স্নিগ্ধ আবেশে তুমি পর্ব -৭

#স্নিগ্ধ_আবেশে_তুমি
#তানজিনা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_০৭

বিকেলে বাগানে ঘুরছি আমি, বাগানে দাড়িয়ে বিগত দিনগুলোর কথা চিন্তা করছি আমি। দেখতে দেখতে পু্রো একটা সপ্তাহ কেটে গেল। এই একটা সপ্তাহে জীবনের বহু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি আমি। এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা, অন্যরকম অনুভুতি। এই দিনগুলোতে সবার আপন হয়ে উঠেছি আমি। কিন্তু তূর্য মানুষটার ব্যবহার ঠিক কিরূপ তা এখনো বুঝতে পারলাম না, এই রাগ আবার এই পানি। তার ব্যবহার ও কথাবার্তা আমার কাছে অজানা রহস্য। তাকে বুঝা আমার জন্য কঠিন। কেন যেন ভালো লাগছে না এখন। মিফতা ঘুমোচ্ছে, তূর্য এখনো বাড়ি আসেন নি। রেহানা চাচি কেন জানি তাদের গ্ৰামের বাড়িতে গেছেন, কি যেন সমস্যা হয়েছে তাদের জমিজমা নিয়ে।মেঘমুক্ত সুনির্মল আকাশে গাঢ় নীল ব্যাপ্তি আর ব্যঞ্জনা! শরতের ছোঁয়ায় শিশির ভেজা ঘাসে কোমল শিহরণ। শরৎ মানেই শিউলি ঝরা সকাল লাবণ্যের জোয়ার। হালকা চপল মেঘ ও রৌদ্র লুকোচুরি খেলছে আকাশ মাঝে। শিউলি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশটায়। এ বাড়ির বাহির দেখলেই লোকে বুঝতে পারবে বাড়ির মালিক কতটা সৌখিন। হরেক রকমের দেশি বিদেশি ফুল আর ফলের চাষ করা হয়েছে বাগানটাতে। আমার মনে হয় বাড়ি থেকে এ বাড়ির বাগানটাই বেশি বড়। বাগানে ঘুরতে ঘুরতে শুনতে পেলেন এক মোহনীয় কণ্ঠস্বর, হ্যাঁ এটা তূর্যের কন্ঠস্বর।

মেহু! কি করছো?

পিছন ফিরে দেখলাম তূর্য। তাকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে, তার ফর্সা মুখটা মলিন হয়ে আছে। তার কন্ঠস্বর কেমন যেন ক্লান্তি মিশ্রিত। সারাদিন পরে শেষ বিকেলে বাড়ি ফিরেছেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারাদিন অনেক পরিশ্রম করেছেন। আমাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি বললেন,

মেহু! এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?

কিছু না তো।

এখানে কি করছো?

ভালো লাগছিলো না তাই এখানে এসে দাঁড়িয়েছিলাম।

ওহ্, আচ্ছা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি তুমি খাবার রেডি করো খুব খিদে পেয়েছে।
বলেই তিনি চলে গেলেন। আমিও তার পিছু পিছু বাড়িতে প্রবেশ করলাম।‌ বাড়িতে গিয়ে আমি রান্না ঘরে ছুটে গেলাম। খাবার গরম করে টেবিলে নিয়ে রাখলাম। সবকিছু রেডি করে বসে থাকলাম কিন্তু তূর্যের আশার কোন লক্ষণ দেখলাম না। আমি উপরে ঘরে চলে গেলাম। তূর্য চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছেন। সে তো ফ্রেশ হয়ে নিচে যাবে বলেছিলো কিন্তু হঠাৎই এমন শুয়ে আছেন কেন? কি হয়েছে? আমি তাকে ডাকতে থাকলাম।

আপনি খাবেন না? তার কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। এভাবে কয়েকবার ডাকতে থাকলাম কিন্তু তিনি কিছুই বলছে না। আস্তে আস্তে তার দিকে অগ্ৰসর হলাম কিন্তু তিনি তো সেভাবেই শুয়ে আছেন। কোন হেলদোল নেই তার। আমি কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে তার গা স্পর্শ করলাম, জ্বরে তার গা পুড়ে যাচ্ছে। বেশ অবাক হলাম এই তো আমার সাথে কথা বললো হঠাৎ করে জ্বর কেন এলো? আমি তার পাশে বসে পড়লাম, জ্বরে সে বেঘোর। তাড়াতাড়ি করে তার গায়ে একটা কম্বল দিয়ে দিলাম। এরপর তার মাথায় জল-পট্টি দিতে থাকলাম। তার কোন সাড়াশব্দ নেই, একেবারে নিরব হয়ে শুয়ে আছেন। আমার বেশ ভয় লাগছে, হঠাৎ করে এতো জ্বর কেন এলো?

রাত প্রায় বারোটা বেজে গেছে, কিন্তু তূর্যের জ্বর এখনো কমে নি। আমি পাশে বসে বসে মাথায় জল-পট্টি দিচ্ছি। আমার পাশে মিফতা বসে আছে। জ্বরটা না কমলেও তূর্য এখন নড়াচড়া করছেন। এপাশ ওপাশ করছেন আর জ্বরের ঘোরে মায়ের নামে প্রলাপ বকছেন। বার বার তার মুখ থেকে মা মা প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। বেশ চিন্তা হচ্ছে এখন। ডাক্তার ডাকতে চাইলেও তূর্য বারণ করে দিয়েছেন। তিনি নাকি এমনিতেই ভালো হয়ে যাবেন। খানিকক্ষণ পরে আমি মিফতা কে ঘুমিয়ে পড়তে বললাম। মিফতা প্রথমে না যেতে চাইলেও আমার কাঠ কণ্ঠের কথা ফেলতে পারলো না‌। তূর্যের মাথায় কাছে বসে আছি আমি।

হঠাৎ তূর্য কাতর কন্ঠে বললেন, মেহু! অনেক রাত হলো তো ঘুমোও।

আমি কিছু না বলে, কাপড় ভিজিয়ে আবার তার কপালটায় রেখে দিলাম। তূর্য আবার বললেন, রাত জাগলে তোমার অসুখ হবে।
আমি বেশ আশ্চর্য হলাম। আজব মানুষ তো নিজের গায়ে কেমন জ্বর এর উপর আমার চিন্তায় মগ্ন।
আমি বললাম, আমার কিছু হবে না আপনি ঘুমোনোর চেষ্টা করুন।
তিনি বললেন, এই পিচ্চি আমার সেবা করতে গিয়ে তোমার কিছু হোক তা আমি চাই না, চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো।
আমি তার কথার কোন পরোয়া করলাম না। ঠাঁয় বসে থাকলাম। এবার তিনি বললেন, মেহু! তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমার কিছু হবে না। এই যন্ত্রনা আমি সহ্য করতে অভ্যস্ত।
মানে? কি বলতে চাইছেন উনি? বুঝতে পারলাম না। আমি হালকা ধমকের সুরে তাকে বললাম, আপনি আর একটা কথাও বলবেন না, চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়েন।
সে আমার কথায় হাসলো। চোখ বন্ধ করে দিয়ে বললো, মেহু! এই জ্বরে আমার কিছু হবে না। আর তো মাত্র কয়টা দিন, এর পর সবচেয়ে কঠিন যন্ত্রনার সম্মুখীন হতে হবে আমাকে। তখন কি করবো? তুমি কি সাথে থাকবে আমার?
তার চোখ দুটো দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। তাকে উল্টো প্রশ্ন করলাম, কি বলছেন আপনি? মানে কি? এভাবে কথা বলছেন কেন? সে আমার কথায় মুচকি হেসে বলল, কিছু না পিচ্চি। আমার মস্তিষ্ক তার কথার কোন উত্তর আবিষ্কার করতে পারবো না। তিনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন আমাকে? কি যন্ত্রনার কথা বলছেন?

মেহু!

সে আবারো ডাকছে আমাকে। আমি সায় দিলাম।

মাথাটায় প্রচুর যন্ত্রনা হচ্ছে। একটু হাত বুলিয়ে দিবে?

তার আদুরে কণ্ঠ শুনে আমার হাত তার মাথায় চলে গেল।আমি নিঃশব্দে তার মাথার সিল্কি চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। হাত বুলোতে বুলোতে এক পর্যায়ে বুঝতে পারলাম সে ঘুমিয়েছে। রাত প্রায় তিনটা বেজে গেছে আমারও প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘরের এক প্রান্তে বসানো সোফার উপর গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম তূর্য নেই। আমি বিছানার উপর শুয়ে আছি, নিশ্চয়ই এটা তূর্যের কাজ। গায়ের কাপড় এলোমেলো হয়ে আছে, ইস বেশ লজ্জা লাগছে। তূর্য আমাকে এভাবে দেখেছেন, এখন তার সামনে যাবো কিভাবে?
ঘুম থেকে উঠে ওয়াসরুমে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখলাম খাটের উপর একটা ছোট ছেলে বসে আছে। ছেলেটা আমাকে দেখে হাসছে সে খাট থেকে নেমে আমাকে এসে জরিয়ে ধরলো আর বললো, মামতি।
আমি তো অবাক‌। এটা কে? এখানে কেন? ছেলেটা আমাকে বললো, কুলে নেও আমাতে। ছোট বাচ্চাদের আমার খুব ভালো লাগে তার উপর এতো সুন্দর করে আমার সাথে কথা বলছে। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। ভারী মিষ্টি ছেলে, খুব সুন্দর করে কথা বলছে। আমি ওকে কোলে করে খাটে বসে পড়লাম।
হঠাৎ রুমের দরজা ঠেলে তূর্য প্রবেশ করলেন সাথে একটা মেয়ে। একে দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে। সে আমাকে বললো, ভাবি চিনতে পেরেছো আমাকে? মনে পড়লো একে তো বিয়েতে দেখেছিলাম। আমি বললাম, জ্বি, কেমন আছেন আপু?
এই তো ভালো, আপনি?
জ্বি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
এই হচ্ছে তূর্যের ফুফাতো বোন আলিশা রহমান। তার মানে ছেলেটি তার।
তূর্য বললেন, মেহু! এদিকে এসো।
আলিশা আপু বললেন, ভাইয়া কি রে তুই? পড়ে তোর কথা শুনবে আগে ভাবীর সাথে কথা বলে নেই। বিয়ের দিন তো চলেই গেলাম। এখন সুযোগ হয়েছে এসেছি আবার কবে না কবে আসবো। তুই যা,
তূর্য মুখটা মলিন করে চলে গেলেন। তার মুখ দেখে বেশ হাসি পাচ্ছে আমার। মুহূর্তেই মনে হলো কাল রাতের কথা তার জ্বর কমে গেছে?

তূর্য বাড়িতে নেই বর্তমানে।
আলিশা আপু, আমি আর মিফতা অনেক ধরে আড্ডা দিলাম সাথে সায়ান ভাইয়া (আলিশার স্বামী) ছিলেন। ড্রইং রুমে সবাই মিলে গল্প করছে আমি সাফিনকে কোলে নিয়ে বসে আছি একপাশে। হঠাৎ সদর দরজায় খেয়াল হতেই দেখলাম তূর্য বাড়িতে প্রবেশ করছেন। হাতে অনেক গুলো প্যাকেট। আমায় চোখের ইশারায় তার কাছে যেতে বললেন আমি সাফিনকে কোল থেকে নামিয়ে সেদিকে গেলাম। সে প্যাকেট গুলো আমার হাতে দিয়ে দিলো।

সবাইকে খাবার দাও।

আপনি বাহির থেকে খাবার আনতে গেলেন কেন? আমিই তেরি করতে পারতাম।

সে মুচকি হেসে বলল, আমার পিচ্চি বউটার তো অনেক কষ্ট হতো। আর আপাতত আমি এটা চাচ্ছি না। খাবার দাও।

আমি সবাইকে নাস্তা সার্ভ করলাম। প্রতিটা সময় তূর্য আমার দিকে চেয়ে ছিলেন।

স্নিগ্ধপরী! বার বার কেন তোমার প্রেমে পড়ে যাই? তোমার নেশায় কেন এতোটা আসক্ত আমি। আমার প্রতিটি আবেশে তুমি, আমার #স্নিগ্ধ_আবেশে_তুমি। তোমার মায়ায় আবদ্ধ আমি। তোমায় ছাড়া আমি কি করে থাকবো? থাকতে পারবো আমি?

চলবে……

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here