“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৪৫
‘কিছু খাবে? মাথা ব্যাথা করছে না তো? ‘
পায়রা বিরস মুখে তাকালো ৷ এ নিয়ে দশবারেরও বেশি জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা। কলেজে পরীক্ষা চলছে। নীলাংশ সারাদিন ভরে খাটাখাটুনি করে, নিজের পড়াশোনা সামলে, মাঝে মাঝে স্যারদের বলায় ভার্সিটিতে জুনিয়রদের ক্লাস করিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। পায়রাকে দেখে চমৎকার হাসে৷ যেনো সব ক্লান্তির অবসান। রাত দুটো বেজে চার মিনিট। পায়রা বলেছে-
‘আপনি যান, ঘুমিয়ে পড়ুন। ক্লান্ত লাগছে না? ‘
নীলাংশ মাথা নাড়িয়ে সুবোধ বালকের ন্যায় ঘরে চলে যায়। এই যেনো সব কথা মেনে নিয়েছে সে। দশ মিনিট যেতেই আবারও ঘুমঘুম চোখে দরজা ঠেলে উঁকি দেয়। ঢুলতে ঢুলতে এসে পায়রার পেছনে দাঁড়ায়। কেটে যেতে থাকে, এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট। পায়রা মাথা উচিয়ে তাকালে বিব্রত হয়ে আবারও হাসে, বলে-
‘তুমি পড়ো। আমি তোমাকে দেখি। ‘
পায়রা চুপচাপ গুণগুণিয়ে পড়ে ৷ নীলাংশ ওভাবেই দু চোখ ভরে দেখে মেয়েটাকে। পড়তে পড়তে এদিকে ওদিকে হেলেদুলে পড়ে। বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ধাঁধিয়ে আসে। মেয়েটা চোখ ডলে, ঠোঁট চেপে টেবিলে রেখে হাই তোলে, পা নাড়াচাড়া করে চেপে বসে। নীলাংশ সবকিছু ঘুমঘুম চোখে মুখস্থ করে নেয়। সবজায়গায় তো এই মেয়েটাই। ঘুমালেও দেখে মেয়েটা স্বপ্নে এসে বিরবির করছে। মাঝে মাঝে মেয়েটাকে নিয়ে কী যে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে! ঘুম ভেঙে যায়, এপাশ ওপাশ ফেরে। মেয়েটার কাছে এসে না দাঁড়ালে বুকটা ছ্যাৎছ্যাৎ করে জ্বলে। এসব তো আর মুখে বলতে পারে না। মেয়েটা কী ভাববে! তারপরও বলতে ইচ্ছে করে –
‘তুমি আমার কাছে এসে বসো পিচ্চি। তোমাকে ছাড়া আমার চোখে ঘুম আসেনা, নিঃশ্বাস আসে না, শরীর ঝিমঝিম করে। মনে হয় এই বুঝি হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাবো! ‘
তবুও বলা হয়না। বুকেই জুবুথুবু হয়ে কথাগুলো লেপ্টে থাকে। না বলা শব্দগুলো বুকে কামড়ে খামচে দেয়। প্রেমের রক্তে রক্তাক্ত বুকে সে নিঃশব্দে বসে থাকে। কত না বলা কথা! পিচ্চিটা পড়াশোনায় ভালো।
তাকেও ভালোওবাসে। শুধু তার মনের উথাল পাথাল ঢেউ টের পায়না। নীলাংশ ঢেউগুলো জমিয়ে রাখে। যদি পড়াশোনা থেকে মনোযোগ চলে যায়! তাহলে তো আর তাঁর পিচ্চির স্বপ্নপূরণ করা হবে না।
পায়রা পড়া থেমে বই থেকে মুখ উঠায়। নীলাংশের শক্ত পুরুষালী হাতটায় নিজের মোমের মতো হাতটা আঁকড়ে ধরে। মিনমিন করে বলে-
‘আপনার শরীর খারাপ হবে না? আমার সুন্দর সাহেব অসুস্থ হয়ে যাবে! ‘
নীলাংশ মলিন হাসে। কোন বাহানা দিয়ে এ ঘরে বসে থাকবে ভাবে। খুঁজে পায়না। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে-
‘তুমি কিছু খাবে, বানিয়ে দেই? ‘
পায়রা না বোধক মাথা নাড়ে। মনে মনে চিন্তা করে, ছেলেটা রান্নার ‘র’ ও জানেনা। কাজের মেয়েকে অর্ডার করলেই তো খাবার হাজির। রান্নাঘরে উঁকি দেয়ার প্রয়োজনটুকুও নেই। তবুও বলে, পায়রার মন ভালো লাগায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
পায়রা মুগ্ধ হয়। নীলাংশের দিকে তাকিয়ে বলে –
‘এখানেই শুয়ে পড়ুন। আমি তো সারারাতই পড়বো। ‘
নীলাংশের মন খুশিতে আকুলিবিকুলি করে। ঘুমে বন্ধ হয়ে আসা চোখ দুটো বন্ধ বালিশে গা এলিয়ে দেয়। এবার সুন্দর ঘুম হবে। পায়রা পড়ে তো একবার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকায়। আধঘন্টা যেতেই নীলাংশ চোখ কচলে উঠে বসে। পায়রার পাশে দাঁড়ায়, দূরে থেকেই মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আদুরে ভাবে বলে-
‘আমি এখানে ঘুমালে তোমার পড়ায় ক্ষতি হবে। আমি বরং ঘরে চলে যাই। তুমি পড়ো। কিছু না বুঝলে ঘরে এসো। তুমি অনেক বড় হবে দেখো! ‘
ঘুমে হেলতে হেলতে সে ঘর থেকে বের হয়। জানে সারারাত আর ঘুম হবে না। বিছানায় ছটফট করে।
লাইট জ্বালিয়ে উঠে বসে। ওযু করে নামাজে দাঁড়ায়।
মোনাজাতেও মেয়েটার দুঃখ লাঘবের আশায় হাত পেতে থাকে। রেজাল্টটা ভালো হলে মেয়েটা খুশি হবে। সেই খুশিটুকুর প্রার্থনা করতে করতে ভোর পর্যন্ত সে জায়নামাজেই কাটিয়ে দেয়।
দরজার আড়াল থেকে পায়রা সেসব দেখে। নতুন ঘটনা তো না! প্রতি পরীক্ষার সময় এভাবেই ছেলেটা রাত কাটায়। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু ভেসে যায়। আনমনেই ভাবে -‘ মুখপোড়া অবহেলিত মেয়েটার জন্য, এত ভালোবাসাও বুঝি কপালে ছিলো! ‘
.
.
.
পায়রার পরীক্ষা শেষ হয়। নীলাংশ মাস্টার্সে পড়ছে।
সময় কাটতে থাকে। পরিবারের সকলের চোখে ধীরে ধীরে নীলাংশ পায়রার সম্পর্ক পরিষ্কার হয়। এলাকা থেকে ভার্সিটির অলিগলি পর্যন্ত পাগল প্রেমিকটার পাগলাটে প্রেমের কথা ছড়িয়ে পড়লো। শান্তশিষ্ট ছেলেটার প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার কথা সবাই জেনে গেলো। অবশ্য তা হবে না কেনো?শেষ পরীক্ষার দিন পায়রা খুশিতে ছাদে ইচ্ছে মতো বৃষ্টিতে ভিজলো। কারো কথায় কান দেয়নি। রাত্রি নামতেই তাপদেবী পায়রায় ভর করলেন। বিছানাও যেনো তাপে পুড়ে যাচ্ছিলো। সেদিন আয়মান সাহেব ঔষধ পত্র এনে দিলেন। রায়ানা জলপট্টি করে দিলো। রূপসা স্যুপ বানিয়ে একটু পরপর খাইয়ে দিলেন। অপূর্ব ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসে ছিলো। আর নীলাংশ! সে কাউকে পরোয়া না করে সারারাত পায়রার হাত ধরে নিঃশব্দে মুখ গুঁজে অশ্রু ফেললো। বিরবির করে বিলাপ করলো-
‘তুমি ভালো হয়ে যাও পিচ্চি! দেখো কখনো বকবো না। ‘
স্যুপ খেয়ে রাতে পাঁচ ছয় বার বমি করলো পায়রা। নীলাংশের উপরেই। নীলাংশ সরলো না, নাক ছিটকালো না। একধ্যাণে রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভাঙা গলায় রূপসার দিকে তাকিয়ে বললো- ‘পিচ্চির খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না ছোটমা? ওর জায়গায় আমার জ্বর হলে কী খুব ক্ষতি হতো! ‘
রূপসা, রায়ানা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো।
সারারাত সেখানে থেকে নীলাংশকে এক পাও সরানো গেলো না। ওখানেই সে বসে বসে জ্বরে নির্জীব মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। নির্দ্বিধায় বমি পরিষ্কার করলো। শেষ রাত হতেই অধৈর্য হয়ে কেঁদে ফেললো ৷ সর্বদা হাসি বিরাজ করা মুখ লাল হয়ে গেলো। কান্নাভেজা চোখে আকুল আবেদন করে বললো –
‘তুমি কোনোদিন দূরে গেলে আমার কী হবে পিচ্চি! ‘
চলবে-