#সেঁজুতি(পর্ব_২৫)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
সাওন ধীর কণ্ঠে বললো,” তুমি আগেরমতো নেই সেঁজুতি।”
সাওনের কথা শুনে সেঁজুতি কপাল কুঁচকে তাকালে সাওন বলে,” এই যে কত কথা পেটের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছো। আগেরমতো থাকলে এতদিনে এ কথা শোনার সাথে সাথে আরও তিনগুণ কথা শুনতে পেতাম। এই জন্যই তো বলি, আমার কান এত ভালো হল কীভাবে। না হলে তব্দা দিয়ে থাকতো। তুমি আগেরমতো নেই, পুরো ভালো হয়ে গেছো। ”
কথাগুলে বলে খিলখিল করে হেসে দেয় সাওন। সেঁজুতি মুখ গম্ভীর করে বলল,”আমি চুপচাপ থাকি এজন্য তোমার ভালো লাগে ? যাও কথাই বলবো না, তখন আরও ভালো লাগবে। ”
সেঁজুতির কথা শুনে থতমত খেয়ে যায় সাওন। ঢোঁক গিলে বলল,”তুমি সত্যিই পরিবর্তন। মজাও বুঝো না।”
কথাটি বলেই করুণভাবে তাকালো সাওন। সেঁজুতি হেসে বললো,”তুমিও পরিবর্তন। তুমিও মজা বুঝো না।”
সেঁজুতির কথায় মৃদু হাসে সাওন।
.
সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া কংলাক পাহাড়। সেখানে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেই মনে হয় আকাশ ছোঁয়া যাবে। সূর্য তখন লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ডুবে যাওয়ার আগ মুহূর্ত তখন। হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায় না, তবে হাত বাড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। এরকম চেষ্টার কিছু মুহূর্ত গ্যালারিতে প্রমাণস্বরূপ রয়ে গেল। এরপর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পরে কটেজে আসলো ওরা।
রাতের খাবারের পরে সাওনের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল সেঁজুতি। কতশত ছবি একেরপর এক দেখে যাচ্ছে৷ পরবর্তীতে সাওনকে দেখানোর জন্য বারান্দায় গেল। তখন ছবি দেখানোর কথা ভুলে গিয়ে মুগ্ধ নয়নে চারিপাশ দেখছে। গম্ভীর ভাবে সাওনকে বললো,” আমায় ডাকলে না কেন? কী সুন্দর মুহূর্ত! ” কথাটি বলেই আবারও চারিপাশের পাহাড়ের দিকে চোখ বুলায়।
চাঁদের আলো এসে পাহাড়ের উপরে পরেছে। ছোট ছোট তারা গুলোর নিভু নিভু আলো এসে ছড়িয়ে আছে চারিপাশে। এই আলোর ভিড়ে অন্য এক আলো মিলে যাচ্ছে। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে সাওন। সেঁজুতিকে নিজের কাছে এনে বললো,” আমি এত খারাপ স্বামী নই তাই ডাকিনি তোমায়। এই চাঁদ দেখে তোমার ছোটবেলার ব্যর্থতার কথা মনে পরলে, আবেগে কেঁদে দিতে। তখন অপেক্ষা করেও দেখতে পারতে না আর এখন নিজের মাথার উপরে চাঁদ। নিশ্চয়ই আবেগ কাজ করতো। ” কথাগুলো বলে খিলখিল করে হেসে দেয় সাওন। সাওনের মুখ চেপে সেঁজুতি বললো,”বুড়ো হয়ে গেলেও ঠিক হবে না, ফাজিল ছেলে। অথচ সারাক্ষণ আমাকে ফাজিল বলে। ”
সেঁজুতির হাত সরিয়ে সাওন হোহো করে হেসে বললো,”তুমি তো ফাজিল’ই। আল্লাহ জানে, আমার ছেলেমেয়ে তোমার মতো হলে কী অবস্থা হয় আমার। তখন দুই পক্ষই সামলাতে হবে ।”
সেঁজুতি হেলেদুলে বললো,”হ্যাঁ, তুমিই তো ছেলেমেয়ে সামলাবে। কারণ, এই বুড়ো সামলাতে হিমশিম খেতে হবে আমার। কখন অকাজ করি আবার কখন ধমক দিবে সেসব তো আমার নিজেকেই সামলাতে হবে। ”
সাওন কপাল কুঁচকে বললো,” সারাক্ষণ অকাজ মাথায় ঘুরে?”
সেঁজুতি ধীর ভাবে বললো,”সেঁজুতি যতক্ষণ থাকবে অকাজও সাথে থাকবে। আর সাওন বুড়োকে জ্বালাবে।”
সাওন ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে বললো,”আচ্ছা! সেঁজুতি বুড়ী।”
.
খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্বরের এলাকা থেকে গাড়িতে পাড়ি জমালো আলুটিলার তারেং পর্যটন এলাকায়। পুরো খাগড়াছড়িকে দেখা যাচ্ছে। সবকিছুকে চোখের সামনে ছোটছোট খেলনার মতো মনে হচ্ছে।
সেঁজুতির ছোট হাসিখুশি মুখ মিলিয়ে যাচ্ছে এই প্রকৃতির সাথে। বাইরের সৌন্দর্য সেঁজুতি দেখলেও, সাওন মাঝেমাঝে চোখ বুলাচ্ছে সেই সৌন্দর্যে। ওর নিজস্ব সৌন্দর্য ওর সাথেই থাকে, সবসময় যাকে দেখার জন্য ব্যকুল হয়ে থাকে।
তারেং এ দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললো,” হ্যাপি ম্যারেজ এনিভার্সারি বাবুই। ঠিক এক বছর আগে আজকের দিনে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল। এই যে চারিপাশে এই হাসিখুশিতে ভরা সৌন্দর্যের মতো আমাদের জীবনের বাকি পথগুলো রাখতে চাই। সাথে থাকবে না, আমার?”
সেঁজুতি শান্ত ভাবে মাথা নাড়ালো। সাওন মৃদু হাসছে।
জীবনের এক অধ্যায় শেষ হল ওদের। বাকি অধ্যায়গুলো শুরু হচ্ছে । ভালো কিংবা খারাপ জানা নেই। তবে এতটুকু জানে শেষ নিঃশ্বাস অবধি একে অপরকে চায়। প্রতি ক্ষণে ক্ষণে চায়।
.
বাসায় ফেরার পরের দিন আনোয়ারা বেগম আসলেন। শান্তভাবেই সবকিছু চলতে রইল। কোনো অভিযোগ থাকলে নিজের মধ্যে রাখেন, মাঝেমধ্যে শব্দ করেই বলে ফেলেন তিনি। তবে এসব গায়ে লাগায় না সেঁজুতি। ও নিজের মতো চলতে রইল আর স্বামী, সংসার, শাশুড়ির দেখাশোনা নিজ দায়িত্বে করছে।
আনোয়ারা বেগম যখন অসুস্থ হয়ে পরে তখন সেঁজুতি নিজ থেকেই তার দেখাশোনা করতে থাকলো। দুই মেয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে আসতে পারে না, আর নিজেরাও আসতে চায় না। মেজো মেয়ে এমনিতেই অসুস্থ। বড় মেয়ে চাইলেও পারে না মাঝেমাঝে এসে মায়ের দেখাশোনা খানিক সময়ের জন্য করে যায়।
সাওন বলেছিল অন্য মানুষ রাখবে। তখন সেঁজুতি বললো,” আম্মার তো তেমন ঝামেলার কিছু নেই! শুধু গোসলের সময়ে সাহায্য করবো আর খাবার নিজ হাতে খাওয়ায়ে দেবো। এসবের জন্য অন্য মানুষ রেখে লাভ কী? এমনিতে হিসেবি আছো ঠিক আছে, কিন্তু আরেকটু হিসেবি হও। সময় যত সামনে এগোচ্ছে সবকিছু ততই কঠিন হচ্ছে। তাই নিজেদেরকে সেভাবে চলতে হবে। তাছাড়া, কয়েকদিনের ব্যপার তো! তারপরে আম্মা এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে, শুধু শুধু অন্য মানুষ রাখতে হবে না। আর আমিও তোমার মায়ের অযত্ন করবো না।”
সেঁজুতির কথায় জোরেসোরে নিঃশ্বাস নিয়ে সাওন বললো,” আচ্ছা, হিসেবি বউ! আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই চলবো। দুজনেই আমার প্রিয়জন তাই একজনকে কষ্ট দিয়ে অন্যজনকে ভালো রাখতে চাই না। মায়ের শরীরের যত্ন করতে হবে, পাশাপাশি আপনার নিজের শরীরের অবহেলা করা চলবে না। তাই অন্য কারো সাহায্য নিতে চেয়েছিলাম। এখন আপনি রাজী না থাকলে কী করার! আপনি মায়ের যত্ন করবেন আর আমি হিসেবি বউয়ের যত্ন করবো।”
সাওনের কথা শুনে হেসে দিল সেঁজুতি।
.
ঘরের কাজকর্ম, রান্নাবান্না করে আনোয়ারা বেগমকে গোছালো। যখন সেঁজুতি ভাতের লোকমা মুখের সামনে ধরলো তখন আনোয়ারা বেগম নিশ্চুপ হয়ে চোখের পানি ফেললেন। সেদিনের কথা মনে পরে, যেদিন সকালে তার সামনে পরোটা তুলে ধরেছিল সেঁজুতি। সেদিন বলেছিলেন, ‘একজনের হাতের খাবার অন্যজন খাবে কেন!’ আজকে সেই অন্যজনের হাত থেকেই খাচ্ছে। আনোয়ারা বেগমকে নিশ্চুপ দেখে সেঁজুতি বললো,” আম্মা! শরীর খারাপ লাগছে?”
জবাবে আনোয়ারা বেগম মাথা নাড়িয়ে না বললেন। সেঁজুতিও কিছু বললো না চুপচাপ আনোয়ারা বেগমকে খাওয়ানোর পরে চলে আসলো।
দশ-বারো দিন কেটে গেল। আনোয়ারা বেগম সুস্থ আছেন। তার বড় মেয়ে এসে দুই-তিন দিন থেকেছিল। তবে আগেরমতো মুখ চালায়নি, সেঁজুতি নিজেও পাশ ঘেঁষে থাকেনি। নিজের কর্তব্য নিজে পালন করেছে হাসিমুখে। সব থেকে বড় সতর্কতা ছিল ওর, রান্নার সময়ে পাশে কাউকে রাখেনি। নিজে পুড়বে তবে কাউকে কোনো বিপদে ফেলতে চায় না। সেঁজুতির এমন পরিবর্তন সবার নজরে গেলেও কিছুই বলার নেই কারো।
মেজো আপুর ডেলিভারি ডেট নিকটে। এই সময়টাতে বাপের বাড়িতে থাকে অনেক মেয়েরা। মেজো আপু মান-অভিমান ভেঙে বললেন, এখানে আসার কথা। শেষ মুহূর্তে ভরসা দরকার তার। তখন আনোয়ারা বেগম শান্ত ভাবে বলেছিল,” এখানে আসো। তোমাদের ভাই-ভাবির কর্তব্য অনুযায়ী সবকিছু করবে। এর বেশি কেউ কিছু আশা করবা না, আর মুখ চালাবে না। কারণ, সাওন বোনদের সেবার জন্য তো বউ আনেনি তাই অন্যকিছু আশা করা ছেড়ে দিয়ে আসতে পারো৷” আনোয়ারা বেগমের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায় সাওনের বোন। আনোয়ারা বেগম বললেন,” আমার ঘরেও অতিথি আসবে। তাই বউ নিজে চাইলেও সাহায্য করতে পারবে না। আমার নাতিকেও যত্নে রাখতে হবে। অন্যসব ছেলে বউরা শাশুড়ির অসুস্থতার সময়ে দূরে সরে থাকতে পারে কিন্তু সেঁজুতি থাকেনি। সে আমার পাশেই ছিল। সে যদি আমাকে নিজের মায়ের মতো ভাবতে পারে, আমি পারবো না কেন! আমিও পারবো। তাই তোমরা দুই মেয়েও এখানে আসতে পারো। আমি আমার তিন মেয়েরই দেখাশোনা করতে পারবো। ”
আনোয়ারা বেগমের মুখ থেকে এমন কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায় সাওনের বোন। তারপরে মেজো আপু বললো,” আমার তো আসাই লাগবে মা।”
আনোয়ারা বেগম বললেন, “হ্যাঁ, আসো। আমি সাওনকে বলে রাখবো সবকিছু যেন গুছিয়ে রাখে।”
মেজো আপু বললো,” ক্লিনিকের ব্যপারে সবকিছু ঠিকঠাক।”
আনোয়ারা বেগম বললেন, “আচ্ছা। ফলমূল, বাজারতো করে রাখতে হবে! সব আত্নীয়-স্বজন এখানেই আসবে, তখন খাওয়াতে হবে । তাছাড়া, আশিক আর ওর মা যদি কিছুদিন এসে থাকে তাহলে সুবিধা হবে। একটু হাতে-হাত কাজকর্ম করে দিলে কষ্ট হবে না। তাই সবকিছু একসাথেই লিস্ট করে দিতে হবে সাওনকে। ”
মেজো আপু বললো, “আচ্ছা৷ ”
আনোয়ারা বেগম বললেন, “হ্যাঁ। গোছগাছ করে সাবধানে এসো।”
আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে সাওনের বোন বললো, “হুম।”
.
সাওনের মেজো বোনের মেয়ে হয়েছে। তিনি সাওনের বাড়িতেই আছেন। সেঁজুতি সবার সাথে বেশ মিলেমিশে আছে। কেউ কিছু বলে না আর বলার সাহস পায় না। কেউ কিছু বললে সবার আগে আনোয়ারা বেগম নিজেই চুপ করিয়ে দেন। এরজন্য কেউ বলেও না কিছু। তার মেয়ে নাতি-নাতনি আছে কিন্তু সে মরিয়া হয়ে আছে ছেলের ঘরের নাতি-নাতনি দেখার জন্য। এসব নিয়ে কেউ রেগে থাকে, কেউ হেসে দেয়। তবুও আনোয়ারা বেগম তার নিজ স্থানে অনড়।
#চলবে