#সেঁজুতি(পর্ব_১৩)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
সেঁজুতির ভাবি বললো, “ সকাল পৌনে আটটায় এসেছি, এ বাড়িতে। বাহ! সেঁজুতির পা পুড়িয়ে আসলো তোমাদের বাড়ি থেকে অথচ তুমি জানোই না!”
ভাবির কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সাওন। ভাবি দৃঢ়ভাবে বললো, “ আর কিছু বলবা? ”
সাওন কাঁপা স্বরে বললো, “ওর কাছে ফোনটা দিতে পারেন?”
সেঁজুতির সামনে মোবাইল ধরার সাথে সাথে সরিয়ে দিলো সেঁজুতি। স্বর বাড়িয়ে বললো, কথা বলবো না।
আমার খোঁজ কোনোকালেই নেয়নি, এখনো লাগবে না।
.
.
সেঁজুতির কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পায় সাওন। তবে সেঁজুতি কথা বলেনি ফোনে। সাওন ব্যকুল হয়ে ছিল সেঁজুতির সাথে কথা বলবে তাই কিন্তু সেঁজুতি কোনো পরোয়া করেনি৷ একবুক হতাশা নিয়ে বিছানায় বসে আছে সাওন।
সকালে আনোয়ারা বেগম আসলেন ছেলের খোঁজ নিতে। এসে দেখে সাওন চিন্তিত হয়ে বসে আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,“ খাবি না, বাবা?”
জবাবে সাওন বললো,”না।”
আনোয়ারা বেগম জোর করাতে চেঁচিয়ে উঠলো সাওন। উচ্চস্বরে বললো,“ সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করো কেন! বলছি খাবো না, তো খাবোই না। এত কথার কী আছে?”
সাওনের রাগান্বিত স্বর দেখে চলে গেলেন আনোয়ারা বেগম। সাওন জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বসে রইলো নিজ স্থানে। আজকেও অফিসে যাওয়া হলো না৷ সাওনের বস ওয়ার্নিং দিয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে চাকরির সমস্যা হবে এবং এ মাসে বেতনের থেকে টাকা কাটা যাবে। পরপর কয়েকবার ছুটি নেওয়া হয়েছে, যা চাকরির জন্য ঝুকিপূর্ণ।
উত্তরের থাই গ্লাস খুলে বাহিরে তাকালো সাওন। সবকিছু থমথমে পরিবেশ মনে হয়। রুমের মধ্যেও নীরবতা। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবারও মোবাইল হাতে নিলো। সেঁজুতিকে পরপর তিনবার ফোনকল দিলো তবে সেঁজুতির কোনো হদিস পেলো না।
এবারে লাগাতার ফোনে মেসেজ দিলো। কোনো রিপ্লাই নেই। সাওনের ভালো ভাবে বুঝা হয়ে গেছে, তার অভিমানীনি অভিমান করে আছে। থাকবেই তো অভিমান করে। রাগের মাথায় ওর গায়ে হাত তুললো, এমনকি কত কথা শুনিয়ে দিলো। মেয়েটির দিকে ভালোভাবে তাকালোই না বরং অপমান করলো। শেষ বার যখন বাড়ি থেকে বের হবে তখনও করুণচোখে তাকিয়েছিল সাওনের দিকে কিন্তু সাওন একবারের জন্যও বাঁধা দেয়নি।
এতদিনের সমস্ত রাগ এসে হঠাৎই গতকাল মাথায় বেঁধেছিল। হয়তো সবার উপরে রাগটা সাওনের মাথায় এসে ভর করে।
তাছাড়া, একমাত্র ভাগ্নে তাঁর। মামা বাড়িতে এসেই যদি এমন হয়। যদি বাচ্চা ছেলেটির কিছু হয়ে যেতো! তখন কী জবাব দিতো। সবকিছু তালগোল পাঁকিয়ে যায় সাওনের মাথায়। তারমধ্যে ওর বোনদের নালিশতো ছিলোই, সাথে আনোয়ারা বেগমেরও। সেই মুহূর্তে সবকিছুর ভুল-সঠিকের যাচাই করার অবস্থাতে ছিল না সাওন। শুধুমাত্র জানতো ভাগ্নে মৃত্যুর মুখ পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। এর কারণ উপলক্ষ্যেই সেঁজুতিকে বকাঝকা করে।
ঠান্ডা মাথায় হওয়ার পরে সবকিছু আশেপাশে ঘুরলো সাওনের। ওর সেঁজুতি কখনোই কারো ক্ষতি করবে না। তাছাড়া, আশিককে কতটা ভালোবাসে সেঁজুতি। এ বাড়িতে আসলে ওর দায়িত্ব সেঁজুতির কাঁধেই তুলে নেয়। সবকিছু মাথায় ঘুরছে সাওনের। সে তড়িঘড়ি করে সেঁজুতিকে ফোনকল দেয় কিন্তু যা হওয়ার তাই হলো। জুতো মেরে গরু দান করলে, সে গরুর লেজেরবারিই খেতে হয়।
মিনিটের পর মিনিট অপেক্ষা করার পরেও সেঁজুতির হদিস নেই। না বলেছে ফোনে কথা। শুধু অপরপাশের মানুষটির থেকে একটা কথাই শুনেছে, কথা বলবে না। কোনোকালেই খোঁজ নেয়নি, তাই এখনো খোঁজ লাগবে না।
এই কথাটি শোনার পরে সাওনের বুক শীতল হয়ে যায়। রাগে যেমন রগ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এবারে রগ কেটে যায়। মনে হয়, রক্ত চলাচলই বন্ধ হয়ে যাবে।
খাটে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সেঁজুতি। একেরপর এক মেসেজগুলো দেখছে৷ সাওনের ফোনকল গুলো ওর হাতে মোবাইল থাকা অবস্থাতেই বাজছিল। তবে সেঁজুতি শুধু নামের দিকেই তাকিয়েছিল, ফোনকল রিসিভ করেনি।
শেষ বারে যখন মেসেজ দেওয়া বন্ধ করে ফোনকল দিয়েছিল, না চাইতেও রিসিভ হয়ে যায়। সাওন হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে, সেঁজুতি নিশ্চুপ হয়ে আছে।
সাওন কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো,“ কথা বলবে না? রাগের মাথায় মানুষ কতকিছুই করে ফেলে, তা মনে গেঁথে রাখবে? সারাদিন অফিসে খাটুনির পরে যদি বাসায় এসে এমন কাহিনী দেখি, তাও নিত্যদিনের একই কাহিনী। তখন আমার অবস্থাটা কেমন হয়, ভেবে দেখবা একটু? আমি নিজেকে সংযত রাখতে চাই, তবুও পারিনি। ”
সাওনের কথা শুনে ছোট করে সেঁজুতি বললো,“ ওহ।”
সেঁজুতির মুখ থেকে এই মুহূর্তে এমন ছোট একটা শব্দ শুনবে ভাবেনি সাওন। শান্ত ভাবে বললো,“ তোমার পায়ে কী হয়েছে?”
সেঁজুতি বললো,“ আপনার না জানলেও চলবে।”
সাওন অস্থির হয়ে বলল,“ এভাবে বলছো কেন? ব্যথা কমেছে?”
সেঁজুতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“ আশিকের ব্যথা কমেছে? ও খেয়েছে তো?”
সাওন ছোট করে জবাব দিলো,“ হ্যাঁ। শরীরের অবস্থা তো কেমন হয়ে আছে, তবে চিন্তা নেই। ঘুমাচ্ছে এখনো। ”
সেঁজুতি স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,“ আচ্ছা।”
সাওন কাঁপা কণ্ঠে বললো,“ সেঁজুতি! জিজ্ঞেস করলাম বললে না তো৷ ”
সেঁজুতি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,“ আপনাকে জানানো মনে করি না। কী বলবো? আপনারা ধরেই নিয়েছেন আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে আশিকের গায়ে ফেলে দিয়েছি, কিন্তু তার অংশবিশেষ আমার শরীরে পরতে পারে এসব ভাবার জ্ঞান হয়নি আপনাদের? এখন কাটা গায়ে নুনের ছিটে দিতে আসছেন?”
সেঁজুতির কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সাওন৷ শান্ত ভাবে বললো,“ আশিকের গায়ে তুমি ইচ্ছাকৃত ফেলেছো একবারো বলেছি আমি!”
সেঁজুতি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কে বলেছে, আপনি কিছু বলেছেন? আপনি তো গায়ে হাত তুলেছেন। শ্বশুর বাড়ি রেখে আপনার বোনেরা এসে বাবার বাড়ি, ভাইয়ের সংসারে পরে থাকবে এবং একেরপর এক কূটনামি করবে তা মানতে পারলে আপনার সংসার করতে বলেছেন। আমিও বলে দিচ্ছি যে সংসারে বোনেরা দিনেরপর দিন এসে থেকে থেকে ভাইয়ের সংসারে বাগড়া দেয় ; সে সংসার করবো না। কথায় কথায় আপনি বলতেন না? মুক্তি দিবেন। আমিই দিলাম মুক্তি। এবারে দুই বোনকে শ্বশুর বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে সারাজীবনের জন্য রেখে দিন। সংসারে উন্নতি হবে। ”
সেঁজুতির কথা শুনে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে সাওন বললো,“ সেঁজুতি! ”
সেঁজুতি, সাওনেরর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললো,“ গায়ে লাগছে আবারও? সত্যি কথা বললে সবার গায়ে লাগবে। এর আগেও যখন বলেছিলাম তখনও গায়ে হাত তুলছেন। সত্যি কথা বলতে, আপনাদের মতো ভেজা বেড়ালদের জন্যই সংসারের উন্নতি হয় না। যে সংসারে বোনেদের রাজত্ব চলবে, সেখানে ভাইয়ের সংসার টিকবে কীভাবে? অন্য বাড়ির মেয়ের এত ঠেকা পরেছে? সে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করবে! অন্য কেউ পারলেও সেঁজুতি পারবে না। ”
সাওন কণ্ঠস্বর বাড়িয়ে বলল,“ উল্টাপাল্টা কথা বাদ দাও এখন। এসবের জন্য ফোন দেইনি। ”
সাওনের সম্পূর্ণ কথা না শুনে সেঁজুতি বললো,“ আমি এগুলো বলার জন্যই ফোন রিসিভ করেছি। ইচ্ছে হলে ফোনকল কেটে দিবেন, না হলে এগুলো শুনতে হবে।”
সাওন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“ একটু তর্ক কম করা যায় না? সবসময়ে এই গুণ না দেখালেও হয়। ”
সেঁজুতি বলল, “ আপনার পরিবারের লোকজন সবসময় কূটনামি গুণ দেখাতে পারলে, আমিও আমার গুণ দেখাবো। তাদের কোনো দোষ হবে না তাহলে আমারও দোষ নেই৷ ”
সাওন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ আচ্ছা! কারো কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। এখন শান্ত হও।”
সেঁজুতি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ সব দোষ তো আপনারই। আপনি প্রধান দোষী। দিনেরপর দিন একপাক্ষিক বিচার করে এসেছেন। সব বোন, মায়ের সাফাই এবং সব দোষ বউয়ের। আপনি সত্য-মিথ্যা যাচাই করেছেন কখনো? মানলাম সারাদিন খাটুনির পরে এসব সহ্য করতে পারেন না। তবুও একবারের জন্যও যাচাই করার সময় হল না? অন্যের উপরে রাগগুলো এসেও আমার উপরে জড়ো হয় কেন? এটা কাপুরুষতার লক্ষণ নয়? ”
সেঁজুতির কথা শুনে সাওন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“ সেঁজুতি! এবারে কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। ”
সেঁজুতি বলল,“ এতদিন অনেকবার হয়ে আসছে। তাছাড়া, আমার কথা শেষ হয়নি এখনো। আমার কথার মধ্যে কথা ঢুকাবেন না। ”
সেঁজুতির কথা শুনে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো সাওন। সেঁজুতি বললো,“ একপাক্ষিক বিচার করার জন্য গতকাল থেকে এত ফোনকল দিয়েছেন? এসব অনেক সহ্য করেছি, আর সহ্য নেই। দয়া করে এমন বিচার চাপিয়ে দিবেন না আমায়। তাহলে আমার থেকে খারাপও কেউ হবে না। আমি এমনিতেই খারাপ, শুধু শুধু অতিরিক্ত খারাপ হতে বাধ্য করবেন না। ”
এবারেও শান্ত ভাবে সাওন বলল,“ আমি কিছু বলতে পারি এখন?”
সেঁজুতি বললো,“ জ্বি বলেন।”
সাওন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,“ এতক্ষণ রাগের মাথায় সবকিছু বলেছো তাইতো? আমার কিন্তু রাগ হয়নি একটুও৷ ভুল আমারই ছিল, প্রথম থেকে অন্যদের মতো গায়ে হাত তোলা, মা-বোনকে অসম্মান করে কথা বললে আজ আমাকেও সবাই ভয় পেতো। তোমার গায়ে তো হাত তুলিনি, থাপ্পড় দেওয়াকে যদি সেভাবে হাত তোলা বলো তাহলে কিছু বলার নেই। সেদিন হাত তুলেছি যথেষ্ট কারণ আছে, অফিস থেকে আসার পরেই মুখে মুখে তর্ক শুরু করেছো। একবারের জন্যও ভেবেছিলা, মানুষটির মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? তা ভাববে কেন? আমি তো মানুষ না, একজন রোবট। যে যা বলে সবকিছু চুপচাপ সহ্য করি। এই গুণ ক’জনেরই বা আছে। সবার তো ভালো কথা সহ্য করারও ধারণ ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু সবরকমের তিক্ত কথাগুলোও আমি অনায়াসেই সহ্য করতে পারি। কতবড় গুণ তাই না? কে ভাবো আমার কথা? বোন? মা? বউ? তিন কূলের এক কূলেও ভালোভাবে ঠাই আছে আমার? মানছি একপাক্ষিক বিচার করেছিলাম প্রথম থেকে ; কাউকেই মুখের উপরে কিছু বলিনি। চুপচাপ ছিলাম। মেজো আপুকে বিয়ে দেওয়ার সময়ে ব্যাংক থেকে যে লোনের টাকা তুলেছি, সেগুলোর চিন্তা মাথায় থাকবে না আমার? সারাদিন মানুষের খাটুনি করেও ঘরে এসে একটু শান্তি পাইনি। যখন থেকে আমি সত্যটা নিয়ে কথা বললাম, তখন থেকেও তোমার চুপ করা উচিত ছিল না? তর্ক করলেই মানুষ জিততে পারে? ”
সাওনের কথা শুনে চুপ হয়ে যায় সেঁজুতি।
#চলবে