#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-২১
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.
নিম্নচাপের প্রভাবে বাইরে অঝোরে বৃষ্টি, বন্ধ জানলা ভেদ করেও সেই বৃষ্টির আওয়াজ ঘরে চলে আসছে, ঝড়ের সাথে ঠকঠকিয়ে কাঁপছে জানলার পাল্লা! মধ্যরাতে প্রকৃতি যেন আজ তাণ্ডবলীলায় মেতেছে, আর তিন্নির পৃথিবী ভেঙে পড়েছে তাসের ঘরের মতো! মাস দুয়েকের উড়ো উড়ো স্বপ্নের রামধনুরঙা ফানুস আজ যেন মুখ থুবড়ে সোজা মাটিতে এসে পড়েছে। অসহ্য যন্ত্রনায় মাথার চুলগুলো দুহাতে সজোরে খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো তিন্নি। কি ভেবেছিলো আর কি হয়ে গেলো?
কেন ? কেন ? কেন?
কেন সায়কের হয়ে তরফদারি করতে গেলো তিন্নি? সাজানো বাগান নিজের হাতে তছনছ্ না করলে কি মনে শান্তি হচ্ছিলো না? ভাবতে ভাবতেই ওর চোখ দিয়ে গড়িয়ে আসা নিঃশব্দ নোনতা গরম জলে ভিজে যাচ্ছিলো বিছানা চাদর বালিশ। বুকের পাঁজরগুলো কে যেন ইলেকট্রিক করাত দিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে কাটছে! শেষে অভিমন্যুও ভুল বুঝলো ওকে? ঠোঁট কামড়ে রক্ত বার করে, চোখের নোনতা জল আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় তিন্নি ওর মনকে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলো “অভিমন্যু ঠিক ফোন করবে, এখন না হোক একটু পর! সব ঠিক হয়ে যাবে আগের মতো”! তাও ভেতর থেকে যেন সায় পেলো না! কে যেন মাথা নেড়ে বলছিলো “সুখ সুখ রঙিন স্বপ্নের আজই শেষ রাত, আর সে ফিরে তাকাবে না!”
তারপর বিদ্যুৎচমকের মতো একটা ভাবনা ঝলক দিলো মাথায় ….. অভিমন্যু কি সায়ককে নিয়ে জেলাস?
.
.
.
.
এক একটা মিনিট কাটছে যেন এক একটা ঘন্টা! অবশেষে বহুপ্রতীক্ষিত ফোনের আলো জ্বলে উঠলো। একবার রিং হতেই ফোন ধরলো তিন্নি, কাঁদতে কাঁদতে সোজা চার্জ করলো — “পুরো কথা না শুনে কেন ফোন কেটে দিলে?”
— কাজ ছিল।
— না, ছিল না।
এর উত্তরে কি বলা যায়? মেজর অভিমন্যু সেন যা উত্তর দিলেন সেটা যদিও তিন্নির কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। অনেকদিন আগেকার সেই নিস্পৃহ, গম্ভীর, আবেগহীন গলাটা খুঁজে পেয়েছেন মেজর অভিমন্যু , স্তব্ধ গলায় বললেন —- “সীমন্তিনী, একটা বড়ো ভুল করতে যাচ্ছিলাম, আজ তুমি আমায় বাঁচিয়ে দিলে। ভেবে দেখলাম, আমার জীবনের সাথে তোমাকে জড়ানোর কোন মানে নেই। একটা সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিকভাবে বাঁচার অধিকার সবার আছে, তোমারও। আমার ছন্নছাড়া অনিশ্চিত জীবন তুমি মানাতে পারবে না। সে শক্তি তোমার নেই।”
কাঁদতে কাঁদতে ফুঁসে উঠলো তিন্নি — “সায়কের জন্য, আমাদের দুজনের মধ্যে একটা থার্ড পারসনের জন্য, তুমি এতটা ওভাররিয়াক্ট করছো?আর ইউ জেলাস?”
যেন সিংহের সাথে শেয়ালের তুলনা। বরফঠান্ডা একটা বিদ্রুপের হাসি হাসলেন মেজর অভিমন্যু সেন, বুকের রক্ত জল করে দেওয়ার মতো।
— আ্যম আই জেলাস?! আর ইউ সিরিয়াস?
তিন্নি হার মানলো না, আগের তেজেই ফুঁসে উঠলো —- “সায়ক আর তুমি, তোমরা দুজনেই একে অপরের নাম শুনলে ক্ষেপে ওঠো কেন? আমি তো বলেছি তোমায়, হি ওয়াজ জাস্ট এ ফ্রেন্ড! এখন বন্ধুও নয়, জাস্ট কলীগ!”
—- এ প্রশ্নটা তুমি নিজেকে করো সীমন্তিনী, কেন তোমার “জাস্ট ফ্রেন্ড” তোমার বয়ফ্রেন্ডের নাম শুনলে ক্ষেপে যায়?
তিনসেকেন্ড চুপ করে থেকে থম মেরে যাওয়া গলায় তিন্নি বললো —- “আমাদের সম্পর্কটার কথা কেউ জানে না অভিমন্যু! তুমি নিজে বারণ করেছো জানাতে!”
—- এক্সাক্টল্যি। আর তারপরও তোমার “জাস্ট ফ্রেন্ড” বা “জাস্ট” কলীগের আমাকে নিয়ে কি রিয়্যাকশন আর তার কারণ কি – সেটা না বোঝার মতো ইমম্যাচিওর তুমি নও! অবভিয়াসলি, হি হ্যাজ এ থিং ফর ইউ !
চাবুকসটান জবাবে মাথার সকল ধোঁয়াশাভাব কেটে গিয়ে টানটান হয়ে বসলো তিন্নি, ধক্ করে উঠলো বুকের ভেতরটা। আর একটা কথাও মুখ দিয়ে বেরোলো না ওর। অভিমন্যুর পোড়খাওয়া ইন্টোরেগেশনের নিস্পৃহ ঠান্ডা স্বর আবারও বেজে উঠলো —- “নাউ টেল মি, ডিড হি অর ডিড হি নট ট্রাই টু টাচ ইউ অন দ্যাট ডে?”
অনেক কষ্টে মুখ ফুটলো তিন্নির —- “তাতে কি যায় আসে অভিমন্যু? এন্ড অফ দ্য ডে আই আ্যম ও.কে! আই হ্যান্ডেলড ইট!”
ভেতর অবধি কাঁপিয়ে দেওয়া বরফের চেয়েও ঠান্ডা ধারালো ছুরির প্রথম আঘাতটা হৃৎপিন্ডে এসে বিঁধলো।
—— এটাই যায় আসে, সবটা জেনেশুনেও তুমি কভারআপ করার চেষ্টা করেছো, আমার কাছে সত্যিটা লুকোনোর চেষ্টা করেছো, এরপরও ওই স্কাউন্ড্রেলটার সাথে কথা বলেছো!
.
.
.
He knows!
কিছুক্ষন স্তব্ধ হয়ে থেকে একটা একটা করে প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করলো তিন্নি। —- “তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো?”
ততোধিক শীতল স্বরে তার প্রত্যত্তর এলো —- “না সীমন্তিনী। বাট স্যাডলি ইউ ডোন্ট ট্রাস্ট মি! আদারওয়াইজ, আমার কাছে এগুলো লুকোতে না!”
চোখ ফেটে এবার জল বেরিয়ে এলো তিন্নির। বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো অনুশোচনায়। কেঁপে যাওয়া গলায় বললো —- “আই আ্যম সরি! আমি বুঝতে পারছিলাম না সবটা শুনে তোমার কি রিয়্যাকশন হবে! যদি তুমি আমাকে ভুল বোঝো….”
—- আ্যজ আই সেইড….. ইউ ডোন্ট ট্রাস্ট মি এনাফ।
কোন অনুযোগ বা অভিযোগ নয়। যেন একটি পর্বের পরিসমাপ্তি ঘোষনা করলেন মেজর অভিমন্যু সেন। আমূল কেঁপে উঠলো তিন্নি।
—- অভিমন্যু … প্লিজ!
—- যেকোনো রিলেশনশিপের বেস হল ট্রাস্ট, দুজনের ওপর দুজনের বিশ্বাস। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি সীমন্তিনী, আই হ্যাভ নো ডাউট, সেদিন খারাপ কিছু হওয়ার হলেও তুমি ঠিক নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে…. বাট ইজ দ্যাট এনাফ? চেষ্টা করা আর সাকসেসফুল হওয়ার মধ্যে ডিফারেন্স আছে। ফরচুনেটলি, ইউ ওয়ার লাকি দ্যাট ডে! বাট হোয়াট আ্যবাউট টুমোরো? মেনলি, হোয়াই ডিডনট্ ইউ টেল মি? তুমি কি ভয় পাও আমায়?
কেঁদে ফেললো তিন্নি! কাঁদতে কাঁদতেই বললো — “আমি জানি না অভিমন্যু! আমি একটা স্টুপিড, ইডিয়ট….”
—- আমার প্রশ্নের উত্তর এটা নয়!
— আমি জানি না। মে বি … মে বি নট! কিন্তু সায়কের জন্য আমরা কেন নিজেদের মধ্যে আর্গুমেন্টস করছি?
— ইটস নট আ্যবাউট হিম। আজ না হয় কাল, এ প্রসঙ্গটা উঠতোই। তুমি আমাকে ভয় পাও কারণ তুমি জানো, হোয়াট আই আ্যম ক্যাপাবেল অফ ডুয়িং, বিকজ অফ মাই জব! এই সত্যিটা বদলাবে না কোনোদিন। ইউ ডিজার্ভ এ নর্মাল লাইফ, এ নর্মাল রিলেশনশিপ, এ নর্মাল পারসন….. সায়কের মতো। আই আ্যম নট দ্য ওয়ান ফর ইউ।
আবারো কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ নয়, দৃঢ় কনক্লুশন, যেন নড়চড় হবে না। আরএকবার কেঁপে উঠলো তিন্নি। ভেঙে পড়ার আগে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো — “সায়কের মতো?? কি থেকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছো অভিমন্যু?”
— যেটা সত্যি, যেটা রিয়ালিটি সেটাই বলছি, নাথিং এলস। আমার জীবনে তুমি ঠিক ততোটাই বেমানান, যতটা তোমার জীবনে আমি।
কাঁদতে কাঁদতেই ফুঁসে উঠলো তিন্নি — “কি করে জানলে? আমার জীবনের সিদ্ধান্ত তুমি একাই কি করে নিতে পারো?”
অভিমন্যু নির্বিকার, আজ ওর মন লৌহকঠিন। হিমশীতল কণ্ঠে বললো — “কারণ সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো তুমি মানসিকভাবে পরিণত নও।”
তিন্নি কিছু রিয়াক্ট করার আগেই নিস্পৃহ গলায় বলতে লাগলো অভিমন্যু — “তুমি বড্ডো নরম, বড্ডো সরল। লাইক আ্যন ইনোসেন্ট কিড…. তর্ক করো না, বিকজ ইউ “আর” এ কিড! আর তাই রিয়্যালিটি ইগনোর করছো। আজ না হয় কাল, আচমকা এমন একটাদিন আসবে যেদিন আমার কোনো খবর পাবে না তুমি, কোনো যোগাযোগ করতে পারবে না। যদি ভাগ্য ভালো হয়, হয়তো দশদিন পরে নিউজপেপারে বা টিভিতে দেখবে আমার মৃতদেহ আসছে তেরেঙ্গায় মুড়ে, কফিনবন্দি হয়ে। সেদিনের সেই মানসিক চাপ তুমি নিতে পারবে না তিন্নি, নিজেকে শেষ করে দেবে। আমার মা’কে এভাবে হারিয়েছি, তোমার জীবনটা এরকম কালবৈশাখীর ঝড়ে আমি উড়িয়ে দিতে পারি না। তার চেয়ে এই ভালো, ইউ চুজ এ নর্মাল পারসন, নট “সায়ক” বাট এ ফেলো ইঞ্জিনিয়ার, একজন সিভিলিয়ান…. হোয়াটেভার, লিড এ নর্মাল লাইফ। তুমি সুখী হও জীবনে, ভালো থাকো। আমার একার জীবন, একাই ভালো আছি। আমার সাথে নিজেকে জড়িয়ে, তুমিও শান্তি পাবে না, আমিও না।”
.
.
.
অভিমন্যুর মা নেই? কত একা এই মানুষটা?
ফোনের এপাশে কখন যে কান্না থমকে গিয়েছিলো তিন্নি নিজেও জানে না। স্তব্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছিলো আর দমবন্ধ হয়ে আসছিল ওর। অভিমন্যুর আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া প্রতিটি সত্যিকথা ওর হৃদয়ে ছুরির আঘাত হানছিলো, ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত নিঃশব্দ জল হয়ে চোখ দিয়ে পড়ছিলো। অভিমন্যুর কথার স্রোত থামলে, খুব ইচ্ছে করছিলো তিন্নির ছুটে যায় সেই একলা মানুষটার পাশে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মানুষটার হাত। চোখে চোখ রেখে বলতে ইচ্ছে করছিলো “তুমি একলা নও অভিমন্যু, আমি আছি সর্বক্ষণ তোমার পাশে, তোমার সাথে।” কিন্তু এতদূর থেকে কি’ই বা করতে পারে তিন্নি অসহায়ের মতো ফোন হাতে বসে থাকা ছাড়া? নিজের অসহায়তার রাগে ঠোঁট কামড়ে ধরলো ও, রক্তের নোনতা স্বাদটা জিভে লাগতে সম্বিৎ ফিরে এলো ওর! এই মুহূর্তে কিছু একটা বলার খুব দরকার, কিন্তু কি বলবে তিন্নি? কি বললে ও অভিমন্যুকে বিশ্বাস করাতে পারবে, ভালোবাসাতে পারবে?
অনেকক্ষন নিঃশব্দ কান্নার পর গলার স্বর খুঁজে পেলো তিন্নি। চোখের জল মুছে বলতে চেষ্টা করলো – অভিমন্যু…..প্লিজ?
— জেদ করো না সীমন্তিনী! সবকিছু জেদ করে পাওয়া যায় না। লাস্ট ফিউ মান্থস ওয়ার এ মিসটেক। ইটস্ ওভার নাউ!
না!না!না! এ কি বলছে অভিমন্যু?
শরীরের সবকটি কোষ, মস্তিষ্ক্র সবকটি নিউরোন একযোগে বিদ্রোহ ঘোষনা করে দিল, শিউরে উঠলো তিন্নি! বুকের গভীর থেকে ডুকরে উঠে আসা কান্নার আভাসটুকু মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টায় বললো — “জেদ তুমি করছো অভিমন্যু…. আমাদের সম্পর্কটাকে একটাও চান্স না দিয়ে! কেন বুঝছো না…”
—- আমি বুঝি, আর বুঝি বলেই বলছি, তুমি পারবে না আমার জীবনের সাথে মানাতে। আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ টু কম্প্রোমাইজ উইদ ইওয়োর হ্যাপিনেস। ইউ ক্যাননট বী মাইন।
—- বাট আই আ্যম অলরেডি ইওয়োরস অভিমন্যু!শিয়ালদা স্টেশনে যেদিন প্রথমবার আমায় প্রাণে বাঁচিয়েছিলে, .. কেন বুঝছো না তুমি না চাইতেও আমি তোমার হয়ে গিয়েছি সেই প্রথম দিন থেকে?
তিন্নির ধরে আসা গলার ঘনত্বটা অভিমন্যুর বুকের দুর্বলতম কোণ ছুঁয়ে গেলো, তবুও চোয়াল শক্ত রেখে মনকে কড়া শাসনে বাঁধলো ও। ঠান্ডা গলায় বললো — “ওসব রূপকথার গল্পে বা কবিতায় হয়, সীমন্তিনী। রিয়াললাইফে পয়েন্টলেস।”
বিষমাখানো তীরের ফলার মতো সোজা বুকের ভেতরে গিয়ে ফুটলো অভিমন্যুর কথাটা, বিনা প্রতিবাদে নিঃশব্দ রক্তপাত লুকিয়ে নিয়ে ধরা গলায় বলে যেতে লাগলো তিন্নি
— না অভিমন্যু! বিশ্বাস করো, যেদিন থেকে তুমি আমার জীবনে পা রেখেছো, আমার সাদামাটা জীবনটা একলহমায় বদলে দিয়েছো তুমি। কোনোদিন বলিনি তোমায়, আজ বলছি। সেরাতে ট্রেনে সারাটা রাস্তা যেতে যেতে শুধু তোমার কথা ভেবেছিলাম…. জানো? NGP স্টেশনে নেমেও তোমাকে খুঁজেছিলাম, যদি তোমরাও নেমে থাকো….পাই নি দেখতে। অতজনের সাথে ঘুরতে বেরিয়েও আমি একলা ছিলাম, হোটেলের ঘরে সারা দুপুর রাত কেঁদেছিলাম আর তোমার দেখা পাবো না বলে! … তোমার পোস্টিং কোন রাজ্যে জানতাম না তাও কি এক ব্যর্থ আশায় পরেরদিন ঘুরতে বেরিয়ে নর্থ সিকিমের প্রতিটি আর্মি চেকপয়েন্টে আমার চোখ তাকিয়েছিল সব ইউনিফর্মে, যদি কোনোভাবে দেখা হয়ে যায় আবার। আমার চোখ কেবল তোমাকেই খুঁজছিলো অভিমন্যু, তোমাকে খুঁজে পাবো না তা জেনেও।
তিন্নির কথাগুলো শুনতে শুনতে একটু একটু করে বুকের ভিতরটা ফাঁকা হয়ে আসছিলো অভিমন্যুর। কি করে স্বীকার করবে ঠিক একই অনুভূতিতে ছেয়েছিল ওর’ও মন? কর্ত্যব্যের দোহাই দিয়ে শেষ জোরটুকুতে মনকে শক্ত করলো অভিমন্যু, যথাসম্ভব নিস্পৃহ স্বরে বললো
— সেটা তোমার পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয় সীমন্তিনী।
একটা ঠান্ডা শিরশিরানি বয়ে গেলো তিন্নির মেরুদন্ড বরাবর। আজ আর কিছু চেপে রাখবে না, আজ আর থামলে চলবে না! মাসদুয়েক আগেকার পুরোনো দিনগুলোর কথা মনে পড়তে নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠলো একটু, তারপর কান্নার মধ্যেই ব্যর্থতার হাসি হেসে বললো
— নাহ অভিমন্যু! “পাগলামি” শুরু হলো সিকিম থেকে ফিরে এসে। তুমি কি জানো, এখন আমার সারাদিনের কাজ ফোনের কল লগ খুলে তোমার ফোন নাম্বারটির দিকে তাকিয়ে থাকা? কোনদিন কত মিনিট কত সেকেন্ড কথা হয়েছে তা আমার ঠোঁটস্থ। সারাদিন আমার মনে হয় তুমি যেন ঠিক আমার পাশেই আছো, স্পষ্ট অনুভব করতে পারি। প্রতিমুহূর্ত মনে হয় অদৃশ্যভাবে আমাকে তুমি রক্ষা করে যাচ্ছো, তুমি থাকতে আমার কোনো বিপদ হতে পারে না। অফিস যাওয়াআসার পথে যে’কটি মন্দির চোখে পড়ে, জানো আমি সবকটায় প্রণাম ঠুকি, যাতে ঈশ্বর তোমাকে অক্ষত রাখে। এখন আমার এমন অবস্থা, তুমি যখন আমায় কাঁদতে মানা করো, আপনাআপনি আমার কান্না বন্ধ হয়ে যায়। তুমি একবার যদি আমায় বল “ভালো থেকো” আমি সত্যি ভালো থাকি সেই দিনটা। ভুল করেও রাস্তায় কারো হাত আমার গায়ে লেগে গেলে সেই জায়গাটা কেমন লাল হয়ে ওঠে, জ্বলুনি শুরু হয়ে যায়! আমার শরীর অন্য কারো ছোঁয়া রিজেক্ট করে দিচ্ছে অভিমন্যু! আমার শরীর,মন, আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সবকিছু তোমার ইচ্ছেতে চলে অভিমন্যু।তুমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেও তারা তোমারই থাকবে। কিছু পেয়েও না পাওয়ার যন্ত্রণা বোঝ? আমি শুধু তোমায় ভালোবাসতে জানি অভিমন্যু। কোনো দাবী ছাড়া, কোনো বাঁধন ছাড়া ভালোবাসা, আমি তোমার শর্তে বাঁচতে চাই, তোমার সাথে থাকতে চাই। এটুকু কি অনেক বেশি কিছু চাওয়া? তোমার কাছে আমার কোনো দাবি নেই, কোনো সম্পর্কের চাহিদা নেই, হয়তো আমাকে ছাড়াও তুমি খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারবে কিন্তু তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না!
কান্নাভেজা গলায় আকুল হাহাকারে মনের কথাগুলো চলছিলো তিন্নি। বলতে বলতে ওর গলা বুজে এলো বারবার, চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়া নিঃশব্দ নোনতা জলের স্রোত একবারের জন্যও বন্ধ হয়নি। আর শুনতে শুনতে ফোনের অপর প্রান্তে অভিমন্যুর পাথরকঠিন হৃদয় কেঁপে উঠছিল বারবার। এসব কি বলে যাচ্ছে তিন্নি? এ’ও কি সম্ভব? কেউ কি’করে কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে? তিন্নির কান্নাভেজা গলা শুনতে শুনতে অদ্ভুত একটা মানসিক ক্লান্তি ধীরে ধীরে ঘিরে ধরছিলো অভিমন্যুকে। যেন অদৃশ্য এক চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছে ও, বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন মুঠোয় ধরে রাখা শুকনো বালিগুলোও বেরিয়ে যাচ্ছে আঙুলের ফাঁক গলে। বুকের ভেতরের উথলপাতাল সাগরঢেউ সামলে অনেকক্ষন চুপ করে থেকে স্তব্ধ গলায় বললো
— কেন জেদ করে চলেছো সীমন্তিনী? এভাবে হয় না! এসব তোমার মনের ভুল। ক’টাদিন সময় নাও, আমার চেয়েও আরো ভালো কেউ নিশ্চয়ই তোমার জীবনে আসবে যার সাথে তুমি খুশি থাকবে, নিরুদ্বেগ জীবন কাটাবে….
থামিয়ে দিলো তিন্নি — “কেন বোঝো না তুমি? আরো কতো স্পষ্ট করে বলতে হবে?”
— বুঝি, সেই জন্যই বলছি! …..
— নিরুদ্বেগ জীবন আমি চাই না অভিমন্যু, অন্য কাউকে আমার চাই না! আমি শুধু তোমাকে চাই। সারাদিনে একবারমাত্র তোমার গলার আওয়াজ শুনে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। যদি সেটাও অনেক বেশি চাওয়া হয় – তাহলে শুধু এইটুকু জানিয়ে দিও প্রতিদিন, পৃথিবীর যে প্রান্তরে, যেখানেই আছো, তুমি বেঁচে আছো! সেই পাওয়াতেই আরেকটি দিন বেঁচে থাকবো আমি।
—- সীমন্তিনী!
— ইউ ইন্টেনডেড টু বি দ্য লাস্ট পারসন আই লাভ! আই আমি অলরেডি ইওরস অভিমন্যু, টুডে-টুমোরো আ্যন্ড ফরএভার। নতুন করে আর অন্য কারো হতে পারবো না। মনটা তো কবেই দিয়ে দিয়েছি তোমায়, এ শরীরটাও তুমি ছাড়া অন্য কেউ পাবে না। যদি এ পৃথিবীতে তোমার জায়গা না হয়, তবে আমারও জায়গা হবে না। যদি তুমি আমার জীবনে না’ই থাকো তবে আমি বেঁচে থেকে কি করবো অভিমন্যু? আমি জানি, তোমাকে যতটাই ভালোবাসি না কেন, তুমি আমাকে ভালোবাসো না!
একটু থেমে মনের গোপনতম চোরাকুঠুরি থেকে টেনেহিঁচড়ে উঠিয়ে আনলো নিজের সকল ইনসিকিউরিটি, শিকড় সমেত। কাঁদতে কাঁদতে বলে যেতে লাগলো তিন্নি —- মাসদুই আগে যখন আমি তোমার জন্য কেঁদে ভাসাচ্ছি, তখন পরপর দুইদিন দেখা হওয়ার পরও, আমার প্রাণ বাঁচানোর পরও তুমি আমার নামটুকু জানতে চাও নি! মনকে বুঝিয়েছিলাম, হতেই পারে আই ওয়াজ নট “দ্যাট ইম্পরট্যান্ট” টু ইউ। কিন্তু এখন? তুমি বলছো আমি তোমায় বিশ্বাস করি না, কিন্তু তুমি কি আমায় বিশ্বাস করো অভিমন্যু? আজ দুইমাস আমরা ফোনে কথা বলি কিন্তু আমাদের মধ্যে ঠিক কি “সম্পর্ক”, আদৌ তোমার সাথে আমার কন্টাক্ট আছে কিনা,সেটা কোন তৃতীয়ব্যক্তি জানে না! আমি তোমাকে সব বলেছি আর তুমি? আজ অবধি, তোমার নিজের জীবন নিয়ে একটা কথা আমায় বলো নি। আমি এও জানি না তোমার বাড়ি কোথায়, ফ্যামিলিতে কে কে আছে! তোমার পাস্ট, তোমার প্রেজেন্ট নিয়ে আমার জাস্ট কোনো ধারণা নেই অভিমন্যু, তোমার একটা ফোটো অবধি নেই আমার কাছে! আমাদের সম্পর্কটার আদৌ কোনো ফিউচার আছে কিনা তাও জানি না! এমনকি……এমনকি তুমি আমাকে প্রতিদিন আই লাভ ইউ’ও বলো না! হয়তো তোমার কাছে এগুলো খুব সামান্য ব্যাপার, ইমম্যাচিওর কথা কিন্তু আমার কাছে এই ছোট ছোট ইমোশনগুলো খুব দামি অভিমন্যু! এবার বলো, এতে আমার খারাপ লাগে না? কষ্ট হয় না? কান্না পায় না? তাও তো কিচ্ছু বলি না তোমায়! তোমার শর্তে, তোমার সবটা নিয়ে আমি শুধু “তোমাকে” ভালোবেসেছি অভিমন্যু, তোমার পরিচয়কে নয়। মাঝেমাঝে যেটুকু ছিঁটেফোঁটা ভালেবাসা দাও আমায়, তাই নিয়েই খুশি থাকি! যদি ভালো না বাসতে পারো, তবে তোমার বন্ধুত্বটুকু নিয়েও আমি খুশি থাকবো। শুধু আমাকে তোমার থেকে আলাদা করে দিও না প্লিজ।
বর্ষার ঘোলাটে জলে ফুলেফেঁপে ওঠা হুগলি নদীর মতো চেপে রাখা সব আবেগ, সব অভিমান হৃদয় ছাপিয়ে বেরিয়ে এলো আজ। বলতে বলতে অবুঝ বাচ্চার মতো আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লো তিন্নি আর দুইহাজার মাইল দূরে ঝকঝকে তারা ভর্তি পরিষ্কার কালো আকাশের নিচে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অভিমন্যু। কি ভেবেছিলো আর কি হয়ে গেলো!একটা ছোট্ট ভুল বোঝাবুঝি থেকে এতো কিছু! মনের ভেতরে এতকিছু চেপে রেখেছিলো তিন্নি অভিমন্যু জানতেও পারে নি। সত্যিই তো! মেয়েটা কোনোদিন কিছু চায় নি ওর কাছ থেকে, শুধু একটু ভালোবাসা ছাড়া। অভিমন্যুর পাথর মন যে তিন্নির ফুলের মতন নিষ্পাপ, নরম মনকে নিঃশব্দে প্রতিদিন আঘাত করে চলেছে তাই বা কে জানতো!দুমড়ে মুচড়ে উঠছিলো বুকের ভেতরটা, অসহায় লাগছিলো নিজেকে এতো দূর থেকে কি করে এই কান্না থামাবে ও? অনেকক্ষণ পর যখন অভিমন্যু নিজের সম্বিৎ ফিরে পেলো তিন্নির কান্না থামে নি তখনও। একটা গভীর নিঃশ্বাস পড়লো ওর, ভালোবেসেও এতো কষ্ট? এই নরম মনটাকে কেন এতো কাঁদাচ্ছে ও? মন স্থির করে নিয়েভারী,শান্ত গলায় প্রায় আদেশ করলো অভিমন্যু — “সীমন্তিনী, calm down, stop crying।”
সেই গলা, যা শুনে তিন্নি মরেছে প্রথম দিন থেকে! যা তিন্নির শিরায় শিরায় মাতুনি ছড়িয়ে দেয় আজও, এত কান্নার মধ্যেও! মুখে চাদর গুঁজে ফোঁপানো বন্ধ করলো তিন্নি। ঠিক যেন একটা পাঁচবছরের শিশুকে বোঝাচ্ছে তেমনি নরম, শান্ত গলায় অভিমন্যু বলে যেতে লাগলো – কেন কাঁদছো? একবারও বলেছি, আমি তোমায় “ভালোবাসি” না? একটা কথা বলো তো, নিয়মকরে প্রতিদিন “আই লাভ ইউ” না বললে ভালোবাসা বোঝানো যায় না? এই যে রাতের পর রাত তোমার সাথে কথা বলছি এতো রিস্ক নিয়ে, কেন বলছি?ভালোবাসি বলেই তো তোমাকে সুখী দেখতে চাই সীমন্তিনী! আমি চাই না তুমি এভাবে কাঁদো আমার জন্য। আমার অনিশ্চিত জীবনে কোনোদিন সুখী হবে না তুমি। আর তুমি সুখী না হলে আমিও যে শান্তি পাবো না!
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জলগুলো মুছে নিতে নিতে ধরাগলায় তিন্নি বললো — “তুমি যদি আমার সাথে না ‘ই থাকলে তবে আমার কিসের সুখ, অভিমন্যু? আমায় কাঁদিয়ে তুমি নিজেও কি সুখ পাচ্ছো? এটা বোঝো না জেদ করে তুমি নিজে আমায় সরিয়ে না দিলে আর কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না?”
অর্থহীন এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর হয় না! বিশাল বড়ো একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে চুপ করে রইলো অভিমন্যু।এই একটি মানুষের জন্য বারবার দুর্বল হয়ে যায় মন! অবুঝ, জেদী মেয়েটাকে নিজের করে নিতে চায়, সবসময় আগলে রাখতে চায়। এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রবল মরুঝড়ে কাছে নিরুপায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কি উপায়? মস্তিষ্কের সাথে মনের যুদ্ধে অবশেষে আবারো হার মানলো মস্তিষ্ক। প্রকৃতির প্রবল ঝড় থেমে গেছে ততক্ষনে, ছাইধোঁয়া মেঘ কেটে গিয়ে ফিরে এসেছে রাতের নীলিমা, ঝকঝকে চন্দ্রমার ছটা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে! নিজের “প্রিয় মানুষটির” কাছে হার মেনে নিয়ে তিন্নির ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নার মাঝে অস্ফুটে ঠোঁট নড়ে উঠলো অভিমন্যুর
— ও.কে।
কাঁদতে কাঁদতে শব্দ করে নাক টানলো তিন্নি — কি ও.কে?
—- যা তুমি বললে। ….. ও.কে।
***********************__******************************
.
.
.
এত্ত ছোট্ট একটা কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগলো তিন্নির। ও যা ভাবছে সেটাই কি ঠিক? এত ক্যাজুয়ালি এমন ইনটেন্স ঝগড়ার পরিসমাপ্তি? কি বলবে বুঝতে পারলো না তিন্নি। গাল বেয়ে গড়িয়ে আসা তপ্ত অশ্রুগুলো মুছে নিতে নিতে ধরা গলায় বললো — “সত্যি?”
— হুমম!
– আ-র? আর কিছু বলার নেই তোমার?
—- তুমি খুব জেদী, সীমন্তিনী।
নরম গলায় পরাজয় স্বীকার করে নিলো অভিমন্যু, শুক্লপক্ষের অষ্টমীর বাঁকা চাঁদের মতো একটা হাসি ফুটে উঠলো তিন্নির ঠোঁটের আগায়, কান্নাহাসি মেশানো গলায় বললো – তোমার থেকে কম।
ঠিক যেন ডেজা-ভ্যু! নিজের অজান্তেই অভিমন্যুর গলায় হাসি ফুটে উঠলো, মৃদু বকুনি দিলো এবার — “আর কাঁদবে না।”
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছে নিলো তিন্নি। — “কাঁদবো না, বাট প্রমিস মি, আর এভাবে আমায় কষ্ট দেবে না?”
শান্ত, অবিচল প্রতিজ্ঞা তার স্বরে — “প্রমিস।”
— কথায় কথায় আর কখনো আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথাও বলবে না?
— বলবো না। আর কিছু ম্যাডাম?
— আর…….আর কখনো এমন করে বকবে না আমাকে?
চাপা হাসির শব্দটা নিঃশ্বাসে লুকিয়ে নিয়ে নরম গলায় অভিমন্যু বললো — আমি তোমাকে বকি না সীমন্তিনী!! কিন্তু তুমি যে বড্ড অবুঝ!
চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে বসে রইলো তিন্নি, এই প্রথমবার অনুভব করলো লংডিস্টেন্সের অভিশাপ। উপলব্ধি করলো আজ যদি ওরা ফোনের বদলে সামনাসামনি থাকতো, এতো সামান্য ব্যাপারে হয়তো এতবড়ো মানঅভিমানের পালা চলতো’ই না! পলকের মধ্যে, চোখের ভাষাতেই সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে যেত হয়তো। ভৌগোলিক দূরত্ব চুলোয় যাক, খুব ইচ্ছে করছিলো ম্যাগপাই পাখির ডানা লাগিয়ে উড়ে যায় সুদূর সিকিমের সেই শুকনো পাহাড়ি উপত্যকার সেই জংলা সবুজ মিলিটারি তাঁবুতে, সপাটে জড়িয়ে ধরে সপাটে জড়িয়ে ধরে মনের মানুষটিকে, তার পাথরকঠিন বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদেও যে সুখ! আর পারলো না তিন্নি! নরম বালিশে মুখ লুকিয়ে ফোনের রিসিভারটা ঠোঁটের খুব কাছে এনে ফিসফিস করে বললো — “আই মিস ইউ। “
গলায় শব্দ করে হাসলো অভিমন্যু — “আমি তো ফোনেই আছি!”
উফফ্!
কিচ্ছু বোঝে না এই আনরোমান্টিক ভূতটা! উথলে ওঠা মিষ্টি মিষ্টি প্রেমসাগরে হতাশার টকটা লুকিয়ে নিয়ে এবার থেমে থেমে বললো তিন্নি
— আই মিস ….”ই-উ” অভিমন্যু। কতোদিন তোমাকে দেখি নি, তোমাকে ছুঁই নি ! বড্ডো ইচ্ছে হয় একবার তোমায় …….
আর না!
ভেতর থেকে ছিটকে আসা মনের কথাগুলো শেষ করার আগেই ঠোঁটে সেলোটেপ লাগিয়ে নিলো তিন্নি, আর কতো খুলে বলবে? গালদুটো ততক্ষনে জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো টকটকে লাল, তেমনি গরম। এবার বোধহয় বুঝলো অভিমন্যু! নিঃশ্বাস চেপে রেখে ঘন হয়ে আসা স্বরে তিন্নির অসমাপ্ত কথার রেশ টেনে বললো – “আর মাত্র সাড়ে চারমাস।”
আর একবার ছলাৎ করে উঠলো বুকের রক্ত, তিন্নির সাথে সাথে অভিমন্যুও কি দিন গুনছে? প্রেমসাগরে মজতে মজতে একটু আগের অভিমানী হৃৎপিণ্ড আর একবার নিংড়ে নিলো দুফোঁটা চোখের জল। ভিজে আসা স্বর সরলভাবে বলে উঠলো — “আর কখনো এভাবে আমায় ভুল বুঝো না অভিমন্যু…… খুব কষ্ট হয় আমার কাঁদতে! বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি যে তোমায়!”
আর একটি বড়ো একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে অনেকক্ষন চুপ করে রইলো অভিমন্যু, হয়তো মুচড়ে উঠলো হৃৎপিন্ডটা! তারপর কোমল স্বরে বললো —- এত ভালোবাসা ভালো নয় সীমন্তিনী, পরে তুমিই কষ্ট পাবে!
মোমের মতো গলে যাওয়া মন নিয়ে কোনো জবাব দিলো না তিন্নি। অনেকটা কষ্টের সাথে আবেশ মাখা ভালোবাসার জোয়ার উথলে পড়ছিলো সারা শরীরে, এতো কান্নাতেও এটুকুই তো সুখ, অন্তত ভালোবাসার মানুষটি যে বোঝে সে কতটা ভালোবাসা পায়! অদ্ভুত এক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে থেকে শুধু ফোনটা সেঁটিয়ে রাখলো কানে, শরীরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের মতো।
—- সীমন্তিনী?
আর একবার ওর নাম ধরে ডাকলো অভিমন্যু, এবারের স্বর আরো গাঢ়। শিরায় শিরায় ছড়িয়ে যাওয়া আবেগে বুজে আসা গলায় সাড়া দিলো তিন্নি
— উমম্?
— আই আ্যাম সরি। আর কেঁদো না!
— ও.কে।
ছোট্ট করে জবাব দিল তিন্নি। ফোনের বেতারতরঙ্গের মধ্যে দিয়ে নিঃশব্দ শিরশিরানি ছড়িয়ে গেল দুপ্রান্তে, শ্রীরামপুর আর নর্থসিকিম আবার বেঁধে রইলো তড়িৎচুম্বকীয় প্রবাহে। আসলে, ধিকিধিকি আগুণ জ্বলছিল দুদিকেই বহুদিন ধরে, দুজনেরই মন পুড়ছিলো অভিমানে। প্রেমেপাগল মানুষদুটো শুধু জানতো না, কি করে মনের কথা মুখে আনতে হয়। কখনো কখনো “ঠিক বুঝে যাবে”র থেকে “ঠিক করে বুঝিয়ে বলা”টা যে বড্ড জরুরী! আজ যখন সন্দেহ, সংশয়, মানঅভিমানের তপ্ত গরল লাভাস্রোতের মতো গলগল করে বেরিয়ে এলো দুজনের মনের ভেতর থেকে, চোখের জলের ধারায় আবার শুদ্ধ হল হৃদয়, ফিরে এলো প্রেম। নিঃশব্দ ভালোবাসার জোর কি তবে পাথরও টলিয়ে দেয়? ভৌগলিক দুরত্ব, সামাজিক প্রোটোকল সবকিছু ভেঙে ফেলে দুজনেরই ইচ্ছে করছিলো একবার ছুটে চলে যায় অপরজনের কাছে, একবার মিশিয়ে নেয় শরীরে শরীরে!
আবেগে বিহ্বল হয়ে থেকে কিছুক্ষন পর অভিমন্যু সামলে নিলো নিজেকে, হাতঘড়িতে সময় দেখে নিজের স্বাভাবিক স্বত্বায় ফিরে এসে বললো — “অনেক রাত হলো, রাখছি এবার। বাট রিমেম্বার, আজকেরটা এক্সেপশন! আর কখনো ফোন করবে না, আমি করবো। ও. কে?”
কেন যে সময়গুলো হাতের মুঠোয় বেঁধে রাখা যায় না? আচ্ছন্ন হয়ে আসা মন নিয়ে কোনরকমে সাড়া দিলো তিন্নি
—- হুমম্!
— আর একটা কথা……
— কি?
— সায়কের থেকে সাবধানে থেকো। বিকজ হি হ্যাড এ থিং ফর ইউ… হি মাইট ট্রাই টু হার্ম ইউ নাউ।
প্রেম প্রেম নেশার চটকাটা ভেঙে গেল এবার! সিকিম থেকে ফেরার পর অফিসের কাজে বারেবারে ইচ্ছাকৃতভাবে সায়ক অপদস্ত করতে চেয়েছিলো তিন্নিকে, সেই কথাগুলো ঝলসে উঠলো মাথায়! অভিমন্যুও কি সেটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে? বুকের ভেতরটা ছাঁৎ করে উঠলো, তারপরই মনের প্রশ্নটা অস্ফুটে বাইরে বেড়িয়ে এলো — “তুমি কি করে জানলে?”
অবিচল, স্থির, গম্ভীর কণ্ঠস্বরটা ভেসে এলো — “জানাটা আমার কাজ সীমন্তিনী! ট্রাস্ট মি!”
— কিন্তু ……সায়ক কেন এমন করবে?
তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তিন্নির। মনে চলছে একটাই প্রশ্ন ‘ওর সকল খুঁটিনাটি খবর অভিমন্যু কি করে জানতে পেরে যায়?’ রক্তে শিরশিরানি জাগানো অভিমন্যুর রাশভারী, গম্ভীর কন্ঠে সম্বিৎ ফিরলো ওর — “তুমি বড্ডো ইনোসেন্ট, সবাইকে চট করে বিশ্বাস করে ফেলো আগের ভুলগুলো ওভারলুক করে! যেটা বলছি, শোনো! নো মোর আর্গুমেন্ট অন দিস।”
উফফ্!
আবার সেই জলদগম্ভীর, মনপাগল করে দেওয়া আদেশজড়িত স্বর, হীরের দ্যুতির মতো ঠিকরে আসা প্রবল পুরুষালী ব্যক্তিত্ব! সব কথাগুলো কানে গেলো না তিন্নির! অভিমন্যু আন্তরিকভাবেই ওর জন্য চিন্তা করে, ওর কেয়ার করে এসব ভেবেই অদ্ভুত মিষ্টি মিষ্টি ভালোলাগায় মনব্যঙাচি লাফিয়ে উঠলো হৃৎপিন্ডের প্রকোষ্ঠে, অলিন্দে-নিলয়ে। অভিমন্যু যেন দাউদাউ আগুন, অবুলুপ্ত ডোডোপাখির মতো সেই আগুনে ঝাঁপিয়ে মরাই যেন তিন্নির ডেস্টিনি।সে বলে না তো কি এসে গেল? অনেক সাহস করে আজ সব অভিমান ভুলে, চোখ বন্ধ করে নিয়ে বেড়ালের মতো আদুরে গলায় সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক শব্দ তিনটি উচ্চারণ করলো তিন্নি — “আই লাভ ইউ।”
তিনসেকেন্ড সব চুপচাপ, তারপর গলায় শব্দ করে হাসলো অভিমন্যু — “কি বলছিলাম আদৌ শুনলে সেটা?”
— ন নাহ্, ….. বাট আই লাভ ইউ!!
পরপর দুইবার! এখনো কি বলবে না সে?
এমনি কিশোরীচপল পাগল মেয়েকে কি করে কিছু বোঝাবেন মেজর অভিমন্যু সেন? হাল ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন একটা, নিজের অজান্তেই ভালোবাসার নরম হাসিতে মুখ ভরে উঠলো ওনার। যে হাসিটা অভিমন্যুকে পুড়িয়ে দেয় প্রতিবার, ছারখার করে দেয় ওর সকল প্রতিরোধ। সেই হাসি মাখিয়ে তিন্নির সকল ছেলেমানুষিকে প্রশ্রয় দেওয়া মেজর অভিমন্যু সেন নেশা লাগিয়ে দেওয়া ঘন স্বরে বললেন — “আই লাভ ইউ টু। নাউ, গুডনাইট…. কাল কথা হবে।”
অবশেষে তবে মহাদেবের ধ্যান ভঙ্গ হলো।
ছলছলে চোখে কান এঁটো করা হাসি নিয়ে বসে রইলো তিন্নি।কোনোদিন ফোনে ও “বাই” বলে না ও অভিমন্যুকে, আজও বললো না; অন্যদিনগুলোয় “রাখলাম” বলে তিনসেকেন্ড অপেক্ষা করে অভিমন্যু কেটে দেয় কলটা। আজ আরএকটা ব্যতিক্রম হলো, সত্যি বলতে আজ দু-দুটো ব্যতিক্রম অলরেডি হয়ে গেছে! তবে কথায় বলে “বার বার তিনবার”, সাহস জুটিয়ে আজ রাতের তৃতীয় ব্যতিক্রমটাও তিন্নি করেই ফেললো! অভিমন্যু ফোন কেটে দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে ওর কান ছুঁয়ে গেলো একটা সুস্পষ্ট, ভেজা চুম্বনের শব্দ।
এক,দুই সেকেন্ডের অপার নিস্তব্ধতা ওপ্রান্তে। তিন্নির কেমন একটা সন্দেহ হলো ~ সে কি শুনতে পেল আদৌ?
তারপর
.
.
তারপর
হালকা হেসে, তিন্নির শরীরের সকল রক্তকনিকাকে তা থৈ তালে নাচিয়ে তোলা হাস্কি ঘনগলায় অভিমন্যু বললো — “প্লেটোনিক ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি না ম্যাডাম। যেদিন দেখা হবে, সুদেআসলে এগুলো মিটিয়ে নেবো। “
.
.
.
হায়! কেন যে এই দূরত্বের অভিশাপ!
ফোন রেখে দেওয়ার পর প্রতিটি রোমকূপ খাড়া হয়ে থাকলো তিন্নির, পেটের মধ্যে ফুরফুরে প্রজাপতি উড়ে বেড়াতে লাগলো। সেই রাতে ওর আর ঘুম এলো না। ডিসেম্বর আসতে আর কতো দেরি যেন?
***********************__******************************
ক্রমশঃ
© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।
<কি? পছন্দ? প্রিয় অংশের স্ক্রীনশটের অপেক্ষায় রইলাম।>
সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n