#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৬৪
ভোর পাঁচটার দিকে বাস বেনাপোল পৌঁছাল। তার আগেই অবশ্য সবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। বেনাপোল নেমে সবাই ফ্রেশ হয়ে ইমিগ্রেশনের সকল কার্যাবলী সম্পন্ন করতে-করতে ঘড়ির কাঁটা ছয়টা পনেরোর ঘর ছাড়াল। ইমিগ্রেশন শেষ করে ভারত সীমান্তের কার্যাবলী সম্পাদনের সময় শুরু হলো বৃষ্টি। প্রথম দিকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হলেও ভারতের বাস কাউন্টারে পৌঁছাতে-পৌঁছাতে বৃষ্টির বেগ বাড়ল। অক্টোবর রেইন বলে কথা! বাস কাউন্টার থেকে সবাই টাকা এক্সচেঞ্জ করে নিল। তারপর আবার বাসে উঠল। এরমধ্যে বৃষ্টির দরুন সবাই কিছুটা ভিজেও গেল। বাসে উঠে সবাই যার যার সিটে বসে তবেই স্বস্তি পেল। চলমান বাসে আবারও শুরু হলো সবার গল্প-আড্ডা। শুধু তাহসিন পুনরায় কানে হেডফোন গুঁজল। এই দীর্ঘ জার্নিতে এটাই হলো তার একমাত্র সঙ্গী। শুধু কী জার্নি? গত নয় মাস ধরে প্রতিটা রাতেরও সঙ্গী। ভাঙা মনের মানুষদের কাছে রাতগুলো খুব অসহনীয়। কেবলমাত্র তারাই জানে একটা বিষাদময় রাত পার করে কীভাবে ভোর হয়। ভোরের সূর্য পুরো পৃথিবীটা আলোয় ভরিয়ে দিলেও, ঐ মানুষগুলোর জীবনের ঘোর অন্ধকার ছিটেফোঁটাও কাটে না। তাহসিনও বর্তমানে এই মানুষগুলোর পর্যায়ে আছে। দুপুর একটা নাগাদ বাস একটা রেস্টুরেন্টের সামনে থামল। সেখানে সবাই দুপুরের ভোজন সেরে পুনরায় বাসে ফিরল। ততক্ষণে বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেছে। বাস যখন কলকাতা পৌঁছাল, তখন বিকাল পৌনে চারটা বাজে। কলকাতা পৌঁছে সবাই নিজেদের বুকিং করা হোটেলে উঠল। যার যার কেবিনে গিয়ে সবাই ফ্রেশ হতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দীর্ঘ জার্নিতে সবাই অনেকটা ক্লান্ত। তাই সিদ্ধান্ত নিল আজ আর কেউ হোটেলের বাইরে যাবে না। সবারই বিশ্রামের প্রয়োজন।
•
সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। আরজ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেই চলেছে। মুনা তাকে কোলে নিয়ে সারা ঘর পায়চারি করছে আর কান্না থামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ফিডার হাতে নিয়ে আফসার রুমে ঢুকতেই মুনা তেজ দেখিয়ে বলল,“এতক্ষণ লাগে ফিডার আনতে?”
আফসার দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মুনার কোল থেকে আরজকে নিজের কোলে নিতে নিতে বলল,“রাগ পরে দেখিয়ো, আগে ওকে খাইয়ে নিই।”
আফসার আরজকে নিয়ে বিছানায় উঠে বসল। ফিডার মুখে পুরে দিতেই আরজের কান্না থামতে শুরু করল। অদূরে দাঁড়িয়ে মুনা শক্ত মুখে বলল,“যেমন বাবা, তার তেমন ছেলে।”
আফসার ভ্রু কুঁচকে মুনার দিকে তাকিয়ে বলল,“আমরা বাবা-ছেলে আবার কী করলাম?”
“আপনারা তো অতি সাধু মানব। সেজন্যই দুজনে একসাথে জ্বালিয়ে মারেন আমাকে।”
“তা, কদিন আমি আরজের মতো চেঁচিয়ে কান্না করেছি? আর কদিন তুমি আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরেছ?”
মুনা দু’পা এগিয়ে গিয়ে বলল,“বাজে কথা রাখুন। এই বাপ-ছেলের জ্বালাতন সহ্য করতে-করতে আমি কবে যেন বনবাসে চলে যাব। তারপর দেখব কাকে জ্বালান। অতিষ্ট হয়ে গেলাম এই ছেলের কান্না শুনতে-শুনতে। একবার শুরু করলে আর থামা-থামির নাম নেই। আমার যেন আর কোনো কাজ নেই, সারাদিন ওর কান্না থামানোর চাকরি নিয়েছি।”
শেষের কথাটা বলতে-বলতে মুনা বেলকনির দিকে হাঁটা দিলো। মুনা বেলকনিতে যেতেই আফসার মৃদু হাসল। গত আড়াই মাস ধরে, ছেলের জন্মের পর থেকে মুনার রাগ নাকের ডগায় থাকে। আফসার এতে বিরক্ত হয় না। গর্ভাবস্থায় মুনার কষ্টগুলো সে স্বচক্ষে দেখেছে। ছেলেটাও হয়েছে কাঁদুনে। একটু পর পর বিরতি নিয়ে কাঁদতেই থাকে। মুনার রাতের ঘুম পর্যন্ত ঠিকমতো হয় না। আফসার সারাদিন ভার্সিটিতে কাটায়। মুনাকে সাহায্য করার জন্য আফসারের বোন আছে। রাতে আফসার যথাসাধ্য চেষ্টা করে ছেলেকে সামলানোর। মুনার স্বাস্থ্যের কথা ভেবে সে রাত জেগে ছেলের দেখাশোনা করার চেষ্টা করে। ফিডার খেতে-খেতে আরজ ঘুমিয়ে পড়েছে। আফসার ভালোভাবেই জানে কয়েক মিনিট পার হতেই আবার ছেলে জেগে যাবে। আরজকে সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে বিছানা থেকে নামল। ফিডারটা টেবিলে রেখে বেলকনিতে গিয়ে দেখল মুনা রেলিং ধরে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আফসার আপন মনে হেসে সন্তর্পণে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে আলতো করে মুনার কোমর জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখল। মুনা কোনো কথা না বললেও মাথাটা আফসারের বুকে এলিয়ে দিয়ে তার হাতের ওপর নিজের দুহাত রেখে চোখ বন্ধ করল। আফসার মৃদু কন্ঠে ডাকল,“মুন।”
মুনা ছোটো একটা শব্দ করল,“হুঁ।”
আফসার মুনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,“আই লাভ ইউ।”
মুনা মৃদু হেসে চোখ মেলে তাকাল। আফসার ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,“এটা কিন্তু ঠিক না।”
“কোনটা?”
“এই যে, আমি লাভ ইউ বললাম, অথচ তুমি উত্তর না দিয়ে হাসলে। ছেলেকে ভালোবাসো, কিন্তু ছেলের বাবাকে ভালোবাসো না।”
মুনা কোমর থেকে আফসারের হাত সরিয়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। দুহাতে আফসারের গলা জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বলল,“তাতে কী? ছেলের বাবা তো ছেলের মাকে ভালোবাসে। তাতেই চলবে।”
আফসার মাথা দুলিয়ে বলল,“একদমই চলবে না।”
“কেন?”
“ছেলের বাবার তো আরও কিছু চাই।” বলেই আফসার দুহাতে মুনার কোমর ধরে কাছে টেনে নিল। রুমের লাইটের আবছা আলোয় মুনার স্নিগ্ধ মুখটায় তার দৃষ্টি আটকে গেল। মুনা আফসারের গলা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে লাজুক হেসে বলল,“ছাড়ুন, আরজ জেগে যাবে।”
“উঁহু, জাগবে না। এটা ওর বাবা-মায়ের একান্ত সময়।” বলতে-বলতে আফসার মুনার কোমর থেকে এক হাত সরিয়ে তার মুখটা তুলে ধরল। আফসারের দৃষ্টি মুনার ঠোঁটে নিবদ্ধ হতেই মুনা নিচু স্বরে বলল,“বলছি তো আরজ জেগে যাবে।”
মুনার বাঁধায় বিশেষ লাভ হলো না। আফসার মুনার অধরে অধর ডুবাল। আগের মতো আজ আর মুনা আফসারের থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করল না। বরং দুহাতে তাকে আঁকড়ে ধরে তার কাছে হার মানল। মুনা টের পায়, দিন দিন মানুষটার যত্ন আর ভালোবাসার কাছে সে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে।
•
সবেমাত্র ডিনার সেরে কেবিনে ঢুকেছে এরেন আর ইলোরা। কেবিনে ঢুকেই ইলোরা ধপ করে বিছানায় সটান শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে এরেন এগিয়ে এসে ইলোরার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলো। ইলোরা প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকিয়ে বলল,“কী হলো?”
এরেন বলল,“নামো।”
“কেন?”
“নামো, তারপর বলছি।”
“উঁহু, ঘুমাব।” বলেই ইলোরা আবার শুয়ে পড়ল।
এরেন আবার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিতেই ইলোরা বিরক্তি নিয়ে বলল,“কী হচ্ছে বলো তো? ঘুমাতে দিবে না?”
এরেন ইলোরাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,“অবশ্যই ঘুমাবে, কিন্তু এখন না।”
ইলোরা পড়ে যাবার ভয়ে এরেনের গলার কাছের জ্যাকেট চেপে ধরে বলল,“কী শুরু করলে?”
“দেখই না।” বলে এরেন খাটের কাছ থেকে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে ইলোরাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। তারপর নিজের লাগেজ নিয়ে বিছানায় রাখল। ইলোরা ভ্রু কুঁচকে এরেনের কান্ড দেখতে লাগল। এরেন লাগেজ খুলে একটা প্যাকেট বের করল। তারপর আবার লাগেজটা আটকে রেখে দিলো। প্যাকেটটা নিয়ে ইলোরার হাতে দিতেই ইলোরা প্রশ্ন করল,“কী এটা?”
“খুলে দেখো।”
ইলোরা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে প্যাকেটটা দ্রুত খুলে ফেলল। প্যাকেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা টুকটুকে লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ আর লাল পেটিকোট। তার সাথে আছে দু মুঠো লাল কাঁচের চুড়ি, লাল গাজরা, লাল লিপস্টিক, কাজল, লাল পাথরের হার আর কানের দুল। মোটকথা কাজলটা ছাড়া বাকি সব লাল রংয়ের। ইলোরা অবাক হয়ে সবকিছু নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে বলল,“এসব কখন কিনলে?”
এরেন মৃদু হেসে বলল,“সারপ্রাইজ।”
“তা বুঝলাম, কিন্তু এসব কি তুমি ঢাকা থেকেই নিয়ে এসেছ?”
এরেন ওপর নিচে মাথা দোলালো। ইলোরা পুনরায় প্রশ্ন করল,“তাহলে তখন না দিয়ে, এখন দেওয়ার কী হলো?”
“আমার এখন দিতে ইচ্ছে করেছে তাই এখন দিয়েছি।”
“তোমাকে না বলেছি এ বছর আর একটা শাড়িও কিনবে না? তারপরও কিনলে! কাবার্ড ভর্তি শাড়ি, এত শাড়ি আমি কবে পরব?”
এরেন এগিয়ে এসে ব্লাউজ আর পেটিকোটটা ইলোরার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাড়া দেখিয়ে বলল,“এসব কথা পরে বোলো। এখন ঝটপট এগুলো পরে নাও।”
ইলোরা চোখ বড়ো করে বলল,“মানে? এখন আমাকে শাড়ি পরতে বলছো তুমি?”
“তোমাকে কখন পরতে বললাম? বলেছি ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে আসতে, শাড়ি আমি পরাব।”
ইলোরা মাথা দুলিয়ে বলল,“মোটেও না। এত রাতে আমি এখন শাড়ি পরব কী করতে?”
“কারণ আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে শাড়ি পরিহিতা অবস্থায় দেখতে।”
“দেখতে ইচ্ছে হলে কাল পরব। এখন রাখো এগুলো।”
এরেন ত্যাড়াভাবে বলল,“একদম না। এখন বলেছি মানে এখনই।”
ইলোরা অসহায় মুখে বলল,“কেন এমন করছো? আমার এখন ভালো লাগছে না শাড়ি পরতে।”
এরেন ইলোরার গাল দুটো টেনে দিয়ে বলল,“তুমি তো পরবে না, আমি পরিয়ে দিব বলছি তো। লক্ষ্মী বউ আমার, পরো না প্লিজ।”
ইলোরা বারবার না বললেও এরেন তা মানতে নারাজ। সে শাড়ি পরিয়েই ছাড়বে। শেষে ইলোরা রাজি হতে বাধ্য হলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গাল ফুলিয়ে বলল,“আচ্ছা পরব। যাও তুমি।”
এরেন অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,“কোথায়?”
“রুম থেকে যাও। আমি শাড়ি পরছি এক্ষুনি।”
“কেন? বললাম না আমি পরাব?”
“দরকার নেই। আমি নিজেই পারব। না ডাকতে আসবে না।”
“উঁহু, আজ আমি পরাব।”
ইলোরা কোমরে দুহাত রেখে চোখ পাকিয়ে বলল,“তুমি যাবে, না কি আমি শুয়ে পরব?”
এরেন মুখটা ছোটো করে বলল,“এমন করো কেন? আমি কি পরপুরুষ না কি? তোমার দশটা না, পাঁচটা না, একটামাত্র জামাই। তার সাথে এমন আচরণ করছো! তার একটা ইচ্ছে পূরণ করতে দিচ্ছ না!”
ইলোরা একইভাবে বলল,“যাবে তুমি?”
“আচ্ছা যাচ্ছি।” বলেই এরেন মুখ ভার করে বেলকনিতে চলে গেল। ইলোরা হতাশ দৃষ্টিতে শাড়ির দিকে তাকাল। এতরাতে এরেনের পাগলামির কারণে এখন ঘুমের বদলে তাকে শাড়ি পরতে হবে। সময় নষ্ট না করে ইলোরা ঝটপট ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে নিল। শাড়ি হাতে নিয়ে একপাশ কোমরে গুঁজতে নিতেই পেছন থেকে কেউ শাড়ি সমেত হাতটাও মুঠোয় চেপে ধরল। ইলোরা চমকে উঠে আরেক হাত দিয়ে শাড়ির মাঝের অংশটুকু বুকে চেপে ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। এরেনকে মিটিমিটি হাসতে দেখে কপাল কুঁচকে বলল,“তোমাকে না বলেছি আমি ডাকব?”
“তোমাকে না বলেছি আমি পরাব?” বলেই এরেন ইলোরার হাতের মুঠো থেকে শাড়িটা কেড়ে নিল। ইলোরা বাঁধা দিতে গিয়েও পারল না। অনুরোধের সুরে বলল,“প্লিজ আমি নিজে পরি না।”
এরেন এবার কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করল,“আমি তোমার কে হই?”
ইলোরা মিনমিনে গলায় বলল,“হাসবেন্ড।”
“তাহলে? মনে তো হচ্ছে আমি আজ পর্যন্ত তোমার ধারেকাছেও ঘেঁষিনি।”
ইলোরা কপাল চাপড়ে বলল,“আচ্ছা পরাও, তবু চুপ থাকো। কথায় পারব না তোমার সাথে।”
এরেন বিনা বাক্যে শাড়ি পরানো শুরু করল। কুঁচি দিতে গিয়ে তাকে খানিকটা বেগ পেতে হলো। হাঁটু গেড়ে বসে কুঁচি গুঁজে দিয়ে এরেন ইলোরার পেটে ছোট্ট একটা চুমু খেল। সঙ্গে সঙ্গে ইলোরা এরেনের জ্যাকেট খামচে ধরে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে এরেন মৃদু হাসল। কুঁচি ঠিক করে উঠে দাঁড়িয়ে আঁচলটা ঠিকমতো কাঁধে রাখল। তারপর ইলোরাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজ হাতে তাকে সাজিয়ে দিলো। চুল আঁচড়ে খোপা করে তাতে গাজরা পরিয়ে দিলো। চোখে কাজল পরিয়ে দিলো। গলায় হার, কানে দুল আর দু হাতে চুড়ি পরিয়ে দিলো। ঠোঁটে গাঢ় করে লিপস্টিক দিয়ে দিলো। এরেনের পাগলামি দেখে ইলোরা রাগ ভুলে মুচকি হাসতে লাগল। সাজগোজ সম্পন্ন করে তবেই এরেন ইলোরাকে আয়নার সামনে নিয়ে দাঁড় করাল। ইলোরা আয়নায় নিজেকে দেখল। আয়নায় তার প্রতিচ্ছবির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এরেন নিচু স্বরে বলল,“সাক্ষাৎ লাল পরীর মতো লাগছে আমার বউটাকে।”
ইলোরা মৃদু হাসল। এরেন কোলে তুলে নিতেই ইলোরা হকচকিয়ে উঠে বলল,“আরে, আবার কোলে তোলার কী হলো?”
এরেন উত্তর না দিয়ে বেলকনির দিকে হাঁটা দিলো। এরেন বেলকনিতে পা রাখতেই ইলোরা অবাক হয়ে গেল। এরেন ইলোরাকে কোল থেকে নামিয়ে দিতেই ইলোরা দু চোখে বিস্ময় নিয়ে বেলকনিতে চোখ বুলাতে লাগল। পুরো বেলকনিটা লাল লাভ সেপ বেলুন, লাল গোলাপ আর লাল লাইট দিয়ে সাজানো। বেলকনির মাঝ বরাবর একটা ছোটো টেবিলে খুব সুন্দর একটা লাল লাভ সেপ কেক। কেকের পাশে লাল রংয়েরই একটা মোমবাতি। বেলকনিটা একটু বড়োসড়ো হওয়ায় ডেকোরেশনটা দারুণ মানিয়েছে। ইলোরা বিস্মিত দৃষ্টি এরেনের দিকে ফেরাতেই এরেন ইলোরার হাত ধরে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কেকের ওপর চোখ পড়তেই ইলোরা থমকে গেল। তার ঠোঁট দুটো আপনা-আপনি একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে গেল। এরেন কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,“হ্যাপি টু ইয়ার ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি মাই সুইট, কিউট কুইন।”
ইলোরার ধ্যান ভাঙল। সে ঘাড় ঘুরিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকাতেই এরেন মিষ্টি হেসে বলল,“সারপ্রাইজ।”
সঙ্গে সঙ্গে ইলোরা ঘুরে দাঁড়িয়ে দু হাতে এরেনকে জাপটে ধরল। খুশিতে তার চোখে পানি চলে এল। এরেনের বুকে মুখ গুঁজে তাকে আঁকড়ে ধরে সে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলো। এরেন বুঝতে পারল ইলোরা খুশিতে আবেগী হয়ে পড়েছে। তার আবেগী বউ বলে কথা! সেও তাই চুপচাপ ইলোরাকে বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর এরেন নিজেই ইলোরার মুখটা দুহাতে তুলে ধরল। মেয়েটা খুশিতে কেঁদেই ফেলেছে। চোখের পানিতে বাঁ চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। এরেন সযত্নে ইলোরার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,“এই বোকা মেয়ে, কাঁদছো কেন?”
ইলোরা কিছু বলতেও পারল না। এরেন বলল,“কান্না থামাও, এটা কাঁদার সময় না রে বউ।”
ইলোরা নাক টানতেই এরেন খানিক রাগত স্বরে বলল,“কাঁদতে বারণ করেছি। হায়রে আমার ছিঁচকাদুনে, আবেগী বউ!”
কথাটা বলেই এরেন ইলোরার কপালে কপাল ঠেকাল। ইলোরা এবার এরেনের জ্যাকেটের কলার চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,“এত ভালোবাসো কেন তুমি? আমার কান্না পায় জানো না?”
এরেন হেসে বলল,“কী করব? এই আবেগী মেয়েটাকে যে আমি ভালো না বেসে ভালো থাকতে পারি না। আমার মন যে তাকে যুগ যুগ ধরে এভাবেই ভালোবাসতে চায়।”
ইলোরার মুখে হাসি ফুটল। এরেন ইলোরার কান্নাভেজা মুখটা ভালোভাবে মুছে দিয়ে অপর দিকে ঘুরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল,“এবার একটু সেলিব্রেশন করতে দিন ম্যাম।”
এরেন কেকের পাশ থেকে লাইটার হাতে নিয়ে মোমবাতিটা জ্বালাল। ইলোরা প্রশ্ন করল,“নিভাবো?”
এরেন বলল,“উঁহু। আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে তুমি আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছিলে। যদিও সেটা বুঝে উঠতে আমার কিছুটা সময় লেগেছিল। তাই আমরা আলো নিভিয়ে নয়, জ্বালিয়ে সেলিব্রেশন করব। এই মোমবাতিটা যেভাবে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, ঠিক সেভাবেই তুমি সারাজীবন আমার জীবনে আলো ছড়িয়ে থাকবে।”
ইলোরা হেসে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল। তারপর দুজন একসাথে কেক কাটল। একে অপরের মুখে কেক তুলে দিলো। ইলোরা এক টুকরো কেক খেয়ে আর খেতে পারল না। অথচ এরেন একটার পর একটা টুকরো মুখে পুরতে পুরতে পুরো কেকটাই সাবার করে ফেলল। কেকটার সাইজ ছোটো হওয়ায় খেতে তার তেমন সমস্যা হলো না। ইলোরা তা দেখে হাসতে হাসতে বলল,“এত জায়গা বাকি রইল কীভাবে তোমার পেটে?”
এরেন তৃপ্তি নিয়ে বলল,“কেকটা অনেক মজা!”
এরেন কেক খাওয়া শেষ করে ইলোরার সাথে কয়েকটা সেলফি তুলল। সেলফি তোলা শেষ হতেই ইলোরা অভিমানী গলায় বলল,“তুমি আসলেই খুব খারাপ।”
“আমি আবার কী অপরাধ করলাম মহারানি?”
“আমাকে বললে না কেন? জানো না আমার মনে থাকে না? গত বছরও মনে ছিল না, তুমি মাঝরাতে ভাইকে দিয়ে বাসে ডেকে নিয়ে সারপ্রাইজ দিয়েছিলে। এবারও মনে ছিল না, আর সেই সুযোগে তুমি সারপ্রাইজ দিলে।”
“বললে কি আর সারপ্রাইজ দেওয়া হত? আমি ঢাকা থেকেই সব প্ল্যানিং করে এসেছি। জারিনকে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে এই শাড়িটা কিনেছিলাম, তবে চয়েস আমার ছিল। ইচ্ছে ছিল ঠিক রাত বারোটায় তোমাকে চমকে দিব, তা-ই করলাম।”
“আর এই বেলকনি কখন সাজালে?”
“আমরা যখন ডিনারে গিয়েছিলাম, তখন হোটেলের কয়েকজন ওয়েটার এভাবে সাজিয়ে রেখে গেছে। বিকেলে তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে, তখনই আমি ওদের আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম।”
“ওহ্! কিন্তু সবকিছু লাল কেন?”
এরেন এগিয়ে গিয়ে ইলোরার কোমর ধরে কাছে টেনে নিয়ে মৃদু হেসে বলল,“কারণ যেদিন তুমি আমার জীবনে এসেছিলে, সেদিন আমি তোমাকে লাল শাড়ি পরিহিতা অবস্থায় দেখেছিলাম। আর তখনই আমি তোমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভাবছি এরপর থেকে প্রতি অ্যানিভার্সারিতে তোমাকে এভাবেই লাল শাড়ি পরাব। নিজের হাতে সাজিয়ে দিব আমার লাল পরীকে। কারণ আমি চাই, সেই প্রথম দিনের মুগ্ধতা আজীবন থেকে যাক। আমি লাল শাড়ি পরিহিতা বউটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকি, যেভাবে প্রথম দিন তাকিয়ে ছিলাম। জানো? আজ সেই দিনটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে, যেদিন হুট করেই তুমি আমার বউ হয়ে গেলে। সেদিন ভেবেছিলাম হুট করে জীবনে আসা মেয়েটাকে মেনে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। অথচ আজ সেই মেয়েটাকে ছাড়া আমার চলেই না। জীবন কত অদ্ভুত!”
ইলোরা ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ঝুলিয়ে এক দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনল। তারপর বলল,“প্রথম দিন আমি এটা ভেবে আফসোস করেছিলাম যে, আমার কপালটা এত খারাপ কেন? অথচ সেদিনও আমি জানতাম না, আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের মধ্যে একজন। যার এমন একটা ভালোবাসার মানুষ আছে।”
এরেন ইলোরার কপালে চুম্বন রেখা এঁকে দিয়ে তার হাতটা নিজের বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরে বলল,“আমৃত্যু আমার বুকের বাঁ পাশে থেকো ইলোনি। আমি তোমাকে যুগ যুগ ধরে ভালোবেসে যাব।”
ইলোরা এরেনের বুকে মাথা রেখে বলল,“ভালোবাসি। জানি আমি তোমার মতো এত বেশি ভালোবাসতে পারি না। তবু বলছি, অনেক বেশি ভালোবাসি।”
এরেন হাসল। ইলোরাকে বুক থেকে সরিয়ে কোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াল। ইলোরা দু হাতে এরেনের গলা জড়িয়ে ধরে চুপটি করে বুকের সাথে মিশে রইল। এরেন এগিয়ে গিয়ে ইলোরাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই ইলোরা বলল,“শাড়ি চেঞ্জ করব না?”
এরেন ডানে-বায়ে মাথা দুলিয়ে বলল,“উঁহু, আজ এভাবেই থাকবে। আমি সারা রাত আমার লাল পরীটাকে দেখব।”
ইলোরা লাজুক হাসল। এরেন উঠে দাঁড়িয়ে বিছানার কাছ থেকে সরে গিয়ে জ্যাকেট খুলে রেখে দিলো। তারপর লাইট অফ করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় উঠে বসতেই ইলোরা শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,“কথার সাথে কাজের কোনো মিল নেই। বললে সারারাত না কি আমাকেই দেখবে। এখন যে ডিম লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতে চলে এসেছ?”
এরেন এগিয়ে গিয়ে ইলোরাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,“এমন আবছা আলোতেই প্রথম দিন তোমাকে লাল শাড়িতে দেখেছিলাম। সেদিন ছিল চাঁদের আলো, আর আজ ডিম লাইটের আলো।”
“দুটোতে বিশাল তফাৎ।”
“আরও একটা তফাৎ ঘটবে।”
“কী?”
এরেন ইলোরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,“সেদিন তোমাকে দূর থেকে দেখেছিলাম, আর আজ কাছ থেকে ভালোবাসব। সেদিন আমাদের মাঝের দূরত্বটা অনেক বেশি ছিল, আর আজ দূরত্ব নামক কোনো শব্দই থাকবে না।”
ইলোরা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। ডিম লাইটের আবছা আলোয় এরেন ইলোরার স্নিগ্ধ, আবেদনময়ী রূপের দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। তারপর একসময় অনুভব করল, শুধু এই মেয়েটাই তার ভালোবাসার কাছে দুর্বল না। সে নিজেও এই মেয়েটার ভালোবাসার কাছে দুর্বল। এরেন ফিসফিস করে বলল,“ইলোনি, তোমাকে খুব আবেদনময়ী লাগছে।”
ইলোরা মৃদু কেঁপে উঠল। এই কথার মানে তার অজানা নয়। ইলোরা ঢোক গিলে নড়েচড়ে বসতেই এরেন তাকে সযত্নে বালিশে শুইয়ে দিলো। ইলোরার ঘন নিঃশ্বাস মুখে আছড়ে পড়তেই এরেন শিহরিত হলো। অতি সন্তর্পণে ইলোরার পেটের কাছের আচঁলটা সরিয়ে দিয়ে মুখ গুঁজল তার নরম পেটে। ইলোরা দু হাতে এরেনের মাথার চুল খামচে ধরল। এরেন তার পেটে ঠোঁট ছোঁয়াতেই সে এক হাতে এরেনের চুল, আরেক হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে ফিসফিস করে বলল,“এত পাগলামী করছো কেন আজ?”
সঙ্গে সঙ্গে এরেন ইলোরার পেটের বাঁ পাশে ছোট্ট একটা কামড় বসিয়ে দিলো। ইলোরা ব্যথায় ককিয়ে উঠতেই এরেন ইলোরার পেট থেকে মুখ সরাল। হন্তদন্ত হয়ে ইলোরার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে পেটের কামড় দেওয়া জায়গাটায় হাত বুলিয়ে দিতে-দিতে অনুশোচনার সুরে বলল,“ইলোনি, বেশি ব্যথা পেয়েছ? আ’ম সরি ইলোনি। আমি কেন এমন করলাম জানি না। সরি লক্ষ্মীটি।”
ইলোরা অবাক হলো। আজ মানুষটার পাগলামি কেমন যেন বাকি দিনের তুলনায় আলাদা মনে হচ্ছে। এরেনের অনুশোচনা দেখে ইলোরা তার গালে হাত রেখে বলল,“আমি ঠিক আছি। এমন করছো কেন তুমি? শান্ত হও।”
এরেন শান্ত হলো না। দ্রুত হস্তে ইলোরার গলার হার খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হার খুলে বিছানার একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর ইলোরার গলায় মুখ ডুবিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজের সাথে জড়িয়ে গায়ে চাদর টেনে নিল। দীর্ঘ সময় পাগলের মতো ইলোরাকে ভালোবাসল। ইলোরা বাঁধা দিলো না। ইতিপূর্বে মানুষটার এমন ভিন্ন আচরণ সে কখনও লক্ষ্য করেনি। আজ যেন মানুষটা উন্মাদ হয়ে ভালোবাসায় মত্ত হয়েছে। মানুষটার ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ল ইলোরার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ইলোরা নির্বাক হয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে রইল। চোখ বুজে মানুষটার প্রতিটা স্পর্শ অনুভব করল। দু বছর ধরে যে মানুষটা তার অস্তিত্বে মিশে আছে, এখন মনে হচ্ছে সেই মানুষটা আজই প্রথম তার এত কাছে এসেছে, তাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে!
চলবে……………………🌸
(দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত। ভেবেছিলাম আগামী এক পর্বে গল্পটা ইতি টানব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আরও এক পর্ব বাড়বে। অর্থাৎ আরও দুই পর্বে শেষ হবে।)