স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৪৬

0
849

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৪৬

ড্রইং রুম ভর্তি মানুষের সমাগম। সোফার হাতলটা ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পায়রা। অনুভূতিহীন পাথরের মতো। অপূর্ব ভ্রু কুচকে সামনে তাকিয়ে আছে। পায়রার দৃষ্টি সামনে। ঠিক নীলাংশ বরাবর। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন তানজিমা। হাতে ডিজাইনার গ্লাস। যার মধ্যে কমলা রঙের জুস দেখা যাচ্ছে। চোখ মুখে ক্লান্তি ভাব ও বিষন্নতা। শরীর শুকনো দেখাচ্ছে। নীলাংশের বুকে গুটিসুটি মেরে বসে আছে অপরূপা সুন্দরী গড়নের একটি মেয়ে। কান্নার দমকে মাঝেমধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছে। নীলাংশ চুপ করে বসে আছে। তেমন কিছু বলছেনা। মেয়েটা হচ্ছে রুশানী চৌধুরী।
বয়স উনিশ বছর। সৌদি আরবেই অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে
পড়াশোনা করছিলো। একমাত্র ভাইয়ের মৃত্যুর পর ভাগ্নীকে নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। পায়রা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সোফার দিকে। প্রথমে চমকালেও এখন নিজেকে সামলে নিয়েছে। বলতে গেলে একপ্রকার সামলানোর অভিনয় করছে। চোখে বারবার অশ্রু জমছে। এই ভয়টাই পাচ্ছিলো পায়রা। আর সেটারই পূর্ব সংকেত। বুকে ছুরিকাঘাতের মতো ব্যাথা করছে। না চাইতেও চোখ ভিজে উঠছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। অপূর্বকে বললো-

‘অপু, আমার মাথাটা ব্যাথা করছে আমি ঘরে যাচ্ছি একটু ঘুমাতে। ‘

অপুর্ব কিছু বলার আগেই পায়রা ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। বিছানায় শুয়ে একের পর এক বালিশ গুলো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো। সহ্য করতে না পেরে হাত চেপে কেঁদে উঠলো। দরজা খুলে দেয়ার সাথে সাথেই দেখেছিলো, নীলাংশের কোলে একটা মেয়ে।
বুকে মাথা এলিয়ে রাখা। সেই দৃশ্য চোখে ভাসতেই চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করে। অবশেষে বাথরুমে বাথটাবে বসে রইলো। পাশের ঝর্ণাটা অন করে দিলো। আঁটকে থাকা কান্না গুলো বেরিয়ে এলো ধীরে ধীরে। সত্যি সত্যিই এবার মাথাটা ধরে গেলো।
কাপড় পাল্টে বের হয়ে শান্ত হয়ে ভাবলো, মেয়েটা তো অসুস্থ। মেয়েটার বয়স তার চেয়ে বড় হলেও খুব বেশি তো আর না। তাই হয়তো নীলাংশ কোলে নিয়েছিলো।
এছাড়া আর তেমন কিছু না। নিজেকে নিজে শান্তনা দিয়ে নিলো। তার সুন্দর সাহেব তারই থাকবে, তার ভাগ কাউকে দিবেনা সে। এই একজন মানুষের জন্যই তো একটু সুখের দেখা পেয়েছে। দু মুঠো ভালোবাসা পেয়েছে। মানুষটা হারিয়ে গেলে আর বাঁচবে না সে!

.
.
.
দুপুর পেরিয়ে যাচ্ছে প্রায়। এমন সময় কাঁথায় টান লাগায় ঘুম হালকা হয়ে গেলো পায়রার। সেই যে ঘুমিয়েছিলো, এখন উঠলো। ঘুমের রেশ না কাটায় আগের সেসব কথা সে বেমালুম ভুলেই গেছে। প্রায়ই ঘুমের সময় নীলাংশ এসে তার পাশে বসে। ভেবেই এক চিলতে হাসি ফুটলো৷ কিন্তু তা তড়িৎ গতিতে ম্লান হয়ে গেলো যখন চোখ খুলে দেখলো নীলাংশ নয় পাশে রায়ানা বসে আছে। মন খারাপ হলেও উঠে বসলো। রায়ানা চিন্তিত গলায় বললো –

‘কী হয়েছে পায়রা?অপূর্ব বললো তোর নাকি মাথা ব্যাথা করছিলো। বিকেল হয়ে এলো বলে, আয় দুপুরের খাবারটা খেয়ে নে। ‘

পায়রা ইতস্তত করে বললো –

‘রায়াবু, আমি এখন ঠিক আছি। ইয়ে মানে..সুন্দর সাহেব কোথায়?’

‘নীল ভাইয়া তো, রুশানীর কাছে। ‘

পায়রা অবাক হলো, তবুও স্বাভাবিক ভাবে বললো –

‘খাওয়া শেষ সবার?’

মূলত পায়রা এটা জানতে চায় যে নীলাংশের খাওয়া শেষ কিনা। রায়ানা বললো-

‘হ্যা! সেই কখন। সবার খাওয়াই শেষ শুধু একজন বাকি। ‘

পায়রার মনের প্রদীপটা জ্বলে উঠলো। আশাভরা চোখে তাকিয়ে বললো-

‘কে বাকি আছে? ‘

‘অপূর্ব। ও জেদ করছিলো, তোর হাতে খাওয়া ছাড়া খাবেনা। ‘

হতাশ হলো পায়রা। চোখ টলটল করলো। আড়ালে মুছে নিলো। যে পায়রাকে ছাড়া একবেলা চা পর্যন্ত খায়না সে আজ তার খবরটা পর্যন্ত নিলো না। বরং, আগেই খেয়ে চলে গেলো। মনের কথাটা বুঝতে দিলো না রায়ানাকে। ছোট ছেলেটা তার জন্য না খেয়ে বসে আছে দেখে ভীষণ ভালো লাগলো পায়রার। যাক, কেউ একজন হৃদয় দিয়ে সত্যিকার অর্থে তাকে ভালোবাসে।

খাওয়া শেষ করে অপূর্বকে পড়া বুঝিয়ে দিলো। অপূর্ব চুপচাপ পড়ছিলো হঠাৎ-ই বললো-

‘জানো ফেয়ারি, আজ যে আপুটা এসেছে সে একটুও ভালো না। ‘

পায়রা আনমনে নানান রকম কিছু ভাবছিলো। অপূর্বের কথায় চমকে উঠলো। অবাক হয়ে বললো-

‘কেনো? ‘

‘তা নয়তো কী! জেবা আন্টিকে খুব বকছিলো। জুসের গ্লাসটা ছুঁড়ে দিয়েছে। ‘

‘এমন কেনো করেছে?’

‘তুমি তো ঘুমিয়ে ছিলে বলে দেখোনি। একের পর এক অর্ডার দিয়েই যাচ্ছিলো। তুমিই বলো তো, সৌদি আরবের মতো খাবার জেবা আন্টি কী করে বানাবে!’

পায়রা চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বললো-

‘থাক তুমি ওসব নিয়ে ভেবোনা। বাবা মারা যাওয়ার শোকটা হয়তো এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাই এমন আচরণ করছে। ‘

সারাদিন বিষন্নতা নিয়েই কাটলো। কোনো কিছুতেই মন বসলো না। নীলাংশ দুপুর বেলাই নাকি বেরিয়ে গেছে। তাকে দেখতে না পেয়ে পায়রার দিনটা পানসে হয়ে গেছে। তবুও, একটা না একটা দিয়ে নিজেকে বুঝ দেয়। দিনশেষে মানুষটা তো তারই তাইনা!

.
.
.
পরদিন সকাল বেলা ফুরফুরে মেজাজে রেডি হয়ে নিলো পায়রা। কাল অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছে নীলাংশ। যতই অভিমান করুক। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে না দেখে কতক্ষণ থাকা যায়! স্কুলে তো নীলাংশই দিয়ে আসবে। তখনই না হয়, সব রাগ অভিমান ঝেড়ে নিবে সে। ব্যাগ নিয়ে নিচে নামতেই দেখলো নীলাংশ জুতা পড়ছে। কিঞ্চিৎ হাসি নিয়ে এগিয়ে আসলো পায়রা। নীলাংশকে কিছু বলার আগেই পেছনে থেকে তানজিমা বললেন –

‘রুশানীকেও সাথে নিয়ে যাও নীল। ওর মনটা ভালো থাকবে। ‘

পেছনে থেকে নীল শর্ট টপস আর জিন্সে এসে দাঁড়ালো রুশানী। মুখে গাম্ভীর্যের চিহ্ন। সৌন্দর্যের সঙ্গে বেশ মানিয়েছে। নীলাংশ বললো-

‘হুম, এসো রুশানী। পিচ্চিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তারপর তোমাকে ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখাবো। ‘

পায়রাকে শুধু একবার ইশারা দিয়ে বের হয়ে গেলো নীলাংশ। পায়রার করুণ দৃষ্টি বা মুখ কোনোটাই হয়তো আজ নীলাংশের চোখেই পড়লো না। মলিন মুখে বের হলো। ড্রাইভিং সিটের দিকে গিয়েই আরেকবার ধাক্কা খেলো সে। রুশানী আগে থেকেই নীলাংশের পাশ বসে আছে। নীলাংশ মৃদু হেঁসে বললো –

‘ পিচ্চি তুমি আজ পেছনের সিটটায় বসে যাও। ‘

পায়রা মাথা নাড়িয়ে পেছনের সিটেই বসলো। এই প্রথম সর্বদা মনকাড়া হাসিটা তিক্ত বিষাক্ত লাগলো পায়রার। তিক্ততার রেশ ধীরে ধীরে পুরো শরীরে বিষের যন্ত্রণা দিতে শুরু করলো। সামনের সিটের দুজনের কথার পরিমাণ এতোই যে পায়রার নিঃশব্দ অনুভূতি গুলে ফিকে হয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রইলো। পায়রা অশ্রু ভেজা চোখে বাহিরে তাকিয়ে আনমনেই বিরবির করে বললো –

‘মন পরিবর্তন করা বুঝি এতোই সহজ! ‘

চলবে-
অবাক হয়েছিলাম, কালকে অনেকের মতামতের সঙ্গে মিল আছে। সকলের মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ, আশা করি ধৈর্য ধরে শেষ পর্যন্ত পাশে থাকবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here