#সেঁজুতি(পর্ব_৫)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি
সাওনদের বাসার সাথেই টিনের ছাওনি দেওয়া ঘরে একজন কমবয়সী মহিলা থাকেন। হাতেগোনা কয়েক টাকা দিলে তিনি কাজ করে দেন। নিম্নবিত্ত সংসারের গৃহিনী সে। এই অল্প বয়সে তিন সন্তানের জননী । স্বামী রিকশা চালক। একদিন কাজে গেলে তিন দিন ঘরে থাকে, এরজন্য নিত্য ঝগড়াঝাটি হয় হাসি’র সাথে। তবে ওর স্বামী’র এসব গায়ে লাগে না। এরজন্য বাধ্য হয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য নিজেও কাজে নেমে পরে । আশেপাশের কয়েকটি ভাড়াটে বাড়িতে কাজ করে সে। তাছাড়াও, মানুষের কথায় টুকিটাকি কাজ করে দেয়। কেউ খুশি হয়ে শ’খানেক টাকা দেয়, কেউ বাড়িয়ে দেয়।
তবে সাওন টাকার উল্লেখ করেনি এখনো, বাজার থেকে ফেরার সময়ে তার সাথে দেখা হয়। তখন মিনমিনে স্বরে বললো, “ আপু! আপনি ফ্রী থাকলে একটু সাহায্য করতে পারবেন? ”
সাওনের কণ্ঠধ্বনি শুনে বেশ চমকে গেল হাসি। রাস্তায় যাতায়াতের সময়ে বেশ কয়েকবার দেখা হয়, তবে কারো সাথেই কথা বলেনা সাওন। আজকে নিজ থেকে এমন কথা বলছে! নিশ্চয়ই অতিমাত্রায় কোনো প্রয়োজন আছে। হাসি নিজেও মুখে মৃদ্যু হাসি দিয়ে বললো, “ হ্যাঁ, বলেন। ”
সাওন বলল, “ মাছ কেটে দিতে পারবেন? আসলে সেঁজুতি’র হাত কেটে গিয়েছে। আপনি একটু সাহায্য করলে ভালো হতো। ”
সাওনের কথায় সম্মতি দেয় হাসি। সাওন মুখে হাসির রেখা টেনে চুপচাপ ঘরে যায়। হাসিও ওর পিছুপিছু যায়। হাসিকে দেখে আনোয়ারা বেগম ভ্রু কুঁচকে তাকালো সাওনের দিকে। সাওন তাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ মাছ কোথায় বসে কাটবে? বলে দাও, সে কেটে দিয়ে যাবে।”
আনোয়ারা বেগম ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বললো, “ মাছ কাটার জন্য মানুষ আনতে হয়?”
আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে সাওন বললো, “ হ্যাঁ, সাহায্য লাগবে তাই আনতে হয়।”
সাওনের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আনোয়ারা বেগম বললো, “ বউ কই?”
সাওন শান্ত ভাবে বললো, “ ওর হাত কেটেছে, হাতে তেলের ছিটে পরেছে। এই অবস্থায় এসব কিছু করতে পারবে না।”
আনোয়ারা বেগম রগচটা হয়ে বললেন, “ আমার মেয়েরা আসলেই ওর সমস্যা দেখা যায়? ”
আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে এবারে রেগে গেল সাওন। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “ অন্যকারো সামনে চুপ থাকতে পারো না? না-কি কথা বললেই হয় মা। কাউকে রাখার দরকার নাই, মাছগুলো আমিই কেটে দিচ্ছি। ছেলের জন্য কাজের মেয়ে এনেছো, সে অসুস্থ থাকলে তো তার স্বামীকেই কাজ করতে হবে। ”
সাওনের ব্যঙ্গাত্মক কথার মানে বুঝতে পেরে চুপ রইলো আনোয়ারা বেগম। হাসি’র সামনে কিছু বললো না এখন। তাঁর মেয়েরা আসলে সবকিছু শোনাবে, ছেলে পরিবর্তন হয়ে গেছে ওই দু’দিনের মেয়েটির জন্য।
আনোয়ারা বেগমকে চুপ দেখে সেঁজুতি’কে ডাকলো সাওন। তড়িঘড়ি করে সামনে এসে দাঁড়ালো সেঁজুতি। শান্ত ভাবে সাওন বললো, “ সবকিছু গুছিয়ে দাও, মাছ কেটে দিবে সে।” সেঁজুতি, আনোয়ারা বেগমের দিকে একবার তাকিয়ে রান্নাঘরে গেল। যা যা লাগে সবকিছু এনে ড্রয়িংরুমে রাখলো। রান্নাঘরের থেকে এখানে সুবিধা হবে, তাই ড্রয়িংরুমে বসেই মাছ কাটতে লাগলো। রুমে যাওয়ার সময়ে হাসিকে উদ্দেশ্য করে সাওন বলে গেল, “ যদি সমস্যা না হয়, আমাদের বাসায় টুকিটাকি সাহায্য করতে পারবেন? ”
সাওনের কথায় সম্মতি দিলো হাসি। সাওন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুমে চলে গেল।
থমথমে পরিবেশে আনোয়ারা বেগম বললেন, “সারাক্ষণ ভালো থাকে আর আমার মেয়েরা আসলেই দুনিয়ার অসুখ এসে ভর করে। ”
আনোয়ারা বেগমের কথাগুলো যে, সেঁজুতিকেই উদ্দেশ্য করে বলা তা বুঝতে পেরেছে সেঁজুতি। এখানে হাসি থাকায় জবাব দিলো না। চুপচাপ রুমে চলে গেল।
সেঁজুতি ধীরকণ্ঠে বলল, “ আজকে তো অফিসে গেলে না। ”
সাওন তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো, “ আজকে আর যাওয়া হবে না, ছুটি নিয়েছি৷ ”
শান্তভাবে সেঁজুতি বলল, “ ওহ। ভাইয়া’রা আসবে না? কী কী রান্না করতে হবে বলে দিয়ো। এখন সবকিছু গোছাতে হবে।”
সেঁজুতি’র সামনে এসে সাওন বললো, “ এই হাত দিয়ে করতে পারবে সবকিছু? ”
সাওনের কথায় হেসে দিলো সেঁজুতি। সাওন কটমট করে তাকিয়ে বলল, “ আমি হাসির কিছু বলেছি?”
সেঁজুতি ওর মুখোমুখি হয়ে বললো, “ হয়তো।”
সাওন নিজের চুল নিজে টেনে বললো, “ কখন বলেছি? নিজেই তো জানি না। ”
সেঁজুতি কোনো ভঙ্গিমা না করে সাওনকে বললো, “এই হাত দিয়ে কাজ করতে পারবো না, তাহলে কাজ কে করবে? দ্বিতীয় বিয়ে করে আনবে?”
সেঁজুতি’র কথা শুনে থতমত খেলো সাওন। সেঁজুতি হাসছে। সাওন বাঁকা হাসির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো, “ কোনো ইচ্ছে অপূর্ণ রাখবো না। ”
সাওনের কথায় হতভম্ব হয়ে গেল সেঁজুতি। সাওন হাসছে। সেঁজুতি’র ভীষণ রাগ হলেও চোখমুখ খিঁচিয়ে খুব জোরেসোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো। মূলত, সাওনকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। মুখে কিছু বলেনি অথচ তার নিঃশ্বাসের শব্দ সাওনের কানে পৌঁছে দিয়েছে যে ; সে ভীষণ রেগে গিয়েছে। সেঁজুতি’র এমন কাণ্ড দেখে ফিকলে হাসি দেয় সাওন।
.
মাছ কেটে ঘর মুছে দিলো হাসি। সাওন তিনশত টাকা দিলো। এবং প্রতিদিন টুকিটাকি কাজ করে দিবে এরজন্য মাসিক বেতন ঠিক করলো। সেঁজুতি রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে সাওনের বোন, বোন জামাই, ভাগ্নে-ভাগ্নী আসে। তাঁদেরকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো আনোয়ারা বেগম। কিন্তু হাতের কাজ কেউ করে না, সবকিছু সেঁজুতি গুছিয়ে সম্মুখে দিচ্ছে।
সোফায় সবাই বসে আছে। সেঁজুতি রান্নাঘর থেকে সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছে আর সাওন নিয়ে আসছে। সাওনের মেজো বোন নুডুলস মুখে দেওয়ার পরে বলল, “ কোনো স্বাদ নেই, মনে হচ্ছে শুধু পানিতেই সিদ্ধ করে রেখেছে।”
সাওনের মেজো দুলাভাই তার বউকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ খারাপ লাগছে কই? সবার রান্নার স্বাদ যে এক হবে এমন তো নয়। ”
সাওনের দুলাভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে সাওনের মেজো বোন কপাল কুঁচকে ফেললো। মুখ থেকে কোনো জবাব বের করলো না।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সেঁজুতি সবার সামনে এসে সালাম বিনিময় করলো। আনোয়ারা বেগম’কে উদ্দেশ্যে করে বললো, “ আম্মা! পোলাও আপনি করে দিয়েন। আমার রান্না ভালো হয় না, ভিজেভিজে হয়ে যাবে। তখন সবার না খেয়ে থাকতে হবে। ”
সেঁজুতি’র কথা শুনে সাওনের দুলাভাইয়ে’রা বললো, “ রান্না করতে করতেই হয়ে যাবে। আমরা ঘরের মানুষ, আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না। ”
তাঁদের কথা শুনে গলা খাকড়ি দিয়ে সেঁজুতি বললো, “ আপনের থেকে পর ভালো হয়, ভাইয়া। তাঁরা একবার কথা শুনিয়ে চুপ থাকে, কিন্তু আপন’রা সবসময় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা শুনাতেই থাকবে। ”
সেঁজুতি’র কথা শুনে সাওনের বড় বোন বললো, “ কথাটি ইঙ্গিত করে বললা?”
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সেঁজুতি বললো, “ যদি মনে করেন ইঙ্গিত করেছি, তাহলে তাই৷ নুডুলস ভালো হয়নি তার জন্য কথা শুনতে হলো। পোলাওয়ের জন্য তো আমার বাড়ির মানুষের কাছে বিচার যাবে। ”
সাওনের বড় বোন বলল, “ ও তো একটু এমন’ই। ওর কথায় গায়ে লাগাতে নেই। ”
এবারে সেঁজুতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “ হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন আপু। ছোট ভাইয়ের থেকেও আট-নয় বছরের মেয়ে যখন বউ হয়ে আসে ; তখন সে বৃদ্ধ হয়ে যায়। আর ছোট ভাইয়ের থেকে তিন-চার বছরের বড় বোন বাচ্চা থাকে। তাদের কথা গায়ে লাগাতে নেই, এমনটাই তো!”
সেঁজুতি’র কথা শুনে উচ্চস্বরে সাওন বললো, “সেঁজুতি! এখানে আপাতত তোমার কোনো কাজ নেই।”
সাওনের কথায় কটমট করে সেঁজুতি বলল, “ হ্যাঁ, যাচ্ছি। আমার স্বামী ভয় পাচ্ছে, ব্যপারটা আমারই দেখতে হবে। ”
কথাটি বলে ঝামটি মেরে সেঁজুতি চলে গেল। সাওনের দুলাভাইয়ে’রা আহাম্মক হয়ে বসে আছে, নিজেদের বউয়ের জন্য। সাওন হাতের মুষ্টি বদ্ধ করে চুপচাপ বসে আছে। আনোয়ারা বেগম বললেন, “দেখছো, সবকিছু? কেমন মুখে মুখে কথা শুনাচ্ছে? এরপরেও আমার ছেলে বলবে, ওর কোনো দোষ নাই।”
আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে সাওন বলল, “এখানে সেঁজুতি নিজ থেকে তো কিছু বললো না, মা। তোমাদের কথার প্রসঙ্গে ওর জবাব দিতে হয়েছে। ”
সাওনের বড় দুলাভাই সাওন’কে উদ্দেশ্য করে বলল, “ চুপ থাকো।”
আনোয়ারা বেগম বললেন, “ শ্বশুর বাড়ি আসছে, কাজ না জানলে তো কথা শুনবেই। এত তেজ দেখানোর কি আছে?”
আনোয়ারা বেগমের এমন কথায় চুপ হয়ে যায় সাওনের দুলাভাইয়েরা। এই একটি কথাই নিত্যদিনের ঝামেলা ছিল৷ ঘুরেফিরে কথাটি ভুক্তভোগী’রা অন্যদের শুনিয়ে দেয় ; তাও আত্নগৌরবের সহিত। অথচ, কোনোসময়ে এই কথাটি শোনার সাথে সাথেই মহা কাণ্ড বয়ে যেতো ঘরে।
আনোয়ারা বেগমের কথা শুনে সাওন বললো,“ কাজ করানোর জন্য ছেলে বিয়ে করিয়েছো? ওর তো কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, বেতন তো দিচ্ছি না কেউ। তাহলে কথা শুনবে কেন, দিন-রাত খাটুনির পরে? অন্ততপক্ষে, বয়স তো দেখবে? হাত কেটে গিয়েছে মেয়েটির। হাত দিয়ে কিছু খেতে পারে না, তবুও কাজ করে যাচ্ছে সে। ভালো হোক কিংবা খারাপ হোক, তার জন্য কথা শোনাতে হবে? এটা তো কোনো রেস্টুরেন্ট না যে, রান্না সুস্বাদু হতেই হবে। না হলে মানুষজন আসা বন্ধ করে দিবে, লোকসান হবে। ও এ বাড়িতে এসেছে ওর স্বামীর জন্য কিন্তু তোমাদের পক্ষপাতিত্ব করতে করতে ; ও নিজের স্বামীকেও উপহাস করে। কথায় কথায় খোঁটা শুনতে হয় তোমাদের জন্য। আমাকে কি রক্তে, মাংসে গড়া মানুষ মনে হয় না কারো? আমি একজন মানুষ , না? যার যখন ইচ্ছে আমাকে নিয়ে উপহাস করে যাবা। ”
#চলবে