“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৫৯
পায়রা চমকে তাকিয়ে আছে। বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ তুমুলভাবে বেগে ছুটে চলছে। জিহ্বা দিয়ে বারবার ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে। নীলাংশের মাতাল দৃষ্টি পায়রার কৌতুহলী চোখে। পায়রা ঘোরে চলে যাচ্ছিলো প্রায়। কিন্তু সম্বিত ফিরলো ক্ষণকাল পরে।
চোখ জ্বলে উঠলো। চোখের তারায় ভেসে উঠলো নিদারুণ নিষ্ঠুর আচরণগুলো।
আচমকা ধাক্কা দিয়ে দাঁড়ালো পায়রা। নীলাংশ তাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেলো। পায়রা ক্রুদ্ধ চাহনি দিয়ে নীলাংশের সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে তালি দিয়ে বলল-
‘আমি আজও বুঝতে পারিনি, একজন মানুষ এতোটা নিখুঁত ভাবে কী করে অভিনয় করে যেতে পারে! ক্লান্ত লাগে না একটুও?’
নীলাংশের হাস্যজ্জ্বল চেহারায় নেমে আসে মলিনতা। বুকের ভিতর চিনচিন করে ব্যাথা করে ওঠে। কী করে বোঝাবে সে, তাঁর পিচ্চিকে সে কতটা ভালোবাসে! ভালোবাসা কতটা অসহায় করে রেখেছে তাঁকে! অসহায়ত্ব গুলো কী একটুও চোখে পড়েনা?
পায়রা ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে চৌচির। এতোটা! এতোটা খারাপ নীলাংশ! এমন কাউকে ভালোবেসেছিলো সে! কত বোকা, ইশশ! এক সন্তানের বাবা হয়ে আবার তাঁর কাছে এসে এমন আচরণ করছে। ছি! ঘৃণায় মুখ কুঁচকে তেঁতো হয়ে যায় তাঁর। কথা বলতেও রুচিতে আঁটকে যায়। ঘৃণা আরও বাড়ে নীলাংশের আরেকটা কথায়-
‘তুমি এখনও অবুঝ রয়ে গেলে পিচ্চি! আমাকে আজও বুঝলে না। ‘
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পায়রার হাতদুটো নিয়ে নিজের গালে ছুঁইয়ে করুণ স্বরে বলল-
‘দুরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়। কথাটা সত্যি পিচ্চি। আমি জানি তুমি খুব রেগে আছো, অভিমান করে আছো। কিন্তু সব ভুলে যাও পিচ্চি। চলো না! আমরা নতুন করে সবকিছু শুরু করি। আমাদের ভীষণ সুন্দর একটা সংসার হবে। তুমি বলেছিলে না! আমাদের বাড়ির অদ্ভুত একটা নাম দিবে। বলো তো?মনে আছে তোমার? ‘
পায়রার স্মৃতির পাতায় ভাসে উজ্জ্বল শান্ত বিকেল।
চোখের তাঁরায় চকচক করে সেসব দৃশ্য। তখন ওদের প্রেমের মাঝামাঝি সময় ৷ নীলাংশ আগে থেকে আরও বেশি যত্নশীল। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শ্বাসে পায়রার কাছে দ্রুত হেঁটে আসছে নীলাংশ। পায়রা ছাঁদে থেকে গুণগুণ করে নামছিলো। নীলাংশের ভার্সিটিতে বোধ হয় কাজ শেষ। পায়রা নামতেই সলজ্জ হেসে বলল-
‘এতো তাড়াতাড়ি! ‘
নীলাংশ মৃদু হেসে দুষ্টমি করে বলে-
‘খুশি হওনি?’
পায়রা নতমুখে লজ্জা পেয়ে বলে-
‘হয়েছি। ‘
নীলাংশ পায়রার দিকে তাকিয়ে বলল-
‘রেডি হয়ে নাও, আজ নতুন কিছু দেখাবো তোমাকে। ‘
পায়রা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। খুশিতে ঝুমঝুমিয়ে তৈরি হয়। প্রায়শই নীলাংশ হুটহাট এসে ঘুরতে নিয়ে যায়। তখন কী যে ভালো লাগে!
আজ গাড়ি করে নয়, বরং সাইকেল নিয়ে বের হয়েছে নীলাংশ। পায়রা গুটিসুটি মেরে পেছনে বসে আছে। এক হাত নীলাংশের কাঁধে। লজ্জায় গাল লাল হয়ে যাচ্ছে। নীলাংশ পার্কের একটা জায়গায় সাইকেল থামালো। খুব একটা দূরে নয়। তাই সাইকেল চালিয়ে দশ মিনিটেই পৌঁছে গেছে। নীলাংশের মুঠোয় পায়রার নরম হাত। একটু পর পরই সেটা নেড়েচেড়ে কী যেনো পরখ করছে আর হো হো করে হেঁসে বলছে-
‘হাহা, পিচ্চি নাম কী আর এমনিতেই দিয়েছি! আমার হাতের অর্ধেকও না তোমার হাত! তুলোর মতো। ‘
পায়রা ধপ করে রেগে গাল ফুলিয়ে বলল-
‘আপনার মতো পাথরের হাত তো না অন্তত! আমার হাত হিসেব অনুযায়ী ঠিকই আছে ৷ ‘
নীলাংশ প্রতুত্তরে পায়রার গাল টেনে দেয় হাসতে হাসতে। দীঘির ঘোলা পানির ওপর মিষ্টি রোদের প্রলেপ। হাত দিয়ে পানি ছুঁয়ে দেখতেই বুঝতে পারে উষ্ণ হয়ে আছে। কী চমৎকার নয়নাভিরাম দৃশ্য!
নীলাংশ আচমকা বলে-
‘পিচ্চি আমাদের বিয়ের পর আমরা বাড়ির সামনে।একটা সুইমিং পুল বানাবো। ‘
পায়রা লজ্জায় কুপোকাত। ইশ! লোকটার একটুও লজ্জা নেই। হুটহাট বিয়ে বিয়ে করে ওকে কুঁকড়ে দেয়। নীলাংশ মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল-
‘তোমার কোনো স্বপ্ন নেই? ‘
পায়রা চকিতে তাকালো। কৌতূহল নিয়ে বলল-
‘কী নিয়ে? ‘
‘কী আবার? আমাদের বিয়ে নিয়ে? ‘
পায়রার চোখে রঙিন কল্পনা জটলা পাকিয়ে নেয়। মনে মনে লজ্জা পেলেও মুখে ঠিকই অনুভূতি প্রকাশ করে-
‘আমাদের যে ঘরটা হবে। সেটা প্রাকৃতিক দৃশ্য দিয়ে ভরপুর থাকবে। বারান্দা দিয়ে চঞ্চল রোদ ঘরে লুটোপুটি খাবে। খুব ছিমছাম গোছের। বারান্দায় একজোড়া চড়ুই থাকবে। খাঁচায় নয়, খড়কুটো দিয়ে তৈরি ওদের নিজস্ব আবাসস্থল। কিচির মিচির শব্দে রোজ যখন ঘুম ভাঙবে তখন নজরটা ঠিক ওখানেই নিবদ্ধ হবে। বাড়ির সামনে কাঠগোলাপের গাছ লাগানো থাকবে। আমি সেখানে নিয়ম করে পানি দেবো। কাঠগোলাপের সাদার মায়ায় জড়াবো। আর আমাদের দুজনের যে ঘরটা হবে, সেটার নাম হবে
‘স্বপ্নচূড়ার আহবান’।
নীলাংশ বিমোহিত হলো। সাধারণের মাঝে অসাধারণ একটা স্বপ্ন! এতো সুন্দর করে কল্পনা করে পায়রা!
নীলাংশের ইচ্ছে করে পায়রাকে নিয়ে কল্পনার রাজ্যেই পাড়ি জমাতে। ঘোর ঘোর লাগে। কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে বলল-
‘এই নাম কেনো? ‘
‘সকল বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে ঐ ঘরটা হবে আমার আমার স্বপ্নের সাজানো ঘর। যে স্বপ্নের ডাক, আহ্বানেই আমি লড়ার শক্তি পাই। যে স্বপ্নটা প্রতিনিয়ত আমাকে বাঁচার অনুপ্রেরণা দেয়। সব স্বপ্ন গুলো আমি আমার সে ঘরটায় জমাবো। নতুন ভাবে। ‘
নীলাংশ উঠে কোথায় যেন গেলো। দৌঁড়ে এসে দুটো কাঠগোলাপ পায়রার কানের পেছনে চুলে গুঁজে দিলো। পায়রা হকচকিয়ে তাকাতেই নীলাংশ তাঁকে দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো –
‘কাঠগোলাপের মায়াগুলো মায়াবিনীর তরে,
যার জোৎস্না হাসির ফাঁদে আমার হৃদয়ে কাঁপন ধরে।
তাঁর স্বপ্ন আলোআঁধারির রহস্য ভেদ করে,
উড়ো চিঠির খামে করে কল্পনাতে ঝড়ে। ‘
বর্তমানে ফিরে আসে পায়রা। নীলাংশের মায়াবী মুখ হৃদয়ে দোল দিয়ে এফোড় ওফোড় করে বের হয়। ভীষণ কষ্টে চোখ দিয়ে ক্ষতবিক্ষত অশ্রু বিসর্জন হয়।
যে অশ্রুতে কিছু পেয়েও না পাওয়ার আক্ষেপ! আর বাদবাকি অপূর্ণ থেকে যাওয়া হাজারও কল্পনা-জল্পনা।
চলবে-