“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান ”
পর্ব-১২
বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে তব্দা খেয়ে কান্না বন্ধ করে দিলো পায়রা। ভেজা চোখে পুতুলের মতো অনুভূতিহীন ভাবমূর্তিতে তাকালো পাশে বসা ছেলেটির দিকে। ক্ষুধার তাড়নায় তার পেট গড়গড় শব্দ করছে ঠিকই কিন্তু তাই বলে কাঁদার কারণ হবে! ছেলেটা কী তার কান্নাকে টিটকারি করলো! নাক টেনে নিলো সে। চোখ বড়বড় করে শাসানোর ভঙ্গিতে বললো –
‘ এই! আপনে কী কইলেন! পিচ্চি কারে কন? ‘
পায়রার শাসানোতে ফিক করে হেঁসে ফেললো নীলাংশ। সে জানতো, এমন করে বললে মেয়েটা আর কাঁদতে পারবে না। ভেজা পাপড়িতে বেশ লাগছে মেয়েটাকে ৷ কেনো জানি কাঁদতে দেখে খারাপ লাগছিলো। গ্রাম্য ভাষা মেয়েটার মুখে বেশ ভালোই মানায়। একটু অন্যরকম ভঙ্গিতে কথা বলে। নীলাংশ হাস্যজ্জ্বল ভঙ্গিতে নিজের হাতের মুঠোয় রাখা কেকের বাক্সটা থেকে এক টুকরো কেক পায়রার মুখের সামনে ধরে বললো-
‘খেয়ে নাও পিচ্চি, ছোটদের খালি পেটে থাকতে নেই। ‘
পায়রা সচকিত হয়ে ছেলেটার মনকাড়া হাঁসির দিকে তাকিয়ে ছিলো। পুরো চেহারায় একটা আদুরে ভাব খেলা করে বেড়ায়। বোঝাই যায়, তিল পরিমাণ আঁচড়ও এই শরীরে পড়েনি। ছেলেদের চোখে মুখে শক্ত শক্ত একটা ভাব দেখা যায় সাধারণত, ইনি ব্যাতিক্রম। চমৎকার করে হাঁসে ছেলেটা। মুখের সামনে কেক ধরায় কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত বোধ করলো। সে যে গ্রামের মেয়ে। কোনো ছেলে মুখের সামনে যদি এভাবে কেক ধরে লজ্জা তো সে পাবেই।
কিন্তু শহরের আধুনিকতার ছোঁয়ায় এ যে বড়ই স্বাভাবিক। তাই তো নির্দ্বিধায় নীলাংশ হাত তুলে রেখেছে। পায়রার এমন অস্থির চাহনিতে ভ্রু কুচকে বললো-
‘কী হলো? খাও! ‘
পায়রা অস্বস্তি নিয়েই মুখ অল্প একটু হা করে কেকটা মুখে পুরে নিল। অল্প খানিকটা খেয়েই কোনমতে বললো-
‘আর লাগবো না, পেট ভরসে। ‘
নীলাংশ হালকা বকা দেয়ার মতো বললো-
‘ মিথ্যা কথা বলো! এইটুকুতে বুঝি পেট ভরে? লায়ার ‘
কথায় অধিকারবোধ যেনো ঠিকরে পড়লো। পায়রার মনে হলো মানুষটা তাকে অনেক আগে থেকেই চেনে।
কত সুন্দর আপনের মতো খাওয়াচ্ছে! ভালো লাগে পায়রার। নীলাংশ আরেক টুকরো বাড়িয়ে দিতেই সে ঝটপট খেয়ে নিলো। কেকের শেষ কামড় দিয়ে পায়রা
হাত দিয়ে মুখ ঝাড়তে ঝাড়তে বললো-
‘আপনের নাম তো কইলেন না! ‘
নীলাংশ টিফিন বক্সটা সাইড ব্যাগে রেখে মোবাইল বের করে মা কে ফোন দিচ্ছিলো ৷ সকাল থেকে আর কথা হয়নি। নিশ্চয়ই মা চিন্তা করছে। ডায়ালে প্রেস করতে নিয়েও পায়রার প্রশ্নে মোবাইলটা পকেটে গুঁজে রাখলো। পায়রার জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললো-
‘তোমার কী মনে হয়? আমার কী নাম হবে? ‘
পায়রা চিন্তায় পড়ে গেলো৷ নাম কী করে আন্দাজ করবে সে! তার তো নামই মাথায় আসছে না। ছেলেটার দিকে তাকালে মন মস্তিষ্কে শুধু একটা শব্দই আসে ‘সুন্দর সুন্দর সুন্দর ‘ অনবরত ঘুরপাক খেতে থাকে। হালকা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ঘন পাপড়িতে ঘেরা ছোট ছোট চোখ, থুতনির নিচে সৌন্দর্যে মোড়ানো টোল, নাকের ডগায় গাঢ় তিল। কোনো কিছু না ভেবেই পায়রা ফট করে মুখ ফসকে বললো-
‘সুন্দর সাহেব? ‘
নীলাংশ স্থির হয়ে তাকালো। ‘সুন্দর সাহেব?’ নামটা তার মনে বারবার ধাক্কা দিয়ে উঠলো৷ আচ্ছা তাকে এমন নাম কেনো দিলো মেয়েটা! আগ্রহী দৃষ্টি দিয়ে বললো-
‘পিচ্চি! আমাকে এই নাম কেনো দিলে? ”
পায়রা বেখেয়ালির মতো করে বললো –
‘আমাগো গেরামে বিদেশ থেইকা এক বিলেতি আইসিলো। তেনারও আপনের মতো হলুদ ফর্সা ত্বক,
বিদেশি কাপড় চোপড়, আর এমন সুন্দর চুল আসিলো। তেনারে সবাই সাহেব কইতো। আমারও আপনারে দেইখা অমনই সাহেবের মতো মনে হইলো৷ ‘
নীলাংশ নিজমনেই হাসলো ৷ সবকিছুর উর্ধ্বে তার তার ‘সুন্দর সাহেব ‘ নামটাই কানে মধুর মতো থইথই করে নেচে উঠলো।
পায়রা কল্পনার জগৎ থেকে ফিরে আসতেই লজ্জায় জুবুথুবু হয়ে গেলো। কী বেহায়ার মতোই না গড়গড় করে পেটের সব কথা বলে দিলো সে৷ সুন্দর সাহেব, নিশ্চয়ই তাকে ছেঁচড়া মেয়ে ভাবলো। কান দুটো লাল হয়ে উঠলো। নীলাংশ ঠোঁট কামড়ে হাসলো পায়রার লজ্জা পাওয়া মিটমিট করে তাকিয়ে থাকা চোখদুটোর দিকে। স্বাভাবিক ভাবে বললো –
‘আমার নাম যদিও সুন্দর সাহেব নয়, তবুও হলে খুব একটা ক্ষতি হতো না। ‘
পায়রা আরও কিছুটা লজ্জিত হলো। তারা খেয়ালই করেনি রাত অনেকটা হয়ে এসেছে। নীলাংশ, পায়রা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লো ৷ সবাই ভেবেছিলো রাতের মাঝেই পৌঁছে যাবে কিন্তু এত জ্যাম যে পৌঁছাতে প্রায় সকাল হয়ে গেলো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো পায়রা। সবাই মোটামুটি উঠে পড়েছে। বাস থেমে গেলো গন্তব্য পৌঁছে। পায়রা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো পাশে বসা ছেলেটা এখনও ঘুমাচ্ছে। পায়রা ইতস্তত করে ডাকলো। নীলাংশ কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। ব্যাগপত্র নিয়ে নিচে নামলো। অন্য বন্ধুরা আগেই নেমে গেছে। জামেল পায়রার ব্যাগ নামিয়ে দিয়ে পাশের দোকান থেকে কিছু খাবার আনতে গেলেন। পায়রা বাস থেকে নেমে একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে। মানুষজনের ভীড়ে প্রথমবার পড়লো৷ নীলাংশ বন্ধুদের সাথে কথা বলছিলো। একটু দূরে পায়রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে আসতে বললো। মেয়েটাকে অল্প সময়েই বেশ আপন আপন মনে হলো তার। পায়রা কিছুক্ষণ পর কাছে আসতেই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো নীলাংশ। তমাল পায়রাকে দেখে প্রায় ক্রাশ খেয়ে ফেললো। মুখ ঢাকা থাকলেও শরীরের গড়নেই বোঝা যায় মেয়েটা সুন্দর।
নীলাংশ নিজেই বললো তাকে পায়রা সুন্দর সাহেব নাম দিয়েছে। তা শুনে তমাল নিজের জামার কলারটা
উঁচু করে চোখে সানগ্লাস পড়ে পায়রার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘তা মেয়ে, আমাকেও একটা নাম দাও দেখেশুনে। ‘
পায়রা তমালের আপাদমস্তকে চোখ বুলিয়ে হঠাৎ হেসে উঠলো। তমাল মুখ কালো করে বললো-
‘হাসছো কেনো মেয়ে? ‘
পায়রা হাসতে হাসতে বললো-
‘আপনার পেন ছেঁড়া ! ‘
চলবে…..