‘স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-১

0
4353

‘স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘
লেখিকা ~নাঈমা হোসেন রোদসী

১.

ধোঁয়া ওঠা গরম গরম পিঠা তৈরি করে পাশের কাসনে রেখে তাওয়া নামিয়ে রাখলেন বিভা। জিনিসপত্র গুলো ঠিকঠাক করতে নিতেই কোথা থেকে দৌড়ে এসে পাশের মোড়াটায় ধপ করে বসলো পায়রা। একবার শ্বাস ফেলে বিভাকে বললো-
‘মা, তারা বুবুকে নাকি আইজকাও দেখতে আসবো?’

বিভা মেয়ের কচি হাতে দুটো পিঠা ভরে দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বললেন –
‘তোর বুবু বড় হইসে। বিয়া তো দেওন লাগবোই ‘

পায়রা পিঠাগুলো মুঠ করে ধরে জোর গলায় বললো –
‘কিন্তু মা সামনে তো বুবুর এইচএসসি পরীক্ষা। এহন বিয়া দিলে তো আর বুবু পরীক্ষা দিতে পারবো না ‘

বিভা রেগে তাকালেন৷ ছোট মেয়েটা কার মতো হয়েছে তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। বড় মেয়েকে একশো বেতের ঘা দিলেও টু শব্দ বের হবেনা মুখ থেকে অথচ ছোট মেয়েটা মাটিতে কথা পড়ার আগেই জবাব দিয়ে দেয়। তাওয়া নিচে রেখে সনের রান্নাঘর থেকে বের হলেন বিভা। মাকে উঠতে দেখে পায়রাও পিছন পিছন এলো৷ মায়ের আচল ধরে চিল্লিয়ে বললো-
‘মা,তারা বুবুরে এহনই বিয়া দিওনা! বুবুর স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া ‘

বিভা পায়রার চুলের মুঠি ধরে গালে এক চড় বসিয়ে দিলেন। গাল চেপে ধরে বললেন –
‘বেশী বাড় বাড়িস না পায়রা। চুপচাপ ঘরে গিয়া তোর বুবুরে বল তৈরি হইতে ‘

পায়রা ফুঁপাতে ফুঁপাতে টিনের বড় ঘরটায় একটা লাথি দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। তারা শাড়ি পড়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো। পায়রাকে কাঁদতে দেখে কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো –
‘কিরে পায়রা? মা বকসে? ‘

পায়রা টলমল চোখে নিজের বড় বোনের দিক তাকালো। তারা হেসে পায়রার চোখ মুছিয়ে কপালে চুমু খেলো। শূন্যে দৃষ্টি রেখে বললো –
‘ আমার জন্য আর কত মাইর খাবি? আম্মায় আমারে কয়দিন পরই বিয়া দিবো। আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন
আর পূরণ হইবো না ‘

পায়রা তার বোনের মলিন মুখটার দিক নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো। কান্না থামিয়ে উঠে বসলো। গায়ের জামাটা টেনে উঠে বুবুর হাতটা কোলে নিয়ে বললো –
‘বুবু,তুমি পালায় যাও। ‘

তারা স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হুহা করে হাসলো। পায়রার ফর্সা টলটলে গালটা আলতো টেনে বললো-

‘তা কী আর হয়! বিয়া তো একদিন করতেই হইবো। এহন তোর পনেরো চলে কয়দিন পর তোরও বিয়া হইবো। ‘

পায়রা ক্ষোভ মেশানো কন্ঠে বললো –
‘নাহ আমি বিয়া করুম না। আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করুম ‘

তারা উঠে দাড়িয়ে শাড়ির কুচি ঠিক করলো তারপর কিশোরী পায়রার রাগে লাল হয়ে আসা মুখটার দিক তাকিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলে মায়ের কাছে যেতে যেতে বললো-
‘স্বপ্ন তো আমিও দেখসিলাম। কিন্তু সবার স্বপ্ন তো আর পূরণ হয়না রে। ‘

পায়রা একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। বোনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বিরবির করে বললো –

‘ বুবু তোমার স্বপ্নও তুমি পূরণ করতে পারতা। কিন্ত মানুষের ভয়ে তা করলা না। তুমি যা করতে পারলা না তা আমি করুম বুবু। আমার স্বপ্ন বড়, মেলা বড় ‘

২.

তুহিন! এই তুহিন!

দিপালী হায়দার গলা উচিয়ে বার কয়েক ডাকলেন৷ হাতের টিফিন বক্সটার ঢাকনা লাগিয়ে সামনে আগালেন । তুহিন বাহিরে যাচ্ছিলো।মায়ের ডাকশুনে ফিরে আসলো। হাতের টিফিন বক্সটা দিপালী ছেলের হাতে দিয়ে বললেন –

‘যা, এটা তোর নানার বাড়িতে দিয়ে আয়। সেমাই করে দিয়েছি। ছোট ভাইটার সেমাই খুব পছন্দের। ‘

তুহিন অসহায় মুখ করে বললো –
‘মা,আমি পায়রাদের বাড়ি যাচ্ছিলাম’

দিপালী রেগে গেলেন। তুহিনের দিকে তেড়ে এসে বললেন-‘শুধু পায়রা আর পায়রা! প্রতিদিন ওই বাড়িতে কী?এত বড় হয়েছিস অথচ আগের মতোই গাধা রয়ে গেলি। ‘

তুহিন মুখ কালো করে টিফিন বক্স নিয়ে হাঁটা ধরলো ।
আজ আর বোধ ওই বাড়ি যাওয়া হবেনা। মা তো আর জানেনা ওই বাড়িতে কী?জানলে হয়তো আর যেতেই দিতো না। সেই ছোটবেলা থেকেই পায়রাকে পছন্দ করে তুহিন। ছোট্ট পায়রার এক বেলা দেখা না পেলে দিনটা পানশে হয়ে ওঠে। কিন্তু মা কী তা বোঝে? তাকে নানা বাড়ি না পাঠিয়ে বড় ভাই তুষারকেও তো পাঠাতে পারে!কিন্তু মা শুধু তাকেই পায়।
নানা বাড়িতে গিয়ে টিফিন বক্স দিয়ে তাড়াহুড়ো করে দিয়ে চলে এলো তুহিন। আজ একবার সে যাবেই। লুকিয়ে চুপিয়েই যেতে হয় তাকে৷ কেউ যদি একবার তাকে দেখে ফেলে তারপর সেই কথা যদি মায়ের কানে যায় তাহলে কী যে করবে! দিপালী আর পায়রার মা বিভার মাঝে অনেক আগে থেকেই চলে তুখোড় তর্কাতর্কি। তুহিন কাদার মধ্যে থাকা ইটের সাড়ি পাড় করে টিনের বড় বাড়িটায় উঁকি দিলো। বিভা বাড়ি নেই। পাত্রপক্ষের জন্য মিষ্টি কিনতে দোকানে গেছে। ঘরে বসে তারা শরবত বানাচ্ছিলো৷
তুহিনকে উঁকি দিতে দেখে মাথায় কাপড় টেনে এগিয়ে এলো। তুহিন তারাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো –

‘তারা বুবু, পায়রা কই? ‘

তারা মুচকি হেসে বললো –
‘কী ব্যাপার তুহিন সাহেব? প্রতিদিনই দেখি পায়রার খোঁজ করো। রহস্য রহস্য গন্ধ পাই ‘

তুহিন মাথা চুলকে হাসলো৷ লজ্জা ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো-
‘ধ্যাত! তারা বুবু বলোনা ‘

তারা সাবলীল ভাবে বললো –
‘মন খারাপ হলে যেখানে যায় সেখানেই ‘

তুহিন ভ্রু কুঁচকে আগ্রহ নিয়ে বললো-
‘কী নিয়া মন খারাপ? ‘

‘তা তোমার পায়রারে গিয়াই জিগাও ‘

তুহিন চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে চলে যাচ্ছিলো। পেছনে থেকে তারা আবার ডাকতেই পেছন ফিরলো। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তারা আমতা আমতা করে মৃদু স্বরে বললো -‘তুষার দাদা কেমন আসে? ‘

তুহিন মুখ ফুলিয়ে বললো- ‘ সে ভালোই আসে। নবাব মানুষ কী আর খারাপ থাকে! মায়ের বড় আদরের পুত্র সে ‘

তারা তুহিনের কথায় যেনো তৃপ্তি পেলো না। আসল কথাটা তো আর জানা হয়নি এখনো। হালকা অস্বস্তি নিয়ে আবার বললো-
‘ মানে শরীর ঠিক আছে তো?অনেক দিন হইলো রাস্তার এই পাড়ে আসে না। তাই আর কি ‘

বোকা তুহিন তারার প্রশ্ন করার কারণও জানতে চাইলো না। সে শুনতে চিন্তায় আছে পায়রার কী নিয়ে মন খারাপ । আনমনা হয়েই উত্তর দিলো –
‘নাহ শরীর ঠিকই আসে৷ দাদারে মা বিলেত পাঠাইবো৷ ওইহানে চাকরি তো চারটি খানি কথা না। তাই ঐসব নিয়া একটু ঝামেলায় আসে আরকি। আমি গেলাম বুবু,ভালো থাইকো ‘

তুহিন যেই রাস্তা দিয়ে এসেছিলো। সেই রাস্তা দিয়েই চলে গেলো। তারা সেই দিক থেকে চোখ সড়িয়ে খাটে গিয়ে বসলো। আঁচলের কোণা দিয়ে চোখ মুছে জানালার ফাঁকে মাথা ঠেকিয়ে নিভু গলায় বললো –

‘আপনে কী আর আইবেন না তুষার ভাই? আপনার আকাশের তারারে নিজের মধ্যে লুকাইবেন না? আপনার তারা যে ভালো নাই’

পায়রা শিমুল গাছটার নিচে বসে হাতে একটা ডাল ভাংছিলো। আসন করে বসে ডালটা টুকরো করতে করতে হাজারো চিন্তা ভাবনা করছিলো। তুহিন দৌড়ে এসে পাশে বসলো। পায়রা একবার তাকিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো। তুহিন গলা খাঁকারি দিয়ে বললো -‘কীরে পাখি? মন খারাপ ক্যান?’

পায়রা অতিগম্ভীরতার সঙ্গে বললো-
‘তুহিন দাদা,তোমরে কে কইলো আমার মন খারাপ? ‘

তুহিন হাসিখুশি হয়ে উত্তর দিলো –
‘তোর মন খারাপ আর আমি জানুম না? ‘

পায়রা তুহিনের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শক্তগলায় বললো-
‘আমার মন খারাপ দেইখে তুমি হাসছো?’

তুহিন হকচকিয়ে উঠে দাড়িয়ে গেলো। তোতলানো গলায় তাড়াহুড়ো করে বললো-‘না না, কী বলিস এসব পাখি?তোর মন খারাপ দেখে হাসবো ক্যান! ‘

পায়রা নিজের বড়বড় পাপড়িতে ঘেরা ডাগরআঁখি দিয়ে তুহিনকে ভস্ম করে দিতে চাইলো৷ রাগ হলেই পায়রা একা সময় কাটাতে বড় ডালপালায় ভরপুর শিমুল গাছটার নিচে বসে থাকে৷ কিন্তু রাগ কমার আগেই যদি কেউ সামনে আসে পুরো রাগটা সেই ব্যাক্তির উপর ঝেড়ে দেয়। তুহিনকে চোখ রাঙিয়ে বড়বড় পা ফেলে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। তুহিন মুখ কালো করে বার কয়েক ডাকলো। ফর্সাত্বকের উপর হলদে ফুটে থাকা জামাটায় থাকা পায়রা রাস্তার ওপারে চলে গেলো।
পাশেই একটা বৈরাগী মহিলা বসে ছিলো তুহিনের মুখটা দেখে হুহা করে হেসে টিটকারী করে জিহ্বা বের করে বললো-
‘কাজ হইবোনা! তোর মতোন হ্যাঙলার জইন্য কী আর পায়রা সুন্দরী বইয়া আসে নাকি!’

বৈরাগী ভেংচি কেটে যেতেই তুহিন গাছটার শেকড়ে সর্বশক্তিতে লাথি মেরে দিলো। শেকড়ের বোধ হয় কাঁচকলাও হলো না৷ কিন্তু তুহিনের বুড়ো আঙুলটার নক ভেঙে উল্টো হয়ে গেলো। পা ধরে দাপাদাপি করতে করতে পায়রার বাড়ির দিকে তাকিয়ে রাগে দুঃখে নিজেকে শান্তনা দিয়ে বললো-

‘ সুন্দরী মেয়েরা একটু ভাব নেবেই তাই বলে আমি পিছিয়ে যাবো! সুন্দর বউ পেতে হলে একটু কষ্ট করতেই হয়। কষ্টের ফল মিষ্টি হয় ‘

তুহিন নিজেকে শান্তনা দিতে দিতে চলে যেতেই বৈরাগী সেদিকে একবার তাকিয়ে পুকুরের সিঁড়িতে বসলো৷ চোখে জল চিকচিক করছে। মুক্ত দানার মতো গড়িয়ে পড়তেই নিজমনেই অস্পষ্ট স্বরে বললো –

‘আকাশের উড়ালপথ এখনও বহুবাকি। ভবিতব্য তার নিজ গন্তব্য লিখছে’

[নোট পড়বেন সবাই]
চলবে…
এসে গেলো নতুন গল্প। আশা করি এবারও সবাইকে সাথে পাবো৷ নতুন যারা আছেন তাদেরকে ধন্যবাদ। আর পুরোনো পাঠকগণকেও অসংখ্যা ভালোবাসা। নিজের মন্তব্য জানাবেন অবশ্যই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here