#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৬১
ধোঁয়া ওঠা কফি মগে চুমুক দিয়ে নাদিয়া তাহসিনের দিকে তাকাল। তাহসিন কফি মগ হাতে নিয়ে অলস ভঙ্গিতে একের পর এক চুমুক দিয়ে চলেছে। রেলিং ঘেঁষে পাশাপাশি দাঁড়িয়েও দুজনের মধ্যে নীরবতা বিরাজমান অনেকক্ষণ। মিনিট দশেক পার করেও যখন তাহসিনের মাঝে মুখ খোলার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না, তখন নাদিয়া নিজেই বলল,“এভাবে আর কতদিন তাহসিন? দু দুটো মাস কেটে গেল।”
তাহসিন নীরব। নাদিয়া উত্তরের অপেক্ষায় তাহসিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেও নিরাশ হলো। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে পুনরায় বলল,“আমি কি দেখতে খুব খারাপ?”
তাহসিন সম্মুখে দৃষ্টি রেখেই এবার ভাবলেশহীনভাবে বলল,“কেউ বলেছে না কি?”
নাদিয়া মাথা দুলিয়ে বলল,“উঁহু। জানতে ইচ্ছে করছে। বল না।”
“নিঃসন্দেহে তুই যথেষ্ট সুন্দরী।”
“ডালিয়ার থেকেও?”
তাহসিন এবার শান্ত দৃষ্টিতে নাদিয়ার দিকে তাকাল। নাদিয়া চাতক পাখির ন্যায় উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। কিন্তু তাহসিন দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে কফি মগে চুমুক দিলো। নাদিয়া বুঝল সে বোকামি করে ফেলেছে। মেকি হেসে বলল,“সরি, আগের মতো পাগলামি করে ফেলেছি তাই না?”
তাহসিন নিরুত্তর। আবারও কিছুক্ষণ নিরবতা চলল দুজনের মাঝে। এবারও নাদিয়াই আগে কথা বলল। সম্মুখে দৃষ্টি রেখে মৃদু কন্ঠে বলল,“আমি কি এতটাই অযোগ্য যে আমাকে ভালোবাসলে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?”
তাহসিনও নাদিয়ার মতোই একই ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,“মাথা ব্যথার ঔষধে যদি মনের ব্যথা সারতো, তাহলে এই প্রশ্নের কোনো একটা উত্তর দেওয়া সম্ভব হত।”
এরূপ উত্তরের বিপরীতে আর কী কথা বলা যায় তা জানা নেই নাদিয়ার। বুক চিরে এক তপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলেও সে তা সন্তর্পণে চেপে নিলো। কিন্তু হঠাৎ করেই আবেগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে চোখ দুটো জ্বলতে শুরু করল। নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে নাদিয়া ধরা গলায় বলল,“দুই মাস ধরে তুই যে কষ্টটা বুকে লালন করছিস, গত দুই বছর ধরে আমি তা হারে হারে টের পাচ্ছি। মন থেকে ভালো তো আমিও বেসেছি তাহসিন। তবে আমি কোন অপরাধের শাস্তি পাচ্ছি বলতে পারবি?”
তাহসিন কফি মগে শেষ চুমুক দিয়ে মৃদু হাসল। নিচু স্বরে কবিতার সুরে বলল,
ঠোঁটের কোণে কৃত্তিম হাসিটা দেখে,
আমাকে সুখী ভেবে
তোমার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের গল্প শোনাও।
আমার আকাশে জমকালো মেঘ জমেছে,
দেখতে নাহি পাও!
এবার নাদিয়াও নিরুত্তর। মিনিট খানেক পর আবার সে মৃদু কন্ঠে বলল,“আজ সন্ধ্যায় আমাকে দেখতে আসার কথা। সবার ধারণা ছেলেপক্ষ আমাকে পছন্দ করবে, কারণ তারা স্ব-ইচ্ছায় বাবার কাছে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। আর আমারও তাই ধারণা।”
তাহসিন নাদিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল,“তোরা কি সিরিয়াল দিয়ে বিয়ে করার প্ল্যান করেছিস না কি? একজনের পর একজন করেই চলেছিস, থামাথামির বালাই নেই।”
কথাটা বলে তাহসিন শব্দ তুলে হেসে উঠল। নাদিয়া শান্ত দৃষ্টিতে তাহসিনের মুখের কৃত্তিম হাসিটা দেখল। তারপর বলে উঠল,“আমি এখনও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাইনি।”
তাহসিন প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“কোন ব্যাপারে?”
“বিয়ের।”
“এত ভাবাভাবির কী আছে? পছন্দ হলে হ্যাঁ বলে দিবি।”
নাদিয়া করুণ দৃষ্টিতে তাহসিনের মুখের দিকে তাকালেও তাহসিন মুখ ফিরিয়ে নিল। নাদিয়ার বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হলো। একসময় সেই তোলপাড় কান্না হয়ে বেরিয়ে এল। নাদিয়া কাঁদছে বুঝতে পেরেও তাহসিন তার দিকে ফিরে তাকাল না। অযথা মায়া বাড়াতে চায় না সে। নাদিয়ার কান্নার শব্দ কমে আসতেই তাহসিন গম্ভীর গলায় বলল,“আমার ভান্ডারে তোকে দেওয়ার মতো এক চিমটি ভালোবাসাও বেঁচে নেই রে নাদি। থাকলে হয়তো আমি তোকে থেকে যেতে বলতাম। সবটা তো কেবলমাত্র একজনকেই উপুড় করে ঢেলে দিয়েছি। যেখানে ভালোবাসাই বেঁচে নেই, সেখানে তোকে নিজের কাছে রাখা আর মৃত গাছের গোড়ায় পানি দেওয়া একই ব্যাপার।”
নাদিয়া বেশ ভালো করেই জানে তাহসিন কষ্টে ধুঁকে ধুঁকে মরবে, তবু ডালিয়া ব্যতিত অন্য কাউকে দ্বিতীয়বার ভালোবাসবে না। হঠাৎ করেই তাহসিনের ওপর নাদিয়ার খুব বিরক্তি এসে গেল। পৃথিবীতে কি আর কেউ প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে দ্বিতীয়বার ভালোবাসেনি? বেসেছে, আর সুখীও হয়েছে। তবে তাহসিন কেন পারবে না? নাদিয়ার আর এক মুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না। ঘুরে দাঁড়িয়ে সন্তর্পণে চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। নাদিয়া চলে যাচ্ছে টের পেয়েও তাহসিন নিশ্চুপ। কয়েক পা এগিয়ে গিয়েও নাদিয়া থেমে গেল। পেছন ফিরে না তাকিয়েই থমথমে গলায় বলল,“বিয়ে যদি ঠিকও হয়ে যায়, রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার আগ পর্যন্ত আমি অপেক্ষায় থাকব। কেউ আমাকে পিছু ডাকলে আমি ফিরে আসব।”
তাহসিন ফিরে তাকাল না। সম্মুখে দৃষ্টি রেখেই শান্ত স্বরে বলল,“অন্তুর কথা যেন সত্যি হয়। ভালোবাসার রঙে রঙিন হয়ে যাক তোর জীবন। অগ্রিম অভিনন্দন।”
এরপর আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেল না নাদিয়া। ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করে ছুটে চলে গেল তাহসিনের রুম থেকে। তাহসিন নীরব। দুপুরের তেজোদীপ্ত সূর্যটা তীর্যকভাবে উত্তপ্ত আলো ফেলছে ঠিক মাথা বরাবর। তাহসিন বেলকনি থেকে ধীর পায়ে রুমে চলে এল। অলস ভঙ্গিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে এক মাস আগের সেই তিক্ত দৃশ্যটা ভেসে উঠল।
দুই মাস আগে,
ডালিয়ার বিয়ের কথা শোনার পর থেকে তাহসিন এতটাই ভেঙে পড়েছে যে বাসা থেকে বের হওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে, মেয়েদের মতো কেঁদেকেটে চেহারার অবস্থা যা-তা করে ফেলেছে। তার মা তাকে নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। বন্ধুরা সবাই মিলে বাসায় এসে তাকে অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করেছে, ভার্সিটিতে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হয়নি। উলটো যখন বন্ধুরা সবাই ফোন করেও তাহসিনকে বুঝানোর চেষ্টা করল, তখন সে ফোনটাও বন্ধ করে রাখল। টানা একমাস এমন নিয়মেই চলল তাহসিনের জীবন। কিন্তু শেষমেশ যখন তাহসিনের মা ছেলের চিন্তায় চিন্তায় নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন, তখন তাহসিনের টনক নড়ল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ভার্সিটিতে গেল। সিদ্ধান্ত নিল মনকে শক্ত করার। কিন্তু চাইলেই কি বাস্তবতা এতটা সহজ হয়? ভার্সিটিতে গিয়েই তাহসিন না চাইতেও ডালিয়ার মুখোমুখি হলো। কিছু সময়ের জন্য থমকে গেল দুজনের পৃথিবী। দুই জোড়া চোখ ঝাপসা হয়ে এল। ডালিয়া বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। তাহসিনের ঐ ঝাপসা চোখে যে তার প্রতি হাজারো অভিযোগ স্পষ্ট। বন্ধুরা দুজনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে একা ছেড়ে দিলো কিছু সময়ের জন্য। ওদের দুজনেরই নিজেদের মধ্যে কথা বলাটা প্রয়োজন। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তাহসিন নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। এদিকে ডালিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা তুলে তাহসিনের অভিযোগমাখা চোখের দিকে তাকানোর সাহস আর তার দ্বিতীয়বার হচ্ছে না। তাহসিন গলা ঝেড়ে মৃদু গম্ভীর কন্ঠে বলল,“কেমন আছিস?”
ডালিয়া উত্তর দিলো না, মাথা তুলে তাকালও না। তাহসিন মিনিট দুয়েক উত্তরের অপেক্ষা করে তারপর ডালিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,“কংগ্রাচুলেশন।”
ডালিয়া এবার ছলছল চোখে নত মুখটা উঁচু করে তাকাল। তাহসিনের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতেই দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা চালাল। তাহসিন তা দেখে ঠোঁটের কোণে কৃত্তিম হাসির রেখা টেনে বলল,“আমার বেলী ফুলের মালা কই? আনিসনি?”
ডালিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাহসিনের মুখের দিকে তাকাল। তাহসিনের ঝাপসা চোখ আর ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসিটুকু দেখে তার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। এতক্ষণ আটকে রাখা চোখের পানি এবার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। তাহসিন নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসার চেষ্টা করে বলল,“ওপস্ সরি। বেলী ফুলের মালা তো তোর হাসবেন্ড পাওনা। তাকেই বরং দিস। কী একটা অবস্থা বলতো! হুটহাট সবাই বিয়ে করে ফেলছে, অথচ আমরা টেরই পাই না।”
ডালিয়া এবারও নিশ্চুপ। তাহসিন ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোণের চিকচিকে পানিটুকু মুছে ফেলে বলল,“কথা বলছিস না কেন? হাসবেন্ড বোধ হয় অন্য কোনো ছেলেদের সাথে কথা বলতে বারণ করে দিয়েছে? স্বাভাবিক, এমন একটা বউ পেয়েছে। দুলাভাই হয়তো বউকে নিয়ে খুব ভয়ে থাকে।”
কথাটা বলে তাহসিন নিজেই হেসে ফেলল। ডালিয়া এবার আর পারল না নিজেকে সামলাতে। দুহাতে মুখ চেপে ধরে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠল। ডালিয়ার কান্না সহ্য করার ক্ষমতা নেই ভেবে তাহসিন ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে পা বাড়াতে বাড়াতে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“বাস্তবতার নিকুচি করি!”
তাহসিন কয়েক পা এগোতেই চোখের পলকে ডালিয়া ছুটে এসে তাহসিনের পথ রোধ করে দাঁড়াল। তাহসিন থমকে দাঁড়িয়ে পড়তেই ডালিয়া তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তাহসিন হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আজ প্রথমবারের মতো ডালিয়া স্ব-ইচ্ছায় তার হাত ধরল। অথচ এই ছোঁয়াতে নেই কোনো ভালোবাসার অনুভূতি। অনুভূতিগুলো আজ শূন্য আকাশে ফানুসের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। ডালিয়া ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,“আ’ম সরি তাহসিন। আমাকে তুই মাফ করিস। বিশ্বাস কর, আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলাম বিয়েটা আটকানোর। কিন্তু পারিনি। আমি জানি না আল্লাহ্ আমাকে কোন পাপের শাস্তি দিলো। আমি চাই না তোর সুন্দর জীবনটা আমার জন্য এলোমেলো হয়ে যাক। ভুলে যা আমাকে, তুই ভালো থাক।”
তাহসিন এবার ফিক করে হেসে দিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,“ভুলে যাব, ভালোও থাকব। তুই পেরেছিস?”
ডালিয়া আরও জোরে কেঁদে উঠল। কান্নাভেজা চোখে তাহসিনের চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,“বলেছিলি আমি বাড়ি থেকে ফিরলে কোনো একটা কথা বলবি। আজ বলবি?”
তাহসিনের বুকের বাঁ পাশটা চিনচিনে ব্যথায় ছেয়ে গেল। ডান চোখের কোণের টলমলে পানিটুকু অবাধ্যের মতো গড়িয়ে পড়তেই সে হন্তদন্ত হয়ে ডালিয়ার মুঠো থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে গড়িয়ে পড়া পানিটুকু দ্রুত হাতে মুছে ফেলল। ডালিয়া উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে আছে তাহসিনের মুখপানে। তাহসিন এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,“থেকে যাক কিছু আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ। অপূর্ণতা নিয়েই আমি ভালো থাকব। দোআ রইল, স্বামী সোহাগী হ। আমার অপূর্ণতা তোর জীবনে পূর্ণতা বয়ে আনুক।”
কথাগুলো বলে তাহসিন আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। শেষবারের মতো ডালিয়ার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে হনহন করে হেঁটে অতি দ্রুত গেইটের দিকে চলে গেল। ডালিয়া ঠাঁয় দাঁড়িয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রিয় মানুষটার এক বুক কষ্ট নিয়ে চলে যাওয়া দেখল। তাহসিন দৃষ্টির আড়াল হতেই বন্ধুরা সবাই ডালিয়াকে ঘিরে ধরল। ডালিয়া ইলোরাকে জড়িয়ে ধরে পুনরায় ফুঁপিয়ে উঠল। তার আহাজারি জানান দিলো প্রেম নামক অসুখে তার জীবনটা এমনভাবেই আক্রান্ত হয়েছে যে এ অসুখ সারাতে তার বৈবাহিক সম্পর্কও ব্যর্থ। শুধুমাত্র সুপ্ত থাকবে বলেই এ অসুখের খবর আর কেউ পাবে না।
পরেরদিনই তাহসিন খবর পেল ডালিয়ার স্বামী তাকে
প্রচুর মেরেছে। খবরটা পেয়ে তাহসিনের কান লাল হয়ে গেল। পরে জানতে পারল ভার্সিটিতে তাহসিনের সাথে ডালিয়ার কান্নাকাটির খবর কোনোভাবে তার স্বামীর কানে পৌঁছেছে। ডালিয়ার ধারণা তার স্বামীর এক আত্মীয় যে ঐ ভার্সিটিতেই পড়াশোনা করে, এ কাজ তারই। এরপর তাহসিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে আর কোনোদিনও ডালিয়ার মুখোমুখি হবে না। অন্তত ডালিয়ার অনুভূতিগুলো ভুলাতে হলেও তাকে দূরে থাকতে হবে। সেদিনের পর থেকে সত্যিই আর সে ডালিয়ার মুখোমুখি হয়নি। ভার্সিটিতে সেদিনই গিয়েছে যেদিন ডালিয়া যায়নি। এজন্য অবশ্য তাকে সব বান্ধবীদের থেকে খোঁজ-খবর নিতে হয়েছে। প্রতিদিন ক্লাস করতে পারবে না বলে তাহসিন একটা কোচিং সেন্টারেও ভর্তি হয়েছে, যাতে পরীক্ষাটা ঠিকমতো দিতে পারে। মাঝে মাঝে বান্ধবীরা এসে তার সাথে দেখা করে যায়, আবার বাইরে ঘুরেফিরে কিছু সময় কাটায়। এ কাজটা অবশ্য নাদিয়া বেশি করেছে। সে দুদিন পর পরই তাহসিনের বাড়িতে এসে তাকে নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছে, তার সাথে অনেকটা সময় আড্ডা দিয়ে মন ভালো রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাহসিন যতই নিজের মনকে শক্ত করার চেষ্টা করুক না কেন, আসলে সে এই কাজটা আজ অব্দিও করতে পারেনি। শেষমেষ বান্ধবীরা সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছে। সবারই ধারণা তাহসিন কোনোদিনই পারবে না ডালিয়াকে ভুলে অন্য কাউকে ভালোবাসতে। কারণ সে নিজেই চায় না ডালিয়া ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে ভালোবাসতে।
•
বিছানায় পা ভাঁজ করে বসে নিজের কাজে ব্যস্ত এরেন। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ সামনের ল্যাপটপে। তার পাশেই যে কলাপাতা রংয়ের শাড়ি পরিহিতা এক তরুণী গাল ফুলিয়ে বসে আছে, সেদিকে তার খেয়ালই নেই। প্রায় বিশ মিনিট এভাবেই কেটে গেছে। শেষমেষ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তরুণীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। হাত বাড়িয়ে হুট করে ল্যাপটপটা বন্ধ করে ফেলল। এরেন বাজেভাবে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে অবাক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। আহাজারি করে বলল,“এটা কী করলে! কাজ করছিলাম দেখছিলে তো।”
এতক্ষণের জমে থাকা অভিমানটা জাগিয়ে তুলে ইলোরা গম্ভীর গলায় বলল,“হ্যাঁ দেখছিলাম। আমি তোমার মতো অন্ধ না যে পাশে আস্ত একটা মানুষ বসে থাকলেও দেখব না।”
এরেন একইভাবে বলল,“আমি তোমাকে বলেছিলাম তো আমার কাজ আছে, ঘুমিয়ে পড়ো। শুনলে না কেন?”
“একজন আমার পাশে বসে রাত জেগে কাজ করবে, আর আমি পড়ে পড়ে ঘুমাব। অতটাও স্বার্থপর নই আমি।”
“এখানে স্বার্থের কী আছে? তুমি শুধু শুধু রাত জেগে পাশে বসে থাকবে কী করতে বলো তো? শরীর খারাপ করবে তো।”
ইলোরা কপাল কুঁচকে বলল,“আচ্ছা? আমার শরীর খারাপ করবে, আর তোমার? তোমার করবে না? তোমার শরীর কি লোহার তৈরি?”
এরেন ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে ল্যাপটপটা সামনে থেকে সরিয়ে রেখে ইলোরার দিকে ঘুরে বসে বলল,“আচ্ছা কী হচ্ছে বলো তো? এই মাঝরাতে এখন কথা কাটাকাটির সময়? কাল না তোমার ভার্সিটি আছে? ঘুমাও না লক্ষ্মীটি।”
ইলোরা ত্যাড়াভাবে বলল,“তোমারও তো অফিস আছে, তুমিও ঘুমাও।”
ইলোরার ত্যাড়া-ত্যাড়া কথা শুনে এরেন কপাল চুলকে বলল,“আমার কাজ আছে তো বাবা। বুঝতে পারছো না তুমি?”
ইলোরা বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,“সবই বুঝি, আমি বাচ্চা না।”
এরেন কিছু বলতে যাবে তখনই ইলোরা রুমের লাইট অফ করে দিলো। এরেন কিছুটা জোরেই বলে উঠল,“আরে, লাইট অফ করলে কেন? অন করো।”
ততক্ষণে ইলোরা ডিম লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় উঠে আসতে আসতে বলল,“লাইট অন করার আর দরকার নেই। এখন ঘুমাবে।”
“আমার কাজ আছে, কতবার বলব?” বলতে বলতে এরেন বিছানা থেকে নামতে যেতেই ইলোরা তার হাত টেনে ধরল।
“বলছি না ঘুমাবে?”
কথাটা বলেই ইলোরা এরেনকে ঠেলে শুইয়ে দিলো। এরেন উঠতে যেতে নিতেই সে এরেনের বুকে মাথা রেখে তাকে জাপটে ধরে নিজেও শুয়ে পড়ল। এরেন এবার শান্ত হয়ে গেল। দুহাতে প্রেয়সীকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আদুরে গলায় বলল,“ঘুমালেই হবে? কাজ করবে কে?”
ইলোরা এরেনের বুকে মুখ গুঁজেই উত্তর দিলো,“ফজরের নামাজের পর তো ফ্রী থাকো, তখন করবে।”
এরেন মুচকি হাসল। মিনিট তিনেক চুপ থেকে ইলোরা মাথা উঠিয়ে এরেনের বুকে থুতনি ঠেকিয়ে, ডিম লাইটের আবছা আলোয় এরেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,“পিএইচডিটা করলে না কেন?”
এরেনও আবছা আলোয় ইলোরার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,“মানে?”
“আমার কাছে লুকালে কেন?”
ইলোরার প্রশ্নে এরেন সন্দিহান কন্ঠে বলল,“এসব কে বলল তোমায়?”
“বাবা আজ আম্মীর সাথে বলছিল, তোমাকে পিএইচডি করতে আমেরিকা যাওয়ার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তুমি না করে দিয়েছ। আমি শুনেছিলাম।”
এরেন ছোটো একটা শব্দ করল,“ওহ্।”
“না করলে কেন?”
“বোঝো না?”
“আমি জানি তুমি আমার জন্য এমনটা করেছ।”
“তাহলে জিজ্ঞেস করছো কেন?”
“বাবা নিজের ইচ্ছেয় তোমাকে আমেরিকা পাঠাতে চেয়েছিল। উনি কী ভাববে বলো তো?”
এরেন ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,“আমাদের জীবনটা খুবই ছোটো ইলোনি। এত ছোটো জীবনে আমি তোমাকে নিয়ে তৃপ্ত হতে পারব না, এটা আমার কত বড়ো একটা আফসোস জানো তুমি? আমি তো তোমাকে নিয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকতে চাই। আর সেখানে শুধু এইটুকু একটা জীবনেই তোমাকে কাছে পাব। এমনটা তো নয় যে আমি বেকার বসে আছি। বিজনেস করছি, সংসার করছি, এভাবেই বেশ আছি। তাই এই ছোটো জীবনের একটা মুহূর্তও আমি নষ্ট করতে চাই না। সবসময় তোমার কাছাকাছি থাকতে চাই। তুমি তোমার বাবার বাড়ি গিয়ে একটা রাত থাকলে সেদিন রাতে আমার ঠিকমতো ঘুম হয় না। অথচ সুদূর আমেরিকায় আমার ঘুম হবে কীভাবে বলো তো? তুমি জানো না আমি প্রেমাসুখে আক্রান্ত? এতটা দূরত্বে থেকে আমার প্রেমাসুখের ঔষধ ইলোনির অভাবে তো আমি মরেই যাব। এত দ্রুত মরে গেলে আমি বাবা হব কীভাবে বলো তো? আমার কত দিনের স্বপ্ন ছোট্ট একটা বেবি আসবে, আমাকে বাবা বলে ডাকবে। আমার বুকের বাঁ পাশে ইলোনি ঘুমাবে আর ডান পাশে বেবিটা।”
এরেনের কথা শুনতে শুনতে ইলোরার চোখ দুটো ভিজে উঠল। সে থমথমে গলায় বলল,“এত সুখ আমার কপালে সইবে?”
এরেন ঝুঁকে এসে ইলোরার মুখটা নিজের দুহাতে তুলে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলল,“আমি তো চাই পুরো জগতের সুখ শুধুই আমার ইলোনিকে দিতে। ইলোনির মুখের একটু হাসি যে আমার বড্ড প্রিয়।”
ইলোরা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,“আমার কিন্তু কান্না চলে আসছে।”
এরেন মৃদু শব্দ তুলে হেসে বলল,“হায়রে আমার ছিঁচকাদুনে বউ রে! তোমার কি জামাই মরছে যে কথায় কথায় বিনা আমন্ত্রণে কান্না চলে আসে? সবসময় রোমান্টিক মোমেন্টেই তোমার কান্না পায় কেন? এত ইমোশন আসে কোত্থেকে হ্যাঁ?”
“তুমি এত ভালোবাস কেন আমায়? কম কম বাসতে পারো না। অতিরিক্ত ভালোবাসা না কি ভালো না।”
“কে বলল শুনি?”
“কী জানি!”
“আমি তো এর থেকেও বেশি ভালোবাসতে চাই। আচ্ছা? ভালোবাসা আরেকটু বাড়ানো যায় কীভাবে বলো তো?”
ইলোরা এরেনের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,“বাড়াতে হবে না। এখন যতটা বাসো, সারাজীবন এতটা বাসলেই হবে। তুমি নিজেও জানো না তুমি আমাকে ঠিক কতটা ভালবাসো।”
এরেন হাসিমুখে বলল,“তাই না কি? কিন্তু আমি তো আপনাকে একটুও ভালোবাসি না মহারানি। এক ফোঁটাও না, এক চিমটিও না।”
ইলোরা এরেনের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,“ফাজলামো করবা না। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাও। গুড নাইট।”
এরেন পুনরায় মৃদু শব্দ তুলে হাসল। ইলোরাকে বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিচু স্বরে বলল,“ভালোবাসি ইলোনি।”
চোখ বন্ধ করেই ইলোরা মুচকি হাসল। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে এই কথাটা বলা এরেনের অভ্যাস। যেন এই শব্দ দুটো তার ঘুমের ঔষধ। জাকির জামানের মুখে এরেনের আমেরিকা না যাওয়ার কথা শুনে ইলোরা মনে মনে নিজেকে দায়ী করছিল। অথচ এই মুহূর্তে তার মনে হলো, ভালোই হয়েছে মানুষটা আমেরিকা যায়নি। চলে গেলে প্রতি রাতে এভাবে বুকে জড়িয়ে ঘুমাত কীভাবে? ঘুমানোর আগে কানের কাছে ফিসফিস করে ‘ভালোবাসি ইলোনি’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করত কীভাবে? হুটহাট টুপ করে কপালে ভালোবাসা দিত কীভাবে? পিএইচডি চুলোয় যাক, মানুষটা তো কাছে আছে।
চলবে………………….🌸
(অনেকদিন পর গল্প দিলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আর দুটো এক্সাম আছে, শেষ হলেই এই গল্পের সমাপ্তি টানব ইন শা আল্লাহ্।)