সেই মেয়েটি আমি নই
.
৯ম পর্ব
.
ইশতিয়াক বেলকনিতে চেয়ার নিয়ে বসে একের পর এক সিগারেট টানছে। তার এখনও মেজাজ গরম হয়ে আছে। একদম ন’ষ্টা মেয়ে। আবার কত বড়ো বেয়াদব তাকে চ’ড় মেরেছে। এই মেয়েকে সে ডিভোর্স দেবে। এমন মেয়েকে সে কিভাবে ভালোবেসেছিল? কিভাবে ওর প্রেমে পড়েছিল? নিজের রুচির প্রতি ঘে’ন্না লাগছে তার। খানিক পরেই তার ফোন বেজে উঠলো৷ মেয়ের কল। রিসিভ করলো সে।
– ‘হ্যালো।’
– ‘ইশতিয়াক, বাবা হঠাৎ কইরা কি সমস্যা হইছে রে?’
– ‘কি সমস্যার কথা বলছো?’
– ‘তুলির মা কল দিয়েছেন৷ তুই না-কি তুলির গায়ে হাত তুলেছিস? এটা তুই কি করলি বাবা? মেয়েটা না-কি তাদেরকে কারণ কিছুই বলছে না এখন সে শুধু ডিভোর্স চায়।’
ইশতিয়াক ক্রোধে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল।
– ‘সে আবার ডিভোর্স চাইবে কি? আমি তাকে ডিভোর্স দেবো। আর চাইবেই তো ডিভোর্স। কোন মুখে আর সংসার করবে ন’ষ্টা মাইয়া।’
– ‘বাবা মাথা ঠান্ডা কর। সংসার করতে গেলে অনেক ঝামেলাই হয়। তাই বলে গালাগাল দিতে হয় না, গায়ে হাত তুলতে হয় না, ডিভোর্স দিতে হয় না৷ তোর বাবা তুলির মা’কে বলেছেন এখনই ডিভোর্স ডিভোর্স না করে তোদের দু’জনকে নিয়ে আগে বসতে। কি হয়েছে সবকিছু আগে আমরা বুঝি৷ এর আগপর্যন্ত মেয়ে ওর মা-বাবার কাছেই থাকুক।’
– ‘এতো বুঝাবুঝির কিছু নাই মা৷ এই মেয়ের সঙ্গে সংসার করতে পারবো না।’
– ‘তুই কোনো মেয়ের সাথেই সংসার করতে পারবি না ইশতিয়াক৷ এই মেয়ে ভালো তাই এতদিন থেকেছে।’
তুলি ‘ভালো’ শুনে ওকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল শুরু করলো ইশতিয়াক৷ তার বাবা মোবাইল নিয়ে বললেন,
– ‘হ্যালো আমার কথা শোন।’
– ‘হ্যাঁ বলো কি বলবা।’
– ‘তোর সংসার করা লাগবে না। মেয়ে তো এখন মায়ের কাছে আছেই। আজ সোমবার। আগামী শুক্রবারে আমি আর তোর মা যাব তুলিদের বাসায়। তোর ইচ্ছা হলে যাবি। না হলে তোর যেতেও হবে না৷ শুধু নতুন কোনো বাড়াবাড়ি করবি না। আমরা আগে যাই, সবকিছু শুনি। ডিভোর্স তখন দিতে হলে দেয়া যাবে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। যাই করো এই মেয়ে এখানে আর আসতে পারবে না।’
– ‘আচ্ছা, এবার নিজের অফিস-টফিস সব স্বাভাবিকভাবে কর। রাখলাম।’
কল কেটে গেল। ইশতিয়াক আবার সিগারেট ধরায়। অফিস তো সে স্বাভাবিকভাবেই করবে। সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলবে। এই মেয়ের জন্য কিছুই আঁটকে থাকবে না। খালি ফ্ল্যাট। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা দেবে, তাস খেলবে। দরকার হয় ম’দ আনাবে।
পরেরদিন ইশতিয়াক স্বাভাবিকভাবেই অফিসে গেল। তুলি সারাক্ষণ রুমেই দরজা বন্ধ করে কাটাচ্ছে৷ ভোরে হুস্না বেগম নাশতা দিতে এলে বলেছে সে মাস্টার্সে ভর্তি হবে আর জব দেখবে। হুস্না বেগম তখন ইশতিয়াকের মায়ের কথা বললেন। তারা কিছু সময় চেয়েছেন। শুক্রবারে এসে কি হয়েছে জানতে চাচ্ছেন। তুলি উত্তরে বলেছে। বসাবসির কিছু নেই মা। আমি এসব বিষয়ে কাউকে কিছু বলবো না। তারা তাদের ছেলের কাছ থেকেই জানুক কি হয়েছে। আর কোনো কথা বাড়াননি হুস্না বেগম। মেয়েটি আপাতত নিজেত মতো থাক। ‘নাশতা কর মা’ বলে তিনি বের হয়ে গেলেন।
*
তুষার রাত এগারোটায় সিলেট এসে পৌঁছেছিল। রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকায় এতো দেরি হয়েছে৷ মাজারে এসে যখন সে বিনোদিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তখন বারোটা ছুঁইছুঁই৷ এই সময়ে ঢাকা ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এদিকে অচেনা এই শহরে অবিবাহিত দু’জন ছেলে-মেয়ে কোথায় হোটেল পাবে তাও জানা নেই তাদের। তাই মাজারেই আলাদা বসে সময় কাটিয়েছে। এর ভেতরে দু’জন নিজেদের কৌতূহলী প্রশ্ন করে সেরে নিয়েছে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা। সবকিছু জেনে বিনোদিনী হতবাক। ওর মতো অবিকল একটা মেয়ে আছে শুনে বিশ্বাসই হচ্ছে না। অন্যদিকে বিনোদিনী সিলেট কিভাবে এসেছে। এতদিন কোথায় ছিল। কেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। সবকিছু শুনে তুষারও অবাক। তারা দু’জনের বাড়িই কোমলগঞ্জ। তুষার মুসলিম, বিনোদিনী হিন্দু৷ ওর বাবা স্কুল শিক্ষক। তুষার বিনোদিনী একই স্কুলে পড়তো। তুষার ছিল ওর দুই ক্লাস উপরে। কিন্তু পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় এক সঙ্গেই যাওয়া-আসা হতো তাদের। সেই থেকেই ধীরে ধীরে তাদের প্রেম হয়ে যায়। উঠতি বয়সের এই প্রেম এক সময় গড়ায় শারিরীক সম্পর্কে। কিন্তু বছর কয়েক আগে থেকে গ্রামে হিন্দু মুসলিমদের মাঝে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে ক্ষমতার লড়াই। একে অন্যের প্রতি হিংসা-বিভেদ৷ বিনোদিনীর বাবা এই গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন না। স্ত্রী থাকতেন সিলেট আর তিনি কোমলগঞ্জ থেকে শিক্ষকতা করাতেন৷ কিন্ত একটা সময় এই গ্রামেই স্ত্রীকে এনে ঘর-বাড়ি করে বসবাস শুরু করেন। কারণ গ্রামে নিজের সম্প্রদায়ের প্রচুর মানুষ আছে। সবার সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন অনেক। কয়েক বছর থেকে হিন্দু-মুসলিম ছেলে-মেয়েদের প্রেম নিয়ে দুই ধর্মালম্বীর লোকই বিরক্ত। এসব নিয়ে কিছুদিন পর পর দুই গোত্রে ঝামেলা হয়, বিচার-আচার হয়৷ তাই যখন তুষার আর বিনোদিনীর বিষয় ছড়িয়ে পড়ে এবং তুষার বাড়াবাড়ি শুরু করে। তখনই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক বসে সীদ্ধান্ত নেয় তারা এখন থেকে এসব মিলে-মিশে প্রতিরোধ করবেন৷ কিছুদিন পর পর প্রেম করে মেয়েরা মুসলমান হবে। এগুলো আর মানা যায় না৷ বিনোদিনী হঠাৎ পালিয়ে যেতে পারে এই ভয়ে তারা মাস্টারকে ডেকে বললেন মেয়েকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে। এর ভেতরে তারা সবাই মিলে নিজের সম্প্রদায়ের ছেলে খুঁজে বিনোদিনীকে বিয়ে দেবেন। আর এভাবেই এখন থেকে সবাই মিলে-মিশে এই সমস্যাগুলোর প্রতিরোধ করবে। মাস্টার পড়লেন বিপদে। একদিকে স্বজাতির চাপ, অন্যদিকে মেয়ে। তাছাড়া বিনোদিনীকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন কিভাবে? অনেক ভেবে ওর খাবারে ঘুমের ওষুধ দিলেন। ঘুমানোর পর মুখ-হাত বেঁধে রাতেই গাড়ি করে গ্রাম থেকে সিলেট নিয়ে যান৷ সিলেট উনার ভাই চা বাগানে থাকে। বিনোদিনী সেখানেই কড়া নজরদারিতে ছিল। এদিকে তুষার ওর খুঁজে পাগল। বিনোদিনীর কোনো খুঁজ নেই। পাগল হয়ে ঘুরে। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকও হিন্দু-মুসলিম ছেলে-মেয়েদের এসব বিব্রতকর পরিস্থিতি নিয়ে বিরক্ত। তাই তুষারের বাবার কাছে নানান কথা আসতে লাগলো। তিনি অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলেকে আপাতত গ্রামে রাখবেন না। তাই ফুপুর বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। এলাকায় কখন কোন ঝামেলায় জড়াবে বলা যায় না। শোনা যাচ্ছে মাস্টারের পরিবারের কাউকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তুষার ঢাকা ফুপুর বাসায় উঠে। এখানে বেশ কিছুদিন থাকার পর হঠাৎ একদিন কাকতালীয়ভাবে রাস্তার অপর পাশ থেকে তুলিকে দেখে ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে বের হতে। তুলিকে দেখে ভাবে এটা তার বিনোদিনী৷ ছুটে যায় রাস্তা পার হতে। কিন্তু রাস্তা দ্রুত গাড়ি চলাচলের কারণে যেতে যেতেই হারিয়ে ফেলে ওকে। তখনই মাথায় আসে ফ্লেক্সিলোডের দোকানের কথা। নিশ্চয় সেখানে নাম্বার পাবে ওর। সে গিয়ে দোকানিকে বললো মোবাইলে রিচার্জ করবে। দোকানী তখন খাতা মেলে বললো নাম্বার বলুন। নাম্বার মুখস্থ থাকলেও তুষার তখন এমনভাবে নাম্বার বলে যেন মোবাইল দেখেই বলতে হচ্ছে তার৷ এই সুযোগে ক্যামেরায় গিয়ে খাতার পুরো পেইজের ছবি তুলে নেয়। বাসায় এসে শেষের নাম্বার তুলে সেভ করতেই ইমু হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে তুলির ছবি দেখে ভাবে এটাই তার বিনোদিনীর নাম্বার।
এখন সকাল এগারোটা। তুষার আর বিনোদিনী বাসে বসে আছে৷ কপালের অবাধ্য চুল সরিয়ে নিয়ে বিনোদিনী বললো,
– ‘মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে। তোমার কারণে সে লাঞ্চিত হলো। ওদের সংসারে ঝামেলা সৃষ্টি হলো। যাইই বলো ওদেরকে খুঁজে বের করে মাফ চেয়ে সব খুলে বলা উচিত।’
– ‘তোমার কি মাথায় দোষ? আমরা এখন কি করবো সেটা ভাবো। ফুপুর বাসায় আর যেতে পারবো না। আমি মোবাইলের শো-রুমে কাজ পেয়েছি কিছুদিন হল। টাকা-পয়সাও নেই। থাকবো কোথায়, বিয়ে করবো কিভাবে সেটাই ভাবছি।’
– ‘তুমি আপাতত ফুপুর বাসায়ই থাকতে পারবে। ওরা তো আর জানে না আমাকে নিয়ে এসেছো। সুতরাং তুমি ফুপুর বাসায় থাকো আর আমাকে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দাও। তারপর মাস শেষ হলে বেতন পাবে। এরমাঝে বাসাও খুঁজে নেবে।’
– ‘কিন্তু তোমাকে রাখবো কোথায়?’
– ‘আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তুমি কোথাও রাখার ব্যবস্থা না করতে পারলে আমি আপাতত একটা জায়গায় উঠতে পারবো।’
– ‘কে?’
– ‘মিলন আর রাধিকা যে পালিয়ে বিয়ে করেছিল ওরা ঢাকায়ই থাকে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে।’
– ‘তাহলে তো ভালোই। ওরাও তো আমাদের মতো।’
– ‘হ্যাঁ, সব রকম সহযোগিতা করবে। কিন্তু তুমি যেভাবেই হোক ওই মেয়েটির স্বামীকে বের করে সব খুলে বলো। আমার বিষয়টা শুনে কষ্ট হচ্ছে। বেচারি নির্দোষ হয়েও কি ঝামেলায় পড়েছে। চরিত্রে কলংক লেগেছে। আমার চেহারার সঙ্গে মিল হওয়ায় এই ঝামেলা হয়েছে বলে নিজেকেও অপরাধী মনে হচ্ছে।’
– ‘কিন্তু ওদের আমি পাব কোথায়? যে নাম্বারে যোগাযোগ করতাম সেটা মোবাইল সহ ভ্যানিটিব্যাগ ফুপুর বাসায়। কল দিয়েও পাব না।’
– ‘ভ্যানিটিব্যাগে খুঁজে পাওয়ার মতো কিছু নেই?’
– ‘না, মোবাইলও লক করা।’
– ‘কি আশ্চর্য, এখন এভাবেই থাকবে না-কি? তুমি যেরকম বলছো ওর স্বামী চ’ড় মেরে টেনে নিয়ে গেছে। বুঝতে পারছো কি অন্যায়টা হয়েছে। ইশ মেয়েটা নির্দোষ হয়েও।’
তুষার ওর পেছনে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
– ‘বাদ দাও এসব। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন খুঁজেও পাব না। নিজেদের চিন্তা করি।’
বিনোদিনী ওর বুকে মাথা রেখে উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে হ্যাঁ সূচক গোঙানি করলো, ‘হু।’
__চলবে__
সেই মেয়েটি আমি নই
লেখা: জবরুল ইসলাম
বি:দ্র: কারা আগেই ভেবেছিলেন তুলির মতো কেউ আছে?