সুবর্ণবন্ধন -৩
পরদিন সকালে সুবর্ণাকে নিয়ে জাহিদ সদরে চলে এলো, সুবর্ণার বাড়িতে। বাড়িতে এসেই জাহিদ একটু ধাক্কা খেলো। ও শুনেছে মেয়ের বাবা বিশাল বড়লোক কিন্তু এতটা হতে পারে আশা করেনি। জেলা সদরের পাশে নিরিবিলি আবাসিক এলাকায় ভীষণ সুন্দর তিনতলা বাড়ি করা। বাজারে দুটো বড় বড় কাপড়ের দোকান সুবর্ণার বাবার। এখানে এসে জাহিদের মনে হলো, বিয়েটা করা ঠিক হয়নি। কারণ সুবর্ণার কষ্ট হবে তার সাথে থাকতে।
শ্বশুর যতো বড়লোকই হোন, তার টাকা পয়সা জাহিদ নিতে পারবে না। গোলাম রসুল স্যার সুবর্ণার মামা, তার কাছে শুনেছে স্বচ্ছল পরিবার, মামা চাচারা ভালো অবস্থানে আছেন। তাই বেশি খোঁজ খবর নেয়নি জাহিদ।
এতো এলাহী আয়োজন!
জাহিদকে বরণ করা হলো দু-ভরি স্বর্ণের মোটা চেইন দিয়ে।
আগে একদফা দেওয়া হয়েছে। তবে সে তুলনায় সুবর্ণার জন্য তেমন কোন কিছু কেনা হয়নি। অবশ্য বিষয়টা সুবর্ণার মামা ম্যানেজ করেছেন। ওর বাবাও বেশি জোর করেননি গয়নাগাটির জন্য। তার জামাইটা হলেই চলবে। জাহিদের একটু দ্বিধা তৈরি হয়েছে, সুবর্ণা কী কোনদিন তার সাথে ভালো থাকবে!
অবশ্য মেয়েটা ভালো। এই এত বড় বাড়ির মেয়ে কিন্তু গত দুদিনে এটা বুঝতে দেয়নি, শীতল পাটিতে বসে খেয়েছে, পুরনো নরম চাদরে ঘুমিয়েছে। কোন মন খারাপ করেনি।
এর কারণ কী , মেয়েটা আসলেই অনেক ভালো, অথবা হয়তো কোন প্ল্যান আছে মাথার মধ্যে। জাহিদ খেয়াল করেছে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে থাকে মেয়েটা।
বাড়িতে এত লোকজনের মধ্যে সুবর্ণার সাথে শারিরীক দূরত্ব রয়েই গিয়েছে। জাহিদও আগায়নি, মনে মনে ভেবেছে, দুয়েকটা দিন যাক, ওর সাথে মানসিক সম্পর্কটা একটু দৃঢ় হোক। জাহিদের বাড়ির বেডরুমটা ঠিক উপযুক্ত জায়গা মনে হয়নি।
এখানে এসে দুটো বিপরীত অনুভূতি হচ্ছে।
এক, সুবর্ণা যদি না থাকে ওর সাথে, আবার একই সাথে মনে হচ্ছে, মেয়েটা একটু কাছে আসতো যদি! কি সুন্দর পুতুলের মতো দেখতে, কালো রেশমের মতো চুলগুলো, ঠিক সাজিয়ে রাখা পুতুলের মতো।
সুবর্ণার বাবা আয়োজনের চূড়ান্ত করলেন। জাহিদের লজ্জা লাগতে শুরু করলো তার আয়োজন দেখে।
দুপুরে জাহিদের আত্মীয় স্বজন এসে খেয়েদেয়ে চলে গিয়েছে। সুবর্ণাকে দুপুরে খাওয়ার পরে অনেক ক্ষণ দেখেনি। কোথায় গেল!
সুবর্ণা রুমে ঢুকলো হাতে একটা কাঁচের বাটি নিয়ে। বাটিতে নীল অপরাজিতা ভেজানো হয়েছে।
বিছনার পাশে রেখে সুবর্ণা জাহিদের পাশে বসলো। জাহিদ কী কিছু ভাবছে, সুবর্ণাকে দুদিন কতো কেয়ার করেছে, এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছে?
সুবর্ণা জিজ্ঞেস করলো, আপনার কিছু লাগবে? কোন সমস্যা হচ্ছে?
জাহিদ বলল, না তো, কেন? আমি আসলে তোমার রুমটা দেখে একটু ধাক্কা খেয়েছি, এত আরামে থেকে অভ্যস্ত তুমি, গত দুদিনে কোন অভিযোগ না করে আমার বাড়িতে, থাকলে , তাই!
সুবর্ণা হেসে বলল, আমি তো হোস্টেলে ছিলাম, এখন ভার্সিটি ডরমিটরিতে থাকি, এত আরামে সবসময় থাকি না।
সুবর্ণাকে খুব সুন্দর লাগছে। দুপুরে শাড়ি পরেছিল, কিন্তু ও সম্ভবত শাড়িতে ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। এখন নীল রঙের সালোয়ার কামিজে সহজ আছে। জাহিদের ধৈর্য্য বাঁধ মানছে না, সুবর্ণাকে কাছে টানতে ইচ্ছে করছে।
জাহিদ ইতস্তত করছে বলে সুবর্ণা জিজ্ঞেস করে ফেলল, কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন প্লিজ।
জাহিদ একটু সাহস করেই সুবর্ণার হাত ধরে ফেলল, দুটো বিষয়েরই চান্স আছে, দুদিনে তৈরি হওয়া সম্পর্কটা হালকা হয়ে যাবে অথবা সুবর্ণা আরো কাছে চলে আসবে।
মেয়েরা খুব সহজে সবকিছুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভাষাটা বুঝতে পারে, স্পর্শের অনুভূতি বুঝতে পারে। জাহিদ কী চাইছে সুবর্ণা বুঝতে পারছে, কিন্তু আশ্চর্য বিষয়, ওর খারাপ লাগছে না। দুদিন আগেই এই ভদ্রলোক জোর করতে পারতেন, কিন্তু করেননি। ওনার বাড়িতে সুবর্ণার উপর কোন অধিকার ফলাতে আসেননি।
এই ঘরটা সুবর্ণার সব চাইতে প্রিয় একটা জায়গা, এখানে কোন ভয় নেই, কোন অস্বস্তি নেই, দূরে কোন অচিন পাখি ‘কুউহু’ করে ডেকে ওঠে। শান্ত দুপুরে বুকের মধ্যে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজতে শুরু করে।
সুবর্ণা হাত ছাড়িয়ে নিলো না, দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। ওর প্রশ্রয়ে জাহিদ খুব কাছে এগিয়ে এলো।
নিজের বা হাতের পাঁচ আঙুলের ফাঁকে সুবর্ণার বা হাতের আঙুল গুলো আঁটকে নিলো। ডান হাতে
সুবর্ণার চিবুক ধরে উপরে তুললো, ফর্সা গাল টকটকে লাল হয়ে আছে। জাহিদ নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ভয় করছে?
সুবর্ণা মাথা নিচু করে ফেলল।
জাহিদ দু হাতে সুবর্ণার মুখটা তুলে কপালে আলতো করে চুমু খেলো! আস্তে করে বলল, আচ্ছা, তুমি ভয় পেলে থাক!
সুবর্ণা তখন অন্য কোন স্রোতে ভাসছে, ভয় পাচ্ছে না। রক্তপ্রবাহে অন্য কোন তৃষ্ণা জেগে উঠছে। সুবর্ণা চোখ বন্ধ করে ফেলে জাহিদকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ফেলল।
জাহিদ ওকে দুহাতে কাছে টেনে নিলো!
স্তব্ধ সময়ের ঘোর কাটে সেই অচিন পাখির ডাকে, “কুউহু, কুউহু”।
৬
জাহিদ আগামীকাল চলে যাবে রাধানগরে। পরীক্ষার ডিউটি আছে, যেতেই হবে। রাতে খাওয়ার পরে সুবর্ণার বাবা বসলেন জাহিদকে নিয়ে। আলোচনার বিষয়বস্তু হলো, ওদের সংসারের প্রয়োজনীয় ফার্ণিচার তিনি পাঠাবেন। জাহিদ একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সে চাচ্ছে না শ্বশুরবাড়ি থেকে কিছু নিতে। কথাটা সরাসরি বলতেও পারছে না।
-শোনেন জামাই…সুবর্ণার বাবা শুরু করলেন।
– ইয়ে মানে আপনি আমাকে যদি আপনি করে বলেন, আমি ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যাই।
– ওহ, তা ঠিক, বলতে চাচ্ছিলাম, আমি আমার আমার মেয়ের সংসার গুছাইয়া দিবো, আপনার মানে তোমার কথা বললে চলবে না।
-মানে আমি বলছিলাম কী…
-এইটা যৌতুক না আব্বা, এইটা মেয়ে পায় তার আব্বা আম্মার থেকে।
জাহিদ একটু অসহায় দৃষ্টিতে সুবর্ণার দিকে তাকালো।
সুবর্ণা বলল, আব্বু, নেওয়া তো যাবে, আমি তো এখনি যাইতেছি না। ঢাকায় ফিরব, পরীক্ষা দিবো। পরে না হয় কিনে দিয়েন।
-ওহ হো, আপনে তো আম্মা ঢাকায় যাবেন, তা কবে যাইতে চান?
-এই তো আব্বা, দুই তিন দিন পরে।
-উহু, এত তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে না। আপনে এক কাজ করেন, জামাইর সাথে রাধানগর যান, দুদিন থাকেন, নতুন জায়গা দেখেন, ভালো লাগবে। তারপর যাবেন ঢাকা।
আহা, এই কথা শুনে জাহিদ মহা খুশী হয়ে গেল মনে মনে। সে বলতে পারছিল না, কিন্তু মনে মনে খুব চাইছিল সুবর্ণা যাক তার সাথে। ওকে রেখে যেতে হবে, এটাও ইচ্ছে করছিল না কিন্তু সব কথা তো আর বলা যায় না।
অদ্ভুতভাবে, সুবর্ণার হঠাৎ জাহিদের সাথে যেতে ইচ্ছে করলো। আগে মনে হয়নি, এই লোক তো দেখে মনে হচ্ছে মনে মনে চায়, সুবর্ণা সাথে যাক! ঢং করে বলছিল, ভয় পাচ্ছো! সুবর্ণা মনে মনে হাসলো, লোকটা খারাপ না, ভালোই লাগছে। শুধু একটু কালো, বাচ্চা কাচ্চা গুলি তো কালো হবে! কি অদ্ভুত, এই কথাটাই বারবার মাথায় ঘুরছে শুধু!
-তাইলে যান আম্মা, ব্যাগ গুছাইয়া ফেলেন।আমি একটা গাড়ি ঠিক করে দিই আপনাদের।
জাহিদ বলল, আব্বা আপনার ঠিক করতে হবে না। আমি দেখছি।
সাইফ সাহেব শক্ত ভাবে বললেন, না, আমি ঠিক করে দিবো।
রুমে ঢুকে জাহিদ সুবর্ণাকে বললো, থ্যাঙ্কস, তুমি সাপোর্ট না করলে আমি ভীষণ অস্বস্তিতে পড়তাম।
সুবর্না বুঝতে পারলো না কোন বিষয়ে বলছে, তাই জিজ্ঞেস করলো, কোন বিষয়ে কথা বলছেন?
-এই যে ফার্ণিচার!
-ওহ আচ্ছা, আব্বা তো দিবেনই, থামাতে পারবেন না। এই দুপুর বেলায় মাছ আসছে, আড়তের সব বড় মাছ, সেগুলো দেখতেই তো নিচে গিয়েছিলাম, পরে আমাকে পাঠিয়ে দিলো উপরে।
-ভাগ্যিস পাঠিয়েছিল, জাহিদের চোখে দুষ্টুমি ভরা হাসি!
কী বদ লোক! একটু লজ্জাও লাগছে না!
জাহিদ একহাতে সুবর্ণাকে কাছে টেনে বলল, একটা বিষয় কিন্তু ভালো হয়েছে, তুমি গেলে আমার ভালো লাগবে, কী জানো তো, নতুন বৌ দূরে রেখে থাকা যায়না!
সুবর্ণা হাসার চেষ্টা করলো কিন্তু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। জাহিদকে এখন ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। অথচ পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম।
সুবর্ণার চুলগুলো ভীষণ সুন্দর, জাহিদ মুখ গুঁজে ঘ্রাণ নিলো নিঃশ্বাস ভরে!
-আপনার কী চুল খুব পছন্দ নাকি? সুবর্ণা প্রশ্ন করলো।
-সেভাবে ভাবিনি তো, তোমার চুলগুলি সুন্দর, ভীষণ সুন্দর!
-কি আশ্চর্য, আমি সুন্দর না?
জাহিদ কথা না বলে চুল সরিয়ে ওর ঘাড়ে চুমু খেলো। তারপর বলল, বাইরের সৌন্দর্যটা আমরা অনেক প্রায়োরিটি দেই, কিন্তু কী জানো, আমার মনে হলো, মানুষ হিসেবে তুমি বা তোমরা অনেক বেশি ভালো। তোমার কিছুটা অহংকারী হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তুমি একদমই তেমনটা না।
কথাটা ভীষণ ভালো লাগলো সুবর্ণার। সবসময় রূপের প্রশংসা শুনে অভ্যস্ত সে। রূপবতী মেয়েদের অন্য গুণ গুলো চাপা পড়ে যায়। অর্জনগুলোও রূপের পাল্লায় মাপে সবাই। ও জাহিদের দিকে ফিরে আলগাভাবে জাহিদকে জড়িয়ে ধরে জাহিদের বুকে মাথা রাখলো।
রাজীবের কথা মনে হচ্ছে, ক্যাম্পাসে ফিরলে কী করবে কে জানে, কাছাকাছি দুটো ডরমিটরি। একটা ছেলেদের আর একটা মেয়েদের। সবাই সবাইকে চেনে, কয়েকটা মাস তো থাকতেই হবে, তখন! জাহিদ কিচ্ছু জানেনা, যদি জানতে পারে, এত সহজ সম্পর্ক থাকবে না আর।
তবু জাহিদের প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে সুবর্ণার কেমন একটা শান্তি শান্তি অনুভূতি হলো।
-রাত বাড়ছে ম্যাডাম, চলেন, শুয়ে পড়তে হবে। সকাল
সকালই বের হতে হবে।
বাতি নিভে রুমটা অন্ধকার হলেও জাহিদের স্পর্শে সুবর্ণার মনের অন্ধকার দূর হয়ে গেল।
চলবে
শানজানা আলম