#সেঁজুতি(পর্ব_১২)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
শেষ বারের মতো যখন সাওনের দিকে করুণ চোখে তাকিয়েছিলো সেঁজুতি। সাওন ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি। চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির চৌকাঠ থেকে বেরিয়ে এলো। কতবার বলার চেষ্টা করেছে, আশিক নিজ থেকেই ওকে ঝাপটে ধরেছিল তাই ব্যালেন্স করতে পারেনি। কিন্তু সবাই ওর কথাটিকে বানোয়াট বলে চালিয়ে দেয়।
বাবার বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই বিভিন্ন কথার সম্মুখীন হতে হয় সেঁজুতিকে। তবে কারো কথার জবাব দেয়নি সে।
সেঁজুতির বাবা শক্ত গলায় বললেন,“ তোর জন্য বারবার এমন কথা শুনতে হবে কেন, রে মা? একটু বাপের মানইজ্জত রাখবি না?”
কথাগুলো বলে তিনি সেঁজুতির মুখোমুখি হয়ে কেঁদে দিলেন। সেঁজুতি নিশ্চুপ হয়ে সোফায় বসে আছে। পায়ের আঙুলগুলো ভাজ করছে আবার সোজা করছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি সেই আঙুলের ভাজে পরছে। কিছুক্ষণ পরে পা দিয়ে মুছে ফেলছে পানি। এভাবেই ক্রমাগত চলতে থাকলো। সেঁজুতির মা গম্ভীরমুখে বললেন,“ কী হয়েছিলো, সেখানে?”
জবাবে সেঁজুতি কিছু বললো না। নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। যাকে শোনানোর সে নিজেই শুনলো না, তাই এখন আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কিই-বা বলবে এখন! সেঁজুতির ভাবি বাবার বাড়িতে গিয়েছে গতদিন, সে এসবের কিছুই জানে না। সেঁজুতির ভাইও সেখানে। তবে ওর ফুফু, কাকা’রা আছেন এ বাড়িতে। খুটিয়ে খুটিয়ে তারাই কথা শোনাচ্ছে, তবে সরাসরি কিছুই বলে না।
সেঁজুতির ফুফু বললেন, “ শ্বশুর বাড়িতে কতকিছু করে যে থাকা লাগে, সেসবের কিছুই তো দেখোনি। মেয়ে মানুষের সবকিছু সহ্য করা জানতে হয়, তাহলে স্বামীর ভাত খেতে পারে। ননদের কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে রইলেন সেঁজুতির মা।
সেঁজুতির বাবা বললো,“ তুই চুপ কর। আমার মেয়ের ভাতের অভাব নেই, যার জন্য সে বাড়িতে পরে থাকতে হবে। ভালো সম্বন্ধ পেয়েছি বিয়ে দিয়েছিলাম, ভাতের অভাবে না। তখন তো ভালো মানুষ দেখছিলাম, এমন মন-মানসিকতার জানলে কখনোই মেয়েকে বিয়ে দিতাম না। ”
সেঁজুতির মা বললো,“ মানুষের মুখ দেখে সবকিছু বিচার করা গেলে তো হতোই। নিজের উপরে এমন ঝড় গেল তবুও বুঝলাম না। এতটা দায়িত্বহীন মা কীভাবে হলাম, আমি!”
কথাটি তিনি সেঁজুতির বাবা, ফুফু, কাকাদের উদ্দেশ্য করে বললেন। তার কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সেঁজুতির পরিবার।
সেঁজুতির মায়ের চোখ গেল সেঁজুতির পায়ের দিকে। তিনি কাঁদোকাঁদো স্বরে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,“ পায়ে কী হয়েছে?”
জবাবে সেঁজুতি নিম্নস্বরে বললো,“ গরম ভাত,পানি পরেছে তাই। ”
সেঁজুতির মা নিচু হয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,“ কিছু দিসনি?”
সেঁজুতি ছোট করে উত্তর দিলো, “ নাহ।”
সেঁজুতির কথা শুনে ওর মায়ের বুকে তোলপাড় শুরু হলো। এবারে সেঁজুতি শক্ত ভাবে বলল, “ পায়ে কিছু লাগাবো না। খবরদার! কিছু দিতে আসবা না৷ সেদিন বিচারসভায় আমার একটা কথাও শুনাতে পারিনি তোমাদের কাউকে। সেদিন আমার দোষ ছিল, আজও আমার দোষ। ”
সেঁজুতির কথায় চুপ হয়ে যায় সবাই। সেঁজুতি সেখানে একমুহূর্তও না বসে রুমে চলে যায়।
.
.
টানা একদিন না খেয়ে আছে সেঁজুতি। ওর মা কয়েকবার এসেছিলেন কিন্তু সেঁজুতি কিছুই খায়নি। শরীর দুর্বল থাকাতে রাত এগারোটা বেজে সতেরো মিনিটে ঘুমিয়ে পরে। আজ মেয়ের পাশেই সেঁজুতির মা শুয়ে আছেন। তিনিও খাননি কিছু, ভাগ্য ভালো ছিল সেঁজুতির বাবা আগে খেয়েছিলো নাহলে তিনিও উপোস থাকতেন।
সেঁজুতির ফুফু তার মেয়েদের কাছে ইতিমধ্যে সবকিছু বলেও দিয়েছেন। ভাইঝির সংসার ভাঙা অবস্থায় তার একটুও আফসোস নেই। বড় জায়গায় বিয়ে হয়েছে, ছেলে সুন্দর, ভালো চাকরি করে এসব নিয়েই হিংসা তার। তার নিজের মেয়েদের এমন এমন বাড়িতে বিয়ে দিয়েছে যেখানে মাথা তুলে দাঁড়াতেই ছাওনি মাথায় লেগে যায়।
.
.
আজ সমস্ত কাজ ওর মেজো বোন আর আনোয়ারা বেগম করেছেন। রাতে তারাই রান্না করে পরিবেশন করলেন। সাওনকে ঘরের প্রত্যেকে ডেকেছে তবে সাওন খায়নি। না খেয়েই শুয়ে আছে। সেঁজুতির মতো সাওনেরও টানা একদিন না খেয়ে কাটলো।
বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে সাওন। ওরতো জানার কথা সেঁজুতিকে। আশিকের সাথে আর যাই করুক কখনো হাত তুলবে না সেঁজুতি, এটা জানা আছে। তাই আজকের এমন অবস্থাও সেঁজুতি স্ব-ইচ্ছায় করতে পারে না। তখন একমাত্র ভাগ্নের এমন অবস্থা দেখে রাগের বসে সেঁজুতির সাথে এমন করেছে। কথাগুলো হয়তো অন্যভাবেও বলা যেতো। কিন্তু ও সত্যিই চলে যাবে! এখানেই বা থাকবে কার কাছে? যার হাত ধরার সে নিজেই হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছে তাহলে থাকবে কেন! এসব ভেবে ঘুম আসছে না সাওনের। মন পোড়ায় তার।
তড়িঘড়ি করে সেঁজুতির ফোনে ডায়াল করলো। রিং হচ্ছে অথচ কেউ রিসিভ করছে না। বেশ কয়েকবার ডায়াল করার পরেও যখন সেঁজুতির হদিস মিললো না ; তখন সেঁজুতির ভাবির কাছে ফোনকল দেয় সাওন।
এতরাতে সাওনের ফোনকল পেয়ে অবাক হয়ে যায় সেঁজুতির ভাবি। সেঁজুতির ভাই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে সেঁজুতির ভাবি কিছু বলে না। সে ফোনে কথা বলছে। সাওনের চিন্তিত কণ্ঠস্বর দিয়ে বললো, “ এতরাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। সেঁজুতিকে ফোন রিসিভ করতে বলবেন, একটু?”
সাওনের কথা শুনে চমকে যায় সেঁজুতির ভাবি। চিন্তিত কণ্ঠস্বর নিয়ে বলে, “ সেঁজুতি তোমার কাছেই তো, ফোন রিসিভ দিয়ে কী করবা?”
সাওন একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো, “ আপনি কোথায়?”
সেঁজুতির ভাবি ধীর ভাবে বললো, “ আমাদের বাড়ি।”
এরপরে ছোট একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সাওন বললো, “ওহ। ঠিকাছে, রাখছি। ভালো থাকবেন।”
সেঁজুতির ভাবি কিছুই বুঝলো না। তার স্বামীকে বললো, “ সেঁজুতি ওদের বাড়িতে নেই, ঝামেলা হল না-কি! মায়ের কাছে কল দাও তো। ”
সেঁজুতির ভাই মায়ের কাছে ফোনকল দেওয়া মাত্রই ওয়েটিংয়ে পায়। অপেক্ষার তর সইছে না তার।
সেঁজুতির ভাই অস্থির হয়ে ওর মায়ের কাছে আবারো ফোনকল দেয়। ওর মা রিসিভ করা মাত্রই সেঁজুতির ভাই উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,“ কী হয়েছে? সেঁজুতি কোথায়? ফোন ওয়েটিং ছিল কেন?”
সেঁজুতির মা কাঁদোকাঁদো স্বরে সবকিছু বললো। সে রাতে সেঁজুতির ভাইয়ের ঘুম হয়নি। না ঘুমিয়েছে সেঁজুতির ভাবি। শুধু অপেক্ষা ছিল কখন ভোর হবে।
সকাল সকাল বেরিয়ে আসে দু’জনেই। সেঁজুতির ভাবি বাড়িতে বলে আসে, সেঁজুতির ভাইয়ের অফিস থেকে কল আসছে। কাজের জন্য যেতে হবে।
অফিসের বাহানা দেওয়ায় কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো না। তবুও কয়েকবার তার মা বলেছিল, এখান থেকেই তো যাওয়া যায়।
সেঁজুতির ভাবি শান্ত ভাবে বলে, সব কাগজপত্র সে বাড়িতে। শুধু শুধু প্রশ্ন করে মাথা খারাপ করবা না। কাজ আছে বিধায় যেতে হচ্ছে৷ কোনো মেয়ে বাপের বাড়ি থেকে স্ব-ইচ্ছায় যায় না।
ভাবির কথা শুনে তার মা কপাল ভাজ করে বললেন, “ সব মেয়ে আর তুই তো এক না। সারাক্ষণ তো সেই শ্বশুর বাড়ি নিয়েই থাকো। ”
মায়ের কথা শুনে সেঁজুতির ভাবি বললো, “ যেখানে আমার শ্বশুর বাড়ি ভালো আছে তাহলে সেটা নিয়েই তো পরে থাকবো। মেয়েদের বিয়ের পরে শ্বশুর বাড়িই সবকিছু। এমনকি সেখানে নিজের বাড়ির থেকে শান্তিতে থাকি। তাছাড়া, এটা মনে রেখো মা। যে বউয়ের মা যত চালাক তার কপালে জুটবে তালাক। সবার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চালাকি ভালো নয়।”
মেয়ের কথা শুনে মুখ দেখার মতো হয় রোশনেয়ারা বেগমের। হাসিমুখে মেয়েকে বিদায় দিয়ে ঘরে এসে বিড়বিড় করতে থাকলো।
.
.
সকালে মোবাইল হাতে নিয়ে চমকে যায় সেঁজুতি। অনেকগুলো ফোনকল সাওনের। এবারে সমস্ত আবেগ এসে বাসা বাঁধে সেঁজুতির মনে। গতকাল মারলো, কিছু শুনলো না আবার কল দিয়েছে কেন! তাও এতগুলো! নিশ্চয়ই খোঁজ নিতে এতগুলো ফোনকল দিয়েছে, বেঁচে আছি না-কি মরে গেছি। এসব ভেবে চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে।
সেঁজুতি কল ব্যাক করলো না। ইতিমধ্যেই ওর ভাই আর ভাবি চলে এসেছে। ওর ভাই বোনের মাথায় হাত রেখে বললো, “ কার কী দোষ আছে জানি না। শুধু এতটুকুই জানি, আমার বোনের কখনোই দোষ থাকে না। সবার পাপকর্মের জবাব দেওয়ায় দোষ মাথায় ভর করে। ”
ভাইয়ের কথা শুনে চুপচাপ থাকে সেঁজুতি। পায়ের অবস্থা দেখে সেঁজুতির ভাবির বুক ধড়ফড় করে উঠে। সেঁজুতি বাঁধা দিলেও শুনেননি তিনি। মলম এনে ওর পায়ে লাগিয়ে দেয়। যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠে সেঁজুতি।
সেঁজুতির ভাই শক্ত গলায় ওর বাবাকে বললো, “ যে মানুষ বাহিরের বিচার করতে পারে, সে কখনোই ঘরের বিচার করতে পারে না। আজ হলো তো প্রমাণ!”
ছেলের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সেঁজুতির বাবা। সেঁজুতির ভাই বললো, “ এত নিখুঁত বিচার করেন আপনি যার জন্য মেয়ের অবস্থা। আমি কতবার বলেছিলাম, ওই বাড়িতে একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। আপনি কী বলেছিলেন, হ্যাঁ? সেঁজুতি মুখে মুখে তর্ক করায় এমন হয়েছে, এমনকি মা’কেও কথা শুনাতে ছাড়েননি। মায়ের মতো গড়ে তুলেছে মেয়েকে। আপনি বাবা?”
সেঁজুতির ভাইকে ধমক দিয়ে চুপ থাকতে বললো, সেঁজুতির মা। সেঁজুতির ভাইয়ের কণ্ঠস্বর আরও উঁচু হয়ে গেল। উচ্চস্বরে বললো,“ একজন মেয়ের মাথার উপরে বাবা, ভাই, স্বামী থাকে। আমার বোন কাকে পেয়েছে? না আপনি নিজে থেকেছেন, না আমাকে পাশ ঘেঁষতে দিয়েছেন। সারাক্ষণ এককথা ছিল, মায়ের মতো মুখের কারণে এমন অবস্থা। ”
সেঁজুতিকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ তুই বাপ ডাকো কেন? আর একবার যদি শুনেছি, তোরে খুন করবো সাথে তোর বাপরেও।”
সেঁজুতির ভাবি কয়েকবার বারণ করলো। ফলস্বরূপ তাকেও ধমক খেতে হলো। ছেলের কথা শুনে চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে সেঁজুতির বাবার। সেঁজুতির মা চুপ হয়ে আছে।
সেঁজুতির ভাইকে দেখে ভয়ে রুমে আসেনি ওর ফুফু। না হলে এতক্ষণে এসে ফোড়ন কাটতো।
সেঁজুতির মা আর ভাবিকে উদ্দেশ্য করে বললো, “এরপর থেকে আমার থেকে যদি কিছু লুকিয়েছো, সব খুন করবো। ”
সেঁজুতির ভাবি শান্ত মাথায় বললো, “ আচ্ছা, সবাইকে খুন করে একা শান্তিতে থেকো। ঘরে ফুফু, কাকা আছে তাই এখন আপাতত চুপ থাকো। ”
সেঁজুতির ভাবির কথার পরে হনহন করে বেরিয়ে যায় সেঁজুতির ভাই। শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ আব্বা! আপনার ছেলের মাথা খারাপ হয়ে যায়, আমাদের কেউ কিছু বললে। ঘরের মানুষের থেকে তো অন্যকেউ জানবে না। আপনি শুধু শুধু কষ্ট পাবেন না। বরং দোয়া করবেন তার মাথা শান্ত রাখতে পারে যেন। রাগে তো সবকিছুর সমাধান হয় না। সমাজ, পরিবার, সেঁজুতির কথা তিন টা-ই চিন্তা করতে হবে।”
.
.
সকালে কয়েকবার ফোনকল দেয় সাওন। সেঁজুতির মোবাইল সাইলেন্স থাকায় দেখেনি। এরমাঝেই সেঁজুতির ভাবির মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠে। রিসিভ করা মাত্রই হতাশা নিয়ে সাওন সালাম দিয়ে বললো, “ ভাবি! সেঁজুতিকে কল দিয়ে একটু বলবেন, আমার ফোনকল রিসিভ করতে? রাতে ঘুমিয়েছিল, এখনো কি উঠেনি?”
সেঁজুতির ভাবি একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, “ উঠেছে। পায়ে মলম লাগিয়েছি তাই ব্যথায় ঝিমোচ্ছে। ”
ভাবির কথা শুনে চমকে গেল সাওন। ধীর কণ্ঠে বললো, “ আপনি এখন বাবার বাড়িতে নেই? সেঁজুতির কী হয়েছে? ”
সেঁজুতির ভাবি বললো, “ সকাল পৌনে আটটায় এসেছি, এ বাড়িতে। বাহ! সেঁজুতির পা পুড়িয়ে আসলো তোমাদের বাড়ি থেকে অথচ তুমি জানোই না!”
ভাবির কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সাওন। ভাবি দৃঢ়ভাবে বললো, “ আর কিছু বলবা? ”
সাওন কাঁপা স্বরে বললো, “ওর কাছে ফোনটা দিতে পারেন?”
সেঁজুতির সামনে মোবাইল ধরার সাথে সাথে সরিয়ে দিলো সেঁজুতি। স্বর বাড়িয়ে বললো, কথা বলবো না।
আমার খোঁজ কোনোকালেই নেয়নি, এখনো লাগবে না।
#চলবে