‘স্বপ্নচূড়ার আহ্বান’
পর্ব-১১
অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তার আশেপাশে থেকে ভেসে আসছে ঝিঝি পোকার ডাক। গাছের ডালে দুই জোড়া পেঁচা জ্বলজ্বলে অক্ষিপুটে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি নিচের দিকে দুই জন অচেনা মানব-মানবীর উপর। গ্রামাঞ্চলের দিকে সাতটা বা আটটা সাধারণত অন্ধকার হয়ে থাকে। বাসের হর্ণ পিপ পিপ করে বেজে উঠতেই ধ্যান ভাঙলো নীলাংশ। বাসের ড্রাইভার অনবরত হর্ণ বাজিয়ে চিল্লাচ্ছে। নীলাংশ ঘোরে ছিলো। মেয়েটার মুখের একপাশ কাছে থেকে দেখে বেশ ভালোই বোধগম্য হলো, মেয়েটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় সুন্দরীর পর্যায়ে পড়ে। খুব কাছ থেকে দেখলে উপরের দাগটা চোখে পড়ে না। তখন মনে হয় সুশ্রী সুদর্শনা মুখের উপর কোনো হালকা প্রলেপ ঢেলে দেয়া হয়েছে। নিজের পকেট থেকে রুমালটা নিয়ে মেয়েটার মুখ যত্নশীল হস্তে আলতো করে মুছিয়ে দিলো। নিচে পড়ে থাকা পানির বোতলটা থেকে অল্প কয়েক ফোঁটা মুখে ছিটাতেই নাক মুখ কুঁচকে নড়েচড়ে উঠলো মেয়েটা। নীলাংশ মৃদু কন্ঠে বললো-
‘উঠুন প্লিজ, বাস নাহলে আমাদের ছেড়েই চলে যাবে।’
কারো গলার মোহনীয়তায় মোড়ানো টুকরো টুকরো আওয়াজ চোখে মুখে বাড়ি খেলো পায়রার। নারীমনের কোনো এক ভিতরের সত্ত্বা টের পেলো কোনো পুরুষ তার উপর ঝুঁকে আছে, আর তার গরম নিঃশ্বাস তার মেয়েলি শরীরের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। চেতনা ফিরে আসতেই হড়বড় করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো পায়রা। নিজের মুখটাও ঢেকে নিলো। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা যত ভালোই হোক সবশেষে তো অপরিচিতই ৷ পরিচিত মানুষও যেখানে রূপ পাল্টে ফেলে সেখানে অপরিচিত মানুষকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তার। পরপর এতগুলো ধাক্কা কাটিয়ে উঠতেও তো সময়ের প্রয়োজন কিন্তু সেই সময়টাও জুটছে না। শুকনো মুখেই ঢোক গিলে নিয়ে বললো-
‘আসলে, শরীরটা ভালো লাগতেসিলো না। কেমনে জানি.. ‘
কথা শেষ করার আগেই নীলাংশ থামিয়ে দিলো। আস্বস্ত করার কন্ঠে বললো-
‘এত বিব্রত হওয়ার মতো কিছু হয়নি তো মেয়ে! পানি পান করবে? ‘
পায়রার সত্যিই একটু পানির প্রয়োজন। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। চোখ তুলে পিপাসী গলায় বললো –
‘হ, পানি খাবো। ‘
নীলাংশ নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রাখা পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললো –
‘ টেক ইট। আর পানি পান করা হয়, খাওয়া না ‘
পায়রা কিছুটা লজ্জিত হলো। সে তো জানে পানি পান করা হয় তারপরও মাতৃভাষা বলেও যে একটা বস্তু আছে। হঠাৎ করে আর বলা যায় না। ছোটবেলা থেকেই যে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে তা হুট করে বদলানো সম্ভব না। লজ্জা পেলেও মাথা নুয়ালো না সে, হালকা জেদি আপসহীন গলার স্বরে বললো-
‘জানি আমি। ‘
কিশোরী মেয়েদের যে অভিমান, রাগ দু’টোই বেশ গাঢ় তা জানে নীলাংশ। মেয়েটার জলন্ত চকচকে নিখুঁত চোখ দুটোই বলে এরা ভীষণ জেদী, প্রতিবাদী, অভিমানী। হয়তো কোনো কারণে মেয়েটা চুপচাপ আছে কিন্তু সত্যিকারে চুপ থাকার মেয়েও নয়। কীভাবে যেন বুঝতে পারলো নীলাংশ, ভেবে নিজেও অবাক হলো। আচ্ছা মেয়েটার নামটা তো জানা হলো না! কৌতুহল বশত নীলাংশ বললো-
‘তোমার নাম কী? ‘
পায়রা পানির বোতলটা আটকিয়ে নিলো। এগিয়ে দিয়ে বললো-
‘পায়রা ‘
নীলাংশ মনে মনে নামটা দুই তিন বার আওড়িয়ে নিলো৷ বেশ পছন্দ হলো তার। মনে হলো নামটা যেনো এই মেয়েটার জন্যই তৈরি। অদ্ভুত সুন্দর। চোখদুটোও তো মেয়েটার পায়রার মতোন। চোখের পলকেও এক ছন্দপতন আছে৷ নিজে উদ্ভট চিন্তায় খানিকটা লজ্জিত হলো। পরক্ষণেই বোতলটা নিয়ে বললো-
‘তো পায়রা, চলো বাসে উঠি। অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। ‘
পায়রার সায় দিয়ে বাসে উঠলো৷ জামেল ঘুমাচ্ছেন বলে কিছু টের পাননি৷ পায়রা আগের সিটে গিয়ে বসলো। নীলাংশ বাসে উঠে ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললো। সামনেই ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছে তেজসী। হতাশ হয় নীলাংশ, এই মেয়েটার মনটা খারাপ না, বুদ্ধিতে মরিচা ধরেছে। নাহলে, ভূত ভূত করে কেউ এভাবে চিল্লায়! নিশানের জন্য মায়া হয় তার। না জানি, সারাজীবন কীভাবে সামলাবে এই কম বুদ্ধির মেয়েকে ৷ দুই পা এগিয়ে পায়রার পাশের সিটে বসলো। পায়রা আগের মতোই নিঃশব্দে বাহিরে তাকিয়ে আছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাসের হালকা আলোয় আবছা দেখাচ্ছে সব। তারপরও এই অন্ধকারই চোখে আরাম দিচ্ছে। পাশে যে ছেলেটা বসেছে বুঝতে পারে সে৷ নাম জানা হয়নি তার। কী হতে পারে নামটা! অবচেতন মনে প্রশ্ন আসে। ছেলেটার ব্যবহার ভদ্র। তাঁরা বুবু বলতো পায়রার চোখ খুব ভালো পর্যবেক্ষক। সহজেই নাকি মানুষ চেনে। কম বয়সেই বোধবুদ্ধি হয়েছে। বুকের মধ্যেখানে
তীর লাগার মতো তীক্ষ্ণ ব্যাথায় ভার হয়ে ওঠে পায়রার। তাঁরা বুবুকে দেখে না খুব বেশি দিন হয়নি। তারপরও মনে হয় যেনো যুগ যুগ পার হলো। মুহুর্ত গুলো যদি ফিরিয়ে আনা যেতো তবে পায়রা আবার ফিরিয়ে আনতো। অজান্তেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়ায় অশ্রু। তাঁরা বুবুকে এই জন্মে আর ভুলবে না সে!
নীলাংশ নিজের ব্যাগটা থেকে একটা বক্স বের করলো। তার মা বাহিরের খাবার খেতে নিষেধ করে। যা যা নীলাংশের পছন্দ হয়,তা নিজ হাতে বানিয়ে দেন। আসার আগে কেক সহ হালকা পাতলা স্ন্যাকস
নিয়ে এসেছিলো৷ তার মধ্যে একটা বাক্সে কয়েক টুকরো কেক রাখা আছে ৷ সে নিজের খাওয়ার জন্য কেক বের করেনি। করেছে পাশে বসা পায়রার জন্য।
সে নিজমনেই ভাবলো, মেয়েটার মুখ শুঁকনো শুঁকনো লাগছে। অনেকক্ষণ যাবৎ না খাওয়া বোধ হয়। আচ্ছা, বাস ভাড়া দেয়ার সময় তো দেখলো একটা লোক ওর ভাড়া দিয়ে দিচ্ছে। নীলাংশ ভাবে, হয়তো লোকটা পায়রার বাবা। তাহলে, এই ছোট মেয়েটাকে কিছু না খাইয়ে কী করে এতটা পথ নিয়ে আসে! কিঞ্চিৎ মনঃক্ষুণ্ন হলো সে। কেকের বাক্সটা পায়রার দিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে চমকে উঠলো৷ এ কি! মেয়েটা কাঁদছে কেনো! সে তো এতক্ষণ খেয়ালই করেনি। দ্বিধা দূরে সরিয়ে পায়রার দিকে একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো –
‘তোমার ক্ষিধে পেয়েছে? ক্ষিধে পেলে বুঝি বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলো পিচ্চি! ‘
চলবে…
কাল থেকে গল্প নিয়মিত আসবে। রিসপন্স বেশি হলে একটা বোনাস পার্টও পেতে পারেন। আজ থেকে আমার ব্যস্ততার ইতি হলো। এটা দ্রুত শেষ হলে, নতুন গল্পও শুরু হয়ে যাবে।