সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-৬০

0
731

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৬০

“ডালিয়ার বিয়ে!”

ভারি অবাক হয়ে কিছুটা জোরেই কথাটা বলে উঠল এরেন। ইলোরা কোলের মধ্যে বালিশ নিয়ে মুখের কাছে দুহাত বেঁধে বসে আছে। চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার আভাস। এরেনের প্রশ্নে সে ওপর নিচে মাথা দোলালো। এরেন কপাল কুঁচকে পুনরায় বলল,“মানে কী? হঠাৎ করে বিয়ে! মাত্র তিন দিন আগেই না ও বাড়ি গেল?”

ইলোরা মুখ থেকে হাত সরিয়ে পুনরায় মাথা দুলিয়ে বলল,“হ্যাঁ। এই তিনদিন ডালিয়া কিছুই টের পায়নি। আজই না-কি বিয়ের পাকা কথা বলার কথা।”

“মামা তো কিছুই বলল না কাউকে। তুমি কার থেকে জেনেছ?”

“ডালিয়া ফোন করেছিল। আর এসব মামির কাজ। মামা যখন ওকে নিতে এসেছিল, তখন মামাও জানত না মামি কেন ডালিয়াকে নিতে পাঠিয়েছে।”

“মামির কাজ বলতে? খোলাসা করে বলো। আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”

“মামি চাইছে তার বড়ো বোনের ছেলের সাথে ডালিয়ার বিয়ে হোক। কিন্তু মামা তাতে রাজি না। এই নিয়ে না-কি দুজনের মধ্যে অনেক ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে গত একমাস ধরে। এখন মামি আত্মহত্যা করার হুমকি দিচ্ছে। মামাও তাই ভয়ে রাজি হয়ে গেছে। মামির ব্ল্যাকমেইলের ভয়ে মামা মুখও খোলেনি এতদিন। মামির মতলব বিয়ের দিন, তারিখ ঠিক করে পরে সবাইকে জানাবে। ডালিয়াকে এই দুইদিন বলেনি। আজ হঠাৎ বলেছে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আজ হয়তো তারিখ ঠিক করবে। ডালিয়া তাড়াতাড়ি আমাকে ফোন করে জানিয়েছে। আমি ভাই আর আব্বুকে জানিয়েছি।”

এরেন কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,“ডালিয়া না তাহসিনকে পছন্দ করে? তাহলে তো ওর বিয়েতে রাজি না থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এটা তো মামি শুনবে না।”

“তাহসিনের কথা তো বলা যাবে না। কারণ তাহসিন মাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। আর যাই হোক, এত তাড়াতাড়ি বিয়ে তো আর করতে পারবে না। ডালিয়া ক্লাসমেটকে পছন্দ করে শুনলে মামি খেপে যাবে। ভাই আর আব্বুকে শুধু বলেছি, ডালিয়া বিয়েতে রাজি না তবু মামি জোর করছে।”

এরেন মাথা দুলিয়ে বলল,“ভালো করেছ। আমিও সাকিবের সাথে কথা বলে দেখছি। এখন মন খারাপ করে থেকো না তো। অফিস থেকে এসে তোমার গোমড়া মুখ দেখতে ভালো লাগে না। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাও।”

কথাটা বলতে বলতে এরেন এগিয়ে গিয়ে ইলোরার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ইলোরাও বিনা বাক্যে এরেনের চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল চালিয়ে বিলি কাটতে লাগল।


“সহজ কথাটা আপনি বুঝতে পারছেন না কেন ভাবি? ডালিয়া বিয়েতে রাজি না।”

সাজিদ হোসেনের কথায় আলিয়া বেগম ফুঁসে উঠে বললেন,“বারবার এক কথা কেন বলছেন ভাইজান? আমি বলছি বিয়েতে রাজি না হওয়ার সঠিক একটা কারণ দেখাতে। তা তো ও পারছে না। তাহলে সমস্যা কোথায়? ছেলে ভালো, সরকারি চাকরি করে, ওর-ও বিয়ের বয়স হয়েছে। তাহলে? এখানে রাজি না হওয়ার কারণ কী?”

সাকিব বলল,“কিছু মনে করবেন না মামি। আপনার এক মেয়ের বিয়ে ফুপাতো ভাই মানে আমার সাথে হয়েছে। হয়তো ডালিয়া চাইছে না আত্মীয়-স্বজনের সাথে ওর বিয়ে হোক। সবার মন তো এক না। মেয়েটা রাজি না, ওকে কেন জোর করছেন?”

আলিয়া বেগম কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,“আত্নীয়-স্বজন বলে কী হয়েছে? আমার বোন খারাপ, না বোনের ছেলে খারাপ? এমন ভালো সম্বন্ধ হাতছাড়া করার কথা ভাবছিস কোন আক্কেলে?”

এরেন বলল,“ভালো সম্বন্ধ এমন আরও পাওয়া যাবে মামি। আমরা নিজেরাই ঠিক করব। ডালিয়া অনার্সটা অন্তত শেষ করুক।”

আলিয়া বেগম চোখ বড়ো করে বললেন,“পাগল হয়েছ? অত বয়স হলে বিয়ে করবে কে? মানুষ বলবে মেয়ের বয়স বেশি। বড়ো মেয়েকেও পড়িয়েছিলাম। অনার্স শেষ হওয়ার পর যারা সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে তারা এসেছে শুধু গায়ের সাদা চামড়া দেখে।”

সাজিদ হোসেন বললেন,“অনন্যা কোনো দিক থেকে কম উপযুক্ত ছিল না ভাবি। ওকে টানছেন কেন? ওর তো বিয়ে হয়েই গেছে।”

আলিয়া বেগম তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন,“হয়েছে তো। বড়ো ঘরে বিয়ে ঠিক করে শেষমেষ কপালে জুটেছে ফুপুর ঘর।”

সাকিব গম্ভীর মুখে বলল,“ফুপুর ঘরে আপনার মেয়ের সুখের কমতি পড়েনি মামি। ওর কথা বাদ দিয়ে অসল কথায় আসুন। আমরা এখানে এসেছি ডালিয়াকে নিয়ে কথা বলতে।”

“কিসের কথা? আমি আমার মেয়েকে এখানেই বিয়ে দিব। কারোর সাথে কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই আমার। আজকে সন্ধ্যায় বিয়ের দিন, তারিখ ঠিক করার কথা ছিল, আজকেই করব।”

মিজানুর রহমান এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা শুনেছেন। এবার তিনি মুখ খুললেন। গম্ভীর মুখে বললেন,“এটা কেমন কথা? ওরা সেই ঢাকা থেকে এসেছে এই বিয়ের বিষয়ে কথা বলতে। আর তুমি কী শুরু করেছ?”

আলিয়া বেগম তিক্ত মুখে বললেন,“আমি কী করছি তা আমার জানা আছে। আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না কারো। বিয়েতে দাওয়াত করব, সবাই এসে খেয়ে-দেয়ে মেয়েকে বিদায় দিবে।”

এরেন বলল,“মামি, হুট করে এভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। আপনি একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবুন। ডালিয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিলে কি ও সুখী হতে পারবে?”

“আমার আর ভাবাভাবির কাজ নেই বাবা। আমি আমার বোনের পরিবারকে ভালোভাবেই চিনি। ওরা নিজের ইচ্ছায় আমার মেয়েকে বউ করতে চাইছে, এটাই বা কম কিসে? তুমি জামাই মানুষ, জামাইয়ের মতোই থাকো। এসব নিয়ে জলঘোলা কোরো না।”

সাজিদ হোসেন শক্ত মুখে বললেন,“আপনি এই বিয়ে দিবেনই?”

আলিয়া বেগম দৃঢ় কন্ঠে বললেন,“হ্যাঁ।”

“আপনি কিছু বলবেন না ভাইজান?”

মিজানুর রহমান আহত দৃষ্টিতে সাজিদ হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললেন,“আমি কী বলা বাকি রেখেছি সাজিদ? বিষ খেতে যায়, গলায় দড়ি দিতে চায়। এসব কার সহ্য হয়? আমাকে মাফ করো ভাই।”

সাজিদ হোসেন, সাকিব আর এরেন মিলে আরও কয়েকবার আলিয়া বেগমকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন। বারবার অনুরোধ করলেন সে যেন তার সিদ্ধান্ত পালটায়। কিন্তু আলিয়া বেগম নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। কারোর কোনো কথাই সে মানতে নারাজ। শেষমেষ সবার হাল ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না। সাজিদ হোসেন থমথমে মুখে বললেন,“ঠিক আছে। আপনাদের যা ইচ্ছা হয় করুন। কিন্তু এই বিয়েতে আমাদের পাবেন না। দুঃখিত।”

সাজিদ হোসেনের কথায় আলিয়া বেগমের কোনো হেলদোল দেখা গেল না। সে শক্ত মুখে বসে রইলেন। কিন্তু মিজানুর রহমান ব্যস্ত হয়ে বললেন,“এসব কী বলছো সাজিদ? আমি তোমাদের ছাড়া মেয়ের বিয়ে দিব! আজ পর্যন্ত তোমাদের ছাড়া আমার বাড়িতে কোনো আয়োজন হয়েছে?”

“মাফ করবেন ভাইজান। আমি কোনো অন্যায় বিয়েতে থাকতে পারব না। আমার ছেলে-মেয়েরাই তো থাকবে না। ওরা না থাকলে আমি কোন বিবেকে থাকব? আপনারা যা করার করুন। আমাদের আর কিছু বলার নেই।”

সাকিব উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“আমাদের এখন চলে যেতে হবে মামা। সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার নিয়েছেন, এখন আপনারা ঠিক কী করবেন তা আপনাদের ব্যাপার।”

মিজানুর রহমান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,“আজকের রাতটা থেকে যা। এলিই তো দুপুরবেলা।”

এরেন আর সাজিদ হোসেনও উঠে দাঁড়ালেন। এরেন বলল,“থাকতে পারব না মামা। রাতে আমার ইম্পর্ট্যান্ট একটা মিটিং আছে।”

সাজিদ হোসেন বললেন,“ডালিয়াকে একবার ডাকুন। ওর সাথে দেখা করে যাই। পরেরবার দেখলে তো জামাইসহ দেখতে হবে।”

আলিয়া বেগম বললেন,“ডালিয়া ঘুমিয়ে আছে। কাঁচা ঘুম না ভাঙাই ভালো। আপনারা বরং আজ থেকে যান। সন্ধ্যায় সবাই একসাথে বসে কথাবার্তা বলে দিন, তারিখ ঠিক করে যাবেন।”

সাকিব তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,“এত কথার পরও আপনি এটা বলছেন? সত্যিই আপনাকে কিছু বলার নেই মামি। বাবা, চলো। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ডালিয়াকে আর দেখতে হবে না।”

মিজানুর রহমান বারকয়েক বলেও সাজিদ হোসেন, সাকিব বা এরেন কাউকেই আটকাতে পারলেন না। দুপুরে কাজ সেরে তারা এসেছিলই শুধু ডালিয়ার বিয়েটা আটকাতে। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বিকেলের শেষভাগেই পুনরায় ঢাকা রওনা দিতে হলো।


সবেমাত্র রাতের খাবার খেয়ে, সব কাজকর্ম শেষ করে রুমে এসে সাকিবের পাশে বসেছে অনন্যা। সাকিব বিছানার মাঝ বরাবর কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল। অনন্যা এসে পাশে বসতেই সে চোখ খুলে বলল,“এইমাত্র তোর মা ফোন করছে। দেখ কী বলে।”

অনন্যা সাকিবের শিয়রের পাশ থেকে নিজের ফোনটা হাতে নিতে নিতে বলল,“ধরোনি?”

সাকিব গম্ভীর গলায় বলল,“তোর ঘাড়ত্যাড়া মায়ের সাথে কথা বলার শখ নেই আমার।”

অনন্যা ততক্ষণে মায়ের নাম্বারে ডায়াল করেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আলিয়া বেগম ফোন রিসিভ করে হ্যালো বললেন। অনন্যা প্রশ্ন করল,“কেমন আছো মা?”

আলিয়া বেগম বললেন,“ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”

“ভালো। ডালিয়া কোথায়?”

“আছে এখানেই। তোর সাথে কথা আছে।”

“আর কী বলবে মা? সারাদিন তো কম বললে না। যতবার ফোন করেছি ততবার শুধু রাগই দেখালে। সাকিবদের সাথেও না-কি একই ব্যবহার করেছ?”

“এসব কথা শুনতে কল দেইনি তোকে। তোর খালা-খালু ওদের আত্মীয়-স্বজন নিয়ে এসেছে। বিয়ে নিয়ে সব কথা বলা শেষ।”

কথাটা শুনেই অনন্যার মুখটা শক্ত হয়ে গেল। সে গম্ভীর গলায় বলল,“এসব আমাকে বলছো কেন? আমি তোমাদের কে হই? তোমাদের যা ইচ্ছা হয় করো।”

“বাব্বাহ্! ফুপা-ফুপুর হাতের পুতুল হয়ে গেছিস? দুদিন ধরে সংসার করে মায়ের সাথে এভাবে কথা বলছিস!”

“কথায় কথায় আমার সংসার টানবে না মা। এসব কথা বলতে এতবার ফোন করেছ?”

“না। তোকে জানাতে ফোন করলাম যে তোর খালু চাইছে বিয়েটা আজই হয়ে যাক। রাতের মধ্যে বিয়ের কাজ শেষ করে কাল ওনারা বাড়ি ফিরবেন। আমিও হ্যাঁ বলে দিয়েছি।”

অনন্যা বিস্ময় নিয়ে কিছুটা জোরেই বলে উঠল,“আজ রাতেই মানে? এসব কী বলছো মা? মাথা খারাপ হয়েছে তোমাদের? একে তো ডালিয়া এই বিয়েতে রাজি না, তার ওপর আবার হুট করে এখনই বিয়ের ব্যবস্থা করছো?”

অনন্যার কথা শুনে অবাক হয়ে সাকিব শোয়া থেকে উঠে বসল। আলিয়া বেগম বললেন,“বিয়ের প্রস্তুতি চলছে, এখন তোর সাথে এত কথা বলার সময় নেই। তোর ফুপা আর সাকিব ফোন ধরেনি। তুই ওদেরকে জানিয়ে দে। কাল যেন সবাই চলে আসে। তোরা আসার পর ওরা ডালিয়াকে নিয়ে যাবে।”

“মা, এমন ভুল কোরো না। ডালিয়ার অমতে বিয়ে দিলে ও সুখে থাকতে পারবে না। তোমার দুটো পায়ে পড়ি মা।”

আলিয়া বেগম রাগত স্বরে বললেন,“তোর ফুপাকে ফোন ধরতে বল। আর কাল সকালে তাড়াতাড়ি চলে আসিস। এখন কথা বাড়াস না।”

অনন্যা ব্যস্ত হয়ে বলল,“ডালিয়া কোথায়? ওর মতামত জানতে চাওনি?”

“ও আবার কী বলবে? বাপ-মা কি খারাপ ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করবে?”

অনন্যাও এবার শক্ত মুখে বলল,“বাবার কথা বলছো কোন মুখে? তুমি নিজেই তো বাবার ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছ। তোমার বোন আর তার দুধে ধোয়া ছেলে যে কত ভালো মানুষ তা আমার জানা আছে। ডালিয়া ওই বাড়িতে এক মাসও শান্তিতে থাকতে পারবে না দেখো। যেচে নিজের মেয়েকে নরকে ঠেলে দিচ্ছ কোন বিবেকে? বোনের ছেলের সাথে জোর করে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য তুমি এতটা নিচে নামতে পারলে মা? ছিঃ ছিঃ!”

আলিয়া বেগম তেতে উঠে বললেন,“থাপ্পড় দিয়ে কথা শিখিয়ে দিব। বিয়ে হয়ে খুব বড়ো হয়ে গেছিস? তুই আমাকে জন্ম দিয়েছিস, না আমি তোকে দিয়েছি? ফোন রাখ।”

অনন্যাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আলিয়া বেগম ফট করে ফোনটা কেটে দিলেন। অনন্যা কান থেকে ফোন নামিয়ে ব্যস্ত হয়ে সাকিবকে বলল,“সাকিব, একটু পরেই ডালিয়ার বিয়ে। এখন কী হবে? মা তো কোনো কথাই শুনতে চাইছে না।”

সাকিব চিন্তিত কন্ঠে বলল,“আমার আর কী করার বাকি আছে বল তো? অনেক তো চেষ্টা করলাম বুঝানোর। যে নিজেই বুঝতে চায় না, তাকে বুঝাব কীভাবে? যেচে নিজের মেয়ের জীবন নষ্ট করছে।”

অনন্যা সাকিবের এক হাত মুঠোবন্দী করে অসহায় মুখে বলল,“কিছু একটা করো প্লিজ। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে ডালিয়ার জন্য।”

সাকিব অপর হাতে অনন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,“দেখছি কী করা যায়। চিন্তা করিস না। বাবার সাথে কথা বলে দেখি আমি। তুই একবার ডালিয়াকে ফোন করে খোঁজ নে।”


সারা রুম জুড়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে পায়চারি করছে আর ডালিয়ার নাম্বারে একের পর এক কল করে চলেছে ইলোরা। বিছানার মাঝ বরাবর পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসে চিন্তিত মুখে ইলোরার দিকে তাকিয়ে আছে এরেন। প্রায় দশ মিনিট ধরে ইলোরা একটানা ডালিয়ার নাম্বারে ডায়াল করেই চলেছে। কিন্তু ডালিয়া ফোন তোলার নামও নিচ্ছে না। এরেন ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“আর কতবার ট্রাই করবে? আমার মনে হয় মামি ওর ফোন সরিয়ে রেখেছে।”

এরেনের কথায় ইলোরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরেনের দিকে তাকিয়ে দু’পা এগিয়ে গিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলল,“এখন কী করব বলো তো? মামিও তো ফোন রিসিভ করছে না। এদিকে তাহসিন এই পর্যন্ত তিনবার ফোন করেছে। সারাদিন ডালিয়া ফোন রিসিভ করেনি বলে ও ভেবেছিল গ্রামে গিয়ে হয়তো ব্যস্ত আছে। সন্ধ্যার পর থেকেই ও আমাকে ফোন করে বারবার জিজ্ঞেস করছে ডালিয়া ফোন রিসিভ করছে না কেন। আমি বারবার অন্য কথা বলে কথা ঘুরিয়েছি। আর কতক্ষণ এভাবে কথা ঘুরাতে পারব?”

এরেন বলল,“বিয়ে আটকানোর আর কোনো উপায় নেই। এখন হয়তো বিয়ে হয়েও যাবে। বিয়ে যখন হবেই তখন তো আর তাহসিনের কাছে গোপন রাখা যাবে না।”

ইলোরা এগিয়ে গিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে এরেনের দিকে গোমড়া মুখে তাকিয়ে বলল,“কী করে বলব ওকে? ও ডালিয়াকে অনেক ভালোবাসে। হঠাৎ করে এমন একটা খবর পেলে ওর মনের অবস্থা কী হবে ভাবতে পারছো? ও তো নিজেকে সামলাতে পারবে না।”

এরেন মাথা দুলিয়ে বলল,“তা ঠিক। আমি ভাবছি ডালিয়ার কথা। মেয়েটা এখন কী পরিস্থিতিতে আছে আল্লাহ্ জানে।”

ডালিয়ার কথা মাথায় আসতেই ইলোরার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। আর কেউ না জানলেও সে জানে মেয়েটা তাহসিনকে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে। ভালোবাসার মানুষটাকে ছেড়ে অন্য একটা পুরুষকে গ্রহণ করাটা তার জন্য কতটা কঠিন, তা হয়তো মুখে প্রকাশ করা সম্ভব না।


ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাহসিন। দৃষ্টিতে তার একরাশ মুগ্ধতা আর চাঞ্চল্যতা। ল্যাপটপের স্ক্রিনে ডালিয়ার হাস্যোজ্জ্বল একটা ছবি ভাসছে। ছবিটা তাহসিন ডালিয়ার অজান্তেই তুলেছিল। ডালিয়া তখন ইলোরা, মুনা, নাদিয়া, টুম্পা আর অরিশার সাথে কোনো মজার বিষয় নিয়ে কথা বলছিল আর প্রাণখোলা হাসিতে মত্ত ছিল। দূর থেকে তাহসিন এই দৃশ্য দেখেই ক্যামেরাবন্দী করে রেখেছিল। মাঝে মাঝে তাহসিন এই ছবিটার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এই তাকিয়ে থাকার মাঝেও যেন সে প্রশান্তি খুঁজে পায়। গ্রামে যাওয়ার পর দুদিন পর্যন্ত মেয়েটার সাথে তার ঠিকমতো কথা হয়েছে। মেয়েটা গ্রামের কত দৃশ্যের ছবি তুলে পাঠিয়েছে। তাহসিন বেশ বুঝতে পেরেছে ডালিয়া গ্রামে গিয়ে খুব উৎফুল্ল হয়ে আছে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে ডালিয়াকে ফোন করেছিল। কিন্তু ফোন রিসিভ না হওয়ায় ভেবেছিল কাজে ব্যস্ত আছে। কিন্তু তারপর সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, তবু ডালিয়া ফোন রিসিভ করল না। বিকাল পর্যন্তও তাহসিন নিজের মনকে বুঝিয়েছে ডালিয়া হয়তো ব্যস্ত আছে। সন্ধ্যা হতেই মনটা আর মানতে চায়নি। প্রতি সন্ধ্যায় ডালিয়ার সাথে অন্তত একবার করে ফোনে কথা বলাটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যায়ও যখন ডালিয়া ফোন রিসিভ করল না তখন সে খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। ব্যস্ত হয়ে ইলোরাকে ফোন করেও কোনো লাভ হয়নি। ইলোরাও না-কি সঠিক কারণ জানে না। অথচ তার মনটা আজ বড্ড উস-খুস করছে। বারবার অকারণেই মন খারাপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে। অজানা আশঙ্কায় মাথাটাও ধরে যাচ্ছে। উত্তেজিত হয়ে অক্লান্ত তাহসিন বারবার ডালিয়ার নাম্বারে ডায়াল করেই চলেছে। ডালিয়ার ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার ভেতরটা আরও আশঙ্কিত হয়ে উঠছে। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে বুকে জাপটে ধরতে। তাহসিন যখন প্রেয়সীকে বুকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছাকে ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত, ঠিক একই সময়ে ডালিয়ার অসাড় হাতটা অন্য এক বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় বন্দী। সবেমাত্র বিয়ে পড়ানো সম্পন্ন করে তার মা তাকে তার নব বিবাহিত স্বামীর হাতে তুলে দিয়েছেন। আলিয়া বেগম তার বোন আর বোনের জামাইকে কাঁদো কাঁদো গলায় কিছু বলে চলেছেন। মিজানুর রহমান বিয়ে পড়ানো শেষ হওয়ার সাথে সাথেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেছেন। এসবের কোনো দিকেই হেলদোল নেই ডালিয়ার। আপাতত সে অনুভূতিহীন এক জগতের বাসিন্দা। সকালে মায়ের মুখে হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে সে খুব চমকে গিয়েছিল। মাকে বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ হয়েছিল তখন এই ভরসায় ছিল যে, ফুপা আর ভাই ঠিক এই বিয়ে আটকাতে আসবে। কিন্তু যখন তারাও ব্যর্থ হলো তখন ডালিয়া মায়ের পায়ে পর্যন্ত ধরেছিল। কিন্তু কোনো কিছুতেই আলিয়া বেগমকে বুঝাতে সক্ষম হয়নি। এদিকে সারাদিন ইচ্ছে করেই সে তাহসিনের ফোন রিসিভ করেনি। ভেবেছিল ছেলেটাকে এসব চিন্তার মধ্যে ফেলবে না। কিন্তু যখন তাহসিনকে ফোন করার জন্য ফোনটা হাতে নিয়েছিল তখন তার মা ফোনটাও কেড়ে নিয়েছিল। এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও ডালিয়া ভেবেছিল বিয়ের তরিখই তো ঠিক হবে, বিয়ে তো আর হয়ে যাচ্ছে না। দরকার পড়লে সে আগামীকালই বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা ফেরত যাবে। কিন্তু এই ভাবনাকে মিথ্যে করে দিয়ে তার খালু জানিয়েছেন আজই বিয়ে হবে। খবরটা শোনামাত্র ডালিয়া কান্না জুড়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার করুণ কান্না আর অসহায় মুখের মিনতি আলিয়া বেগমের মন গলাতে পারেনি। দিশাহারা ডালিয়ার তখন আর কিছুই করার ছিল না। তার এই খালাতো ভাইকে সে কোনোকালেই পছন্দ করত না। ছেলেটা যে একের পর এক মেয়ের সাথে মেলামেশা করে তা তার অজানা নেই। কিন্তু গুরুজনদের সামনে ভদ্রতার মুখোশ পরে বলেই তার এত কদর। সবকিছু জানা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে এই মানুষটাকেই আজ ডালিয়া নিজের স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছে। গ্রহণ করেছে কি না তাতেও সন্দেহ আছে। বাধ্য হয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে বিয়েটা করলেও সে নীরব। চোখ দিয়ে শ্রাবণের ঢল নামছে ঠিকই, কিন্তু গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোনো অজানা শক্তি তার কন্ঠনালি রোধ করে রেখেছে, মস্তিষ্ক তার কার্যক্ষমতা হারিয়েছে, শরীরে এক ফোঁটাও শক্তি নেই নড়াচড়া করার মতো। স্বামীর হাতে নিজের হাত আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তাতে নেই কোনো অনুভূতি। অনুভূতিগুলো তো এখন শুধু তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে চলেছে,“আজ এই মুহূর্ত থেকে তুমি অন্য কারো সহধর্মিণী। এতদিন যাকে মনে জায়গা দিয়ে চুপিচুপি ভালোবেসেছ, তার বদলে আজ থেকে নিজের স্বামীকে ভালোবাসার চেষ্টা করতে হবে। নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে নিজের স্বামীর নিকট। ভুলে যেতে হবে, কেউ একজন আছে যাকে তুমি ভালোবাসো, যে তোমার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।”

আদৌ কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? প্রথম ভালোবাসার অনুভূতিগুলো কি এতটাই ঠুনকো যে সেটা এক মুহূর্তে ভুলে যাওয়া সম্ভব? ডালিয়া তো সেটা পারবে না। সে তো চেয়েছিল জীবনে একজন পুরুষকেই মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে। ভালোবাসার মানুষটার হাতে হাত রেখে বহুদূর পথ চলতে। তবে তার সাথেই কেন এমন হলো? চোখের পানি গড়িয়ে হাতের ওপর পড়তেই অসাড় ডালিয়ার মস্তিষ্কে একটা কথাই কড়া নাড়ল,“তাহসিন এই বিয়ের খবর শুনলে ওর মনের অবস্থা কী হবে? খুব পাগলামি করবে? প্রচন্ড কষ্টে আমার মতোই দমবন্ধ হয়ে আসবে? মেয়েদের মতো কেঁদেকেটে একাকার করবে? ওর সাথে দেখা হলে আমি কী উত্তর দিব?ওর মুখ থেকে তো ‘ভালোবাসি’ শব্দটা শোনা হলো না। ও তো বলেছিল ঢাকায় ফিরলে কিছু একটা বলবে। সেই কিছু একটা কি ‘ভালোবাসি’ শব্দটা? আচ্ছা? ও কি আমার চুলে জড়াবে বলে, আমার হাতে গাঁথা বড়ো একটা বেলি ফুলের মালার জন্য অপেক্ষা করে আছে?”

চলবে………………….🍁

(আসসালামু আলাইকুম পাঠকগণ। এর পরের পর্ব কবে আসবে জানা নেই। পাঁচ তারিখে আমার এক্সাম শুরু হবে। সবাই দোআ করবেন আমার জন্য। হ্যাপি রিডিং।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here