সেদিনও জ্যোৎস্না ছিল পর্ব-১৫

0
6405

#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল

#তানিয়া

পর্ব:১৫

তৃতীয় বারের মতো কবুল শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে ঠোঁট জোড়া অনড় হয়ে যায় মেহুর।মনে হচ্ছে গলার মাঝে কাটা বিঁধে আছে।কোনভাবে শব্দ বেরুচ্ছে না।এদিকে আমেনা খালা কানে এসে ফিসফিসয়ে বলে,

“কও মা কবুল কও। খাড়াই গেছো ক্যান?আল্লাহ যা করে ভালার লাইগা করে।তুমি ভাইবো না।কবুলটা কইয়া দাও মা।”

আমেনা খালা কি বলছে সেগুলোতে মন দিতে পারছে না মেহু।তার বারবার মনে হচ্ছে এ বিয়ের আসর থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচত। কিন্তু মেহু উপায়হীন, তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আর এখান থেকে পালালে তাকে তিমির কূপে পড়তে হবে যা সে চায় না।তাই এখন বিয়েটায় তার একমাত্র বাঁচার পথ।কিন্তু এ বিয়েটা করতে গিয়ে সে যে একজন অচেনা মানুষের জীবনে জোর করে প্রবেশ করছে তা সে জানে কিন্তু বাধ্য হয়ে এটা করছে।এ মুহুর্তে মেহুর নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হচ্ছে। নিজেকে বাচাতেে সে অন্যের জীবনকে ব্যবহার করছে এটা অন্যায় তবুও সে করবে।অন্তত নরক যন্ত্রণা ভোগ করার চেয়ে কারো জীবনে জোর করে প্রবেশ করা খুব একটা অসংগতি নয়।তবে এতক্ষণ যা ঠিক মনে হচ্ছিল কবুল শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে তার অপরাধ বোধ বারবার তাকে নাড়া দিচ্ছে।বিয়ে নামক সম্পর্কটাকে এতক্ষণ মেহুর মুক্তির পথ মনে হলেও এখন কেন জানি ভয় করছে।জীবনের এমন একটা পরিস্থিতিতে তাকে পড়তে হবে জানা ছিল না।

আজকে মায়ের কথা মনে পড়ছে।হয়তো মা বেঁচে থাকলে তাকে এতকিছুর মুখে পড়তে হত না অথবা হয়তো দেখা যেত মা থাকলেও কিছু হত না।কারণ শকুনের নজর তার ওপর! মা কি পারত মেয়ে হয়ে লড়াই করতে?আরেকবার কবুল শব্দটা উচ্চারণ করলেই সে গৃহপরিচারিকা থেকে গৃহবধূ হয়ে যাবে।কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার জায়গাটা কাজের মেয়ে থেকে মনিবের হয়ে গেল।এটা হয়তো কপাল! এসব এলোমেলো ভাবনা ভাবছে আর টপটপ করে চোখের জল ফেলছে কিন্তু জলটুকু কারো চোখে পড়ছেনা কারণ সবার মাঝখানক একহাত ঘোমটা টেনে মেহু বসেছে।চোখের জল আড়ালে যা সবার চোখের অগোচরে।

“কবুল”!

কাজী সাহেব সহ উপস্থিত সকলে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলেন।মেহুর কবুল বলা শেষ হতেই এবার আদ্যর কাছে গেল।আদ্যও কবুল বলতেই এখন সেটাও সম্পূর্ণ হল।ধর্মীয় মতে মেহু আদ্যর স্ত্রী। এ বাড়ির মেজ বৌ!

আদ্যর রুমটা গোছানো পরিপাটি। সহজে কেউ ঢুকতে পারে না।আদ্য ছেলেটা একটু গোছানো ধরনের। সবকিছু পরিষ্কার আর ধকধকে থাকাটা তার চায়।তিন ভাইয়ের মধ্যে আদ্য একটু ব্যতিক্রম ধর্মী।আর সেই ছেলের বৌ নাকি মেহু।এটা ভাবতেই শিরদাঁড়ায় কম্পন শুরু হয়ে গেল।খুব কান্না পাচ্ছে তার।না জানি আদ্য আসলে তাকে কি করে ফেলে।হয়তো দরজা বন্ধ করে উরাধুরা মারবে।কেন তার বিপদের জন্য আদ্যকে বলির পাঁঠা হতে হল। জাহান্নামের চুলায় যাক তাতে আদ্যর কি?নিশ্চয়ই এসব ভাবছে আদ্য।ভাবতেই চোখটা ভিজে উঠল মেহুর।

ছাদের কর্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আদ্য।সবকিছু কল্পনা লাগছে।সকালেও সে একজন ব্যাচেলার ছিল আর রাত হতেই এখন সে বিবাহিত তাও আবার সেই মেয়েকে যাকে কাজের মেয়ে হিসেবে জানে।শেষে কিনা একটা কাজের মেয়েকে তার বিয়ে করতে হল।বিয়েটা সে কখনো করত না যদি না মা তাকে জোর করত।আদ্য মাকে খুব ভালোবাসে আর সেই ভালোবাসার আবদার খাটাতে মা তাকে ডিরেক্ট কাজের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিল।আদ্য একটা সিগারেট ধরাল আর আকাশের পানে চেয়ে রইল।কত বড় একটা চাঁদ উঠেছে।পূর্ণিমার চাঁদ আদ্য খুব পছন্দ করে।এ অভ্যাসটাও সে মা থেকে পেয়েছিল।আদ্যর অভ্যাস গুলো সে তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে।দেখতেও অনেকটা মায়ের মত।সবকিছুর জন্যই হয়তো সে মাকে এতটা ভালেবাসে।আদ্য এতই চিন্তায় মশগুল যে পেছনে তার মা এসে দাঁড়িয়েছে তার খবর নেই।

লুৎফার সিদ্ধান্ত জানানোর পর যখন সবাই হতবাক হয়ে যায় তখনো লুৎফা নির্বাক।তার ভাব ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যা বলেছেন তা বিন্দু মাত্র ঠাট্টা নন।তবে বিষয় হচ্ছে আদ্য রাজি হবে কিনা?তিনি যখন এ বিষয় নিয়ে আদ্যর সাথে কথা বলতে যান তখন আদ্য হতবাক হয়।সে প্রথমে অমত করলেও পরে রাজি হল যদিও কয়েকবার না বলেছিল কিন্তু তিনি জানেন আদ্য তাকে ফেরাবে না।তাই একটু আহত সুরে কথা বলতেই আদ্য রাজি হয়ে গেল।

কিন্তু বিয়ের পর থেকে তিনি ভয় পাচ্ছেন আদ্য তার সাথে কেমন রিয়েক্ট করবে সেটা ভেবে।যদিও এখনও তার সাথে আদ্যর একবারও কথা হয় নি।তাই ছেলেকে খুজতে খুজতে ছাদে এসেছেন আর পেয়েও গেলেন।

“আদ্য”!

মায়ের ডাকে তাড়াতাড়ি জ্বলন্ত সিগারেট পা দিয়ে পিষে স্বাভাবিক হয়ে নেয় আদ্য।

“মা তুমি এখানে? কিছু বলবে?”

মিসেস লুৎফা ভয় পাচ্ছেন। তার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন।

“আদ্য তুমি কি সিগারেট খাও?”

“না মা তবে মাঝে মাঝে যখন.. ”

“থাক বলতে হবে না।আমি তোমার সাথে কথা বলার জন্য এসেছি। তোমার কি মনে হয় আমি যা করেছি ভুল করেছি!”

আদ্য মর্মাহত চোখে মায়ের দিকে তাকায়।হয়তো আদ্য ভেবেছিল মা তাকে এমন একটা কাজের জন্য নিজের অনুশোচনা দেখাবে কিন্তু মা কি বলছে?আদ্য কিছু বলতে গিয়েও বলল না।কারণ মাকে আঘাত করে কথা বলতে সে কখনও চায় না আর তাই তো এক কথায় বিয়েতে রাজি হল।এখন এসব নিয়ে কথা শুনানো মানে অযথা মাকে আঘাত করা।আদ্য দু পা এগিয়ে এসে বলল,

“মা আমাকে কেন এসব জিজ্ঞেস করছ?তুমি বরাবরের মতোই জানো তোমার সিদ্ধান্তকে আমি কতটা শ্রদ্ধা করি।তাই তুমি যা করবে আমি তাই মানব।”

লুৎফা আহসান হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলান।আসলে তিনি বুঝতে পারছেন ছেলে তার এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইছে না তাই সময় গড়ালে এটা নিয়ে পরে কথা বলা যাবে।আপাতত নিরব থাকুক।

“আদ্য মর্জিনা ওহ্ শিট আই মিন মেহু। ও হয়তো একলা থাকতে ভয় পাচ্ছে তুমি রুমে যাও। অনুরোধ করছি ওকে নিয়ে রাগারাগি করো না।বড় ভালো মেয়ে নাহলে ভালো ঘরের মেয়ে হয়েও এমন একটা পরিস্থিতির মুখে পড়ত না।তুমি রুমে যাও রাত হয়েছে। ”

আদ্য হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। লুৎফার আহসান ছেলের যাওয়ার পানে চেয়ে থাকে।

দরজার কাছে আসতেই থেমে যায় সে।ঢুকতে ইচ্ছে করছেনা কি জানি কি হয়! রাগ লাগছে কিন্তু সেটাকে সংবরণ করতে হবে।কোনোভাবে মাকে বোঝানো যাবে তার কাজে আদ্য কতটা অসন্তুষ্ট হয়েছে।

রুমে ঢুকতে দেখল রুমটা অন্ধকার। দরজা লাগাতে ফ্যাচফ্যাচ কান্নার আওয়াজ কানে লাগলো। ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠল। এ মুহূর্তে এসব বিষয় বস্তু অসহ্য লাগছে। আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করছেনা না।ড্রিম লাইটের আলোতে বোঝার চেষ্টা করছে মেহু কোথায়?

“মেহু। ”

আওয়াজ নেই তবে হেঁচকির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

“প্লিজ স্টপ ইট।ভালো লাগছে না।আজ অনেক ধকল গেছে। কান্না বন্ধ করে শুয়ে পড়।”

শুনশান নীরবতা। হয়তো বাধ্য মেয়ের মত মেহু শুয়ে পড়েছে।আদ্যও শুয়ে পড়ল।দুজনের মাঝে একটা কোলবালিশ।অপর প্রান্তে মেহু।আদ্য ভাবছে তার বাবার কথা। বাবাকে সে ভালো মতো চিনে।যদি জানে কাজের মেয়ে মর্জিনা ওরফে মেহুর সাথে তার বিয়ে হয়েছে তাহলে কি যে করবে!!

পাশ ফিরতে মেহুর দিকে চোখ পড়ে। জ্যোৎস্নাটা একদম মেহুর মুখে পড়েছে। মলিন মুখেও পরী লাগছে তাকে!!
,
,
,
চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here