স্বপ্নচূড়ার আহবান
লেখিকা -নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব-২
৩.
টিনচালা ছাদের উপর ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। গুটিয়ে বিড়ালের মতো হয়ে শুয়ে আছে পায়রা। বাজ পড়ার
তীব্র আওয়াজে কিছুক্ষন বাদেই কেঁপে কেঁপে উঠছে। পাশেই তারা ঘুমাচ্ছে। তারার কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে কোনো ছন্দ পতন না ঘটিয়ে হাতে হালকা ভড় দিয়ে উঠে বসলো। পাশের চেয়ার থেকে ওরনা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে উঠে বসলো৷ জানালার পাশে মাথা ঠেকিয়ে পায়রা দূরে দৃষ্টি দিলো। তারার এপাশ ওপাশ করে ঘুম ভেঙে গেলো, পায়রাকে জানালার পাশে বসে থাকতে দেখে উঠে বসলো। পায়রাকে উদ্দেশ্য করে বললো –
‘কীরে পারু! এত রাইতে না ঘুমাইয়া কী করস? ‘
পায়রা একবার তাকিয়ে আবার জানালার দিকে মুখ ফেরায়। মৃদু স্বরে বলে -‘বুবু,তুষার ভাইরে তুমি ভালোবাসো তাই না?’
তারা চকিতে তাকায়। ছোট বোন যে ব্যাপারটা ধরে ফেলবে তারা ভাবেনি। পিছনে বালিশ দিয়ে পিঠ এলিয়ে বসে তারা হালকা করে বললো-‘ হু’
পায়রা জিঙ্গাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে-
‘কেন ভালোবাসো?সে তো অত সুন্দর না৷তবে মানুষটা রসিক ‘
তারা ক্ষনিকের জন্য চোখে হাসলো৷ চোখ বন্ধ করে বললো-
‘ এই তো ভুল আমার। রসিক মানুষের প্রেমে পড়তে নাই ‘
‘কেন?’
তারা উদাস গলায় চোখ খুলে তাকিয়ে বললো-
‘জানিস পারু,সব মানুষরই পরিবর্তন হয়। বয়সের সাথে স্বভাব বদলায়া যায়। কিন্তু, যহন কোনো মানুষের স্বভাবের দ্বারাই আমরা সেই মানুষের প্রেমে পড়ি তখন তার বদলাইয়া যাওয়া আর মানতে পারি না। ‘
তারা শ্বাস ফেলে ভেতরের উত্তপ্ত বাতাস ত্যাগ করে হাসফাস কমাতে চাইলো৷ পায়রা তার বোনের কষ্টভরা মলিন মুখটা দেখে ভেতরে ক্ষোভ জমায়। ভেতরে ভেতরে তুষারকে আচ্ছা করে বকে। তারার কাছে গিয়ে গাল ফুলিয়ে বললো- ‘এবার তুষার ভাই আসলে আমি আচ্ছা কইরা বইকা দিমু।’
তারা পায়রার বাচ্চামোতে হাসলো৷ পায়রার মাথাটা কোলে নিয়ে হাত বুলিয়ে বললো-‘আর যাই হোক, তুই যে এমন ভূল করবিনা তা ঢের জানা আছে৷ শোন পারু রসিক মানুষ যে খারাপ তা কিন্তু না। আসলে মানুষের ভেতরের আত্মারে ভালোবাসতে হয়, তার হাসিরে ভালোবাসতে হয়। এই দুই জিনিস কহনো বদলায় না ‘
পায়রা চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে চোখ বুজলো ঘুমাতে। পায়রা বুঝতে পেরেছে তার বোন অতীত হাতরিয়ে কষ্ট টেনে আনছে। প্রশ্নতে ক্ষত আরও গভীর হবে, যা সে চায়না৷ কিছুক্ষণ বাদেই পায়রা ঘুমিয়ে পড়লো। তারা চোখের পানি মুছে, পায়রার গোল মুখটায় তাকালো। নিচু হয়ে কপালে চুমু খেয়ে হেসে মাথা বালিশে দিয়ে শোয়ালো। আরও কিছুক্ষণ তারা পায়রার মায়াবী ফর্সা মুখটার দিক তাকিয়ে রইলো, পায়রার মুখটাই এমন। কিছু সময় তাকালে প্রশান্তি অনুভব হয়। পায়রা বোধ হয় গ্রামের সুন্দরী দুই মেয়ের মাঝে একজন৷ পায়রা যেমন সুন্দর তেমন লম্বাও বটে। শহরেও এত লম্বা মেয়ে কম পাওয়া যায় । পাঁচ ফুট সাত এর পায়রা। আর একজন সুন্দরী আছে চেয়ারম্যানের মেয়ে। কিন্তু লম্বায় কম, ছোট খাটো পুতুলের মতোন তাই নামও পুতুল। নানান চিন্তায় দু চোখের পাতা একসময় লেগে গেলো৷
৪.
সকালে ঘুম ভেঙে পায়রা স্কুলের জন্য তৈরী হয়ে জুতো জোড়া চাপিয়ে নিচে নামলো। জুতোজোড়া পুরোনো হয়ে গেছে। দুই দিকে ছিড়বে ছিড়বে ভাব।
বাবাকে বলতে হবে নতুন জুতো আনতে। এই ভেবে নিচে বাড়ির উঠানে আসতেই চমকে উঠলো। সামনেই দাঁড়ানো সোহাগ আর তার সাত মাসের পোয়াতি বউ। চমকানোর কারণ তাদের আগমণ নয়৷ শুধু সোহাগের অসহায় মুখটা। সোহাগ যে তার কৈশোরের প্রথম অনুভূতি৷ ছোট বেলায় ভীষণ আদরের ছিলো পায়রা তার চাচাতো ভাই সোহাগের। সোহাগের মনেও ছিলো পায়রার জন্য ভালোবাসা। পায়রার কিশোরী মনে কিছু একটা দোলা দেয় সোহাগের প্রতি৷ কিন্তু সোহাগের সাহস হয়নি পায়রাকে নিজের মনে কথা জানানোর কারণ তার আগেই তার মা তাকে রেশমির সাথে বিয়ে করিয়ে দেন। পায়রা নিজের হালকা অনুভূতি গুলো ধীরে ধীরে ভূলে গেছিলো এতদিনে৷ কিন্তু আজ সোহাগের হঠাৎ আগমন সব যেনো এলোমেলো করে দিলো৷ নিজের মনকে শান্ত করে এগিয়ে আসলো পায়রা। সোহাগের বউ রেশমিকে দেখে প্রশ্ন করলো –
‘ভালো আসেন রেশমী ভাবী?’
রেশমী হেসে বললো -‘আসি ভালাই। কতদিন পর তোমারে দেখলাম৷ মেলা সুন্দর হইয়া গেসো৷ ‘
পায়রা হাসলো। বাড়ির ভেতরে ঢুকতে বলে মাকে ডাকলো৷ তারপর ঘরের ফ্যান চালিয়ে বসতে বললো। সোহাগ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।পায়রা শরবত এগিয়ে দিতেই সোহাগ চোখ নামালো৷ পায়রা আগের থেকে সুন্দর হওয়াটা সোহাগের বড্ড চোখে লাগছে৷ তবে তার নজরে কোনো কামুকতা নেই। আছে এক একগুচ্ছ পিপাসা। এতদিনের সংসারে সোহাগের রেশমির প্রতি মায়া ছাড়া তেমন কিছু জন্ম নেয়নি৷ কথায় আছে না, এক বিছানায় থাকলেই ভালোবাসা হয়না। হাফ ছেড়ে এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পায়রার হাত থেকে গ্লাসটা নিলো৷ পায়রা আর সামনে থাকতে চাইলো না। ভালোবাসা না হলেও কিছু অনুভূতি তো ছিলো৷ কিন্তু মানুষটা এখন বিবাহিত। কিছু একটা বুকে চেপে ধরে। রেশমি এখন সোহাগের বউ। মানুষটা বাবা হবে কিছুদিন পর। তার দিকে তাকানোও পাপ।
‘আসি ‘
বলেই জায়গা থেকে প্রস্থান করলো৷ উঠান পেড়িয়ে আসতেই পায়রা মনে মনে ভাবলো -‘ সোহাগ দাদার জইন্য তো আমার তেমন কিসু ছিলো না তারপরও বুকে কেমন অস্থির ভাব হইতেসিলো। তারা বুবু তো তুষার ভাইরে সবথিকা বেশী ভালোবাসে তাইলে তারা বুবুর কেমন লাগে! ‘
পিছনে একবার তাকিয়ে সামনে আগাতে লাগলো পায়রা। যদি সেই মানুষ গুলো আমাদের নাই হয় তাহলে কেনো তাদের সাক্ষাৎ ঘটে এই ছোট জীবনে। ছোট জীবনে কিছু বিষাদ স্মৃতির জন্যই তাদের আগমণ? এই যে হুটহাট কিছু বিষন্নতা মনের কোণায় দলা পাকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে এগুলো যদি না থাকতো তাহলে সুখের কী মর্ম থাকতো! কালো বলেই হয়তো সাদা আছে। কষ্ট আছে বলেই হয়তো সুখের এত দাম! ছোট ছোট দুঃখ ঘাপটি মেরে বসে বলেই তো আমরা সুখকে বড় ভালোবাসি৷
পায়রা পাশেই পুকুরটার দিক তাকালো। বৈরাগী খালা আজও ঐ জায়গাটায় বসে আছে৷ মাঝে মাঝে পায়রার মনে হয় মানুষটা বড়ই সুখী। এইযে, কাজ কাম নেই৷ সারাদিন বনবাদাড়ে হন্ন হয়ে ঘুরে৷ কেউ বাঁধা দেয়না। মানুষই এসে খাবার দিয়ে যায়। শান্ত পুকুরের পাড়ে মোটা গলার স্বর ভাসায়। কোনো কষ্টই তো নেই। একদিন পায়রাও শলা পরামর্শ করবে বৈরগী খালার সাথে। তাহলে নিশ্চয়ই সেও সুখী হতে পারবে৷ গলা উচিয়ে সেও গান ভাসাবে, আকাশ বাতাস রাঙাবে। কী সুন্দর হবে সে অনুভূতি!
”আহা! আহা সে কী সুখ! ”
বৈরাগী খালা ইশারায় ডাকলো পায়রাকে৷ পায়রা ঝলমলে হেসে আগাতে লাগলো৷ কানে এলো বৈরাগী খালার উচ্ছ্বসিত স্বরের এলোমেলো গান৷
চলবে-