“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৪২
বাড়িতে ঢুকেই নীলাংশ পায়রা চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলো। পায়রা ঘর্মাক্ত দেহে ক্লান্তি নিয়ে নীলাংশের টিশার্টের পিছনের অংশটুকু খানিকটা টেনে
ফিসফিস কন্ঠে বললো-
‘সুন্দর সাহেব! ভেতরে কী হচ্ছে? ‘
নীলাংশ আস্বস্ত করে পায়রার হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললো-
‘চিন্তা করোনা। তুমি ক্লান্ত হয়ে গেছো। যাও রুমে গিয়ে রেস্ট নাও, আমি দেখছি। ‘
পায়রা হ্যা বলে জুতোজোড়া গুছিয়ে রেখে চলে গেলো ঘরে। কাপড়চোপড় পাল্টে বের হতেই দেখলো আয়মান সাহেবের ঘর থেকে তানজিমার কান্নাকাটির আওয়াজ আসছে। পায়রা দ্রুত সেদিকে গেলো। নীলাংশ পাশে দাঁড়িয়ে কাউকে ফোন করছে। রায়ানা দরজার পাশেই ছিলো। পায়রা রায়ানাকে বললো-
‘রায়াবু, কী হয়েছে? ‘
রায়ানা নিচুস্বরে বললো-
‘বড়আম্মুর ছোট ভাই, যে সৌদি আরবে থাকে। তানভীর চৌধুরী সে নাকি অসুস্থ। বড়আম্মু নিজের ভাইকে খুব ভালোবাসেন। তাঁর বউ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। মেয়েকে নিয়েই এতদিন সুদূরে
পড়ে ছিলেন। মেয়ের বয়স কম, আর এই অসুস্থ অবস্থায় দেখাশোনার কেউ নেই। তাই, বড়আম্মু কান্না করছেন। জেদ ধরেছেন, আজকের মধ্যেই আমেরিকাতে যাবেন। ‘
‘কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কীভাবে! ‘
‘ঐ তো,নীলাংশ ভাইয়া ফোন করে টিকিট বুক করছে।’
নীলাংশ ফোন কেটে চিন্তিত কন্ঠে বললো-
‘মম, প্লিজ আর কেঁদো না। রাত একটার একটা ফ্লাইট আছে। সেটাই বুক করে দিয়েছি। ‘
তানজিমা ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছিলেন। নীলাংশের কথা শুনে চোখ মুছে দ্রুত জামা কাপড় গুছাতে শুরু করলেন। পায়রা বুঝতে পারলো, তানজিমা শক্ত মনের হলেও নিজের মানুষ গুলোকে একটু বেশি ভালোবাসেন। কেমন যেন একটা ভয় হলো পায়রার।
এই ধরনের মানুষ গুলো খুবই আত্মকেন্দ্রিক হয়। সবসময় নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতেই বেশি ভালোবাসেন। নিজের চোখে যা ভালো মনে হয় তা বাদে সব ভুল। অন্য কারো ভালো মন্দে তাঁর মাঝে কোনো তফাৎ আসেনা। ভয়টার কারণ বুঝলো না পায়রা। মনে মনে প্রার্থনা করলো, খারাপ কিছু যেনো না হয়।
সেদিন রাতেই তড়িঘড়ি করে সব গুছিয়ে তানজিমা বসে রইলেন। ফ্লাইটের দুই ঘন্টা ধরেই বের হবেন বললেন। সবাই-ই বললো আরও পরে বের হতে। কিন্তু তাঁর মন যেনো অন্য দেশে চলে গেছে। পায়রা, রায়ানা, অপূর্ব এক সাইডে দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্ব বারবার হাই তুলছে। তারপরও পায়রার ওড়নার কোণা ধরে পেচিয়ে হেলে পড়ছে। পায়রা ওর দিকে তাকিয়ে বললো-
‘তুমি ঘুমাতে যাও অপু। স্কুল আছে তো। উঠতে পারবে না। ‘
অপুর্ব এতক্ষণ ঘুমে ঢুললেও এখন দুষ্ট হাসি দিয়ে পায়রার হাত টেনে কানে কানে বললো-
‘আজ আর খুশিতে ঘুম হবে না! ‘
পায়রা ভ্রু কুচকে বললো-
‘কীসের খুশি?’
‘উফ বোকা! বড়আম্মু না থাকলে কোনো কাজে বকা খেতে হবে না। এবার থেকে যত ইচ্ছে আনন্দ করা যাবে।’
পায়রা বড়সড় চোখ করে অপূর্বের গাল টেনে দিয়ে বললো-
‘ওরে দুষ্ট! আগে তো মুখটা করলার মতো করে রাখতে। আর এখন পাকামো! ‘
অপূর্ব একটু লজ্জা পেলো। ইতস্তত করে বললো –
‘একটা কথা বলবো শুনবে?’
‘হ্যা বলো! ‘
‘আবার কষ্ট পাবে না তো? ‘
পায়রা সন্দেহবাতিক দৃষ্টি দিয়ে বললো-
‘বলো কী? ‘
‘আসলে, ইয়ে মানে। আমি যখন মামাবাড়ি থেকে বাসায় ফিরি তখন তোমাকে দেখে নাক ছিটকেছি। খুব একটা পছন্দ করিনি। কিন্তু, একদিন নীল ভাইয়ু বলেছিলো ‘উপর দেখে মানুষের ভেতর নিয়ে মন্তব্য করা পাপ। যাকে এই মুহুর্তে দেখতে অসহ্য লাগছে, হতেই পারে দুই মিনিট বাদে তাঁকেই সবচেয়ে বিশ্বাস যোগ্য মনে হতে পারে ! ‘
তারপর থেকেই আমি বুঝতে পারলাম তুমি মোটেও খারাপ নও। তুমি একটা হোয়াইট ফেয়ারি! ‘
পায়রা অন্য দিকে তাকিয়ে চোখ মুছলো। নীলাংশের দিকে নিগুঢ় চাহনিতে তাকিয়ে রইলো। নীলাংশ তানজিমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পায়রাকে তাকাতে দেখে প্রথমে ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেও পরে স্মিত হাসলো।
পায়রা প্রথম বার লজ্জায় চোখ সরালো না। তাকিয়েই থাকলো বিরবির করে কিছু একটা বললো। নীলাংশ থমকালো। খুশির অশ্রুতে চোখযুগল ভিজে উঠেছে।
দূর থেকেও নীলাংশ বুঝতে পারলো, পায়রা বলেছে-
‘ভালোবাসি! ‘
চলবে-