“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৫৮
অবাকের শীর্ষে পৌঁছাতে আর বেশি দেরি নেই পায়রার। একের পর এক শক খাচ্ছে সে। অফিস রুম থেকে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে সবে বের হচ্ছিলো। সুইজারল্যান্ডের আবহাওয়ার সাথে বাংলাদেশের আবহাওয়ার আকাশ পাতাল তফাৎ। অনেক সময় লাগবে মানিয়ে নিতে। পায়রার ভাবতেই অবাক লাগে, একসময় এই গরমেই সে দিব্যি কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাতো। কাঁথা জাতীয় কিছু না থাকলে ঘুমই আসতো না। অথচ, সময় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে নিজের মাঝেও কতটা পরিবর্তন এসেছে! অবশ্য পৃথিবীর সব জিনিসেরই পরিবর্তন ঘটে। আর সে তো মানুষ মাত্র!
মিটিং-এ নীলাংশের কার্যকলাপ শুধু তাঁকেই নয় বরংচ প্রতিটি মানুষকেই সমহারে অবাক করছে। আডাম এখন মোটামুটি অর্ধেক কাহিনী জানে। মূল ঘটনা তো বলতে গেলে সবারই চক্ষুর আড়ালে। নীলাংশের উপর একরকম বিরক্ত হয়েই মিটিং এর কাজ দ্রুত করে বের হয় সে। একটু পর পরই অদ্ভুত রকমের কান্ড করছিলো। পায়রা যখন নিজেদের কম্পানির কাজ প্রদর্শন করছে তখন নীলাংশ অপলক তাকিয়ে আছে।
পায়রা ওদিকে ধ্যান না দিয়ে কাজ অবিরত করে যাচ্ছিলো। কিন্তু তাতেও খুব একটা সফল হলো না। নীলাংশ ইচ্ছে করে অবুঝ ছাত্রের মতো বাগরা দিয়ে বললো-
‘কী বললেন , বুঝতে পারলাম না। ‘
পায়রা একবার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বার শুরু থেকে ভেঙে ভেঙে বোঝালো কোন ধরনের প্রোডাক্ট ডিজাইন করা হবে। কোন কোন দেশে সেল হবে। কিন্তু নীলাংশ একইভাবে বললো-
‘আরেকটু বিশ্লেষণ করে বলুন না! ‘
পায়রার পায়ের রক্ত মাথায় উঠে টগবগ করছে। নীলাংশের কাজগুলো সে ইচ্ছাকৃত তা বোঝার বাকি থাকে না। ওকে যে নীলাংশ রাগিয়ে মজা লুটছে তা ভালোই বুঝলো। খিচিয়ে যাওয়া মেজাজ বিরবির করে বললো –
‘সদ্য জন্মানো শিশু! ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানেনা! ‘
আজকের মিটিং ফ্রিনাও উপস্থিত ছিলো। পায়রার কাছাকাছি থাকায় অর্ধেকটা শুনেছে। কিন্তু বাংলায় বলায় কিছুই বোধগম্য হলো না। তাই চোখ বড় বড় করে বললো –
‘হোয়াট ডিড ইউ সে? সড্য জনানো সিসু! ‘
নীলাংশ আর আভাস দুজনই বুঝতে পারলো পায়রা কী বলেছে। আভাস মিটমিট করে হাসলেও নীলাংশ পানসে মুখ করে তাকালো। পায়রার ক্ষিপ্ত মেজাজ আরও এক ধাপ লাফিয়ে উপরে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে সবাইকে বললো-
‘আমার গরমে শরীর খারাপ লাগছে। আমি তো বোঝাতে অক্ষম। তাই, আভাস স্যারই বাকিটা বলুক।’
নীলাংশের দিকে একবার কটমট করে তাকিয়ে ভস্ম করে দিয়ে বের হলো সে। নিজের কেবিনে এসে সোফায় পিঠ এলিয়ে বসলো। যত ঝগড়াই করুক। রাগে উপরে উপরে নিজেকে ভীষণ কঠোর দেখালেও এরকম সেই জানে ,নীলাংশ সামনে থাকলে বুকে কতটা যন্ত্রণা হয়। নীলাংশ মিটিং রুমে যখন ঠোঁট চেপে হেঁসে ওকে বিরক্ত করছিলো তখন বিরক্তির চেয়ে শতগুণ বেশি কষ্টের লাভা ওর বুকে আছড়ে পড়ছিলো। কলজে ফালাফালা হচ্ছিলো। চোখ ঘোলাটে হয়ে আসলেও রাগ দেখিয়ে অন্য দিকে মুখ করে রেখেছিলো। মনের সবচেয়ে কাছের মানুষটা যখন কাছে হয়েও নিজের থাকে না তখন কষ্টের কোনো সীমা পরিসীমা অবশিষ্ট থাকেনা। নীলাংশের দিকে তাকালেই মনে পড়ে, সে এখন একজন স্বামী কারো বাবা। সোফার কুশনটা হাঁটুতে রেখে মুখ গুঁজে রাখলো। কুশোনের নরম তুলোগুলো ভিজে উঠলো উষ্ণ অশ্রুতে। পায়রার ইচ্ছে করে নীলাংশকে নিজের হাতে খুন করতে। সব যন্ত্রণা, অবহেলার শাস্তি দিতে।
ঠাস করে দরজা খোলার আওয়াজে চোখ তুলে তাকালো পায়রা। দ্রুত চোখ মুখ মুছে নিলো। মুখের গম্ভীর মুখোশ পড়ে নিলো। নীলাংশ ভেতরে ঢুকে ভেতর থেকে চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিলো। পায়রা দাঁড়িয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। নীলাংশ বাচ্চাদের মতো টেবিলে বসে পা ঝুলাচ্ছে। পায়রা হতবাক হয়ে রাগী স্বরে বললো –
‘আপনি! আপনি আমার কেবিনে নক না করে বিনা পারমিশনে ঢুকলেন কেনো?’
নীলাংশ কিছু একটা ভেবে, দুষ্ট হাসি ফুটিয়ে বললো –
‘কেনো তুমি ঐ গানটা শোনোনি? ‘
হাসি দেখেই পায়রার ভ্রূদ্বয় কুঁচকে আসলো। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললো-
‘কী শুনবো?’
নীলাংশ টেবিল থেকে নামলো। হাত থেকে চাবিটা খোলা জানালার দিকে ছুঁড়ে দিলো। পায়রার বুক ধরফর করছে। নীলাংশ এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে পায়রার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে কানের কাছে গেয়ে উঠলো-
‘Bahar se koi andar na asake,
Andar se koi bahar na jasake,
Socho kabhi asa ho to kya ho?
Socho kabhi asa ho to kya ho?
Hum tum ek kamre me band ho jaye!
Or chabi kho jaye! ‘
শব্দ গুলো পায়রার কান ছুঁয়ে সোজা হৃদযন্ত্রে এসে হানা দিলো। নীলাংশের চোখের দিকে তাকাতেই মনে হলো, চোখজোড়া বুঝি তাঁকে ধ্বংস করে দিবে। জিহ্বা দিয়ে ঢোক গিলে নিলো। কপালের অর্ধেকটা শিশিরবিন্দুর মতো ভিজে উঠলো। আগে তো,এমন ভয় লাগেনি পায়রার। পরীক্ষার সময় গুলো প্রতি রাতই নীলাংশ তার ঘরে আসা যাওয়া করতো। অথবা, পায়রা নিজেই যেতো। কত সময় নীলাংশের কাঁধে মাথা রেখেই ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুমাতো। কিন্তু আজ! আজকে নীলাংশের চোখগুলোতে কী যেনো একটা দেখছে পায়রা। নীলাংশের গায়ের শুভ্র ঘ্রাণ পায়রার নাসিকা রন্ধ্র ভেদ করছে। পায়রার ভয় লাগলেও উপরে উপরে তেজ দেখিয়ে নীলাংশের বুকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু নীলাংশের বলিষ্ঠ হাত তা হতে দিলো না। মুখে দুরন্তপনা যুক্ত হাসি দিয়ে পায়রার নরম হাতদুটো শক্ত করে ধরলো। পায়রা রাগী কন্ঠে চিল্লাতে চিল্লাতে বললো-
‘ছাড়ুন বলছি! আমি এখন চিৎকার করবো!’
নীলাংশ ফিক করে হেঁসে দিয়ে বললো-
‘রুম তো সাউন্ড প্রুফ বেবি! ‘
পায়রা বড় ঢোক গিলে নিলো। মিনমিন করে বললো –
‘বেবি! বেশি বকছেন আপনি’
‘বেশি বকছি না মাই কুইন ৷ তুমি চাইলে চিৎকার করে তোমার সো কল্ড স্বামীকে ডাকতে পারো। ‘
পায়রা হতবুদ্ধি হয়ে গেছে। কালকে সে যে আচরণ করেছে এতে নীলাংশ তার ধারের কাছে আসারও কথা না। কিন্তু তবুও এমন নির্লিপ্ততা ভীষণ হতাশ করছে পায়রাকে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই রুম সাউন্ড প্রুফ। প্রতিটি কাঁচ তারই জানান দিচ্ছে। পায়রা ভাবলো, শক্তের ভক্ত নরমের জম। তাই সে শক্ত ভাবেই বললো-
‘এটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না। আপনি আন্দাজও করতে পারছেন না, আমি আপনাকে কী করবো!’
নীলাংশের হাস্যজ্জ্বল চেহারা আগের তুলনায় আরও প্রশস্ত হলো। আরও এগিয়ে আসলো। পায়রা পেছনে দুই কদম পিছিয়ে যেতেই ধপ করে সোফায় পড়ে গেলো। নীলাংশ পায়রাকে মাঝখানে রেখে সোফার পাশে দুই হাত রেখে নিজের ওষ্ঠজোড়া পায়রার বরাবর রেখে মাদকীয় কন্ঠে বললো-
‘সময় সুযোগ দু’টোই অনন্ত,
এমন কিছু দাও যা করুক সময়কে জীবন্ত! ‘
চলবে-
(কালকে দিতে পারিনি তার জন্য দুঃখীত। অনেকেই অপেক্ষায় ছিলেন, আমি জানি। আজ যে দিতে পারবো ভাবিনি ৷ বলতে গেলে বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাটুকু নেই। একটা মাইনর এক্সিডেন্ট হয়েছে। আল্লাহর শুকরিয়া, আরও বড় কিছু হতে পারতো। মাথায় আর ব্যাক সাইডে ভীষণ ভাবে চোট লেগেছে। কাল দিতে পারিনি খারাপও লাগছিলো, কমেন্ট দেখেছি। রিপ্লাই করতে পারিনি, প্লিজ কিছু মনে করবেন না।আমি সবার কমেন্টই পড়েছি, পাঠকদের অসংখ্য ধন্যবাদ ও ভালোবাসা। )