স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-২৩

0
884

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব~২৩

‘কী হলো! ওঠো পিচ্চি। ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? ‘

মাথায় মৃদু টোকা দিতেই পায়রা হুড়োমুড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এতক্ষণের কথা মনে পড়তেই লজ্জায়
কুঁকড়ে যাচ্ছে। ছিহ! কী ভাবলো সুন্দর সাহেব, আর তারই বা কী হয়েছিলো! অমন ঘোর কেনো লাগলো।
নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিলো। চোখ তুলে তাকাতেও কেমন লাগছে। চুপ করে নীলাংশকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে যায় পায়রা।
পায়রার ডাগরডোগর চোখে একরাশ লজ্জা দেখে মিটমিট করে হাসলো নীলাংশ। মেয়েটা দারুণ লজ্জিত হয়েছে। সে মাথার চুলগুলো ঝাঁকিয়ে ঝলমলে ভঙ্গিতে হাসলো। অচেতন মন কোনো অচেনা কারণে ঝুমঝুমিয়ে গাইছে। গাড়ি লক করে দিয়ে পকেটে দুই হাত গুঁজে প্রফুল্ল মুখে পায়রার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
পায়রা রোদে চোখ ছোট ছোট করে, আঙুল কপালে উঠিয়ে কিছু একটা গুণছে। নীলাংশ মৃদু হেসে বললো –

‘কী গুনছো পিচ্চি? ‘

পায়রা বোধ হয় বিরক্ত হলো। সংখ্যা হারিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যে। নীলাংশ বুঝতে পেরে বললো-

‘তোমার স্কুল চৌদ্দ তলা পর্যন্ত, গুণতে হবে না।’

পায়রা মুখভর্তি বিস্ময় নিয়ে তাকালো৷ মাথায় হাত রেখে বললো –

‘খাইসে! চৌদ্দ তালা, এত্ত! ‘

নীলাংশ ফিক করে হেঁসে বললো –

‘হুম, চৌদ্দ তলা। ‘

পায়রা স্কুলের বিশাল গেটটা দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেছে। তখন নীলাংশ হুট করেই পায়রার ডান হাতটা মুঠোয় নিয়ে স্কুলের ভেতর প্রবেশ করলো। পায়রা যেনো ইলেকট্রনিক শক খেলো৷ শরীর রগে রগে কাঁপন ছড়িয়ে গেলো। ইচ্ছে করছে এখনই হাতটা টেনে সড়িয়ে নিতে৷ কিন্তু এক মিশ্র অনুভূতিতে সিক্ত হয়ে গুটিগুটি পায়ে নীলাংশের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলো।
নীলাংশ তাকে স্কুলের নিচতলায় একটা রুমে নিয়ে এসেছে। বেশ বড় একটা কাঁচের কেবিন। কাঁচের দরজার হাতলটা ভেতরের দিকে ধাক্কা দিতেই সামান্য খুলে গেলো। নীলাংশ অনুমতি নেয়ার মতো নক করতেই, মধ্যবয়স্ক একজন লোক হেঁসে ভেতরে ঢুকতে বললো। পায়রার কেমন একটা ভয় লাগছে।
সেই প্রথম বার যখন সে প্রাইমারিতে ভর্তি হয়েছিলো ঠিক তেমন ভয়। সেদিন মাস্টার বাবার স্নেহ ভালোবাসায় প্রথম দিনটা স্মৃতিমধুর হয়ে রয়েছে।

নীলাংশ ভেতর এসে সামনে বসা লোকটাকে সালাম দিয়ে একটা চেয়ারে বসে পায়রাকেও বসতে বললো।
পায়রা দুরুদুরু বুকে মাথা নিচু করে পাশে বসলো। এতক্ষণ যে কারণে তার অস্বস্তিতে গা কাপছিলো, ঠিক সেই নীলাংশের হাতটাই সে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।
নীলাংশ একবার পায়রার দিকে তাকিয়ে তার ভয় বুঝতে পেরে হাত ছাড়লো না। সামনের লোকটি বললেন –

‘তোমার বাবা কালই আমাকে বলেছে, তার মেয়েকে এখানে ভর্তি করাবেন৷ তো নীলাংশ, তোমার বোনের আগের স্কুলের রেজাল্ট কার্ডটা দাও। ‘

নীলাংশ বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো ৷ ‘বোন!’ এইসবের মানে কী! বাবা পায়রাকে তার মেয়ে বলেছে তাতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু, তার বোন কেনো বানাতে হবে! দাঁত চেপে কোনো রকম হেঁসে হাতের কার্ডটা এগিয়ে দিলো। তিনি কার্ডে দুই একবার চোখ বুলিয়ে বললেন –

‘ইম্প্রেসিভ! গ্রামে পড়াশোনা করেও নাম্বার অনেক বেশি। ‘

নীলাংশ পায়রার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। সে আাসার আগেই কার্ড দেখেছে। খুব অবাক হয়েছিলো। পায়রার অতীতের তেমন কিছুই সে জানেনা। শুধু বাবার কাছে শুনেছে পায়রা জীবনটা অনেক স্ট্রাগলের। অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু, পায়রাকে এখন পর্যন্ত নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি৷ যখন ইচ্ছে হবে নিজেই বলবে। এখন পড়াশোনায় এগিয়ে যাক। পায়রাকে দুই তিনটি প্রশ্ন করে অধ্যক্ষ নূর মাহবুব প্রসন্ন মুখেই ভর্তি করার পারমিশন দিলেন। টাকা জমা দিয়েই ভর্তি হওয়া যাবে। কাল থেকে ক্লাস করবে। অবশ্য নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা হতে খুব একটা সময় নেই৷ দুই মাস আছে আর। এই সময় কোনো স্কুলে ভর্তি নেয়া হয়না। কিন্তু,
আয়মান সাহেবের অনুরোধে ও পায়রার মতো মেধাবী
শিক্ষার্থীকে হাতছাড়া করার সাধ্যি নেই বলেই সম্ভব হলো। নূর মাহবুবকে ধন্যবাদ জানিয়ে নীলাংশ আগের মতোই পায়রার হাতটা মুঠোয় রেখে বাহিরে বের হলো।
গেট দিয়ে বের হতেই নীলাংশ বললো-

‘চলো, তোমাকে আমার ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাই। স্কুলে খুব বড় মাঠ নেই। কিন্তু ক্যাম্পাসে আছে। আজ তো আমি ক্লাস করিনি, নোটগুলোও কালেক্ট করতে হবে। ‘

পায়রা খুশি মনেই হ্যা বললো। নীলাংশ পায়রাকে নিয়ে এবার ক্যাম্পাসে ঢুকলো। পায়রা হতবাক হয়ে সবকিছু তাকিয়ে দেখছে ৷ সত্যিই খুব সুন্দর। মাঝখানে একটা ফুলের বাগান ছোট বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা। সবুজ ঘাসে মাটি আবৃত। দূরে বামপাশে সাজানো লাইটিং করা একটা ক্যান্টিন। আর দুইটা ভবন। চোখে ধাঁধা লেগে যায়। এখন দশটা বাজতে আর কিছুক্ষণ বাকি। হালকা রোদ উঠেছে। তাই নীলাংশ পায়রাকে ক্যান্টিনের এক পাশে দাঁড় করালো। কিছু বলার আগেই একটা বন্ধু দূর থেকে ইশারা দিয়ে ডাকলো৷ নীলাংশ পায়রাকে দাঁড়াতে বললো, সে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। নীলাংশ যেতেই প্রবীর সহ আরও বন্ধুরাও আসলো। সবাইকে পায়রার কথা বলতেই ওরা উৎসাহ নিয়ে ক্যান্টিনে গেলো। পায়রার এত মানুষের মধ্যে একটু অস্বাভাবিক
লাগছে। তারপরও হাসিমুখেই সবার সঙ্গে কথা বলছে।
সকাল থেকে পায়রা কিছু খায়নি। তাই নীলাংশ মৃদু হেসে সবাইকে বললো এখন সে সবাইকে ট্রিট দিবে।
এটা পায়রার নতুন স্কুলে ভর্তির উপলক্ষে। সবাই খেতে বসলো। পায়রা নীলাংশের পাশে বসে আছে। নীলাংশ সবার পছন্দ অনুযায়ী খাবারের অর্ডার দিলো। পায়রাকে জিজ্ঞেস করলো কী খাবে। পায়রা সরল মনেই বললো-

‘ভাত খাবো৷ ‘

তিতিক্ষা বার্গারে প্রথম বাইট বসিয়েছিলো মাত্র। পায়রার কথা শুনে হো হো করে হেঁসে বললো –

‘আরে ক্ষ্যাত নাকি! সিরিয়াসলি ভাত! এই যুগে এসেও
এমন কে করে? ‘

নীলাংশ রাগী কন্ঠে বললো –

‘তিতি! তোকে কতবার বলবো কাউকে হেয় প্রতিপন্ন না করতে? ‘

তিতিক্ষা কথাটা কানে নিলো না। মূলত কারীমা আর তিতিক্ষা দু’জনেরই পায়রাকে পছন্দ করেনা। তারা পায়রার প্রতি সবার এত কেয়ার দেখে প্রচুর বিরক্ত।
এই যুগেও নাকি মানুষ বোকার মতো ভাত খেতে চায়! আর ভাত হলো পুরনো যুগের ক্ষ্যাত মানুষের খাবার। মডার্ন যুগে কে খায়! চিরিয়াখানার প্রাণী যত্তসব! কথাটা বিরবির করে বললেও পায়রাসহ সবাই আবছা হলেও শুনতে পেলো। তমাল পাশ থেকে তিতিক্ষার হাত চেপে চুপ করতে বললো। পায়রা মনে মনে কিছুটা ক্ষুন্ন হলো। তার অপমানে নয়। বরং ভাতের প্রতি এতটা অনীহায়।
ভাত ভালো না-ই লাগতে পারে। কিন্তু কোনো খাবারের প্রতি এমন তাচ্ছিল্যতা ভালো লাগলো না। পায়রা তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বললো-

‘আপু আপনার মনে হয় না আপনি নিজেকেই অপমান করলেন? ‘

তিতিক্ষা কড়া চোখে তাকিয়ে বললো-

‘কী বললে? হোয়াট ডু ইউ মিন? ‘

পায়রা হাসলো। ওরনার আড়ালে দেখা গেলো না। গাঢ় গলায় বললো –

‘ আপনাদের শহরের কোনো নিয়ম কানুন হয়তো আমি জানিনা। তবে দেখছি, আপনারা নিজের সংস্কৃতি প্রকাশে বড্ড অনিচ্ছুক। যেখানে বিদেশি মানুষরা গর্বের সঙ্গে নিজের ভাষাকে কোটি কোটি মানুষের সামনে তুলে ধরতে চায়। এটাকে ক্ষ্যাত অথবা বোকামো বলা যায় না। এটা হলো দেশপ্রেম। আমি আমার দেশকে কতটা ভালোবাসি এটি কখনো আমার অসহায়ত্ব বা দুর্বলতা হতে পারে না। আপনি কী জানেন? যেই ভাতকে আপনি অবজ্ঞা করে কথা বললেন। এই ভাতের একটা শিষ উৎপাদন করতে একজন মানুষ ঠিক কতটা পরিশ্রম করে? রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, গাধার খাটুনি খেটে তারপর তৈরি হয়।
ভাতের অভাবে কত মানুষ মারা যায়! ‘

বলে সবার দিকে একবার তাকালো পায়রা। সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পাশের সিটে অন্য মানুষও তার দিকেই নজর দিয়ে আছে। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবারও বললো-

‘শুধু তাই নয়, মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া প্রতিযোগিতার ফাইনালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক নারী কিশোয়ার চৌধুরী পান্তা ভাত তৈরি করে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। কেউ ভাবতেও পারেনি যে রান্নার এরকম একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পান্তা ভাতের মতো একটি আটপৌরে খাবার পরিবেশন করা যায়।
কিন্তু তিনি করে দেখিয়েছেন। অস্ট্রলিয়ার মতো দেশে যদি একজন নারী এতটা গর্ব করে ‘পান্তা ভাত ‘ তুলে ধরতে পারে তাহলে বাংলাদেশেরই একটা সামান্য রেস্তোরাঁ অথবা এই দোকান পাটে কেনো ভাতের নাম নিলে সবার হাসির কারণ হতে হবে?
আর নিজের সংস্কৃতির অবমাননা তো নিজেরই অপমান, সে হিসেবে আপনি নিজেকেই নিজে ছোট করছেন। ‘

সামনের একটা বোতলের ক্যাপ খুলে নিজের মুখের ওরনাটা টেনে সরিয়ে ফেললো সে৷ তার মুখে হাসির আভা৷ মুখের একপাশে দাগটা দেখে নীলাংশ আর তেজসী বাদে সবাই চমকে উঠলো। পায়রা পানিটা পান করে বোতল পাশে রাখতে রাখতে বললো-

‘আমি আমার গ্রামের ভাষা বলে দেখেই যে অশিক্ষিত ছাগল তা ভাবা বন্ধ করুন। আমি আমার গ্রামের ভাষাকে মন থেকে মুছে ফেলতে চাইনা। আর মুখের দাগ কখনোই আমার ব্যাক্তিত্বে প্রভাব ফেলতে পারে না। একজন মানুষের বাহির দেখে ভেতর চেনা সম্ভবও না। এখন থেকে এই দাগও আমি আর ঢাকবো না।
সবাই জানুক, এসিড ভিক্টিমদেরও স্বাধীন স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার অধিকার আছে ৷ কে কী ভাবলো, এতে আমার যায় আসে না৷ জীবনটা যেহেতু আমার, চেহারা আমার তাহলে কীভাবে বাঁচবো সে সিদ্ধান্তও হবে শুধু আমার।’

চলবে….
আলহামদুলিল্লাহ, পেজ ঠিক হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here