স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৪

0
1514

স্বপ্নচূড়ার আহবান
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~৪

৭.

টানা দুই ঘন্টা মুরগীর মতোন বসে কান ধরে থেকে পায়রার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শিরায় শিরায় ব্যাথা শুরু হলো। না পেরে চোখ থেকে দুই এক ফোটা পানি বের হয়ে গেলো৷ কিছুক্ষণ পরই জামেল স্যার এসে সামনে দাঁড়ালো। ক্লাসের ক্যাপ্টেন শহীদকে সামনে দাঁড় করিয়ে অন্য ক্লাস এটেন্ড করতে গেছিলেন তিনি৷ স্বাভাবিক ভাবেই শহীদও পায়রার মায়া মুখের মায়ায় আটকে আছে তাই শহীদ পায়রাকে বলেছিলো ‘তুই চইলা যা পায়রা, স্যারে জিগাইলে আমি কমু তুই অসুস্থ ছিলি’ কিন্তু পায়রা কিছু বলেনি। তার আত্মসম্মান যে কতটা তা মোটামুটি সবাই জানে তাই শহীদ কিছু করতে না পেরে বারান্দায় পায়রার উপর রোদ পড়ার জায়গাটায় বড় একটা ছালা মুড়িয়ে দিয়েছে। তবুও রোদ না লাগলেও দুই ঘন্টা একনাগাড়ে এভাবে বসলে যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে। অসুস্থতা তো আর সবার মতো পায়রার সুন্দর মুখখানি দেখে মায়া করে চলে যাবে না! তাই অসুস্থতা পুরো দমে ঝেকে বসলো পায়রাকে। মাথা ঘুরিয়ে পড়বে পড়বে ভাব এমন সময় জামেল স্যার এসে হাত ধরে ফেললো। পায়রা স্যারকে দেখে কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়ালো। তিনি পায়রাকে আদেশের স্বরে বললেন-

-‘ যা যা, অনেক হয়েছে৷ আমি তো ভেবেছি তুই বুঝি এতক্ষণে বাসায় চলে গেছিস। এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? আর ক্লাস করা লাগবে না বাসায় চলে যা আরাম কর’

জামেল স্যারের কথা মতো পায়রা মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে চুপচাপ ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো৷ পায়রা যেতেই সেদিক তাকিয়ে শ্বাস ফেললেন জামেল। তিনি মনে মনে পায়রাকে নিজের মেয়ে মনে করেন৷ দীর্ঘ কুড়ি বছরের সংসারে কোনো সন্তান হয়নি তার। ভালোবাসার স্ত্রীকে ছেড়ে দেয়া বা অন্য কাউকে জীবনে আনার মতো সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেননি। সেই চার বছরের গোল ফ্রকের দুই বেণীর পায়রাকে কোলে নিয়ে প্রথম মনে হয়েছিলো সে বাবা হওয়ার আনন্দ পেলো৷ ছোট্ট পায়রার সামনে কখনোই সেই ভালোবাসা তিনি প্রকাশ করেননি। জমা করে রেখেছেন নিজের অতি গোপনীয় ছোট মনে কুঠুরিতে বন্দী করে৷ তাছাড়াও ক্লাসের সবচেয়ে সাহসী মনের মেয়েটাই পায়রা। এরকম কিছু মানুষ আমাদের আজীবন ভালোবেসে স্নেহ করে অথচ আমরা বুঝতে পারিনা। কারণ, হতাশার গান সর্বদাই আমাদের কানের কাছে বাশির মতোন বাজানো হয়।

ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গোসল করে নিলো পায়রা। বের হয়ে চুল মুছতে মুছতে ঘরে যেতে নিতেই কানে এলো কলপাড়ের পিছনের দিকে থেকে ফিসফিস আওয়াজ৷ সন্দেহ নিয়ে উঁকি দিতেই পায়রা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেলো৷ মনে মনে ভাবলো ‘তুষার ভাই! মেলা দিন আগেই তো তুষার ভাইয়ের রিনা আপার সাথে বিয়া ঠিক হইলো তাইলে তারা আপারে এমন কইরা চাইপা ধরসে কেন!’
তুষার তারার বাহু চেপে ধরে কটমটিয়ে বললো-
‘কী শুনলাম এডা তারা? তুই নাকি বিয়া করবি! ‘

তারার চোখে পানি নেই। অথচ মনে হয়েছিলো তারার সে নিজেকে সামলাতে পারবেনা যদি এই মানুষটা সামনে চলে আসে৷ অথচ এখন মনে হচ্ছে ভালোই হলো, এই লোকটাও তো স্বার্থপরের ন্যায় তাকে ছেড়ে বড়লোকের মেয়ে বিয়ে করছে৷ তাহলে,সে কেনো পারবেনা? সামনে দাঁড়ানো নির্দয় মানুষটিকে দেখিয়ে দেবে সে পারে নিষ্ঠুর হতে৷ হাতের বন্ধনী ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে বললো -‘ যা শুনসেন সত্যি। আমি আর আপনার আশায় নিজের জীবন নষ্ট করুম না, আমার স্বপ্ন শেষ হইয়া যাওয়ার পরও আপনারে অন্ধের মতোন আপনারে বিশ্বাস কইরা গেসি আর আপনে টাকা পয়সা দেইখা আমারে ছাইড়া দিলেন! এবার আমিও বিয়া করমু’

৮.
তুষারের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। তার মতে সে তো আর ইচ্ছে করে রিনাকে বিয়ে করছেনা! তার মায়ের জোরে করছে কিন্তু তারা কেনো করবে। বোকা তুষার এ বুঝতে পারলো না যে, সামাজিক দিক থেকে একটা মেয়েকেই সবচেয়ে বেশি প্রেশার দেয়া হয়। রাগে দাঁত চিবিয়ে বললো- ‘তুই এই আশা ভুইলা যা, আমি থাকতে তোর কোনো বিয়া হইবো না। তোর এমন হাল কইরা দিমু যে তুই বিয়ার নাম ভুইলা যাবি ‘

এমন করে শাসানোতে তারা কিছুই বললো না। তার মতে, তুষার হয়তো এমন কিছুই করতে পারবেনা। ভালোবাসার মানুষকে কী চাইলেই আঘাত করা যায়! কিন্তু তারা কী জানে, সে তুষারের ভালোবাসা নয় জেদ মাত্র। ভালোবাসা ছেড়ে দেয়া সহজ হলেও জেদ ছাড়া বহু কঠিন।

তুষার ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে যেতেই তারা দৌড়ে ঘরে ঢুকলো৷ পায়রা দাঁড়িয়ে সবটাই দেখলো। কিছু না বলে ঘরে ঢুকতেই দেখলো, মা ঘর পরিষ্কার করতে করতে বলছে-
‘ পায়রা, আইজ তোর বুবুর বিয়া হইবো। তৈরি হইয়া নিস ‘

পায়রা অবাক হয়ে বললো-
‘কী কও! কাইলই তো দেখতে আইলো। আর আইজ বিয়া! তাও কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া ‘

‘তো কী! ভালাই হইসে। যত কম মানুষ আইবো ততোই ভালা। তোর বোন তো আর তোর মতোন রুপসী না যে মানুষ দেইখা মুখে ফেনা তুলবো। কালা গায়ের রং, বেশি মানুষ আইলে কানপড়া দিয়া বিয়া ভাইঙ্গা দিবো ‘

পায়রা বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থাকলো৷ গমগমে গলায় বললো -‘বুবুরে কালা কও ক্যান মা! বুবুর গায়ের রং তো শ্যামলা ‘

‘শ্যামলা আর কালার মইধ্যে আবার পার্থক্য আসে নাকি?’

পায়রা আর কথা বাড়ালো না। ছোট বেলা থেকে সে নিজের বুবুকে মায়ের থেকে বেশি ভালোবাসে। খেলার সাথি, ঘুমের সাথি, সুখ দুঃখের গল্পের সাথী। নিজের বোনের শ্যাম গায়ের সাথে তাকে মেলালে পায়রার রাগ কষ্ট দুটোই হয়। তারা বুবুকে ছোট বেলা থেকে এত অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে! বুবু কী কখনো সুখ পাবে না! পায়রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে গেলো। সন্ধ্যার সময় কাজী সহ কিছু মানুষজন এলো৷
পায়রা তারাকে সাজতে দেখে বললো –
‘বুবু আমারেও সাজায় দাও’

তারা ছোট বোনের আবদারে হাসলো৷ তার ভেতরের খবর তো কেউ জানে না। যেখানে বিয়ের সাতদিন আগে থেকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়, হলুদ, মেহেদী। মা কত আদর করে মেয়েকে বিদায় দেয় অথচ গায়ের রংয়ের কারণে সে সুখটুকুও তার ভাগ্যে জুটলো না। এই ছোট বোনটা ছাড়া তার আপন বলতে কেউ নেই। মা তো শুধু পণ্য বিক্রির মতো গছিয়ে দিতে চাইছে। চোখে পানিটুকু মুছে হালকা হেসে পায়রাকে পাশে বসিয়ে বললো –
‘একদিন তুইও লাল টুকটুকে শাড়ি পড়বি। রাজকুমার এসে তোকে নিয়ে যাবে। দেখবি একদিন তুই খুব সুখী হবি’
পায়রা গদগদ হয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো-
‘বুবু,তুমি আমাকে ভুইলা যাবা না তো? ‘

তারা ছোট পায়রার মুখ আজলায় নিয়ে অজস্র চুমু খেলো৷ এই আদরের ছোট বোনটাকে কী করে ছাড়বে সে ভেবে পায়না তারা৷ নিজের মাথার ঘোমটাটা পায়রার মাথায় দিয়ে বললো-
‘একদম বউ বউ লাগছে৷ দাড়া আমি আমার মালাটা এনে পড়িয়ে দেই। ‘
বলে তারা অন্য রুমে গেলো মালা নিয়ে আসতে। পায়রা নিজেকে আয়নায় দেখার জন্য উঠে জানালার পাশে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই কোথা থেকে যেন কেউ এক বোতল গরম পানি ছুঁড়ে ফেললো, তা গিয়ে লাগলো পায়রার মায়বী ফর্সা মুখটায়। খেয়াল হলো এটা গরম পানি নয় দগ্ধ করে দেয়ার এসিড।

পায়রা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো -‘মাগোওও’
গলা সহ মুখটা যেনো জ্বলে পুরে ছাই হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মুখটায় কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়লো পায়রা৷ চিৎকার করতে করতে একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো৷ এ যেন, মৃত্যুযন্ত্রনা থেকেও কষ্টকর। পৃথিবী থেকে সকল মায়া যেন পায়রা ধীরে ধীরে ত্যাগ করে চলে যাচ্ছে এক নরকে৷ সেখানে শুধু তাপ আর তাপ!

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here