“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৩৫
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেললো পায়রা। নীলাংশের চোখ ঘোলাটে হয়ে আসলো। পুরুষ মানুষের কাদতে নেই তাই নীলাংশ কাঁদল না। কিন্তু ভেতরটা খুব খুব পুড়লো। পায়রার পাশে বসে মাথাটা আলগোছে নিজের কোলে তুলে নিলো। পায়রার কান্নার দমক কমেছে কিন্তু চোখ মানা শুনছেনা তাইতো গড়গড় করে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। পায়রা গুটিসুটি মেরে শুয়ে রইলো। নীলাংশ হাত বুলাতে বুলাতে বললো –
‘জানো পিচ্চি, আমাদের জগতের একটা নিয়ম আছে।
এই নিয়ম মেনে যে চলতে পারবে সে টিকে থাকবে। ‘
‘আর যে মানবে না?’
কথার মাঝেই প্রশ্ন করলো পায়রা। নীলাংশ বরাবরের মতোই মৃদু হেঁসে পায়রার ঘন চুলে হাত বুলিয়ে বললো-
‘জগত তাঁকে আরও পরীক্ষা করবে তারপর তাঁকে বাধ্য করবে হারতে। জগত কারো পরোয়া করে না। ‘
‘জগত তো তাহলে বড় নিষ্ঠুর সুন্দর সাহেব!’
বোকা কথায় না হেঁসে পারলো না নীলাংশ। ইচ্ছে করলো পায়রার ফোলা গাল দুটো টেনে দিয়ে চুমু খেতে। দ্বিতীয় ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখলেও প্রথম ইচ্ছেটা পূরণ করে নিলো। হালকা করে দুই আঙুলে টেনে দিলো গাল। পায়রা উঁচু করে গাল ফুলিয়ে তাকালো।
নীলাংশ ফিক করে হেঁসে বললো –
‘জগতের নিয়ম বড্ড সহজ পিচ্চি। যারা দুনিয়াকে ভালোবাসবে তাদের দুনিয়াও সমপরিমান ভালোবাসা ফিরিয়ে দিবে। কিন্তু মানুষ সহজ জিনিসটাকেই কঠিন করতে বেশি ভালোবাসে। ‘
‘যেমন?’
‘যেমন ধরো, একটি শিশু যখন জন্মায় সে কিন্তু একা হয়েই আসে। ধরণী মাতা তাঁকে বুকে জড়িয়ে বড় করে। তাহলে, আমাদেরও তো উচিত আমার ধরণীকে
ভালোবাসা। আমরা এই ধরণীর বুকে অজানা কোনো কাউকে ভালোবেসে যাই। সেই অব্দি ঠিক আছে। কিন্তু
আমরা সেই মানুষটাকে না পেলে ভাবি সব দোষ এই ধরণীর, দোষারোপ করে বলি ‘এই পৃথিবী আমাকে কী দিলো? ‘ অথচ একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারবো, এই পৃথিবী আমাদের কতকিছুই বিনা হিসাবে দিচ্ছে। অক্সিজেন, খাবার, নিজের অগণিত সৌন্দর্য এই মানুষের জন্যই সে বিলীন করে দেয়। অথচ আমরা? এই একটু কিছু হলেই বলি মরে যাবো। পৃথিবীর তো তাহলে অধিকার আছেই একটু অভিমান করার। ‘
‘আমাদের তাহলে কী করণীয়? ‘
‘নিয়তিকে বিশ্বাস করা। আমরা যত ক্ষমতাবানই হইনা কেনো, নিয়তিকে হারানোর ক্ষমতা কারো হবে না। কারণ জন্মের পূর্বেই আমাদের সৃষ্টিকর্তা নিয়তি ঠিক করেই দিয়েছেন। তাই বলে এমন নয় যে, নিয়তি আমাদের সঙ্গে অবিচার করবে। বরং, যা হয় ভালোর জন্যই হয়। যদি আমি সৎভাবে চেয়েও পছন্দের কোন জিনিস না পাই তাহলে বুঝতে হবে আমার জন্য সৃষ্টিকর্তা আরও ভালো কিছু রেখেছেন। নিয়তিতে যদি কোনো কিছু আমাদের পাওয়ার থাকে তাহলে শত বাঁধা অতিক্রম করে তা শুধু মাত্র আমাদেরই হবে। ব্যবধানটা সময়ের। ‘
সবকিছু শুনে পায়রা আনমনে বললো-
‘সুন্দর সাহেব, আমি আমার পুরনো চেহারা কী কখনো ফিরে পাবো না? ‘
নীলাংশ পায়রার দিকে তাকালো। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পায়রা। নীলাংশকে তাকাতে দেখে মন খারাপের সুরে বললো –
‘আমার খুব ইচ্ছে করে সেই পুরনো দিন ফিরে পেতে।
আজ যখন জাফরা মেয়েটা বললো আমার চেহারা দেখলে বমি আসে তখন আমার আফসোস হলো, কেনো আমার সাথে এমন হলো! ‘
নীলাংশ পায়রার দিকে মায়াদৃষ্টি দিয়ে বললো-
‘আমি জানি পিচ্চি, তুমি অনেক সহ্য করেছো। ‘
‘কী জানেন আপনি?’
‘সবকিছু। ‘
পায়রা অবাক হয়ে বললো-
‘আপনাকে কে বলেছে?’
‘বাবা। ‘
‘কবে?’
‘যেদিন তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসলাম। ‘
পায়রা চুপ করে রইলো ৷ তারপর নীলাংশের কোল থেকে মাথা সরিয়ে বালিশে গিয়ে শুয়ে বললো-
‘আপনি এ সময় রোজ পড়াশোনা করেন। দুইটার বেশি বেজে গেলো। আমার জন্য সময় নষ্ট হলো। ‘
নীলাংশ মৃদু হেঁসে বললো –
‘আজ পড়বো না। ‘
পায়রা চোখ ছোট ছোট করে বললো –
‘তো কী করবেন?’
নীলাংশ ভাবছিলো গল্প করার কথা বলবে। কিন্তু পায়রার সন্দেহবাতিক নজর দেখে দুষ্ট হাসি দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পায়রার কাছাকাছি এসে বসলো। পায়রা চোখ বড় বড় করে বললো-
‘একি! আপনি কাছে আসছেন কেনো? ‘
‘কেনো? কাছে আসলে কী হবে? ‘
পায়রার বুকে হাতুড়িপেটার মতো আওয়াজ হচ্ছে। বারংবার ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করছে। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে চেঁচিয়ে বললো –
‘দূরে যান আপনি। ‘
নীলাংশ আরও কিছুটা এগিয়ে আসলো। নীলাংশের তপ্ত নিঃশ্বাস চোখেমুখে লেপ্টে যাচ্ছে পায়রার। পায়রা চোখ খুলে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে থাকলো। নীলাংশ হো হো করে হেঁসে দূরে সরে গেলো। পায়রা বুঝতে পারলো নীলাংশ এতক্ষণ তাঁকে ভয় দেখিয়ে মজা করছিলো। রেগে হাতের কাছে থাকা বালিশটা ছুঁড়ে দিতেই নীলাংশ হাসতে হাসতে বালিশটা মুখে লাগার আগেই ধরে ফেললো। টিটকারি করে বললো –
‘ লাগলো না তো পিচ্চি! ‘
আরেক দফা হেঁসে নিলো সে। পায়রা বালিশ কাঁথা সব ছুঁড়ে দিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো। নীলাংশ উঠে বেরিয়ে গেলো। পায়রা ফিক করে হাসলো।
.
.
কেটে যাচ্ছে মাসের পর মাস। দু’জনের সুপ্ত অনুভূতির প্রকাশ না হলেও দুজনেরই তা জানা। ‘ভালোবাসি’ বলা হয়নি। তবুও দুজনই একে অপরকে নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়ে নির্ঘুম রাতে বিভোর থাকে। নীলাংশ এখন অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ছে ৷ পায়রার এসএসসি শেষ হলো। আজ তাঁর রেজাল্ট দিবে। সকাল থেকেই বেশ ভয়ে ভয়ে আছে । নামাজ তো এমনিতেই পড়ে। রেজাল্টের নাম শুনে আরও বেশি করে পড়া শুরু করে দিয়েছে। নীলাংশ বুঝতে পারেনা হাসবে নাকি কাঁদবে।
দুইদিন যাবৎ এক প্রশ্ন করে করে মাথা খেয়ে দিচ্ছে।
‘আমি যদি ফেল করি? ‘ নীলাংশ যদিও পায়রা ফেল করার ছাত্রী না। শেষ পরীক্ষার সময় পায়রা খুব অসুস্থ ছিলো এই কারণেই পায়রার যত ভয়।
পায়রার দরজা হালকা চাপিয়ে দেয়া ছিলো। অপূর্ব প্রবেশ করলো । এখন অনলাইনের যুগ। পায়রার রেজাল্ট দিবে বলে সবাই ড্রইং রুমে বসে আছে। পায়রা নফল নামাজ পড়ে জায়নামাজটা গুছিয়ে রাখলো। অপূর্বকে গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুক ধকধক করছে পায়রার। নিশ্চিত এতক্ষণে রেজাল্ট দিয়ে দিয়েছে। অপূর্ব পায়রার ওড়নার কোণা ধরে পেচাতে পেচাতে বললো-
‘চলো, তোমাকে ভাইয়ু ডাকছে। ‘
পায়রা ভয়ে ভয়ে বললো-
‘আমার রেজাল্ট কী বেরিয়েছে অপু?’
অপূর্ব মুখটা পেঁচার মতো করে বললো –
‘ভাইয়ু আর বড়বাবাকে দেখলাম তোমার নামে বকাবকি করছে। ‘
চোখের কোণে জল জমলো পায়রার। নিজের থেকে বেশী পায়রা নীলাংশের আর আয়মান সাহেবের চিন্তা করে। এতগুলো টাকা খরচ করে তাঁকে পড়াশোনা করালো। সে যদি একটা ভালো রেজাল্টই না দিতে পারে তবে, এই বাড়িতে আর থাকবে সে। কাঁদো কাঁদো মুখ করে অপূর্বের হাত ধরে ড্রইং রুমে গেলো। সবাই থমথমে মুখ করে বসে আছে। পায়রা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াতেই নীলাংশ গম্ভীর রাগী স্বরে বললো –
‘বসো। ‘
পায়রার ইচ্ছে করলো সব ছেড়ে ছুঁড়ে পালাতে। আফসোস সে পারলো না। বাধ্য মেয়ের মতো বসলো। নীলাংশ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো-
‘এখন যা বলবো পায়রা, তাঁর জন্য নিজেকে প্রস্তুত রেখো। ‘
পায়রা ঘাবড়ে গেলো। এই পর্যন্ত কোনোদিন নীলাংশ তাঁকে নাম ধরে ডাকেনি। খারাপ কিছুর আভাস পেয়ে আনমনেই কেঁদে ফেললো সে৷ নিজেকে শক্ত করে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। নীলাংশ আরও কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো…
চলবে…
বড় করে দেয়ায় একটু বেশি সময় লাগলো।। হ্যাপি রিডিং।