স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব- ৪৪

0
1046

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৪৪

‘আপনি সত্যিই চলে যাচ্ছেন! ‘

করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো আশরীন। স্বপ্নীল ব্যাগ গোছাচ্ছিলো। তাঁর মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে গেছে এক মাস আগেই। রোজ রোজ মামা ফোন করে বলেন আমেরিকা যেতে। আপনজন বলতে তো একমাত্র সেই মামাই আছে। তাঁর কথা ফেলতে পারে না সে। মাস্টার্স কমপ্লিটের পর সে, রেডিওতেই মনোনিবেশ করেছিলো
কিন্তু এভাবেই আর কতদিন!

সবশেষে ঠিক করলো আমেরিকাতেই যাবে সে। রেডিও এর কাজটা ছেড়ে দিয়েছে। অনেক মেয়ে ভক্তরা ইতোমধ্যে তাঁকে হাজার হাজার ফোন করছে। সেসব কলে এমনেই বিরক্ত হয়ে ছিলো।
হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজ আসে। দরজা খুলতেই আশরীন কথাটা বললো। স্বপ্নীল বারকয়েক শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করলো। বিপরীত ব্যাক্তির প্রতি যদি কোনো অনুভূতি না থাকে তাহলে তাঁর কথাটাও বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। আশরীনের কান্নায় লাল হয়ে যাওয়া মুখটা স্বপ্নীলের হৃদয় কাঁপাতে পারলো না। সে দরজা খুলে বললো-

‘ভেতরে এসে বসো। ‘

আশরীন ধীর পায়ে ভেতরে আসলো। স্বপ্নীল বাসায় একা ছিলো বলে শুধু একটা সেন্ডো গেঞ্জি পড়েছিলো।
হুট করে আসায় সে সুঠাম শরীরে শার্ট জড়াতে জড়াতে আসলো। আশরীন এক ধ্যানে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে থাকলো। মানুষটাকে না দেখে সে কীভাবে থাকবে ভাবতেই বুক ফেটে কান্না আসে। ঠোঁট কামড়ে কান্না রোধ করে। স্বপ্নীল খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বসলো। চোখে মুখে বিরক্তির চিহ্ন। তারপরও শান্ত গলায় বললো –

‘হ্যা, আমি আমেরিকা চলে যাচ্ছি। ‘

‘আবার কবে আসবেন?’

‘দেখি, কবে আসা যায়। ‘

‘আমেরিকা না গেলে হয় না?’

স্বপ্নীল ভ্রু কুচকে তাকালো। আশরীন দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। স্বপ্নীল তাঁর মনের কথা জানে তারপরও এমন ভান ধরে থাকে যেনো সে কিছু বোঝেইনি।
স্বপ্নীল ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই বললো-

‘আমার কিছু কাজ আছে, ব্যাগগুলো প্যাক করতে হবে। ‘

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দাঁড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেলো স্বপ্নীল। অপমান অবহেলায় ভেতরটা থমথমে হয়ে গেলো আশরীনের। মুহূর্তেই মনে হলো, ছেলেটা খুব পাষাণ, খুব! কীভাবে একটা মেয়েকে ভালো মন্দ না বলে ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলো। ভালোবাসাকে পাওয়ার শুধু আর একটা চেষ্টা করবে সে। তারপর সবটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিবে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়ালো । স্বপ্নীল দ্রুত হাতে ব্যাগে জামা কাপড় গুলো ঢোকাচ্ছে। আশরীন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলো। স্বপ্নীল আশরীনকে দেখে তেমন কোনো রিয়েক্ট করলো না। দেখেও না দেখার মতো কাজ করে গেলো। আশরীন নিজেকে আটকাতে পারলো না। মৃদু শব্দে কেঁদে উঠলো। স্বপ্নীল হাতের জামাটা রেখে আশরীনের দিকে তাকালো। অবাক কন্ঠে বললো-

‘এই মেয়ে! কাঁদছো কেনো?’

আশরীন কান্না থামালো না। ভাঙা গলায় বললো –

‘আপনি কী এখনও বুঝতে পারছেন না! ভালোবাসি আপনাকে। ‘

স্বপ্নীল চুপচাপ কান্না দেখলো। নীরবতা কেটে বললো-

‘তোমাকে বলেছিলাম, আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। ‘

‘পায়রাকে তাইনা?’

‘তুমি কীভাবে জানলে! ‘

আশরীন পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হয়ে স্বপ্নীলের কলার ধরে ফেললো। স্বপ্নীল বিস্মিত মুখে তাকিয়ে আছে। আশরীনের চোখে মুখে রাগ।

‘পায়রা আপনাকে ভালোবাসে না! তবুও কেনো এমন করছেন?’

‘পায়রা বাসে না তাতে কী! আমি তো বাসি। এখন ও ছোট। আমি আমেরিকা থেকে এসে ওকে বিয়ে করে নিজের বানিয়ে নিবো। ‘

বুক ভেঙে আসছে আশরীনের। ভালোবাসার মানুষের মুখে অন্য কারো নামই তো সহ্য করা যায় না। সেখানে বিয়ে করার কথা বলছে। আশরীন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে। করুণ স্বরে বললো –

‘মরীচিকার পেছনে ছুটছেন আপনি। বিশ্বাস করুন আমি খুব ভালোবাসি আপনাকে। পায়রা বাসে না, কখনো পাবেন না তাঁকে। মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে একদিন আসল ভালোবাসা হারিয়ে ফেলবেন! ‘

স্বপ্নীলের এতক্ষণে মেজাজ তুঙ্গে। আশরীনের হাতটা ধাক্কা দিয়ে নিজের কলার থেকে সরিয়ে দিলো। আশরীনের দিকে আঙুল উঁচু করে বললো –

‘জাস্ট শ্যাট আপ! এতক্ষণ কিছু বলিনি কারণ তুমি একটা মেয়ে। অনেক দিন যাবৎ আমার পেছনে পড়ে আছো। চুপচাপ বের হয়ে যাও! ‘

আশরীন কান্না করতে করতে আরও কিছু বলতে নিলে স্বপ্নীল হাত শক্ত করে ধরে টানতে টানতে ফ্ল্যাটের বাহিরে এনে দাঁড় করালো। দরজা লাগানোর আগে ঠান্ডা গলায় বললো –

‘ফাইন্ড সামওয়ান বেটার। তোমাকে আমার জাস্ট বিরক্ত লাগে। ভালোবাসা সে তো বহুদূর। ‘

আশরীন কাঁদতে কাঁদতে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে চলে গেলো। একবার শুধু পেছনে ফিরে নিজের উপর হেঁসে বললো –
‘আমি হয়তো বেশি বেহায়া হয়ে গেছিলাম। কিন্তু কী করবো,আমি যে মানতে পারিনা। আপনি কেনো আমার হবেন না!
.
.
.

বারান্দায় দাঁড়িয়ে নতুন নিমগাছটায় পানি দিচ্ছিলো পায়রা। কয়েক দিনেই অনেক গুলো ছোট ছোট পাতা গজিয়েছে। পাশেই নয়নতারা সহ কিছু ছোট ফুলের টব। বারান্দাটা নিজের মনমতো রঙ দিয়ে সাজিয়েছে পায়রা। নীলাংশের ইউনিভার্সিটিতে একটা অনুষ্ঠান আছে। সেখানেই ব্যস্ত সে। পায়রা মনে মনে মিস করছে নীলাংশকে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন পাশের বারান্দায় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে সে টেরই পায়নি। পানির মগটা সাইডে রাখতেই খেয়াল করলো স্বপ্নীল দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দেখতে পাওয়ায় চমকে উঠলো। স্বপ্নীলকে দেখে বললো-

‘আরে! স্বপ্নীল ভাইয়া আপনি! ‘

স্বপ্নীল মৃদু হেঁসে বললো –

‘এসেছি তো অনেক ক্ষণ হলো। তুমি তো গাছের যত্ন নিতে ব্যস্ত। ‘

পায়রা লজ্জা পেয়ে গেলো। না জানি কতক্ষণ ধরে তাঁকে লক্ষ্য করছে! তবুও, এখন আগের মতো খুব একটা বিরক্ত লাগে না স্বপ্নীলকে। মাঝে মধ্যেই দেখা সাক্ষাৎ হওয়ায় গল্প গুজবে বন্ধুর মতো মনে হয় পায়রার। স্বপ্নীল মন খারাপের সুরে বললো –

‘আমি আজ চলে যাচ্ছি পায়রা। ‘

‘কোথায়?’

‘আমেরিকা। ‘

‘কিন্তু হঠাৎ! ‘

‘হুম, আর.জে এর কাজটা ছেড়ে দিলাম। এক মাস হলো রেজাল্টের। নাম্বারও ভালো। তাই মামা, প্রেশার করছে যেতে। ‘

‘ওহ!’

এতদিন কথাবার্তা বলায় অজানা একটা টান অনুভব হলো পায়রার। অবশ্য তা, শুধু মাত্র বন্ধুত্বের জন্যই।পায়রার মন খারাপ লক্ষ্য হতেই স্বপ্নীলের মনটা খুশি হলো। মনে মনে ভাবলো হয়তো পায়রাও তাঁর জন্য কিছুটা অনুভব করে। মন খারাপের ভীড়ে একটুখানি আনন্দ পেলো। হাসিমুখে অনেক আশা নিয়ে বললো-

‘তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো পায়রা? ‘

পায়রা সচকিত হয়ে তাকালো। মুহুর্তেই ভাবলো, কথাটা হয়তো বন্ধুত্বের উদ্দেশ্যে বললো স্বপ্নীল। সে বুঝতেই পারলো না, সামনের মানুষটার কথায় কতটা অসহায়ত্ব ও ভালোবাসা মিশে ছিলো। পায়রা স্বাভাবিক ভাবেই হাসিমুখে বললো-

‘খুব করবো! ‘

সেদিনই দেশ ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি জমালো প্রেমময় যুবকটি। শত শত আশা ভরসা নিয়েই হাসতে হাসতে দেশ ছাড়লো। অথচ সে জানলোই না, তাঁর হৃদয়ের রাণীটি কখনো তাঁর ছিলোই না।৷

চলবে –

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here