#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৬৩
দ্রুত পায়ে হেঁটে হসপিটালের করিডোর পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়াল জারিন। কোনো কিছু না ভেবেই দরজার নব ঘুরিয়ে দরজাটা হালকা খুলে ভেতরে উঁকি মেরে বলল,“আসব?”
ডক্টর আরহাম শেখ মনোযোগ দিয়ে একটা ফাইল দেখছিল। মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে ফাইল থেকে চোখ উঠিয়ে দরজার দিকে তাকাল। জারিনকে দেখেই ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে মৃদু হেসে বলল,“আরে মিস জারিন! আসুন, আসুন।”
জারিন ভেতরে ঢুকে দরজাটা আটকে ধীর পায়ে এগিয়ে যেতেই আরহাম হাতের ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে বলল,“প্লিজ টেক ইউর সিট।”
জারিন বিনা বাক্যে সামনের চেয়ারটাতে বসে পড়ল। আরহামের দিকে তাকিয়ে বলল,“আপনার সাথে কথা আছে।”
“শিওর, বলুন।”
জারিন ছোটো একটা দম নিয়ে বলল,“এভাবে হুট করে সরাসরি বিয়ের প্রপোজাল দেওয়ার মানে কী?”
আরহাম হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,“বিয়ের প্রপোজাল দেওয়ার একটাই মানে, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। এছাড়া আর কোনো মানে আছে বলে আমার মনে হয় না।”
“বিয়ে করতে চান মানে! আপনি আমাকে কতদিন ধরে চিনেন? মাত্র ছয় মাস ধরে আম্মীর ট্রিটমেন্টের জন্য আসি আপনার কাছে। এর বাইরে তো আমার সাথে আপনার তেমন পরিচিতিও নেই। এটুকু চেনা-জানায় আপনি সোজা গিয়ে বাবার কাছে বিয়ের প্রপোজাল দিয়ে বসলেন! আজব!”
কথাগুলো বলতে বলতে জারিনের চেহারায় রাগ ফুটে উঠল। আরহাম একইভাবে বলল,“আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আমি নই, আমার বাবা প্রপোজাল নিয়ে গিয়েছিল।”
“আপনিই তো পাঠিয়েছেন।”
“তা পাঠিয়েছি।”
“কেন পাঠিয়েছেন?”
“বিয়ে করব তাই। বয়স তো আর কম হলো না। কদিন পর বুড়ো হয়ে গেলে বিয়ে কবে করব?”
“এসব জেনে আমি কী করব? আমি কি বলেছি আপনাকে বিয়ে করব? আমাকে না জানিয়ে আপনি এমন একটা কাজ কীভাবে করলেন?”
“কুল ডাউন মিস জারিন। এত হাইপার হচ্ছেন কেন? আপনাকে আমার ভালো লাগে, তাই বিয়ে করতে চাই। কারণ আমি হালাল সম্পর্কে বিশ্বাসী। এমন তো নয় যে আমি আপনার সাথে প্রেম করে বেড়ানোর জন্য আপনাকে প্রপোজাল দিয়েছি। আমি গিয়ে আমার ফ্যামিলিকে জানিয়েছি। তারা গিয়ে আপনার বাবাকে জানিয়েছে। আপনাকে দেখে তাদেরও পছন্দ হয়েছে, তাই ব্যাপারটা বিয়ে অব্দি পৌঁছাতে পেরেছে।”
জারিন বিরক্তি নিয়ে বলল,“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না ডক্টর আরহাম।”
আরহাম স্বভাবসুলভ হেসে বলল,“আপনার বাবাকে না বলে আমাকে কেন বলছেন?”
“কীভাবে বলব? বাবা তো আমার কথা শুনতেই চাইছে না। আপনি এসব শুরু করেছেন, আপনিই থামান প্লিজ।”
আরহাম দুহাত টেবিলে ভাঁজ করে রেখে সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বসে প্রশ্ন করল,“কীভাবে থামাব?”
জারিন ফট করে জবাব দিলো,“বাবাকে বলবেন আপনার ফ্যামিলির কেউ একজন আমাকে পছন্দ করেনি, তাই বিয়েটা হবে না।”
“কিন্তু আমার বাবা তো অলরেডি জানিয়ে দিয়েছে যে, আপনাকে আমার পুরো ফ্যামিলি পছন্দ করেছে। এখন তো আবার উলটো কথা বলা যাবে না।”
“তার মানে আপনি বিয়েটা আটকাবেন না?”
আরহাম অবাক হয়ে বলল,“আপনার মনে হয় আমি বিয়েটা আটকানোর জন্য নিজে আপনাকে পছন্দ করেছি?”
জারিন হুট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রাগত স্বরে বলল,“রাখুন আপনার পছন্দ। আমি আপনাকে বিয়ে করব না, ব্যাস। আপনি না আটকালে আমি নিজেই আটকাব।”
আরহাম ঘাড় কাঁত করে বলল,“ট্রাই ইট।”
জারিন রাগে গজগজ করতে-করতে দরজার দিকে পা বাড়াতেই আরহাম পিছু ডাকল,“মিস জারিন।”
জারিন দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে পেছন ফিরে তাকাতেই আরহাম মিষ্টি হেসে বলল,“রাগলে আপনাকে আরও কিউট লাগে। ভাবছি বিয়ের পর আপনাকে প্রতিদিন এক বেলা করে ইচ্ছে করেই রাগিয়ে দিব।”
আরহামের এরূপ কথা আর মিষ্টি হাসিতে জারিনের রাগ মাথায় চড়ে বসল। সে শক্ত মুখে দাঁতে দাঁত পিষে রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করতে-করতে, ধুপধাপ পা ফেলে চেম্বার থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় নিজের রাগ দরজার ওপর ঢেলে দরজাটাও ঠাস করে আটকালো। জারিনের কান্ড দেখে আরহাম মৃদু শব্দ তুলে আপন মনে হাসল। আজ থেকে প্রায় ছয় মাস আগে জারিন তার মাকে নিয়ে আরহামের চেম্বারে এসেছিল। প্রথম দর্শনেই যে সে মেয়েটার প্রেমে পড়েছিল, এমনটা নয়। জারিন প্রায়ই তার মাকে চেকআপ করাতে নিয়ে আসত। বলাবাহুল্য ধীরে ধীরেই এই চাঞ্চল্য স্বভাবের মেয়েটাকে ভালো লাগতে শুরু করেছিল। দিন দিন ভালো লাগাটা ভালোবাসায় রূপান্তর হয়েছে। কিন্তু মনের কথাটা বলবে-বলবে করেও বলা হয়ে ওঠেনি। জারিনের পছন্দের কেউ আছে কি না, এই নিয়ে আরহাম কনফিউজড ছিল। আর তাই জারিনের সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়েছে। যখন জানতে পেরেছে জারিনের বাবা তাকে বিয়ে দিতে চাইছে, তখনই হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছে। নিজের বাবা-মাকে জারিনের বাবার কাছে পাঠিয়েছে। জারিনকে তারাও বেশ পছন্দ করেছেন। জাকির জামানও আরহামের মতো ছেলে হাতছাড়া করতে নারাজ। এদিকে এরেন ভালোমতোই জানে যে জারিন বিয়েটা আটকানোর চেষ্টা করবে। তাই সে আগেভাগেই আরহামের সাথে একান্তে কথা বলেছে। এটাও বলেছে জারিন যেকোনো সময় আরহামের সাথে কথা বলতে আসতে পারে। রনির ব্যাপারে সব খোলাখুলি বলার পরও আরহাম এরেনকে আস্বস্ত করেছে যে সে জারিনকেই বিয়ে করবে। জারিনের অমতকে সে পাত্তা দিবে না। মেয়েটাকে সে ভালোবাসে যে! অতীতে বাসুক মেয়েটা অন্য কাউকে ভালো। সে তার ভালোবাসা দিয়েই মেয়েটার অপূর্ণতায় পূর্ণতা দিবে।
•
দরজায় টোকা পড়তেই ইলোরা হাতের ভাঁজ করা কাপড়গুলো ঝটপট কাবার্ডে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে ওপাশে জারিনকে দেখে হাসিমুখে বলল,“আপু, ভেতরে এসো।”
জারিন ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে প্রশ্ন করল,“ভাইয়া কোথায়?”
“ওয়াশরুমে, ফ্রেশ হচ্ছে। মাত্র ফিরল।”
“ওহ্!”
ইলোরা জারিনের গোমড়া মুখটা নিরীক্ষণ করে বলল,“তোমার মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন আপু? কিছু কি হয়েছে?”
জারিন হাসার চেষ্টা করে বলল,“আমি ঠিক আছি ভাবি। ভাইয়ার সাথে একটু ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলব।”
“কোন বিষয়ে?”
জারিন কিছু বলার আগেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। এরেন বেরিয়ে এসে জারিনকে দেখে ভ্রুকুটি করে বলল,“কিরে বুড়ি? মুখটা চুপসে আছে কেন?”
ইলোরা বলল,“আপু তোমার সাথে কী যেন ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে এসেছে।”
এরেন প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে জারিনের দিকে তাকিয়ে বলল,“হ্যাঁ বল।”
জারিন এরেনের দিকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে চঞ্চল হয়ে বলল,“বাবাকে একটু বুঝা না ভাইয়া। বাবা আমার কথা শুনতেই চাইছে না। এই প্রথম বাবা এমন অবাধ্যের মতো আচরণ করছে আমার সাথে।”
এরেন ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জারিনের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,“কেন এমন করছিস বুড়ি? একজনের জন্য তো জীবন থেমে থাকে না। আমি জানি তুই রনিকে ভুলতে পারছিস না। কিন্তু এভাবে তো জীবন চলে না। বাবা-আম্মী তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। আম্মীর শরীরের অবস্থা তো দেখছিস। এতটা টেনশন নেওয়া তার জন্য ক্ষতিকর। এই পর্যন্ত কত প্রপোজাল বাবা ক্যানসেল করেছে। শোন বোন, তাদেরও তো ইচ্ছে হয় তোকে একজন যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দিতে। এভাবে কতদিন বাঁচবি?”
জারিন আহত মুখে বলল,“আমি সব বুঝি ভাইয়া। কিন্তু বিশ্বাস কর, তবু আমার বিয়ে করতে ইচ্ছেই করছে না।”
“মনকে শক্ত কর। নিজেই নিজের মনকে বুঝানোর চেষ্টা কর। আমি জানি তুই সঠিক সিদ্ধান্তই নিবি।”
ইলোরাও এবার জারিনের কাছে এগিয়ে এসে বলল,“আপু, তুমি খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে। এভাবে থেমে থাকা তোমায় মানায় না। ডক্টর আরহাম খুব ভালো লোক। একটু ভেবে দেখো প্লিজ। আগেই না করে দিয়ো না।”
জারিন বলল,“তোমরাও আম্মীর মতোই কথা বলছো!”
এরেন বলল,“আমরা তোর ভালো চাই রে বুড়ি। তোকে এভাবে দেখতে আমাদের কারোরই ভালো লাগে না।”
“কীভাবে দেখতে? আমি যেমন আছি, ভালো আছি ভাইয়া।”
“সত্যিই কি তাই?”
জারিন কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,“ভাইয়া প্লিজ……।”
জারিনের কথার মাঝপথে এরেন বলল,“বিয়ের ডেট এখনও ফিক্সড হয়নি বুড়ি। তোকে যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে। ভেবেচিন্তে ফাইনাল ডিসিশন জানাবি। তার আগেই বাবার সাথে এটা নিয়ে কথা বাড়াস না। যা বলার আমাকে বলবি।”
জারিন বুঝল এটা নিয়ে এরেনের সাথেও কথা বলে লাভ হবে না। তাই সে মাথা দুলিয়ে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না। ‘আসছি’ বলে দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল। জারিন চলে যেতেই এরেন গিয়ে বিছানায় পা তুলে বসে পড়ল। ইলোরা তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,“তোমার কী মনে হয়? আপু রাজি হবে?”
এরেন ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বলল,“অবশ্যই।”
ইলোরা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,“এতটা নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে? এইমাত্রও তো বলে গেল তার ইচ্ছে নেই।”
“ওসব তুমি বুঝবে না।”
“বুঝব না মানে কী? আমি কি বাচ্চা না কি? আজব!”
এরেন হুট করে বলে উঠল,“এই, ভালো কথা মনে করেছ। মুনার বেবির কত মাস হলো?”
ইলোরা একটু ভেবে বলল,“মাত্র এক মাস।”
“ভাবছি কাল একবার যাব। বেবিটাকে দেখে আসব, ওকে?”
ইলোরা খুশি হয়ে বলল,“ওকে।”
“ওর বেবিটা কিন্তু অনেক কিউট।”
“মায়ের মতো হয়েছে।” বলতে বলতে ইলোরা এগিয়ে গিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে এরেনের মুখোমুখি বসল।
এরেন কপাল কুঁচকে বলল,“বেবি কিউট হয়েছে বলেই মায়ের মতো হয়েছে? বাবার মতোও তো হতে পারে। ওর বাবার চেহারা কি খারাপ? এই, তার মানে আমার বেবি বেশি কিউট হলে বলবে তোমার মতো হয়েছে, আর কম হলে বলবে আমার মতো?”
ইলোরা যেন আহাম্মক বনে গেল। চোখ জোড়া সরু করে বলল,“এ আবার কেমন কথা? আমি তো সত্যি কথাই বললাম, তুমি এতভাবে প্যাঁচাচ্ছ কেন?”
“বুঝি বুঝি, আমাকে বোকা ভেবো না।”
“তুমি আর তোমার আজগুবি কথা। ধুর!” কথাটা বলে ইলোরা উঠে যেতে নিতেই এরেন তার হাত টেনে ধরে কাছে টেনে নিল। বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিচু স্বরে বলল,“এই ইলোনি, ঝটপট অনার্স শেষ করো তো।”
ইলোরা ভ্রুকুটি করে বলল,“এমনভাবে বলছো যেন আমি চাইলেই ঝটপট শেষ করতে পারব! কদিন পরই তো এক্সাম। থার্ড ইয়ারে উঠে তারপর আরও দুই বছর।”
“আমার তো এত অপেক্ষা ভালো লাগছে না।”
“কিসের?”
“কিসের আবার? আমি বাবা হব না?”
ইলোরা লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে ফেলল। এরেনের বুকের কাছের টি-শার্টে নখ খুঁটতে-খুঁটতে বলল,“তুমি নিজেই তো বলো অনার্স শেষ না করে বেবি প্ল্যানিং করবে না।”
“তা তো ঠিকই। তোমার পড়াশোনায় ব্যাঘাত চাই না আমি। কিন্তু ইদানীং বাবা হওয়ার ইচ্ছেটা তীব্র হচ্ছে। আচ্ছা? তোমার ইচ্ছে হয় না?”
এরেনের প্রশ্নে ইলোরা আরও লজ্জা পেল। লাজুক হাসলেও প্রশ্নের উত্তর দিলো না। এরেন পুনরায় আবার বলল,“বলো না।”
ইলোরা এরেনের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,“চুপ করো তো। আমার লজ্জা লাগছে।”
“ইশ্ রে! আমার লজ্জাবতী বউ রে! কত বছর পেরুলে যে এই লজ্জা কাটবে! অবশ্য আমি চাইও না লজ্জা কাটুক। আমার তো এই লজ্জাবতী ইলোনিকেই চাই।”
ইলোরা নিঃশব্দে হাসল। এরেন ইলোরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,“ইলোনিরও যে মা হতে ইচ্ছে হয়, তা কিন্তু আমি জানি। ভাবছি দুই বছর না, এক্সাম শেষ হলে তিন মাস পরেই বেবি প্ল্যানিং করব। আপনি কী বলেন মহারানি?”
ইলোরা লজ্জায় পারলে এরেনের বুকের মধ্যে ঢুকে যায়। তার কান্ড দেখে এরেন মৃদু শব্দ তুলে হেসে উঠল। দুহাতে ইলোরার মুখটা তুলে ধরল। তবু ইলোরা সরাসরি এরেনের চোখের দিকে তাকাল না। এরেন আফসোসের সুরে বলল,“ইশ্! এই লাজুক মুখটা কয়েক যুগ ধরে দেখার সুযোগ পাব না, ভাবতেই প্রচন্ড রকমের আফসোস হয়।”
ইলোরা এবার ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে এরেনের মুখের দিকে তাকাল। এরেন ইলোরার অধরে আলতো করে অধর ছোঁয়াল। কপালে কপাল ঠেকিয়ে আওড়ালো,“ভালোবাসি ইলোনি। কতটা, তা হয়তো এ জীবনে কোনোদিনও বুঝাতে পারব না।”
•
শ্যামলী এনআর ট্রাভেলস এসি কাউন্টার, আরামবাগ। যাত্রীরা সব বাসের জন্য অধীর অপেক্ষায় বারবার সময় দেখছে, কেউ হাতঘড়িতে, কেউবা ফোনের স্ক্রিনে। এরেন, ইলোরা, তাহসিন, অরিশা, মাহাদি, জারিন এবং আরহাম চায়ের কাপে চুমুক দিতে ব্যস্ত। কাউন্টারে এসে হতে জারিন গাল ফুলিয়ে বসে আছে। কাউন্টারে এসে ডক্টর আরহামকে লাগেজ হাতে দেখে সে বেশ অবাকই হয়েছিল। পরে যখন এরেনের কাছে জানতে পেরেছে আরহামও তাদের সাথে যাচ্ছে, তখনই তার রাগ উঠে যায়। কিন্তু এখানে রাগ দেখানোটা সমীচিন নয় ভেবে চুপচাপ গাল ফুলিয়ে আছে। ইলোরা বারবার এরেনকে এটা-ওটা প্রশ্ন করেই চলেছে। তার একটাই প্রশ্ন,“এভাবে হুট করে আমরা কেন ইন্ডিয়া যাচ্ছি?”
কিন্তু এখনও এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর সে পায়নি। প্রতিবারই এরেনের উত্তর ছিল,“গেলে এমনিতেই জানতে পারবে।”
আজ সকালে যখন এরেন ইলোরাকে বলেছিল ব্যাগপত্র গোছাতে সাহায্য করতে, তখন ইলোরা খুব অবাক হয়েছিল। ব্যাগপত্র গুছিয়ে কী হবে জিজ্ঞেস করায় এরেন বলেছিল তারা ইন্ডিয়া যাচ্ছে। অথচ গতরাতেও এ বিষয়ে এরেন ইলোরাকে কিচ্ছুটি বলেনি। এরেনের মুখ থেকে কোনো প্রশ্নের উত্তর বের না করতে পেরে ইলোরা ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়েছিল। তারপর জারিন আর আন্নি হককেও প্রশ্ন করেছিল। কিন্তু তারাও এরেনের মতো একই আচরণ করেছে। সারাদিনে প্রশ্ন করতে-করতে কান ঝালাপালা করার পরও এরেন, জারিন বা আন্নি হক, কেউই মুখ খোলেননি। কাউন্টারে এসে তাহসিন, অরিশা, মাহাদি এবং আরহামকে দেখে আরও অবাক হয়েছে। তারা যে যাচ্ছে, তা-ও এরেন বলেনি। তবে ইলোরা এটুকু বেশ বুঝতে পারল যে, যা হচ্ছে সবার প্ল্যান মতোই হচ্ছে। শুধু সে-ই জানে না। আজ রাত সাড়ে দশটায় তাদের যাত্রা শুরু হবে। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বাস এল। বাসের সুপারভাইজার এসে তাদের ব্যাগপত্র সব বাসে উঠিয়ে দিলো, সঙ্গে তারাও উঠে পড়ল। বাসে ওঠার সময় ইলোরা বাসটা ভালোভাবে দেখে নিয়ে আপন মনে বাসের নামটা উচ্চারণ করল,“শ্যামলী এনআর ট্রাভেলস।”
এরেন তার হাত ধরে বাসে উঠাতে-উঠাতে বলল,“বিজনেস ক্লাস বাস। জোস জার্নি হবে ম্যাম।”
পাশাপাশি সিটে এরেন-ইলোরা, জারিন-আরহাম এবং অরিশা-মাহাদি। তাহসিনের পাশের সিটে তারই সমবয়সী বেশ সুন্দরী এক মেয়ে বসেছে। গোলাপী হুডিতে মেয়েটাকে দারুণ মানিয়েছে! মেয়েটাকে তাহসিন কেবল একবারই খেয়াল করল। ঠিক রাত সাড়ে দশটায় বাস ছাড়ার পর যে তাহসিন কানে হেডফোন গুঁজেছে, আর খোলার নামও নেয়নি। বাস ছুটে চলেছে হাইওয়েতে। তাহসিন সিটে গা এলিয়ে দিয়ে, চোখ বন্ধ করে মুহূর্তটা অনুভব করছে। পাশের সিটে বসা মেয়েটা কয়েকবার ডাকতেই তার ধ্যান ভাঙল। কান থেকে হেডফোন খুলে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“এনি প্রবলেম?”
মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল,“নো। একচুয়্যালি আমি সবসময় প্রচুর কথা বলি তো। তাই এতটা সময় চুপ থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমরা কি পরিচিত হতে পারি?”
“শিওর, হোয়াই নট?”
মেয়েটা এক হাত তাহসিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,“আ’ম তানিশা।”
তাহসিন মেয়েটার হাতের দিকে একবার তাকিয়ে, নিজের হাত দুটো পকেটে গুটিয়ে নিয়ে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বলল,“আ’ম তাহসিন।”
তাহসিনের আচরণে মেয়েটা বোধ হয় কিছুটা বিব্রত বোধ করল। অপ্রস্তুত হেসে ‘ওহ্’ শব্দটা উচ্চারণ করে দ্রুত কানে হেডফোন গুঁজল।
ইলোরা গাল ফুলিয়ে এরেনকে এক আঙুল দিয়ে খোঁচা মেরে বলল,“এই, বলো না।”
এরেন কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বলল,“কী বাচ্চামো করছো ইলোনি! মোমেন্টটা এনজয় করতে দাও না প্লিজ।”
ইলোরা অধৈর্য হয়ে বলল,“ধুর! কী শুরু করেছ তোমরা সবাই? অরিরা যাবে তা বললে না কেন?”
“বললে কি সারপ্রাইজড হতে?”
“ওরা আমাকে বলল না কেন?”
“আমিই বারণ করেছিলাম। এ বিষয়ে ওদের সাথে কথা হয়েছিল আরও দুমাস আগে। সবার সাথেই কথা হয়েছিল। এরমধ্যে অরিশা, মাহাদি আর তাহসিন রাজি হয়েছে। মুনা আর আফসার স্যার তো বেবি নিয়ে যাবে না, টুম্পার মা রাজি হয়নি। আর আরহাম ভাইকে বলার সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়েছে। তার তো ইন্ডিয়া আসা-যাওয়া আছে, তাই কোনো প্রবলেম হয়নি। তোমাকে কেউ বলিনি, কারণ আমি তোমাকে ছোটোখাটো সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
“সারপ্রাইজড তো হয়েছিই। ঘুম থেকে উঠেই হুট করে ইন্ডিয়া যাওয়ার খবর শুনে আকাশ থেকে পড়েছি। এখন বলো তো যাওয়ার কারণ কী। সবার সাথে প্ল্যান করলে, আমি কেন বাদ পড়লাম?”
“রিল্যাক্স ইলোনি, বলছি তো গেলেই জানতে পারবে।”
“ধুর! সকালে ব্যাগপত্র গোছানোই উচিত হয়নি আমার। সঙ্গে সঙ্গে না বলে দিলে এমনিতেই বলে দিতে, এত তোষামোদ করতে হত না।”
এরেন মৃদু শব্দ তুলে হেসে ইলোরার এক গাল টেনে দিয়ে বলল,“আরে রেগে যাচ্ছ কেন বউ? আচ্ছা বলছি, শোনো।”
ইলোরা নড়েচড়ে বসে এরেনের দিকে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাল। এরেন বলল,“আমার প্ল্যানটা আসলে জারিন আর আরহাম ভাইকে নিয়ে।”
ইলোরা কিছু না বুঝতে পেরে প্রশ্ন করল,“মানে?”
“জারিন তো বিয়ের ডিসিশন নিয়ে এখনও বিভ্রান্তিতে ভুগছে। দেখো, দু দুটো মাস কেটে গেল। এরমধ্যে আরহাম ভাইয়ের ফ্যামিলি কতবার এসেছে বাবা আর আমার কাছে! জারিনের ডিসিশনের জন্য তো আমরা বিয়েতে হ্যাঁ-ও বলতে পারছি না। তাই আমি প্ল্যান করেছিলাম সময়-সুযোগ বুঝে ওদের নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসব। একসাথে অনেকটা সময় কাটালে হয়তো আরহাম ভাইয়ের সাথে জারিনের সম্পর্কটা ভালোও হতে পারে। জারিনকে আমি অন্যকিছু বুঝিয়েছি। তাই ও তোমার সাথে শেয়ার করেনি। কিন্তু তোমাকে যদি বলতাম, তাহলে আমি নিশ্চিত তুমি যেকোনো সময় মুখ ফসকে জারিনের সামনে বলে ফেলতে। দুজন যেই গল্পের ঝুলি নিয়ে বসো প্রতিদিন! মিথিলা আর রনিও এই প্ল্যানের বিষয়টা জানে। ওরা নিজেরাই যেতে রাজি হয়নি। কারণ ওরা চোখের সামনে থাকলে জারিন আরহামের সাথে কথাটুকুও বলার শক্তি পাবে না। আমি, রনি আর তাহসিন মিলেই সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছি। এবার বলো প্ল্যানটা কেমন?”
ইলোরা মাথা দুলিয়ে বলল,“প্ল্যান ভালো। কিন্তু এটা তোমার সঠিক সময় মনে হলো? কদিন পর তো আমার এক্সাম।”
“ওসব নিয়ে ভেবো না। মাত্র এক সপ্তাহেরই তো ব্যাপার। আপাতত এনজয় করো। মুহূর্তটা কত সুন্দর, খেয়াল করেছ?”
ইলোরা মুচকি হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,“সত্যিই সুন্দর!”
“একটু ঘুমিয়ে নাও।”
ইলোরা আপত্তি জানিয়ে বলল,“গল্প করি না। ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না।”
এরেন ইলোরার মাথাটা নিজের কাঁধে রাখতে-রাখতে বলল,“ফেরিতে গল্প কোরো। এখন একটু ঘুমাও।”
ইলোরা পুনরায় দ্বিমত পোষণ করল। এরেন আর তাকে ঘুমাতে বলল না। ইলোরার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গল্প জুড়ে দিলো। বাস ফেরি ঘাটে পৌঁছানো পর্যন্ত দুজন ননস্টপ গল্প করল। মাহাদি আর অরিশাও তাই করেছে। এদিকে জারিন বাসে উঠে হতে কানে হোডফোন গুঁজে ছিল। আরহাম অনেক চেষ্টা করেও তার সাথে একটাও কথা বলতে পারেনি। ফেরিতে ওঠার পর সবাই বাস থেকে নামল। একে একে সবাই ওয়াশরুমে গেল। ওয়াশরুম থেকে এসে সবাই নদী দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আকাশে পূর্ণ চন্দ্র থাকার দরুন মুহুর্তটা আরও বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছে। জ্যোৎস্না রাতে নদী দেখার অনুভূতিটা একটু বেশিই সুন্দর। তারমধ্যে আবার সদ্য শীতের আগমন। আরহাম সবার জন্য ঝালমুড়ি কিনল। সবাইকে ঝালমুড়ি দেওয়ার পর জারিনের দিকে এগিয়ে ধরতেই জারিন সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলল,“ধন্যবাদ, কিন্তু আমি বাড়ি থেকে খাওয়া-দাওয়া করে বেরিয়েছিলাম।”
আরহাম বলল,“তা তো আমরা সবাই-ই খেয়ে বেরিয়েছি। অনেকটা সময় কেটে গেছে। এখন ঝালমুড়ি খাওয়ার জায়গা হয়তো পেটে আছে।”
জারিন আর কথা বাড়াতে চাইল না। আরহামের হাত থেকে ঝালমুড়ি নিয়ে চুপচাপ খাওয়া শুরু করল। আরহাম তার পাশে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে ঝালমুড়ি চিবোতে লাগল। মিনিট পাঁচেক পর নদীর দিকে দৃষ্টি রেখেই বলে উঠল,“মিস জারিন, আপনার ইচ্ছে হয় না এমন কোনো এক ভরা জ্যোৎস্না রাতে কারো কাঁধে মাথা রেখে চাঁদ দেখতে?”
জারিন তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,“পৃথিবীর সব মানুষের ইচ্ছে পূরণ হয় না। কারো কারোরটা অপূর্ণ রয়ে যায়।”
“তাই বলে কি স্বপ্ন দেখা থেমে যাবে?”
“স্বপ্নই যেখানে চুরমার হয়ে যায়, সেখানে আর স্বপ্ন দেখার কথা আসে কোত্থেকে?”
আরহাম ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে জারিনের দিকে তাকিয়ে বলল,“কেউ যদি চুরমার হওয়া স্বপ্নগুলো জোড়া লাগতে চায়, তাতে দোষ কী? তাকে কি সুযোগ দেওয়া যায় না? অতীতের জন্য কি বর্তমান তুচ্ছ করা ঠিক?”
ঝালমুড়ি চিবোনো থামিয়ে জারিন আরহামের দিকে তাকাল। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করল,“আপনি আমার অতীত সম্পর্কে কী জানেন?”
“রনি ভাইকে এখনও খুব ভালোবাসেন, তাই না?”
আরহামের পালটা প্রশ্নে জারিন কিছু সময়ের জন্য থমকে গেল। তারপর এদিক-ওদিক দৃষ্টি বিচরণ করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,“ভাইয়া দেখছি আপনাকে আমার জীবন বৃত্তান্ত সবই বলে দিয়েছে।”
“তবুও তো দু দুটো মাস পেরিয়েও আপনার মুখ থেকে ‘হ্যাঁ’ বের করতে পারলাম না।”
জারিন পুনরায় নদীর দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল,“এতদিনে আপনি আরও ভালো কাউকে খুঁজে নিতে পারতেন। হয়তো সে আমার থেকেও বেশি সুন্দরী হতে পারত।”
“আমার তো আপনার থেকেও সুন্দরী কাউকে চাই না, আপনাকেই চাই। একবার হাতটা ধরেই দেখুন না, কথা দিচ্ছি, মৃত্যুর আগে ছাড়ব না। ধরবেন?”
জারিন এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না। ঝালমুড়িতে মনোনিবেশ করল। আরহাম হঠাৎ লক্ষ্য করল কিছুদূর থেকে একটা ছেলে জারিনের দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রথমে আরফান তেমন পাত্তা না দিলেও, পরে দেখল ছেলেটা একইভাবে তাকিয়েই আছে। ছেলেটার দৃষ্টি মোটেও সুবিধার মনে হলো না। আরহাম গলা ঝেড়ে বলল,“মিস জারিন, আমার মনে হয় আপনার এখন বাসে ওঠা উচিত।”
জারিন বলল,“কেন? এখানেই তো ভালো লাগছে।”
“আপনার বাঁ দিকে তাকান। একটা ছেলে আপনার দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।”
জারিন অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁ দিকে তাকাল। একটা ছেলেকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল,“কী লোক রে বাবা! আমি বাসে যাচ্ছি।”
জারিন বাসের দিকে পা বাড়াতেই আরহামও তার পিছু নিল। জারিন দেখেও কিছু বলল না। আরহাম জারিনের পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে বলল,“একটা রিকোয়েস্ট করব?”
জারিন প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে তাকাতেই আরহাম হাসিমুখে বলল,“বাকি সময়টা কি হেডফোন ছেড়ে পাশের মানবের সাথে গল্প করে কাটানো যাবে? একচুয়্যালি, আমার এভাবে চুপচাপ সময় কাটাতে ভালো লাগে না। কেমন যেন নিজেকে রোবট, রোবট মনে হয়।”
জারিন কোনো উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসল। আরহাম তাতেই সম্মতি খুঁজে নিল। অনেক্ষণ ধরে অদূরে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়ি চিবোতে চিবোতে জারিন আর আরহামকে লক্ষ্য করছিল তাহসিন। তারা বাসে উঠতেই তাহসিনও হাতের ঝালমুড়ির প্যাকেটটা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে, বাসের দিকে পা বাড়াতে-বাড়াতে তাচ্ছিল্যের স্বরে বিড়বিড় করে বলল,“শালার ভালোবাসা!”
ঝালমুড়ির প্যাকেটটা নদীর পানিতে ছুঁড়ে ফেলে মাহাদি অরিশার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। মাস খানেক আগেও এই হাতটা ধরতে গেলে তার দুবার ভাবতে হত। অরিশা তার পরিবারকে জানাতেই চাইছিল না সম্পর্কের ব্যাপারে। মূলত সে তার বাবাকে ভয় পায়। অথচ তার বাবা মোটেও মেয়ের পছন্দকে অস্বীকার করার মানুষ নন। শেষমেষ মাহাদি নিজেই তার বাবাকে দিয়ে অরিশার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। পরে মেয়ের পছন্দের কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে অরিশার বাবা রাজি হয়ে যান। দু পক্ষের সম্মতি থাকলেও এখনও বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়নি। তবে অরিশার এক্সামের পরপরই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মাহাদি হাত ধরার সঙ্গে সঙ্গে অরিশা মৃদু হেসে বলল,“ফিলিংসটা দারুণ!”
প্রতিউত্তরে মাহাদিও হেসে বলল,“হুম। ভাবছি পূর্ণিমা দেখে বিয়ের ডেট ফিক্সড করব।”
“কেন?”
মাহাদি অরিশার কানের কাছে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলল,“বাসর রাতে বউকে নিয়ে জ্যোৎস্না গায়ে মাখব।”
অরিশা লজ্জায় মাহাদিকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে কাছ থেকে সরিয়ে দিলো। নিচু স্বরে বলল,“দিন দিন অতি ভদ্র থেকে অতি অভদ্র হয়ে যাচ্ছ।”
মাহাদি হেসে বলল,“সবই প্রেমের কেরামতি।”
এতক্ষণ অবধি এরেন শীতটাকে জ্যাকেট আর শাল দিয়ে আটকে রাখলেও, এখন সেগুলো ভেদ করে শীত তার শরীর স্পর্শ করছে। ইলোরা তাকে লক্ষ্য করে হেসে বলল,“বাসে চলো আমার শীতকাতুরে বর। তোমার কাঁপুনি উঠে যাচ্ছে।”
এরেন শালটাকে আরও ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নিতে-নিতে বলল,“এই ঠান্ডা তো আমার এনজয়ের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে বাড়িতেই ঠিক থাকি। বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমালে শীত বাবাজি কাছে আসারও সুযোগ পায় না। এখানে তো বউকে একটু জড়িয়েও ধরতে পারছি না।”
ইলোরা এরেনের বাহুর কাছের জ্যাকেট টেনে ধরে নিচু স্বরে বলল,“উলটা-পালটা কথা বন্ধ করো, আর আস্তে কথা বলো। এমনভাবে বলছো যেন এনাউন্সমেন্ট করছো। আশেপাশের লোকজন শুনলে কী ভাববে বলো তো?”
“কিছুই ভাববে না। ভাববে কেন? এখানকার কোন বিবাহিত পুরুষ তার বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায় না?”
এরেনের ত্যাড়া উত্তর শুনে ইলোরা নিজের কপাল চাপড়াল। এরেন ইলোরার হাতটা ধরে ফেলে হেসে বলল,“আরে কপাল চাপড়াচ্ছ কেন? তোমার কি জামাই মরছে? দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে তোমার সামনে।”
ইলোরা কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বলল,“আবার উলটা-পালটা কথা?”
“সরি সরি, আর বলব না ম্যাম।”
“এখানে আর থাকার দরকার নেই। বাসে চলো।” বলতে বলতে ইলোরা এরেনের হাত ধরে টেনে বাসের দিকে নিয়ে গেল। ইলোরা গলা উঁচিয়ে ডেকে বলল,“এই অরি, আসবি না কি আরও থাকবি এখানে?”
“আসছি।” বলে অরিশা আর মাহাদিও বাসের দিকে চলল।
বাসে উঠে আরহামকে জারিনের সাথে গল্প করতে দেখে এরেন সিটে বসে ইলোরাকে বলল,“মনে হচ্ছে প্ল্যানটা সাকসেসফুল হতে শুরু করে দিয়েছে।”
“এটাই তো চাই। এবার যদি আপু একটু বোঝে।” বলে ইলোরা হাসল। প্রায় আধা ঘন্টা পর ফেরি থামল। বাস আবারও চলতে শুরু করল। এবার এরেন বলার সঙ্গে সঙ্গেই ইলোরা তার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো। এমনিতেও ঘুম পাচ্ছে এখন। ইলোরা ঘুমিয়ে পড়ল কিছু সময়ের মধ্যেই। তারপর এরেনও চোখ বন্ধ করল। তাহসিন, অরিশা আর মাহাদিও ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছে জারিন আর আরহাম। আরহাম অনেক কষ্টে এটা-ওটা বলে জারিনের সাথে গল্প জমিয়েছে। এত সহজে ঘুম দিয়ে তা নষ্ট করতে চায় না। বাস যশোরে পৌঁছানো পর্যন্ত তারা একটানা গল্প করল। জানালা দিয়ে প্রকৃতি দেখল। তারপর চোখে ঘুম নেমে এলে আর তা উপেক্ষা করতে পারল না। সিটে গা এলিয়ে দিয়ে দুজনেই ঘুমের প্রস্তুতি নিল।
চলবে………………….🌸
(আগামী দুই পর্বে গল্পটা শেষ হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ্। শেষটা গুছিয়ে নিতে আমার একটু সময় লেগেছে। দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং।❤️)