#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল
#তানিয়া
পর্ব:৫
বাসায় ছোট খাটো একটা অনুষ্ঠান মত হয়েছে। হবেই না কেন?ব্যবসার জন্য বড় ধরনের একটা প্রজেক্ট পেয়েছে তার খুশিতে পার্টি না দিলে হয়।আদ্য ফিরেছে আজ সকালে।কথা ছিল গত সন্ধ্যা বা রাতে সে আসবে।কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে আরেকটা কল আসায় সে বাসায় না এসে অন্য কাজে যায়। সেখান থেকে একেবারে আজ সকালে এসে পৌঁছায়।তখনো বাসার কেউ ঘুম থেকে উঠে নি।
মেহু তৈরি হচ্ছিল বাইরের কাজের জন্য। মোটামুটি নিজের পোটলা নিয়ে বের হতে যাবে ঠিক তখনি দরজার কলিং এর আওয়াজ হয়।মেহু ভয়ে দরজা খুলে না কারণ তার আন্দাজে ছিল গতকাল যখন আদ্য আসে নি নিশ্চয়ই এত সকালে সেই হবে।তাই সোজা দৌড় দিয়ে মেহু আমেনা খালাকে ডেকে আনে।আর আড়ালে চলে যায় মেহু।যেটা ভেবেছিলো সেটাই।আদ্য দরজার দৌরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। আমেনা খালাকে দেখে এক গাল হেসে দেয়।
“ভালো আছো তো খালা?”
“হয় বাবা ভালা আছি,তুমি কেমন আছো?ঐ দিহের কাম কেমন? ”
“সব ভালো খালা।বাড়ির বাকিরা কোথায় এখনো উঠে নি?”
না বাবা কাল অনেক রাইত পর্যন্ত তোমার লাইগা জাইগা ছিলো তুমি যহোন কইলা ভোরে আইবা তয় সকলে ঘুমাইতে গেছে। হয়তো বেলা হইবো তুমি আসো গোসল সাইরা লও আমি তোমার লাইগা নাস্তা দিতাছি।”
“না খালা এতো তাড়াহুড়ো করতে হবে না। আমি আগে একটা ঘুম দিব।যেখানে ছিলাম সেখান থেকে নাশতা করে এসেছি।আপাতত লম্বা শাওয়ার নিয়ে ঘুমাব।বাবা মা উঠলে আমাকে ডেকে দিও।”
আদ্য হাসিমুখে কথা শেষ করে নিজের রুমে চলে যায়। আদ্যর চলে যাওয়ার পর মেহু আড়াল থেকে বের হয়।
“খালা এই কি সেই পোলা যে আমার লগে ঝগড়া করছিলো।দেহো কতো সুন্দর কইরা তোমার লগে কথা কয়, আর আমার লগে কাটাকাটা কথা কইছে!”
” আরে ছেমরি তুইও কি তারে কম কইসোস?অহোন এসব বাদ দে।যে কামে যাইতাসোস দেখিস তাড়াতাড়ি চইলা আসিস। আজ বাড়িতে মেলা কাম।”
কাজের কথা মনে হতেই মেহু দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়।
সকাল সাড়ে ন’টা। এখনো সবার ঘুম ভাঙে নি।লুৎফা উঠে রান্নাঘরে পৌঁছতে আদ্যর খবর পায়।সেই খুশিতে তাড়াতাড়ি ছেলের রুমে যায়। ঢুকতেই আদ্যর ঘুমন্ত মুখটা চোখে পড়ে। চুলগুলো এখনো ভেজা।বোঝায় যাচ্ছে এসে মাত্র শাওয়ার নিয়েছে।কতটা স্নিগ্ধ লাগছে আদ্যকে। লুৎফা ছেলের মাথার পাশে বসে হাত বুলিয়ে দেয়।উঠে যেতে শাড়িতে টান পড়ে। বুঝতে পারে ছেলে তার ঘুমায় নি।তাই পেছনে ফিরে গিয়ে ছেলের মাথার কাছে বসে।
“তুমি ঘুমাও নি?”
“হু তবে তোমার হাত লাগতেই ঘুম উধাও।কেমন আছো মা?”
“ভালো।তবে তুমি এতটা শুকালে কেন?যত্ন নিতে না বুঝি?”
“হু একটু অবহেলা হয়েছে। আসলে যে কাজটার জন্য বাহিরে ছিলাম তা বড় গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।সবটা concerned শুধু কাজে দিয়েছিলাম তাই নিজেকে দেখার সময় হয় নি।তবে এবার থেকে দেখবো।”
“হুমম দেখা যাচ্ছে কতটা দেখবা?তুমি এতটা উদাস কেনো আদ্য?জীবনে চলতে হলে সব দিক দিয়ে সমান তাল রাখতে হয় একটাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্যটা অবহেলিত হলে তো সমস্যা তাই না?”
“সরি মা। সত্যি বলছি এবার থেকে সবদিক সমান তালে চলবো।বাবা উঠেছে।”
“না গতকাল জেগে থাকায় এখনো উঠে নি।তবে আজ হয়তো লেট হবে।তাছাড়া অফিসেও যাবে না বোধ হয়।তুমি তৈরি হয়ে এসো আমি সবাইকে খবর দিচ্ছি। দেরী করো না।”
“ঠিক আছে মা আমি এক্ষুনি আসছি তুমি যাও। ”
লুৎফা বের হতে আদ্য আরো কিছু সময় বিছানায় গড়াগড়ি করে নেয়।তারপর বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
আজকের খাবার টেবিলটা যেনো অন্যদিনের তুলনায় বেশ জমজমাট লাগছে।বলতে গেলে আদ্যর আসায় সবাই বেশ খুশি সেই সাথে ব্যবসার কাজটা সফল হয়েছে দেখে সবাই আনন্দে গদগদ। সেই সুবাদে কেউ বাহিরের কোনো কাজে যাবে না।উদ্দেশ্য, ভাই এর সাথে সবাই সময় কাটাবে।
সুজাতার মেয়ে সূচী রান্নাঘরে গেলো মেজ ভাই এর পছন্দ আলুর চপ বানানোর কথা জানাতে। আমেনা খালা আগে থেকেই জানত আদ্য এলেই আলুর চপের ব্যবস্থা করতে হবে।তাই আগে থেকেই সে সব ঠিক করে রেখেছিলো।যেই না অনুমতি পেলো অমনি বানানো শুরু করলো।
“ও মাইয়া তাড়াতাড়ি আলু গুলান রে ভর্তা কইরা দে।দেহোস না সূচী মাই কি কইয়া গেলো?”
“দেখছি তো খালা।তোমাগো আদ্য বাবা কি আলুরচপ বেশি খায় নি?এর লাইগা তো আলুর লাহান ফুইলা গেছে। ”
কথা টা বলে হি হি করে হেসে উঠে মেহু।তৎক্ষনাৎ আদ্য চলে আসে।
“কি বললে তুমি?আমি আলুর মতো ফুলে গেছি।এই মেয়ে কে তুমি?আর এতো সাহস কী করে হয় আমাকে আলু বলার।তুমি জানো আমি রোজ জিমে যায়। আমার বডি দেখেছো।কোনদিক দিয়ে তোমার আমাকে আলু মনে হয়।
মা ও মা মা!”
চিল্লাতে চিল্লাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যায় আদ্য। আসলে আদ্য নিচে আসছিলো আমেনা খালাকে আলুরচপের সাথে ভালো করে চিকেন ফ্রাই সাথে সস দিয়ে একটা রোস্ট তৈরি করতে বলার জন্য কিন্তু রান্নাঘরের কাছাকাছি এসে যখন মেহুর মুখ থেকে আলু শব্দটা শুনলো তখন তার মাথা চড়ে গেলো।সাথে সাথে নিজের রাগটা গড়গড় করে মেহুর ওপর ছাড়লো শুধু তাই নয় পুরো বাড়িকে এক জায়গায় করলো।আমেনা খালা মেহুর কাছে এসে বললো,
“আরে ছেমড়ি কইছিলাম বেশি ফটরফটর করিস না দেখলি তো কি হইলো?অহোন লাগতাছে তোর কাম চইলা যাইবো।আদ্য বাবার কথা এ বাড়ির বেবাকে মানে।তাছাড়া বড় আপা আদ্য বাবারে খুব ভালোবাসে।সে যদি রাগ কইরা তোরে তাড়াইয়া দেয় তাহলে কেউ কিছু কইতে পারবো না বুঝসোস?”
“খালা আমি তো তোমারে মশকরা কইরা কইতাছিলাম। হে লোক আইসা শুনবো কে জানতো?খালা এবারের মতো বাঁচাও।হাচা কইতাছি আমি আর ঐ পোলার ত্রিশ সীমানায় যামুনা।”
“আইচ্ছা তুই অহোন চুপ থাক।একদম বোবা হইয়া যা।আমি দেখতাছি কি করন যায়। তয় তুই একদম চুপ থাকবি ঠিক আছে? ”
মেহুর উত্তরের পরোয়া না করে আমেনা বাহিরে চলে আসে।ভয়ে আর ভীতিতে মেহুর চোখে জল চল আসে।এ আশ্রয়টা হারালে সে একদম শেষ হয়ে যাবে।অন্তত তার নিরাপত্তা হিসেবে এ জায়গাটা বেশ পাকা।এখন সে কি করবে?যদি আদ্যর কথায় লুৎফা তাকে বের করে দেয় তাহলে তো…..না না এসব কথা ভাববে না।খারাপ কথা ভাবলে খারাপই হবে তাই ভাববে না এসব।আল্লাহকে ডাকছে মেহু।
আদ্যর চেচামেচিতে সবাই বসার রুমে একত্রিত হয়।লুৎফা ছেলের কাছে এসে জানতে চায় কারণ কি?
“মা ঐ যে আমেনা খালার সাথে একটা মেয়ে আছে কি নাম..?”
“কে মর্জিনা?”
“জরিনা নাকি মর্জিনা জানি না?মেয়েটা আমাকে কি বলেছো জানো, আমি নাকি আলুর মতো দেখতে।”
কথাটা শুনে বাড়ির ছোটরা হা হা করে হেসে উঠে। আদ্যর অগ্নি দৃষ্টি দেখে সবাই হাসিটা হজম করে নেয়।লুৎফা অবাক হয়ে ছেলেকে দেখে।
“আদ্য তোমার কোথাও ভুল হয়েছে। মর্জিনা এমন ব্যবহার করতে পারেনা। গত দেড়মাস এ বাড়িতে আছে কখনো কারো সাথে আবোলতাবোল কথা বলেনি।তুমি হয়তো ভুল শুনেছো।”
“না মা আমি ভুল শুনিনি।এতটাও ভুল আমি শুনবো না।ও স্পষ্ট বলেছে আমি নাকি আলুর মতো দেখতে।”
“আদ্য আমার মনে হয় ও অন্য কিছু মিন করে বলেছে তুমি সেটা নিজেকে মিন করেছো।”
“তোমার সবকিছুতে একটু আগ না বাড়ালে হয় না নীলা।আদ্য যখন বলছে নিশ্চয়ই ভুল বলবেনা।”
নীলাকে নিক্ষেপ করে কথা ছুড়লো সুজাতা।চাচীর কথায় নীলার মুখটা থমথমে হয়ে যায়
“মা তোমার যদি মনে হয় আমি ভুল বলেছি তাহলে ঐ মেয়েকে ডাকো।ডাকো মা তাহলে সব পরিষ্কার হবে।”
লুৎফা নিরূপায় হয়ে ছেলের মান রাখতে মর্জিনাকে ডাকে।এরমধ্যে মেহুর প্রাণটা প্রায় অর্ধেক বেরিয়ে গেছে। যদি এ বাড়ি থেকে চলে যেতে হয় তাহলে হয়তো মরেই যাবে।মর্জিনা ভয়ে ভয়ে সবার সামনে আসে।
লুৎফা কিছু বলার আগেই সুজাতা এগিয়ে যায় মেহুর কাছে।
“এই তুই বল আসল কাহিনী কি?তুই কি সত্যিই মেজ ছেলেকে আলু বলেছিস?”
মেহু হাত মোচড়ামুচড়ি করি।আসলে সে যা ভেবে কথাটা বলেছিলো সেটা তো এদের বোঝানো সম্ভব না। হিতে বিপরীত হলে আবার।কিন্তু যা বলতে চায় তাও তো পরিষ্কার করে বলতে পারছে না।
“কি রে বোবা হলি নাকি?বল আদ্য যা বলছে তা কি ঠিক? ‘
“জ্বি মানে..আসলে….”
ঠাসসসসসস…
পুরো পরিবেশটা নিস্তব্ধ। আমেনা খালা মুখে শাড়ী টেনে এনেছে। উপস্থিত সবাই স্তব্ধ।
“কাজের মেয়ে কাজের মেয়ের মতো থাকবি।মনিবকে কি বলে ডাকতে হয় তা জেনে নিবি নতুবা শিখে নিবি।অতিরিক্ত নাচানাচি করলে চুল ধরে বের করে দিব।তখন রাস্তায় রাস্তায় থাকবি মনে রাখিস।ক্ষমা চা আদ্য থেকে। ”
মেহু পাথরের মতো আদ্যর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
“আমারে ক্ষমা কইরা দিয়েন।ভুল কইরা ভুল কথা কইয়া ফেলছি আর কোনোদিন কমুনা মাফ কইরা দেন।”
আদ্য তেজীভাব নিয়ে মেহুর সামনে থেকে চলে যায়।
“আজকের চড়টা মনে রাখবি।এটা তোর আগামী কাজের শিক্ষা হিসাবে মাথায় রাখবি।রাসকেল”
কথা শেষ হতে সবাই এক এক করে চলে যায়। লুৎফা আর নীলা মেহুর কাছে আসে।
“মা মর্জিনা তুমি কিছু মনে করো না।আসলে আদ্য ছেলেটা ওমনি।তাছাড়া সুজাতা এমন কিছু করবে ভাবতে পারিনি।ক্ষমা করে দিও মা।যাও কাজে যাও।”
ওরা চলে গেলে মেহু দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। মুখে কাপড় গুজে ঝরঝর নয়নে পড়ে থাকে।আমেনা খালা কাছে এসে জড়িয়ে ধরে,
“মা রে কান্দিস না।ছোট আপা এমনি।মাইনসে রে বড়ই আঘাত দিয়া কাম করে।আমি ওনার বয়সে বড় হমু কিন্তু আমারেও একবার তরকারির বাটি ছুইড়া দিছিলো।মা রে কামের মাইয়া হওয়া সহজ না।প্রতিটা সময়ে অপমান সওন লাগে।আর কান্দিস না।তুই ওপরে যা। এদিকটা আমি সামলামু।যা মা তুই আরাম কর।”
মেহু রুম অন্ধকার করে বসে আছে। এভাবে সুজাতা সবার সামনে তাকে চড় দিবে সেটা সে ভাবতে পারে নি।কাজের লোক বলে কি মান সম্মানহীন নাকি মেহু, নাকি কাজ করলে উঁচু জাতরা নিচুদের মানুষ মনে করে না?সব কষ্ট কেনো তাকে সইতে হচ্ছে।
পিতৃহারা মাতৃহারা আর পলায়ন রূপী হয়ে কেনো তাকে বাঁচতে হচ্ছে? কেনো আল্লাহ সব পরীক্ষা তার ভাগ্যে তুলে ধরেছেন।ভাবতেই ডুকরে উঠে মেহু।নিচে কতো হইহট্টগোল হচ্ছে কিন্তু মেহু একা এ চালাঘরে বসে আছে। কেউ নেই যে তার খবর নিবে?এ পৃথিবীতে এতো মানুষ কিন্তু কেউ যেনো মেহুর নয়।কতোটা অসহায় মেহু!!
,
,
,
চলবে…….