স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৫১

0
908

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৫১

অল্প আলো ও অল্প অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে উঁকি দিচ্ছে একফালি চাঁদ। রুমের সঙ্গে এটাচড মিনি ছাঁদটার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পায়রা।
এখানের বাড়িটা বেশ অন্য রকম ভাবে তৈরি। হালকা শীত শীত লাগছে। গায়ে সাদা রঙের একটা পাতলা শার্ট আর স্কার্ট। রাতে ঘুমানোর জন্য সাধারণত এগুলোই পড়ে সে। ছাঁদের দরজার পাশেই একটা দোলনা। সেখানে বসে পড়ে সে। দৃষ্টি চাঁদটির দিকেই আবদ্ধ। চাঁদের সাথে নিজের একটা খুব মিল পায় পায়রা। চাঁদের অঢেল সৌন্দর্যের মাঝেও যে একটা দাগ দেখা যায়। তেমনই সম্পূর্ণ সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও মুখে দাগই সবার চোখে পড়ে। একটা সময় ছিলো, যখন পায়রা আয়নার সামনে দাঁড়ালেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো। হা-হুতাশ করতো ‘আমার চেহারাটা কেনো আগের মতো হয়না! ‘ কিশোরী মনে প্রায়শই ভাবনা আসতো টাকা পয়সা হলে এই দাগআলা চেহারা সে রাখবেই না। সার্জারী করে ঠিক হয়ে যাবে। এখন পায়রার নিজের কাছেই লাখ লাখ টাকা পড়ে থাকে।
কিন্তু নিজের চেহারা নিয়ে কোনোরূপ হীনমন্যতায় ভোগে না সে। হ্যা, নিজের চেহারা পাল্টানোর চেষ্টা করেনি পায়রা। জীবনের একটা পর্যায়ে সে উপলব্ধি করে, এই মুখটার কারণেই সে আজ এই পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলো। যদি তার সাথে সেরকম একটা এক্সিডেন্ট না হতো, তাহলে নিজের ভেতরের অদম্য স্পৃহা সে বুঝতেই পারতোনা। পদে পদে যখন মানুষ তাকে তাচ্ছিল্য করেছে, তখন মনের অবচেতনে একটা জেদ তৈরি হতো। সেসব মানুষকে দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করতো, একজন এসিড ভিক্টিমেরও বাঁচার অধিকার আছে। রঙ, বর্ণ, জাতির ভেদাভেদ বানোয়াট। পায়রার মনে পড়ে, কোন ক্লাসে যে একটা প্রবন্ধ ছিলো । তার মধ্যে একটা লাইন ‘সবশেষে মানুষ সত্য! ‘ এই কথাটাকে প্রমাণ করেছে পায়রা। শত শত আঘাত, অপমান সহ্য করেছে। এত সহজেই এতো কিছু পায়নি সে। এখনও মনে পড়লে তার নিষ্ক্রিয় চোখে জল জমে, তার জীবনের সেই ভয়ঙ্কর কালরাত্রি। সাত বছর আগের সেই আধারে বিষলক্ষ্মীর আগমন!

“সাত বছর আগে ”
-এলোমেলো হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে পায়রা। মুখে হাসি। সেই হাসিতে মিশে আছে পাওনা না পাওয়ার বেদনা। উপর থেকে ডিজে গানের লিরিকস ভেসে আসছে। সহ্য করতে না পেরে বালিশ নিয়ে কানে চাপা দিয়ে রেখেছিলো। নোনাজলে বালিশের উপরিভাগটা
ভিজে উঠেছে। বালিশ সরিয়ে উঠে বসে পায়রা। মাথা ভো ভো করে ঘুরছে। কী অসহ্য রকমের যন্ত্রণা!

বুক ফেটে চৌচির হয়ে হাহাকার করে। ভালোবাসা হারানোর হাহাকার! এক ধোঁকাবাজের প্রেমে পড়ার হাহাকার! পায়রা তাচ্ছিল্য হেঁসে নিজেকে নিজেই বলে- ‘ধোঁকাবাজই তো! ‘

রায়ানা ঘরে আসার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। এই বাড়িতে আর এক মুহুর্তও না। এখানে থাকা তার জন্য যে কতটা দুর্বিষহ! তা হারে হারে টের পাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ থাকলে দম আঁটকে মরেই যাবে। দুপুরেও তেমন একটা খায়নি সে। খেতে গেলেই মনে পড়ে, নীলাংশ প্রায়ই তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে পুরো খাবারটা খাওয়াতো। তখন তো কোনো কিছুতেই ফাটল চোখে ধরা দেয়নি। কেনো, আগেই সতর্ক হয়ে গেলো না সে!

এক মুহূর্তও দেরি না করে আলমারি খুলে নেয়। পুরো আলমারি ভর্তি জামা কাপড়। চোখের পানি মুছে নিজের পুরনো জামার ব্যাগটা বের করে। মাত্র তিনটে জামা। একদিন ধুয়ে রেখেছিলো সে। পুরনো হলেও পরিষ্কার। থ্রি পিস পড়ে তৈরী হয়ে নেয়। পুরো ঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। টেবিলে একটা চিরকুট রেখে দিয়েছে। ঘরের প্রতিটি কোণায় নীলাংশের সঙ্গে অজস্র স্মৃতি জড়িয়ে আছে। এই মায়া ছেড়ে যেতে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। বারান্দায় নিজের লাগানো ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো, আজকের পর থেকে এই ফুলগুলোও হয়তো শুকিয়ে মরে যাবে। রোজ সকালে উঠে পানি দিয়ে মাটিতে সার দিতো। কত যত্নের! ভালোবাসার মানুষটাকেও তো বুকের ভিতর যত্ন করে জায়গা দিয়েছিলো! ফুলগুলো প্রস্ফুটিত হয়ে থাকলেও মানুষটা হয়তোবা কখনো তার ছিলোই না!

দরজা আঁটকে বেরিয়ে আসে। পুরো বাড়ি ফাঁকা। সুবিধাই হয়েছে। কেউ থাকলে হয়ত যেতে পারতো না সে। মুখে কাপড় দিয়ে আঁটকে নিয়ে একবার ছাঁদে যায়। যাওয়ার আগে, শেষ বারের মতো মানুষ গুলোকে একবার দেখে নিতে। ছাঁদের একদম কর্ণারে চুপিসারে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ নেই এই সাইডে। চোখ দুটো গিয়ে আবদ্ধ হয় স্টেজের দিকে। হলুদ পাঞ্জাবিতে কী নির্মল দেখাচ্ছে নীলাংশকে! এক হাতে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে তার। নিজের গালে নিজেই চড় বসিয়ে দেয়। কতটা বেহায়া সে ছি!

নীলাংশ আর রুশানী একসাথেই বসে আছে। কী সুন্দর হাসি দুজনের মুখে। কত বড় প্রাপ্তি পেতে যাচ্ছে যেনো। রুশানী একটু পর পর লাজুক হাসি দিচ্ছে।
রায়ানা আর অপূর্ব বিরস মুখে পাশে বসে আছে। তাদের দিকে তাকিয়ে পায়রার কষ্ট হয়। ছোটমা, আর এই দুইজনই বড় আপন হয়ে গেছিলো তার কাছে। কিন্তু তার কপালে আপন মানুষ গুলোর ভালোবাসা সহ্য হয়না। চোখ মুখ মুছে নীলাংশের দিকে দূরদৃষ্টি দিয়ে বিরবির করে বললো –
‘আপনাকে আমি অভিশাপ দেইনি সুন্দর সাহেব। কিন্তু রুহের একটা আহাজারিও থাকে! আমার ভয় হয়, আহাজারি গুলো যেনো অভিশাপ হয়ে আপনার জীবনে ফিরে আসে! ভালো থাকবেন। ‘

চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে যায় সেখানে থেকে। বাড়ির থেকে নামতেই নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে। বললেই তো আর একা থাকা যায় না। মাথা গোজার একটা ঠাঁই প্রয়োজন। রাত অনেক হয়েছে, এই সময় কোথায় যাবে সে! ব্যাগে টিফিন না খেয়ে জমানো কিছু টাকা আর মাস্টার বাবার দেয়া টাকাগুলো আছে। সব মিলিয়ে তিন হাজার টাকা। আপাতত একটা জায়গায় রাতটা কাটাতে হবে। সকাল থেকে নতুন কোনো জায়গার খোঁজ করা লাগবে। হাঁটতে হাঁটতে অচেনা একটা জায়গায় এসে পড়লো। শহরে আসার অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু গাড়ি দিয়েই বেশির ভাগ যাতায়াত হতো। হাঁটার অভ্যাস নেই। কিছু পথ এগুতেই মনে হলো কে যেনো তার পিছে পিছে আসছে। পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখছে না। হঠাৎ বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। আরেকটু সামনে যেতেই একদল বখাটে ছেলেরা তাঁকে ঘিরে ধরে। ভয় পেয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই দুই তিন জন মিলে হাত চেপে ধরে। আত্মা কেঁপে উঠলো। ভয়ে ভয়ে বললো-

‘এমন করছেন কেনো! আমাকে যেতে দিন প্লিজ! ‘

চিকন করে একটা ছেলে নোংরা দৃষ্টি দিয়ে হাসতে হাসতে বললো-

‘আহারে! কচি খুকি। কিচ্ছু বোঝেনা। ‘

পায়রা মাথা নত করে বললো –

‘আমাকে ছাড়ুন। ‘

কান্না করে ফেলে সে। ছেলেগুলোর হাসির মাত্রা বাড়ে। পায়রার গা থেকে ওরনাটা ছিনিয়ে নেয়। মুখটা সাদৃশ্য হতেই বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করে বলে-

‘শালি! আইজকা শুধু মুখ না পুরা শরীরেই দাগ হইয়া যাইবো। ‘

গা গুলিয়ে বমি আসে পায়রার। এতো নোংরা দৃষ্টি আর কথার স্বীকার সে সারাজীবনেও হয়নি। ঠোঁট কাপিয়ে কেঁদে উঠলো। মনে মনে সাহস করে একজনকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। পেছনে কুকুরের মতো তাড়া করে ছেলেগুলো। অনেকটা পথ অতিক্রমের পর অচেনা একটা জায়গায় উষ্ঠা খেয়ে পড়ে। তারপরও মুখে আওয়াজ করেনা। মুখ চেপে অন্ধকারে মিশে যায়। মিনিট খানেক পার হওয়ার পর সাড়াশব্দ না পেয়ে এগিয়ে যায়। পায়ের পাতার অনেকটা অংশে কেটে রক্ত ঝড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই দেখে একটা গাড়ি এদিকেই আসছে। কীভাবে যেনো, সে মাঝরাস্তায় এসে পড়লো। মূলত দুর্বল শরীর নিয়ে চোখেও ঘোলাটে দেখছে। গাড়ি সামনে এসে ব্রেক করে। গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন একজন মানুষ। পায়রার মুখে উজ্জ্বল হাসি ফোটে। লোকটি এগিয়ে আসতেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পুরোপুরি জ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার আগে অস্পষ্ট স্বরে বলে- ‘স্যার! ‘

আভাস চমকিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। এক রোগীকে রক্ত দিয়ে বাড়ি ফিরছিলো সে। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর মন দুটোই বিরক্ত। হঠাৎ মাঝরাস্তায় একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুত গাড়ি থামায়। পায়রাকে বিধ্বস্ত ওরনাবিহীন পড়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠলো। দ্রুত পাঁজাকোলে তুলে গাড়িতে বসালো। সেখানে থেকে হসপিটালে। দুইদিন রেস্টের পর আভাস তাকে জোর করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। পায়রা চায়নি যেতে। কারো ঝামেলা বাড়তে। কিন্তু আভাসের মুখের উপর কথা বলার সাহস পায়না।
অগত্যা সেখানেই যেতে হয়। তারপর ঘটে আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা!

যে ঘটনার রেশ ধরে দুজনই সুইজারল্যান্ডে পাড়ি জমায়। বর্তমানে আভাস নিজের বিজনেস দেখছে। পায়রাও বিজনেসের সঙ্গে জড়িত। এখানে নতুন করে পড়াশোনাও শুরু করে। এই বাড়ি, গাড়ি সবটাই আভাসের সাহায্যে করতে পেরেছে। আভাস পরবর্তীতে কোনোরকম অর্থ দেয়নি। মানসিক সাপোর্ট দিয়েছিলো। এতে ধীরে ধীরে নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে শিখে সে। বিজ্ঞানের উপরই পড়াশোনা করছে সে। নিজের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। খট করে দরজা খুলে কেউ ভেতরে আসে। পায়রা অতীতের স্মৃতির পাতা থেকে বর্তমানে ফিরে আসে। দরজায় আভাস মুচকি হেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। পায়রা চোখ মুখ মুছে সেদিকে তাকিয়ে বললো…

চলবে-

(গল্পের প্রয়োজনে কিছু অবাঞ্ছিত শব্দ ব্যবহার করতে হয়েছে। ভুলভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here