াল। মিথিলা কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। রনি মুচকি হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলল,“কী পুঁচকি? এত লাফালাফি করছিস কেন?”

মিথিলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কপাল কুঁচকে বলল,“হুট করে এসে খাম্বার মতো সামনে দাঁড়িয়েছেন কেন? ভয় পেয়েছি না আমি?”

“তাই না-কি? তুই আবার আমাকে ভয় পাস কবে থেকে শুনি?”

“সরুন তো।”

কথাটা বলে মিথিলা পাশ কেটে সরে যেতে নিতেই রনি পেছন থেকে তার এক হাত টেনে ধরে আবার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলো। তারপর মনোযোগ দিয়ে মিথিলার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দৃষ্টি বুলাতে লাগল। মিথিলা চাপা স্বরে বলল,“ফুটবলের মতো চোখ করে কী দেখছেন এভাবে? চোখ তুলে হাতে ধরিয়ে দিব। বেশরম লোক!”

রনি ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভেবে বলল,“তুই যা মনে করিস আমি তাই। তবে সেটা শুধুই তোর কাছে। অন্য সবার কাছে আমি নিতান্তই এক ভদ্র ছেলে।”

“হ্যাঁ, আমি ছাড়া সবার সামনে তো ভদ্রতা বজায় রেখে চলেন।”

“তোর সামনে আমি ভদ্র সাজতে চাইও না পুঁচকি। যাই হোক, এমন ভূতনি সেজেছিস কেন?”

মিথিলা মুখ বাঁকিয়ে বলল,“ভূতকে বশ করে মারার জন্য।”

“ওহ্ আচ্ছা। ভূতকে তো বশ করে বসে আছিস সেই কবে থেকে। তা, ঘুরে ঘুরে সবাইকে হলুদ লাগাচ্ছিস আর তোর চেহারায় এক ফোঁটাও হলুদ দেখছি না যে? কেউ লাগাতে এল না?”

মিথিলা দুষ্টু হেসে বলল,“লাগাবে কী করে? কাউকে সুযোগ দিয়েছি না-কি?”

রনি এক ভ্রু উঁচিয়ে দু’পা এগিয়ে আসতে আসতে বলল,“আচ্ছা? কেউ যে সুযোগ পাবে না, আমি তো সেটা পেতেই পারি। কী বলিস?”

রনির কথা শুনে মিথিলা পেছন ফিরে ভোঁ দৌড় দিতে গিয়েও পারল না। তার আগেই রনি তার এক হাত মুঠোয় চেপে ধরে হেঁচকা টানে কাছে নিয়ে এল। মিথিলার পিঠ রনির বুকের কাছে গিয়ে ঠেকল। মুহূর্তে মিথিলার হৃদস্পন্দনের গতি দ্বিগুণ বেড়ে গেল। রনির কাছ থেকে সরে যেতে চাইতেই রনি আরেক হাতে মিথিলার হাতের বাটি থেকে কিছুটা হলুদ নিয়ে গালে লাগিয়ে দিলো। মিথিলা চোখ দুটো বন্ধ করে প্রিয় মানুষটার স্পর্শ অনুভব করল। অবচেতন মনে রনির হাতটা মিথিলার গাল থেকে গলায় নেমে আসতেই মিথিলা ছিটকে সরে দাঁড়াল। রনিও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। মিথিলা লাজুক হেসে এদিক-ওদিক না তাকিয়ে রনির সামনে থেকে ছুটে চলে গেল। রনিও মুচকি হেসে মিথিলার পিছু নিল।

তাহসিন খেয়াল করল অনেকক্ষণ যাবত ইলোরার ফুপাতো ভাইটা ডালিয়ার পেছনে লেগেই আছে। ডালিয়াও কোনোরকম আপত্তি ছাড়াই ছেলেটার সাথে হেসে হেসে গল্প করছে। এতটুকু পর্যন্ত তবু ঠিক ছিল। কিন্তু ঐ ছেলে ডালিয়ার গালে হলুদ ছোঁয়াতেই তাহসিন জ্বলে উঠল। নাদিয়া একটা হলুদের বাটি হাতে অদূরেই দাঁড়ানো ছিল। তাহসিন হঠাৎ নাদিয়ার হাত থেকে হলুদের বাটিটা ছোঁ মেরে নিয়ে ডালিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। ডালিয়া তখন গল্পে মশগুল। তাহসিন ডালিয়ার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে বাটি থেকে অনেকটা হলুদ নিয়ে ডালিয়ার সমস্ত মুখে মাখিয়ে দিলো। আকস্মিক ঘটনায় ডালিয়া লাফিয়ে উঠে পেছন ফিরে তাকাল। কোনোরকমে চোখ দুটো মুছে তাহসিনের দিকে সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। তাহসিন বাঁকা হেসে বলল,“ইশ্! পুরো মুখে লেগে গেল। খেয়াল করিনি রে। কষ্ট করে নিচে গিয়ে মুখটা ধুয়ে আয়।”

পাশ থেকে রাফিন বলে উঠল,“ভাই, দেখে লাগাবে তো। পেছন থেকে লাগালে তো এমন হবেই।”

ডালিয়া ভ্রুকুটি করে তাহসিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হয়তো কিছু আঁচ করতে পারল। সে হালকা হেসে বলল,“সমস্যা নেই। আমি ধুয়ে আসছি।”

কথাটা বলে ডালিয়া দ্রুত পায়ে হেঁটে নিচে চলে গেল। ডালিয়া চলে যেতেই তাহসিন বাটি থেকে আরেকটু হলুদ নিয়ে রাফিনের মুখে মাখিয়ে দিয়ে হেসে বলল,“আরে ভাই, বোনের বিয়েতে একটু হলুদ ছোঁয়াতে দিবেন না, এটা কেমন দেখায়?”

কথাটা বলেই তাহসিন দ্রুত পায়ে সেখান থেকে সরে গেল। রাফিনও এবার ডালিয়ার মতোই হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এতক্ষণ অবধি নাদিয়া আর টুম্পা তাহসিনের কার্যকলাপ খেয়াল করছিল। টুম্পা খিলখিল করে হেসে উঠলেও নাদিয়ার চোখে-মুখে একরাশ কালো মেঘ এসে ভীড় করল। না চাইতেও মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে আলগোছে একটা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস চেপে গেল।

সাকিব অনন্যাকে ডেকে বলল,“অনু, আমি নিচে যাচ্ছি। ওদের সবাইকে নিয়ে তুই নিচে চলে আসিস।”

অনন্যা হেসে বলল,“আরে শোনো, ইলোর বান্ধবীরা মনে মনে খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে আছে, তা কি জানো?”

“না তো। কেন? ওরা তো এ বাড়িতে নতুন আসেনি, এর আগেও অনেকবার এসেছে।”

“হ্যাঁ। ঐদিন ইলোকে পালাতে হেল্প করল না সবাই মিলে? সেজন্যই তোমাদের সামনে কিছুটা লজ্জায় আছে।”

সাকিব হেসে বলল,“ওদের বলে দাও কেউ ওদের ওপর রেগে নেই।”

অনন্যা মাথা দোলাল। সাকিব অনন্যাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে গিয়েও আবার দু’পা পিছিয়ে এল। অনন্যা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাকিব হুট করে তার গালে চটাস করে একটা চুমু খেয়ে বলল,“এত সুন্দর করে সেজেছিস কেন? নতুন করে প্রেমে পড়ে গেছি।”

অনন্যা প্রতিউত্তরে কিছু বলার আগেই সাকিব মুচকি হাসি মুখে ঝুলিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল। অনন্যা লাজুক হেসে সাকিবের চলে যাওয়া পথের দিকে আড়চোখে তাকাল।
সবার হলুদ ছোঁয়ানো শেষ হওয়ার পরও ইলোরা মুখ খুলল না। অরিশা কপাল চাপড়ে বলল,“ঐ, তুই কতক্ষণ এমন পেঁচার মতো মুখ করে থাকবি? একটা ছবিতেও মুখে হাসি নেই। কেউ দেখলে বলবে এই মেয়েকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিচ্ছে।”

অরিশার সাথে বাকি সবাই তাল মিলালো। ইলোরা সেসব কথায় কান না দিয়ে হঠাৎ বলে উঠল,“অন্তুকে ভীষণ মিস করছি রে।”

ইলোরার কথায় সবার মুখের হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটাকে আজ তার পুরো বন্ধুমহল খুব করে মিস করছে। কিন্তু সে যে সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। অরিশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য মেকি হেসে বলল,“যাই হোক, ইলোর মুখ থেকে কথা তো বের হলো।”

বেশ কিছুক্ষণ সবাই মিলে আড্ডা দেয়ার পর নিচে চলে গেল। খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই বিদায় নিয়ে যার যার বাড়ি চলে গেল। ইলোরা রুমে ঢুকে তাড়াতাড়ি শাড়ি চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে তবেই স্বস্তি পেল। তখনও মিথিলা আর ডালিয়া রুমে আসেনি। অনেকক্ষণ ধরে এক জায়গায় ঠাঁয় বসে থাকায় পা দুটো ব্যথা করছে। বিছানায় উঠে সে অলস ভঙ্গিতে সটান শুয়ে পড়ল। চোখ দুটো বন্ধ করার সাথে সাথেই দরজা খোলার শব্দ হলো। চোখ খুলে দেখল মালিহা বেগম রুমে এসেছেন। ইলোরা মাকে দেখে উঠে বসল। মালিহা বেগম এগিয়ে এসে বিছানায় বসতে বসতে প্রশ্ন করলেন,“ক্লান্ত লাগছে?”

ইলোরা মুখ ফুলিয়ে বলল,“পা ব্যথা করছে। অনেকক্ষণ এক জায়গায় বসে ছিলাম তো। তোমার খাওয়া হয়েছে?”

“হ্যাঁ। এটা তোর কাছে রাখ তো।”

মালিহা বেগম একটা বক্স এগিয়ে ধরলেন। ইলোরা এতক্ষণ মায়ের হাতের দিকে খেয়াল করেনি। বক্সটার দিকে তাকিয়ে সে বলল,“গহনার বক্স?”

মালিহা বেগম মাথা দোলালেন। ইলোরা মায়ের হাত থেকে বক্সটা নিয়ে খুলে ফেলল। বক্সের ভেতরে এক সেট গহনা দেখে সে অবাক হয়ে বলল,“এসব কার আম্মু? একদম নতুন মনে হচ্ছে।”

মালিহা বেগম মুচকি হেসে বললেন,“হ্যাঁ। এটা তোর আব্বু আর আমি মিলে তোর জন্য গড়িয়ে রেখেছিলাম।”

“এত টাকা খরচ করতে গেলে কেন? এত দামী গহনার কী দরকার ছিল?”

“এর থেকে মেয়েটা আমাদের কাছে বেশি দামী। বিয়ে হয়ে পরের ঘরে চলে যাওয়ার পর তো তেমন কিছু দেওয়াও হবে না।”

ইলোরার চোখে পানি চলে এল। সে গহনার বক্সটা পাশে রেখে মায়ের এক হাত মুঠোয় চেপে ধরে ধরা গলায় বলল,“আমাকে মাফ করে দিও আম্মু। তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি।”

মালিহা বেগম মলিন হেসে বললেন,“বাবা-মায়েরা এসব মনে রাখে না। তাই এসব বাদ দে‌। এই তো মাত্র সেদিন ছোটো ছোটো পায়ে সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়িয়েছিলি। এত তাড়াতাড়ি কত বড়ো হয়ে গেলি! বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িও চলে যাবি!”

ইলোরা মাকে জড়িয়ে ধরে মৃদু শব্দ তুলে কেঁদে উঠল। কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,“আমি কি মানিয়ে নিতে পারব আম্মু? আমার খুব ভয় লাগে। যদি না পারি?”

মেয়ের কান্নার শব্দ কানে যেতেই মালিহা বেগমের চোখ দুটোও ভিজে উঠল। মুহূর্তে তিনিও দুহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে গুনগুনিয়ে কেঁদে উঠলেন। ডালিয়া আর মিথিলা রুমে এসে দেখল মা-মেয়ে সমান তালে কেঁদে চলেছে। তারা এগিয়ে গিয়ে মালিহা বেগমকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে কান্না থামাল। রাত অনেক হয়েছে ভেবে মালিহা বেগম চলে গেলেন। ডালিয়া আর মিথিলা তাদের পরনের শাড়ি চেঞ্জ করতে লেগে পড়ল। ইলোরা গহনার বক্সটা আলমারিতে তুলে রেখে ফোন খুঁজে বের করল। পাওয়ার বাটন অন করেই দেখল এরেন এই পর্যন্ত পাঁচবার কল করেছে। ইলোরা সেদিকে খেয়াল না দিয়ে বিছানায় উঠে শিয়রের কাছে ফোনটা রেখে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতেই ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। ইলোরা চোখ খুলে ফোনের দিকে তাকাল। স্ক্রিনে এরেনের নামটা দেখেই ফোনটা কেটে দিলো। পরপর আবার কল আসতেই সে ফোনটা সুইচ অফ করে রাখল। মনে তার একরাশ অভিমান জমা হয়ে আছে। এ অভিমান তো এত সহজে ভাঙার নয়। ইলোরা চোখ বন্ধ করে আগামীকালের নতুন সকালের কথা ভেবে মৃদু হাসল। কাল থেকে আবার নতুনভাবে, নতুন উদ্যমে প্রিয় মানুষটার সাথে পথচলা শুরু হবে। এবার থেকে আর কোনো লুকোচুরি থাকবে না, থাকবে না কোনো বাঁধা। সম্পর্কটা হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন।

চলবে……………….……🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here