স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৪১

0
882

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৪১

‘আসবো স্যার?’

চেয়ারে হেলান দিয়ে কপালে ডান হাত ঠেকিয়ে বসেছিলেন আভাস। মিহি কন্ঠস্বর কানের পর্দা
ভেদ করে মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই সোজা হয়ে বসলেন।
সামনে তাকাতেই দেখলেন দরজার বাহিরে দুই বেণী করা ধবধবে সাদা বর্ণের কলেজ ড্রেস পরিহিতা পায়রা
দাঁড়িয়ে আছে। হাতের মুঠোয় কিছু পরীক্ষার খাতা।
ক্লাস টেস্ট হয়েছে আজ। পায়রা ক্লাসের প্রথম ক্যাপ্টেন। নিজের গ্রাম্যকালীন সময়ে বাঁদরামি করেই সময় কেটে যেতো। ভালো রেজাল্ট হওয়া সত্ত্বেও এত দায়ভার কাঁধে নিতে চাইতো না। তাইতো, ক্লাসের সবচেয়ে গোবাচোরা শহীদকে সব চাপিয়ে দিতো।
শহীদ খুশিতে আটখানা হয়েই সেসব করতো। ‘ক্যাপ্টেন’ নামটাতেই তো কেমন একটা সম্মানিত ভাব আসে। পায়রা মাঝে মাঝেই স্কুল ফাঁকি দিয়ে মেলায় ঘুরতে চলে যেতো। শহীদকে শাসিয়ে দিতো, যেনো অনুপস্থিতির খাতায় তাঁর সহ বাকি বান্ধবীদের নাম না ওঠায়। শহীদ দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে দিতো। মাসে একদিন অবশ্য ক্লাসটিচারের বেতের কড়া বাড়িও জুটতো। নিজের গলায় ঝুলানো ক্যাপ্টেনের লম্বা ব্যাজটা দেখতে দেখতে আনমনেই হারিয়ে গেছিলো সেসব চাঞ্চল্যকর মধুর স্মৃতিতে। আভাস
পায়রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতরে আসতে বললেন। পায়রা মাথা নিচু করে হেঁটে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পরীক্ষার খাতাগুলো আভাসের সামনে রাখলো। মিনমিন করে বললো –

‘স্যার, সবগুলো খাতাই এখানে আছে। চেক করে দিয়েছি নাম্বার, রোল। ‘

আভাস খাতার দিকে একবারও তাকালেন না। তাঁর দৃষ্টি পায়রার নিচু করে রাখা মুখটার দিকে। পায়রা যখনই তাঁর সামনে দাঁড়াতো সবসময় মুখ উঁচু করে
এক টুকরো সুবাসিত হাসি দিয়ে। চোখ ভরাট থাকতো সম্মানের সহিত। অথচ, গত পরশুদিনের ঘটনাটার পর পায়রা তাঁর দিকে ভালো করে তাকাচ্ছেও না। পায়রা এমনই। যখন কেউ একবার তাঁর বিশ্বাসের জায়গা নাড়িয়ে দেয় তখন দ্বিতীয় বার আর সে জায়গায় কখনো বসার সুযোগ দেয়না। সে ভালো সঙ্গে খুব ভালো। আর খারাপকে বরাবরই এড়িয়ে চলে।

কলমদানি থেকে লাল রঙের বলপেনটা হাতে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে আভাস বললো-

‘গতকাল একবার ডেকেছিলাম বোধ হয়। পরীক্ষার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলার জন্য। ‘

পায়রা তেমন কোনোরকম চমকায়নি, বা অবাকও হয়নি। কাল ইংরেজি ক্লাসের সময় দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন
দিহান এসে বলেছিলো ক্লাস শেষে আভাস স্যার তাঁকে
কেবিনে ডেকেছেন। পায়রা তখন বলেছিলো, সে যাবে। কিন্তু, মনের খচখচানিতে আর যেতে পারেনি। কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁর। আজ তো খাতা জমা দিতে তাঁকে আসতেই হলো। দিহানের উপর তো আর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া যায়না। ব্যাক্তিগত সমস্যাটুকু পাশে রেখে তারপর আসলো পায়রা। এখন কোনোমতে শুধু বের হয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছে সে। জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে বললো-

‘শরীরটা খারাপ ছিলো তো, তাই আসতে পারিনি। ‘

‘ওহ আচ্ছা। ‘

‘তাহলে, আমি আসি স্যার? ‘

তাড়াহুড়ো করে বললো পায়রা৷ আভাস মুচকি হাসি দিয়ে বললো-

‘বসো তো পায়রা। একটু দেখি তোমাকে। ‘

হকচকিয়ে গেলো পায়রা। অকপটে বলা কথাটায় বেশ
খানিকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। কাঁপা হাতে চেয়ারটা টেনে বসলো। নার্ভাস হলে পায়রা বারবার হাত দিয়ে মুখ ঘষে। অতিরিক্ত হড়বড়তায় অজান্তেই মুখে হাত ঘষলো। আভাসের দৃষ্টি নির্লিপ্ত। সে যে কোনো মেয়েকে এমন নার্ভাস করে দিচ্ছে এটা খুবই সাধারণ।
পায়রা পরিস্থিতি সামলাতে বললো-

‘আর কিছু বলবেন স্যার? খাতা পত্র তো দিলামই আর কিছু কী বাকি আছে? ‘

আভাসের মুখের ভঙ্গিমা বুঝতে পারছেনা পায়রা। মনে হচ্ছে এ যেনো লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এর আঁকা “মোনালিসা” চিত্রটি। যার রহস্য ভেদ সম্ভব না। হয়তো সম্ভব, কিন্তু তা পায়রার পক্ষে না। তাঁর জীবনে দেখা সবচেয়ে অদ্ভুত পুরুষ আভাস বোস। গম্ভীর মুখ করেও যে কেউ এত প্রসস্থ হাসতে পারে এই ব্যাক্তিকে না দেখলে সে জানতোই না। আর পায়রার মাথায় এটাও ঢুকছেনা, এখানে হাসার কী আছে! এমন করে মুখ হাসিহাসি করে রেখেছে যেনো এই মুহুর্তে কোনো বিশাল জোকারকে তাঁর সামনে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
তা দেখে মজা নিচ্ছে আভাস। কথাগুলো মনে মনে আওড়িয়ে বিরক্ত বোধ করলো পায়রা। তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার আগেই আভাস বললো-

‘পায়রা, তুমি কী জানো মানবসমাজের সাধারণ বাজে স্বভাব কী?’

পায়রা কিছুক্ষণ ভেবে বললো-

‘না,কী? ‘

‘কোনো ঘটনার মূল ব্যাখ্যা না শুনেই নিজের মতো করে পুরো কাহিনিটা সাজিয়ে নেয়া। আমরা পছন্দ করি, নিজের মনমতো সবকিছু বানাতে সাজাতে। তাতে সত্যিটা বদলে যায় না। সত্যিটা সত্যির মতোই থাকে, শুধু বদলায় দৃষ্টিভঙ্গি। আর তা যখন, আমাদের সামনে আসে, দিয়ে যায় একগুচ্ছ অনুশোচনা। তখন মনে মনে একটা কথাই বলার থাকে ‘ইশ, পুরো সত্যিটা জানা উচিত ছিলো!’

পায়রা তাকিয়ে সবগুলো কথা শুনলো। মনে মনে ভাবলো হতেই পারে সেদিনের ঘটনা গুলোর ভেতরে লুকিয়ে আছে কোনো সত্য। কিন্তু তেমন আগ্রহ বোধ করলো না পায়রা। ঐ যে, সচক্ষে একবার মানুষ যা দেখে তাই তাঁর মস্তিষ্কে সেট হয়ে যাচ্ছে। ভালো ভালো যুক্তিগুলো পায়রার মস্তিষ্কে নেগেটিভ হয়ে ছড়াচ্ছে।
অতিমাত্রায় সুন্দর জিনিস গুলোর মাঝে কিছু খুঁত থাকে। তা জানে পায়রা। আভাসকেও তাঁর কাছে এমনই লাগছে। তারপরও কিছুটা কৌতুহল নিয়ে বললো-

‘আপনি কীসের কথা বলতে চাইছেন স্যার? ‘

আভাস আবারও হাসলো। পায়রা এবার একটু বেশিই বিরক্ত হয়ে গেলো। চুপ করে উঠে দাঁড়িয়ে বিনয়ী হয়ে বললো-

‘আজ আমি আসি স্যার। আপনার শরীরটা মনে হয় খারাপ। কথায় তাল হারিয়ে ফেলছেন। সুস্থ হয়ে বলবেন, আমি আসবো। আমার অপেক্ষায় একজন মানুষ বাহিরে রোদে দাঁড়িয়ে আছে। ‘

কেবিন থেকে বেরিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো পায়রা।
কেমন একটা দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেছিলো।
আভাসের দিকে সে আর ফিরে চাইলো না। চিন্তা করে নিলো, আর দেড় বছর। ইন্টার প্রথম বর্ষের অর্ধেক তো প্রায় কেটেই গেছে। এইচ.এস.সি পরীক্ষাটা দিয়েই
অন্য জায়গায় চলে যাবে। আর কোন রূপ ঝামেলায় পড়তে চায় না সে।
আনমনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বের হলো। হয়তো তখনও পায়রা জানতো না ঝামেলা কখনো মানুষের পিছু ছাড়েনা।

গাড়িতে বসে অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছে নীলাংশকে। পায়রার খারাপ লাগছে। অনুষ্ঠানের যাবতীয় কাজ সেরে আবার আলাদা করে নীলাংশ তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। পায়রা কিছু একটা ভেবে বললো-

‘শুনছেন? ‘

নীলাংশ ড্রাইভ করতে করতে ক্লান্তিমাখা একটা হাসি ফুটিয়ে বললো –

‘বলো, পিচ্চি। ‘

‘প্রতিদিন আমার জন্য এত কষ্ট করার কী দরকার!
আমি নাহয় স্কুল বাসে করেই.. ‘

কথা শেষ হওয়ার আগেই নীলাংশ ভ্রু কুচকে বললো-

‘কোনো দরকার নেই। আমাকে কী তোমার এতো অকর্মণ্য মনে হয়? ‘

‘না না, সেটা বলছি না। আপনার পড়াশোনা করে সব মিলিয়ে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে কষ্ট হয়ে যায়। ‘

নীলাংশ গাড়িটা সাইডে পার্ক করলো। গাড়ি থেকে বের হয়ে দুই কাপ কোল্ড কফি নিয়ে আসলো। আগের বার
পায়রা বেশ পছন্দ করেছিলো এই জায়গার কফি। নীলাংশের তা মনে আছে। কফি এনে পায়রাকে হাতে ধরিয়ে দিলো। পায়রা চুপচাপ খাচ্ছিলো। কফির অল্প খানিকটা ঠোঁটের কোণে লাগতেই পায়রা মুছতে যাচ্ছিলো হাত দিয়ে। কিন্তু তাঁর আগেই নীলাংশ হাত ধরে ফেললো। টিস্যু দিয়ে খুব যত্নে মুছিয়ে দিলো। পায়রার এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে ঠিক করে দিলো। পায়রা নিচু স্বরে বললো-

‘এসবের কী প্রয়োজন? ‘

নীলাংশ মৃদু হেঁসে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বললো-

‘প্রিয়জনকে ভালো রাখাটাই জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ‘

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here