সেই তো এলে তুমি পর্ব_৩০

0
932

#সেই_তো_এলে_তুমি
#পর্ব_৩০
#Saji_Afroz

নওয়াজ আজ খুব দেরীতে ঘুম থেকে উঠেছে৷ সকালে সে শুধু চা পান করেছে। এছাড়া আর কিছু খায়নি। একেবারে দুপুরের খাবার খাবে জানিয়েছে।
গোসল সেরে নামাজ আদায় করে ডাইনিং এ এসে বসে নওয়াজ। টেবিলের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হয় সে। মনেহচ্ছে কোনো বিয়ে বাড়িতে এসেছে। এত এত রান্না! চিংড়ির বাটি হাতে তানিশা এসে বসলো নওয়াজের পাশের চেয়ারে। সে আজ হালকা বেগুনি রঙের সুতি শাড়ি পরেছে। ব্লাউজের রঙ সাদা হওয়াতে শাড়ির রঙটা আরও ফুটে উঠেছে। চুলে খোপা করে রেখেছে তানিশা। সামনে কিছু চুল বের করা। কোমরে আঁচল গুজে আছে তার। দেখেই মনে হচ্ছে পাক্কা গৃহিনী।
সবাই এসে বসার পর তানিশা খাবার বাড়তে শুরু করলো। নওয়াজ মুখে দিয়েই বলল, আজকে এত আয়োজন মা? আর এত মজা হয়েছে খাবার!
-তানিশা করেছে সব। এই বাড়িতে আসার পর রান্না করেনি সে। নতুন বউদের সবাইকে রান্না করিয়ে খাওয়াতে হয়। এসব তো কিছুই পালন করা হলো না। তাই আজ সে নিজ ইচ্ছেই করলো এসব।
.
নওয়াজ ভেবেছিল কোমরে আঁচল গুজে সে শুধু বাটি আনতেই সাহায্য করেছে। এত কাজ যে তানিশা পারে অজানা ছিল নওয়াজের। তৃপ্তি নিয়ে সে খাবার গুলো খায়। ভালোই লাগছে তার খেতে।
খাওয়া শেষে নওয়াজ উঠে চলে যেতে চাইলে তাকে আঁটকায় তার বোন। সে বলল, ভাবী প্রথম রেঁধেছে আজ। তোমার কোনো উপহার তাকে দিতে হবে।
-আমি কি উপহার পকেটে নিয়ে ঘুরি! হঠাৎ করে কী দেব?
-কিছু তো দিতেই হবে ভাইয়া।
.
নওয়াজ মা নিজের আঙুলে থাকা রিংটি খুলে তানিশাকে পরিয়ে দিলেন। নওয়াজের বোন রুম থেকে একটি বই এনে ভাবীকে দিলো। এসব দেখে নওয়াজ বলল, তোরা তো দিয়েছিস। আমি কিছু জানতাম না, আমায় ছাড় দে।
-উহু ভাইয়া! আমিও জানতাম না। তাই তো সংগ্রহে থাকা বই থেকে ভাবীকে দিলাম। এইবার তুমিও কিছু দাও।
.
নওয়াজ একটু ভেবে পকেটে হাত দিয়ে কচকচে এক হাজার টাকার একটি নোট বের করে তানিশার দিয়ে এগিয়ে বলল, ভালো রান্না করো তুমি। এটা উপহার হিসেবে রাখো। পছন্দ মতন কিছু নিয়ে নিও।
.
তানিশাও হাসিমুখে তা নিয়ে ধন্যবাদ জানায়। আর আপনমনে বলল, এই টাকা তো আমি বাঁধিয়ে রাখব। খরচ করার প্রশ্নই আসেনা!
.
.
বুশরা এই বাড়িতে আসার পর থেকে তায়শার সাথে কোনো হয়নি তার। অবশ্য তায়শাও বলার চেষ্টা করেনি।
বুশরা নিজের রুম গুছিয়ে রাখছে। হঠাৎ তায়শা আসলো। তাকে দেখেও কাজেই মনোযোগ রাখলো বুশরা। তায়শা বলল, তুমি কেনো আমার উপর ক্ষেপে আছ? ক্ষেপে থাকার কথা আমার৷ কারণ আমার হবু বর হুট করে তোমাকে বিয়ে করতে চায়ছে। মানলাম তার ভাই এর সাথে আমি যা করেছি ঠিক করিনি। কিন্তু এতে তোমাকে বিয়ে করতে চাওয়ার কারণ কী?
.
বুশরা আলনায় কাপড় রাখতে রাখতে বলল, আমি জানিনা।
-তুমি নিশ্চয় সম্মতি দাওনি? কেনোই বা দেবে! তোমার বোনের সাথে বিয়ে ভেঙেছে সে।
-সম্মতি দেওয়া কী উচিত নয়? যে বোন আমার সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি করেছে, যার জন্য নওয়াজ অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে তার কথা কেনো ভাবব আমি?
.
বুশরা যে এসব জানে তা জানতো না তায়শা। সে অবাক হয়ে বলল, তোমায় এসব কে বলেছে?
-সত্যি কখনো চাপা থাকেনা।
.
সে বিষয়টা পালটে তায়শা বলল-
দেখো নিহিরের সাথে বিয়ে তোমার হবে না। কেউই মানবে না এটা। অন্য কোথাও বিয়ে করার চেয়ে তুমি বরং নওয়াজ ভাই এর কাছেই ফিরে যাও। বউকে ডিভোর্স অবধি দিয়ে ফেলেছেন তিনি। তিন মাস পর একটা সাইনেই সব শেষ হবে। তবে সমস্যা কোথায়? ভালোবাসার মানুষের কাছেই যাবা।
.
বুশরা তার দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যিই তুই আমার ভালো চাস?
-হুম। তাইতো এসব বলছি। আর কেউ সাপোর্ট না করলেও আমি তোমাদের এক হতে সাহায্য করব।
-যার জন্য আমার এই অবস্থা তারই সাহায্য নেব আমি? এতই যদি ভালো চাস তবে কখনো নওয়াজকে ওসব আজেবাজে কথা তুই বলতি না।
.
তায়শা বুঝতে পারলো নওয়াজই তাকে এসব বলে দিয়েছে। কিন্তু এই বিষয় নিয়ে সে নওয়াজের সাথে রাগারাগি করতে পারবে না। এখন নওয়াজকে প্রয়োজন তার।
তায়শা বলল, এখন কী চাও তুমি? নিহিরকেই চাও?
-আমার চাওয়া না চাওয়া নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। বাবা আসলেই আমার চাওয়া সম্পর্কে তাকেই বলব।
.
বুশরা নিহিরের বিষয়টা খোলাসা করলো না তায়শার কাছে। তায়শা ভাবলো, বুশরা ঠিকই তার বাবাকে নিহিরের কথা বলবেন। যদিও বুশরার বাবা দেশে আসবেন না। কিন্তু এই মিথ্যেও কতদিন লুকোবে। এরমধ্যে না আবার নিহির আর বুশরার সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে যায়! এর আগেই কিছু একটা করা জরুরী। এসব ভেবে অস্থির হয়ে উঠে তায়শা।
.
.
আজ বুশরাকে খুব বেশি মনে পড়ছে নিখিলের। সে জানেনা বুশরার কাছে ফোন আছে। তাই সে অনেক ভেবে বাধ্য হয়েই তায়শাকে ফোন দেয়। তায়শা তার ফোন দেখে অবাক হলেও রিসিভ করে। নিখিল কোনো কথা না বলেই বলল, বুশরাকে দাও।
.
তায়শা বিরক্ত নিয়ে বলল, তা ওকে ফোন দিলেই পারো।
-ওর কাছে ফোন আছে?
-তোমার ভাই যে হবু ভাবীর জন্য পাঠিয়েছে সেটা জানোনা?
.
তায়শার কথার ধরণ শুনে নিখিল বলল, হিংসে হচ্ছে না কি?
-একদমই না। এই তায়শাকে কত ছেলে কত কিছু দিতে বসে আছে। ওহ হ্যাঁ! প্রমাণ তো তুমি নিজেও আছ। আর তাছড়া বুশরা ওই বাড়ির বউ হবে না। এটা ধরে রাখো।
.
নিখিল খানিকটা রাগ নিয়েই বলল, সে এই বাড়ির বউই হবে। তুমি তা ধরে রাখো।
.
এই বলে ফোনের লাইন কেটে দেয় নিখিল। তার ভীষণ রাগ হয় তায়শার প্রতি। নিজেকে কী মনে করে সে! নিহির অভিনয় করলেও নিখিল করবে না। সেই বুশরাকে বিয়ে করে নিয়ে আসবে। তাছাড়া নিখিলের মনে বুশরার জন্য আলাদা একটা জায়গা তৈরী হয়ে হয়েছে। হয়তো ভালোবেসে ফেলেছে সে বুশরাকে!
.
.
নিহির হুট করেই বুশরাকে ফোন করে বেরুতে বলল। জানালো দরকারেই ডাকছে তাকে। নিহির সচারাচর এমনটা করেনা। তাই বুশরা ভাবলো, হতে পারে আসলেই কোনো দরকার। মানুষটা তাকে এত সাহায্য করেছে। তাকে যদি নিহিরের দরকার হয় অবশ্যই যাওয়া জরুরী। এই ভেবে তৈরী হয়ে বুশরা বেরিয়ে পড়ে৷ তাকে এভাবে তাড়াহুড়ো করে বেরুতে দেখে তায়শা তার পিছু নেয়।
নিহিরের মেসেজের ঠিকানা অনুযায়ী সে একটি রেস্টুরেন্টে এসে থামলো। ছুটে ভেতরে এসে নিহিরের দেখা পায় সে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কোনো সমস্যা?
.
নিহির তাকে এভাবে দেখে চিন্তিত হয়ে বলল, বসুন আপনি। পানি খান আগে।
.
নিহির পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই বুশরা ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস পানিই খেয়ে ফেলল। নিহির বলল, এত সিরিয়াস নেবেন জানলে এভাবে তাড়া দিতাম না আপনাকে।
-তবে কী সিরিয়াস কোনো ইস্যু না?
-নাহ!
-তবে?
-আসলে কাল চাচীর জন্মদিন। প্রতিবার তাকে শপিং এ নিয়ে যাই আমি। ভাবলাম এইবার তাকে না নিয়ে তার জন্য কিছু নিয়ে সারপ্রাইজ দিই। কিন্তু আমি মেয়েদের এসব ব্যাপারে একদমই কাঁচা। ভাবলাম আপনাকে সাথে নিই।
.
বুশরা লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে হেসে দেয়। সাথে বলল, এই ব্যাপার! ভালোভাবে বললেই পারতেন। আমি কি না কি ভেবেছি!
-আগে খেয়ে নিন। এরপর চলুন শপিং এ যাওয়া যাক।
.
আগামীকাল সেনোয়ারা বেগমের জন্মদিন ঠিকই। কিন্তু তার জন্য সারপ্রাইজ প্লান করে বুশরাকে ডাকা একটা বাহানা মাত্র। বুশরাকে অনেক বেশি দেখতে মন চাইছিল তার। যার জন্য এই বাহানা!
.
খাওয়া শেষে তারা শপিংমল এ আসে। সেনোয়ারার জন্য শাড়ি নেওয়া শেষে নিহির বুশরাকেও অনেকটা জোর করে একটি শাড়ি নিয়ে দেয়। এদিকে তাদের পিছু নিয়ে এসব দেখে জ্বলছে আর ক্যামেরাবন্দী করছে তায়শা। তার জায়গায় বুশরা নিহিরের সাথে ঘুরছে, খাচ্ছে, শপিং করছে এসব মানতে পারছে না সে। তায়শা নওয়াজকে এসব ছবি পাঠিয়ে দেয়। এদিকে নওয়াজও এসব দেখে নিজেকে সামলাতে পারছে না। তার ভুলের মাশুল দিতে প্রস্তুত হওয়ার পরেও কেনো বুশরা ফিরছে না তার কাছে এখন তা স্পষ্ট।
.
.
বুশরা বাসায় আসতেই আলিয়া খাতুন বললেন, পাত্রের মা এসেছে তোকে দেখতে। মাত্রই তোকে ফোন দিতে যাচ্ছিলাম। ভালো হলো চলে এসেছিস।
-হঠাৎ?
-আরেহ আমিও জানতাম না! তুই দেখি তৈরীও আছিস। যা ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখা করে নে।
.
এই বলে বুশরার হাত থেকে প্যাকেট ও তার ব্যাগ নিয়ে তায়শাকে দিয়ে তিনি বললেন, এসব ওর রুমে রেখে আয়।
.
এই বলে তিনি বুশরার মাথায় ওড়না দিয়ে তাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে গেলেন। আর তায়শা বুশরার রুমে এলো। সে বুশরার আগেই শপিংমল থেকে বেরিয়েছিল। তাই আগেই চলে এসেছে।
তায়শা প্যাকেটের ভেতরে থাকা শাড়িটা দেখলো। খুব সুন্দর শাড়িটা। আজ যেসব ওর হওয়ার কথা ছিল সেসব হচ্ছে বুশরার! ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তার। বুশরার ব্যাগে থাকা ফোন বেজে উঠলো। তায়শা তা বের করে দেখে নিহির ফোন করেছে। সে ইচ্ছে করেই ফোনটা রিসিভ করে। নিহির বলল, বাসায় ঠিকমতো গিয়েছেন? অর্ধেক পথ থেকে নেমে গেলেন তাই খবর নিচ্ছি।
-বাসায় এসে পাত্র পক্ষের সামনেও সে চলে গেছে।
.
তায়শার কণ্ঠ শুনে নিহির বলল, তাহরিমা?
-জি আমি।
-বুশরা কোথায়?
-সে কী! একসাথে এতক্ষণ থেকেও সে বলল না যে আজ তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে! অবশ্য না বলাই স্বাভাবিক। পাত্র যদি নিহির থেকেও ভালো হয় তবে তাকেই বিয়ে করে নেবে। তায়শার বোন নিশ্চয় তায়শার মতোই হবে।
-বুশরা মোটেও তোমার মতন নয়।
-তাহলে সে তোমাকে কিছু জানায়নি কেনো?
.
এই বিষয়ে কিছু বলতে পারলো না নিহির। বুশরা কেনোই বা জানাবে! নিহির তো আর সত্যি সত্যিই তাকে বিয়ে করতে চায়নি যে তাকে এসব জানাবে সে।
তায়শা বলল, যাই। মিষ্টি নিয়ে যাই আমি। বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে আসবে অবশ্যই।
.
এই বলে সে ফোনের লাইন কেটে দেয়। অন্যরকম এক শান্তি অনুভব করছে তায়শা। পরবর্তী ঘন্টা গুলো যে বুশরার কেমন কাটবে সেটা সম্পর্কে তার ধারণাও নেই। এটাতো কেবলমাত্র শুরু হলো!
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here