স্নিগ্ধ আবেশে তুমি পর্ব -৪

#স্নিগ্ধ_আবেশে_তুমি
#তানজিনা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_০৪

ধরনী বুকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে, সন্ধ্যা হয়ে এসেছে! সেই বিকেল থেকে মিফতার সাথে গল্প করতে করতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে এলো টেরই পেলাম না। এই হাজারো বিষয়ে আলাপন হলো তার সাথে‌। একদিনেই দুজনের মধ্যে খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে এলো। আমরা দুইজনে ছাদে বসে বসে গল্প করছিলাম, একটু আগে তূর্য এসে ডাক দিয়ে গেছেন। তবুও আমাদের গল্প ভাণ্ডারের জমানো গল্পবলি এখনো শেষ হয়নি। আমরা আমাদের মতো গল্প করে চলেছি।

এই স্টুপিডের দল! কখন থেকে বলছি নিচে নামো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে কানে যাচ্ছে না?

পরোক্ষণেই দেখতে পেলাম তূর্যকে। সে বোধহয় রেগে আছেন, তার মুখ রাগে লাল হয়ে আছে কপালের রগ দুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাকে দেখে আমারও এই মুহূর্তে বেশ ভয় লাগছে‌‌। মিফতা আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আমাকে জরিয়ে ধরলো। এখন আমি তূর্যের মুখোমুখি! আমার পিছনে মিফতা। ভয়ে আমি পাথরের মতো জমে যাচ্ছি, কিছু বলার সাহস হচ্ছিল না। তূর্য আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার রাগের কারণ ততটা ভালো করে বুঝতে পারলাম না। সে রাগী কন্ঠে মিফতাকে ঘরে যেতে বললেন। মিফতা প্রথমে আমায় ছেড়ে যেতে চাইলো না পরোক্ষণেই তূর্যের দৃষ্টিপাত লক্ষ্য করে সে এক দৌড়ে চলে গেল। এখন আমার কি হবে? আমার তো ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। তূর্য আমার এক হাত টেনে আমায় নিচে নিয়ে আসলেন। অনেক শক্ত করে চেপে ধরায় অনেক ব্যথা পাচ্ছি আমি, ব্যথায় কাতরানো অবস্থায় আমার বাগযন্ত্র দ্বারা একটি ধ্বনিই উচ্চারিত হচ্ছে। তূর্য এর কোন পরোয়া করলেন না। ছাদ থেকে নিয়ে এসে আমাকে খাটের উপর ধাক্কা মেরে ফেলে দিলেন। অনেকটা জোরে হওয়ায় বেশ ব্যাথা পেলাম। আমাকে ফেলে দিয়ে তূর্য ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় কয়েকটা ঘুষি দিলেন। তার হাত কেটে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। তাতে তার কোন হেলদোল নেই, সে এখনো আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার হাত দিয়ে অনেক রক্ত বের হচ্ছে আমি আর বসে থাকতে পারলাম না দৌড়ে তার দিকে অগ্রসর হলাম। হঠাৎ এমন করছেন কেন উনি? কি হয়েছে ওনার? পাগল হয়ে গেলেন নাকি উনি? তার কাছে গিয়ে নিজের শাড়ির আঁচলটা দিয়ে তার হাতটা পেঁচিয়ে নিতে নিলেই মুহূর্তেই সে আমাকে এক জাটকায় সরিয়ে দিলেন। আমি পড়ে যেতে নিয়েও কোনরকম দাঁড়িয়ে রইলাম। সে এবার আমাকে দেয়ালের দিকে ধাক্কা দিয়ে আমার গাল চেপে ধরলেন।

খুব শখ না অন্যদেরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করার? আমি আছি কেন? আমাকে ভালো লাগে না? এই তাসকিন মাহমুদ তূর্য কখনো নিজের জিনিসে অন্যের হাত পছন্দ করে না। মনে রাখবে, যেটা আমার সেটা শুধুই আমার‌।

এই বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি ঘটনার কিছুই বুঝতে পারলাম না। সেখানেই বসে কাঁদতে শুরু করলাম। কি হয়েছে? কি করেছি আমি? যার জন্য আমার সাথে এই ব্যবহার!

কিছুক্ষণ পর তূর্য আবার ফিরে এলেন‌। এসেই ড্রয়ার থেকে আমার সব শাড়িগুলো বের করে নিলেন। এরপর এগুলো নিয়ে নিচে চলে গেলেন। কিছুই বুঝতে পারলাম না। এতে এতোটা পাত্তা না দিয়ে বসে বসে কাঁদতে থাকলাম। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে চোখে ঘুম চলে এসেছে কে জানে, সেখানে বসেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভাবি মণি, ওঠো খাবে না?

চোখ মেলে দেখলাম মিফতা। বেচারা আমার অবস্থা দেখে কেঁদেই ফেলেছে। না বলে দিলাম। মিফতা আমাকে জরিয়ে কেঁদে দিলো।

ভাইয়ার সাথে রাগ করে আমার সাথে কথা বলবে না?

আরে না, পাগলি।

ভাবি মণি, ভাইয়া অনেক বকেছে?

নাহ,

তোমার গালগুলো লাল কেন? আর জিনিসপত্র ভাঙচুর করেছে কে? আর তুমি এভাবে বসে ঘুমিয়ে ছিলে কেন?

আমি চুপ করে রইলাম।

ভাবি মণি, ভাইয়া তোমার শাড়িগুলো পুড়িয়ে দিলো কেন?

মানে?? কি বলছো?? পুড়িয়ে দিয়েছে!

হ্যাঁ, সেই সন্ধ্যায়।

আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। এমন কেন করছেন উনি?
এখন আরো বেশি খারাপ লাগছে। মিফতাকে কোনরকম বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিলাম।

পুরোনো এক বাড়িতে ভয়ংকর দৃষ্টিতে দুটো ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে তূর্য। ছেলেগুলোকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। তূর্যের দৃষ্টিপাত লক্ষ্য করে ছেলে দুটোর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কি হবে কেউই বুঝতে পারছে না। এটা বুঝতে পারছে তাদের সাথে ভালো কিছু হবে না এখন‌। অনেক ক্ষণ চুপ করে থাকার পর তূর্য গর্জে উঠলো। তূর্যের গর্জনে যেন পুরো এলাকা কেঁপে উঠলো।

তোদের সাহস তো কম না, তোরা তাসকিন মাহমুদ তূর্যের দিকে হাত বাড়িয়েছিস। তোদের দেখে অবাক হচ্ছি।

মাফ করে দেন তূর্য ভাই, আর কখনো এমন হবে না।

মাফ!
তূর্য অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ে‌। তা দেখে ছেলেগুলোর কলিজা শুকিয়ে যায়।

ফ্ল্যাশব্যাক….

সন্ধ্যায় মেহরোজ আর মিফতা দুজনে মিলে ছাদে গল্প করছিলো। এমন সময় বাড়িতে দুটো ছেলে এসেছিলো কিছু জিনিসপত্র দেওয়ার জন্য। কথা বলার সময় হাত নাড়তে গিয়ে মেহরোজের পেটের থেকে শাড়ির অংশটুকু সরে যায় এতে তার পেটের অংশটুকু উন্মুক্ত হয়ে যায়। ছেলেগুলো এটা দেখে হা করে তাকিয়ে থাকে আর একে অপরকে বলতে থাকে,

দোস্ত, মালটা জোস!

এসবের কোন কিছুই তূর্যের দৃষ্টিগোচর হয় নি। সেই রাগ থেকেই রোজের সাথে তার এই ব্যবহার!

তোদেরকে মাফ করবো? আর আমি?

ভুল হয়ে গেছে তূর্য ভাই, আর কখনো হবে না। এবারের মতো মাফ করে দেন।

তূর্য এখন আর মাফ করতে জানে না। মাফ করা তো সে সেদিনই ভুলে গেছে যেদিন তার সাথে সবচেয়ে বড় অন্যায় হয়েছিল!
তূর্যের চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

ছেলেগুলোর আর বুঝতে বাকি রইল না যে তাদের কপালে কি আছে। তূর্য অন্য একটা লোককে ডেকে কিছু বলে সেখান থেকে বেড়িয়ে এলো। শুনতে পেল ছেলেগুলোর কাতরানোর কন্ঠধ্বনি।

রাত প্রায় আড়াইটা! গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আমি। হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমি শূন্যে ভাসছি কিন্তু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ায় আমার মন চোখ খুলতে সায় দিলো না। খানিকক্ষণ বাদে টের পেলাম কেউ আমার হাতে পরম যত্নে একের পর এক চুমু এঁকে দিচ্ছে। আমি ভয় পেয়ে চোখ মেলে তাকালাম,‌ আবছা আলোয় তূর্যের মুখ খানিকটা বোঝা যাচ্ছে। আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছেন তিনি। আমি তৎক্ষণাৎ উঠে বসলাম। সে আমার একদম পাশ ঘেঁষে বসে পড়লেন। হঠাৎ সে বললো,

বউ!

তার কথায় আমি শিহরিত হলাম।

সে আমার গাল স্পর্শ করে বলে উঠলো,

বউ! খুব লেগেছে তাই না, আ’ম সরি। তোমার সাথে রাগ দেখানোটা আমার ঠিক হয় নি।

আমি আরেক দফা আশ্চর্য হলাম। এই রাগ করলেন এখন আবার সরি বলছেন। মানুষটার ব্যবহার আমার ঠিক বোধগম্য হলো না। আসলে কি করছেন উনি?

বউ! আর কখনো তোমার সাথে এমন করবো না, প্রমিজ। আর কখনো না। সরি, সরি, সরি, সরি, সরি।

আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে আবার বললো,

বউ!

হুম।

হঠাৎ করেই তূর্য আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন।

বউ! মাথাটা খুব ব্যাথা করছে, একটু হাত বুলিয়ে দেবে?

তার আদুরে গলার আওয়াজ শুনে শিহরিত হলাম।
সে আমার এক হাত টেনে নিয়ে মাথায় দিতে দিলো, আমি পরম যত্নে বিলি কাটতে লাগলাম। সে চোখজোড়া বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার মুখে ক্লান্ত ভাব ফুটে উঠেছে। হঠাৎ মনে পড়লো তার হাতের কথা, অনেকটা কেটে গিয়েছিলো তো তখন। আমি তার হাতের দিকে নজর দিতেই দেখলাম ব্যান্ডেজ করা‌। আমি তার মাথায় হাত বুলোতে থাকি। হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কখন যে ঘুমের সাগরে পাড়ি দিলাম বুঝতেই পারলাম না।

সকালে উঠে নিজেকে কারো বাহুডোরে আবদ্ধ অবস্থায় দেখে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। বেশ শক্ত করে আমায় জরিয়ে ধরে গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছেন তূর্য। তার ফর্সা মুখটা কেমন যেন লাগছে, ক্লান্ত ভাব তাতে স্পষ্ট। তার এলোমেলো চুলগুলো কপালে নেমে এসেছে। অজান্তেই আমার হাত সেদিকে চলে যায়, চুলে হাত বুলিয়ে সেগুলোকে আরো এলোমেলো করে দেই আমি।এখন পুরো বাচ্চাদের মতো লাগছে তাকে। আলতো হেসে তার নাক টেনে দেই আমি। সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ খুলে তাকালো আমি বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। কি করবো বুঝতে পারছি না, সে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে এখন। এখন কি হবে? কি করবো আমি?

চলবে…….

(অনুগ্ৰহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন হয়েছে জানাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here