“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৪৮
ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ স্পষ্ট হয়ে বসে গেছে পায়রার। চোখের জল পড়া বন্ধ হয়ে গেলো। শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো নীলাংশের দিকে। নীলাংশ রাগে জ্ঞানশূণ্য হয়ে থাপ্পড়টা মেরে দিলেও পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলো কী করেছে। আকুতি মেশানো গলায় বললো –
‘সরি পিচ্চি! আমি.. আমি বুঝতে ‘
‘ক্ষমা কেনো চাচ্ছেন? আমার চাওয়া উচিত। এতদিন আপনাদের দয়ায় বেঁচে আছি। এই তো বেশি তাই না? আমি একটু বেশিই আশা করেছিলাম। তার প্রতিদান
ভালোভাবে পেয়ে গেছি। ‘
পায়রা অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। নীলাংশের দিকে তাকাতে ঘৃণা লাগছে তার। নীলাংশ পায়রার হাত ধরতেই পায়রা দুই কদম পিছিয়ে গেলো। ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো –
‘আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টাও করবেন না। দয়া করে একা ছেড়ে দিন। ‘
নীলাংশ পায়রার কথা পরোয়া না করে শক্ত করে জাপ্টে ধরলো। পায়রা ছটফটিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। নীলাংশ পায়রার মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো-
‘এমন করো না পিচ্চি। কথা শোনো আমার। ‘
পায়রা জোরপূর্বক ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরালো।
নীলাংশের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বললো –
‘কী শুনবো! আপনার আর রুশানীর প্রেম কীর্তন শুনাবেন আমাকে! শোনানোর দরকার নেই। মাত্র দুইদিনেই অনেক ভালো করে দেখে নিয়েছি। ‘
নীলাংশ ধাক্কা খেয়ে আলমারিতে হেলে পড়লো। পায়ে ব্যাথা পাওয়ায় রাগ উঠে গেলো। পায়রার দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বললো-
‘ফাইন! তোমার যা মনে হয় তাই। আমি রুশানীর সঙ্গেই প্রেম করছি। অনেক আগে থেকেই। তোমাকে কখনোই ভালোবাসিনি আমি। ‘
বড় বড় পা ফেলে বের হয়ে গেলো সে। পায়রা ডুকরে কেঁদে উঠলো। রাগের মাথায় হয়তো সত্যিটাই বলে দিলো সে। কী করে এতো নাটক করলো! এক নিমিষেই সব স্বপ্ন ভেঙে তচনচ করে রেখে দিলো! নিজেকেই ধিক্কারের পর ধিক্কার দিতে থাকলো।
.
.
.
কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলো পায়রা। সারাদিনটাই তো কান্নাকাটিতে কেটে গেলো। মাথা ব্যাথায় চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। শরীরে জ্বরও এসে গেছে বোধ হয়।
অপূর্ব টেনেটুনে তুললো পায়রাকে। রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ছোট মানুষ বুঝতে পারলো না জ্বরটা। পায়রা নাছোড়বান্দার মতো কিছুক্ষণ শুয়ে ছিলো। কিন্তু, অপূর্বের একটা কথায় উঠে বসলো। তানজিমা নাকি কিছু একটা বলবেন। এজন্য সবাইকে উপস্থিত থাকতে বলেছেন। পায়রার কষ্টে জর্জরিত মনটা ভয়ে আরেকটু কেঁপে উঠলো। না জানি, আবার কী জন্য ডাকছে। বহু কষ্টে উঠে অপূর্বের সাথে ডাইনিং রুমে গেলো সে। আজ সারাদিনে দুপুরের খাবারের পর ঘর থেকে বেরই হয়নি। সবকিছুই শান্ত নীরব। পায়রা টলানো পায়ে বসলো। নীলাংশ অপরপাশে বসে আছে। দেখে মনেই হচ্ছে না যে মাঝখানে এতকিছু ঘটে গেছে। রুশানী তেমন একটা কথা বলেনা। চুপচাপই আছে। চিন্তায় পায়রার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। কম ঝড় তো যায়নি। এখন আবার বড় কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস। সবার খাওয়া শেষ হতেই ড্রইং রুমে বসে তানজিমা গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন –
‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ‘
আয়মান সাহেব বললেন –
‘কী সিদ্ধান্ত? ‘
‘আমি চাই রুশাকে আমার পরিবারের একজন সদস্য করতে। ‘
আয়মান সাহেব প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বললেন-
‘সেটা নতুন করে বলার কী আছে! রুশানী থাকুক সমস্যা কোথায়?’
‘আহা! আমাকে কথা শেষ করতে দাও। আমি বলতে চাইছি, রুশানীর সঙ্গে নীলকে বিয়ে করাতে। ‘
নৈশব্দিক বজ্রপাতে পায়রা চমকে উঠলো। এতক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকলেও এখন সামনে তাকালো। কেউ সেদিকে খেয়াল করলো না,সদ্য যৌবনা মেয়েটার মন ভেঙে চোখ থেকে দুই ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। দুর্বল হাতে মুছে নিলো সে।
আয়মান সাহেব ভীষণ অবাক হয়ে বললেন –
‘কী বলছো! ‘
‘ঠিকই বলছি। তানভীর মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলে গিয়েছিলো আমি যেনো রুশাকে ভালো রাখি। আর নীলের সঙ্গে বিয়ে হলে আমার নীলও ভালো থাকবে। ‘
আয়মান সাহেব কিছু একটা ভেবে বললেন-
‘ঠিক আছে, কিন্তু ওদের মতামতটাও তো গুরুত্বপূর্ণ। ‘
তানজিমা বিজয়ী হাসি দিয়ে বললেন –
‘ওদের সম্পূর্ণ মতামত আছে। ‘
‘কী বলছো! ‘
‘হ্যা, নীলকে আমি আগেই জিজ্ঞেস করেছি ওর কোনো সমস্যা নেই এই বিয়েতে। ‘
আয়মান সাহেব বিস্মিত মুখে নীলাংশের দিকে তাকিয়ে বললেন-
‘নীল বাবা, তোমার উপর কোনো চাপ নেই। বিয়ে সারাজীবনের জন্য একটা বড় সিদ্ধান্ত। তুমি সত্যিই রাজি? ‘
নীলাংশ মৃদু হেঁসে বললো –
‘জ্বী বাবা। এখানে এতো ভাবার কিছুই নেই। আমি রাজি। ‘
রুপসা আর রায়ানা অপর সোফায় বসে ছিলেন। কোনো কথাই তাদের হজম হচ্ছিলো না। রায়ানা বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে গেছে। পায়রাকে ছোট বোনের মতো আদর করে সে। তাই বেশ উদ্বিগ্ন গলায় বললো –
‘ভাইয়া! তুমি সত্যিই রাজি? ‘
নীলাংশ যেনো বিরক্ত হলো। সে নির্বিকার চিত্তে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বললো-
‘বুঝতে পারছিনা। এতো অবাক হচ্ছিস কেনো? ‘
‘তুমি এমন কী করে করতে পারো! ‘
রাগে ফসফস করে বলে ফেললো রায়ানা। নীলাংশ অবুঝ ভাবে বললো-
‘এমন মানে! মম কখনো আমার জন্য খারাপ কিছু করেনা। আমি রুশাকে ভালো রাখবো। ‘
রায়ানা আর সহ্য করতে না পেরে রেগে নিজের রুমের চলে গেলো। রূপসা একবার নীলাংশের দিকে আহত দৃষ্টি দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। আয়মান সাহেবও কিছুটা হতাশ। নীলাংশের আচার-আচরণ দেখে তিনি মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলেন পায়রা আর নীলাংশ, দু’জনকে এক সুতোয় বাঁধবেন। কিন্তু নীলাংশের কথা শুনে আগের ধারণা ভুল মনে হচ্ছে। তানজিমা রুশানী আর নীলাংশকে নিয়ে নানান কল্পনা জল্পনা শুরু করে দিলেন। এক সপ্তাহ পর গায়ে হলুদ তারপর বিয়ে। রুশানী আর নীলাংশের মুখে মৃদু হাসি। পায়রা সবকিছু দেখলো। নির্বিকার চিত্তে উঠে দাঁড়ালো। চোখ মুখ স্বাভাবিক। নীলাংশ আর রুশানীর দিকে এগিয়ে এসে বললো-
‘কংরেচুলেশনস!’
নীলাংশ অবাক হয়ে তাকালো। পায়রার চোখ মুখ তো স্বাভাবিক থাকার কথা ছিলো না। তাহলে!
পায়রা মুখে কৃত্রিম হাসি বজায় রেখে প্রস্থান করলো।
ঘরে এসে লুটিয়ে পড়লো বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
চোখের পলকেই যেনো সাত দিন কেটে গেছে। পুরো বাড়ি রঙবেরঙের বাতিতে ঝলমল করছে। যারা যারা পায়রা আর নীলাংশের সম্পর্কের কথা জানতো তারা সবাই প্রচুর রেগে আছে। নীলাংশের কোনো বন্ধুবান্ধব
আসেনি। ওরা সবাই নীলাংশের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। রায়ানা পায়রাকে এসে খাওয়া দাওয়া করিয়ে দেয়। নাহলে, এক সপ্তাহে একবারও ঘর থেকে বের হয়নি পায়রা। অতিরিক্ত প্রয়োজন হলেই বের হয়,
পুরো বাড়ির আলোকসজ্জা বুকে ছুরিকাঘাতের মতো
ফালাফালা করে দেয় যেনো। তার থেকেও নিষ্ঠুরভাবে কষ্ট তখন পায় যখন দেখে, রায়ানাকে নিয়ে নীলাংশ বিয়ের জামা কাপড় কিনতে বের হয়। হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে। এক সপ্তাহে প্রতি দিনই এসব দেখে পায়রা। মুখ বুঁজে সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। কোনো তৃতীয় ব্যাক্তি হলে এসব ঠুনকো ছিলো। কিন্তু যে মানুষটা তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছিলো সেই যখন এমন বদলে যায়, বুক চিড়ে কান্না বের হয়। সেসব দেখিয়ে কারো সামনে নিজেকে দুর্বল করতে চায়না। রূপসা, রায়ানা, অপূর্ব সারাক্ষণই তার সাথে থাকে। পায়রা হাসেনা, কাঁদেনা। দুই একটা কথা বলে চুপ হয়ে যায়।
সবার জোড়ে রায়ানা আর অপূর্বকেও হলুদে অংশগ্রহণ করতে হলো। রায়ানা বিরক্ত হয়ে শাড়ি পড়ে পায়রার কাছে এসে বিকালের নাস্তাটা দিয়ে দিলো। পায়রার দৃষ্টি হলুদ রঙের শাড়িটির দিকে। সে খুবই স্বাভাবিক ভাবে বললো –
‘রায়াবু, সুন্দর লাগছে তোমাকে। ‘
রায়ানা অবাক হয়ে গেছে। এই কয়দিনে প্রথম নিজে থেকে কথা বললো মেয়েটা। রায়ানা পায়রার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘তুই কী করে সহ্য করছিস এসব! ‘
পায়রা নিঃশব্দে হাসলো। রায়ানার কান্না পায় মেয়েটাকে দেখে। তারও ভালোবাসার মানুষ আছে। কলেজ লাইফ থেকে একজনকে ভালোবাসে সে। তার সাথে হলে হয়তো মরেই যেতো সে। ভাবতেই টলমলে চোখে পায়রাকে জড়িয়ে ধরলো। কান্না মিশ্রিত গলায় বললো –
‘তুই হয়তো জীবনে এর চেয়েও ভালো কিছু ডিজার্ভ করিস বোন। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘
‘হুম, সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘
পায়রার কন্ঠে কিছু একটা ছিলো যা হৃদয় কাঁপালো রায়ানার। কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলো।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো রাত সাড়ে এগারোটায়। রায়ানা আর রূপসা কারোরই তেমন খেয়াল ছিলো না পায়রার কথা। ছাদেই প্যান্ডেল বেঁধে অনুষ্ঠান হচ্ছিল।
ছাদ থেকে নামতেই দুজনের মনে পড়লো। দ্রুত পদে ঘরে ঢুকলো। পায়রাকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পুরো বাড়িতে পাওয়া গেলো না। সবাই একে একে ঘরে এসে দেখে গেলো৷ সব জামাকাপড় জিনিসপত্র একইভাবে পড়ে আছে। শুধু পায়রার গ্রাম থেকে আনা সেই তিনটে জামাই গায়েব। নীলাংশ অস্থির ভাবে পুরো ঘরে সব চেক করলো। পায়রাকে পাওয়া না গেলেও টেবিলে রাখা চিরকুটটা নজরে আসলো। চিরকুট পড়ে নীলাংশ ধপ করে নিচে বসে পড়লো।
‘প্রিয়রা তো আমাদের হৃদয়ের সবচেয়ে উঁচু স্থানে থাকে তাই না? কিন্তু আমি বোধ হয় কখনো আপনার প্রিয়জন হতে পারিনি সুন্দর সাহেব।
আমি নাহয় আপনার জীবনে এক অপ্রিয়া হয়েই থেকে যাবো!’
.
.
.
নিস্তব্ধতা ঘেরা চারপাশ। বাস চলছে অবিরাম গতিতে।
জানালার পাশে মুখ করে বসে আছে এক মেয়ে। হাতে কাপড়ের ব্যাগ। গায়ে পুরনো একটা জামা। অন্ধকারে ঢেকে থাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি অস্পষ্ট করে বললো-
স্বপ্ন ভাঙা ডালা আমার,
প্রেমভরা বুকে।
মরীচিকার আবছা ডাকে,
মরণ হয় সুখে।
সুখের পানে তাকিয়ে রয়
মোর দুই চোখ।
স্বপ্নচূড়ার আহ্বানে ছুটে চলি বহুদূর,
আদৌও মিলবে কী সুখের প্রতিরূপ?
চলবে-
(যখন উপন্যাসটি শুরু হয় তার কয়েক দিন আগে আমি কবিতাটি পোস্ট করেছিলাম ট্রেইলার স্বরুপ।
কেউ বুঝেছে কেউ বোঝেনি। শুরু থেকে যেভাবে সাজানো ছিলো আমি সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি। কেউ হতাশ হবেন না। জীবনটা শুধু এক জায়গায়তেই শেষ হয়ে যায় না। কারো কারো জীবনের সংগ্রামটা অনেক বড় হয়। আশা করি সে পর্যন্ত সবাই পাশে থাকবেন।)