“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৫৫
ভীষণ অন্য রকম একটা সকাল। গ্রামের মেঠোপথে কোকিলের সুরেলা কন্ঠ ভেসে আসছে কর্ণকুহরে। মিষ্টি রোদ এলোমেলো হয়ে প্রতিটি কোণা তপ্ত করছে।
গ্রাম থেকে দূর শহরের অলিগলিতেও উদ্ভাসিত চঞ্চলা ছোঁয়া বসন্তের। চারদিকে তাকালেই যেনো কেউ ফিসফিস করে বলে- ‘বসন্ত এসে গেছে! ‘
পায়রা হোটেলের কামরার জানালাটা খুলে দিলো ৷
এক সুশ্রী দমকা হাওয়ায় ভেতরটা ভালো লাগায় জুড়িয়ে গেলো। বাহিরের জায়গাটায় চোখ পড়তেই মুগ্ধ হলো দৃষ্টি। রাস্তায় এক পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের অসমাহিত সৌন্দর্য নিজেকে তুলে ধরে আছে। একটু পর পর আশেপাশের শৈল্পিক মনকে জাগিয়ে তুলছে।
বহুদিন পর নিজের দেশের এহেন রূপে নির্বাক হয়ে রইলো সে। জুরাইখে কম জায়গা পরিদর্শন করেনি।
প্রথম প্রথম সেসব জায়গায় গিয়ে আনন্দিত হলেও নিজের দেশের চিত্র বেশিই সুন্দর মনে হয়।
দরজার নব খুলে কেউ ভেতরে আসলো। অতি সন্তর্পণে পেছনে এসে দাঁড়ালো। পায়রা পেছনে না তাকিয়েই হাসিতে আচ্ছাদিত কন্ঠে বললো-
‘গুড মর্ণিং। ‘
আভাস ফস করে হতাশার শ্বাস ফেললো। হাতের চিনামাটির কফির কাপটা পায়রার হাতে ধরিয়ে বললো-
‘তুমি দিন দিন অনুভূতিহীন হয়ে যাচ্ছো! ‘
পায়রা হাসলো প্রতুত্তরে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো-
‘ক্ষতি কী! আপনার থেকেই শিখেছি। ‘
আভাস কাঁউচে পা ঝুলিয়ে বসলো। নিজের হাতের কফির দিকে তাকিয়ে বললো-
‘আমি আর তুমি কী এক হলে! ‘
আভাসের কথায় কোনো জবাব দিলো না পায়রা। আভাস ভ্রু উঁচিয়ে বলে-
‘আজকে আনমনা লাগছে তোমাকে। ‘
পায়রা অন্য রকম হেঁসে বললো –
‘তাই নাকি! ‘
‘হুম। কী নিয়ে চিন্তা করছো?’
পায়রা জানালার পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে-
‘আজকের দিনটা একটু অন্য রকম। ‘
আভাস কফির খালি মগ টি-টেবিলে রেখে ঘড়ি দেখতে দেখতে বললো –
‘বসন্তের সময় তো। তাই আবহাওয়া সুন্দর। ‘
পরমুহূর্তেই তাড়া দিয়ে বললো-
‘পায়রা নয়টা বেজে গেলো বলে! মিটিং আছে। রেডি হয়ে নাও। ‘
আভাসকে পায়রা পিছু ডেকে বললো –
‘স্যার, নতুন কোম্পানির সঙ্গে এতো বড় একটা ডিল হলো। সব খোঁজ খবর নিয়েছিলেন তো? ‘
আভাস পেছনে না ফিরেই রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বললো –
‘গেলেই জানতে পারবে। ‘
পায়রা চিন্তিত মুখে তৈরি হতে চলে গেলো। হাতে সময় আছে মোটামুটি। বেশি দূরের পথ তো না। ওদের হোটেলের থেকে দশ মিনিট সময় লাগবে হেঁটে যেতে।
____________________
ছোট লোকমা বানিয়ে মুখে তুলে দিতেই তা টুকুর টুকুর করে খেয়ে নেয় নিসা। নীলাংশের মন আত্মতুষ্টিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। চোখ দুটো প্রশান্ত হয়। নিসা মুখের খাবার গিলে বলে-
‘আর খাবো না সুপারম্যান । ‘
নীলাংশ জোর করে না। হাতটা ধুয়ে নেয়। নিসাকে উঠিয়ে কোলে বসাতেই আবদার করে বলে-
‘আমাকে আজ তোমার অফিসে নিয়ে যাও, প্লিজ! ‘
নীলাংশ মৃদু হেসে বললো –
‘তুমি ওখানে বোর হয়ে যাবে সোনা। তোমার সমবয়সী কেউ নেই তো। ‘
‘উহহু! আমি যাবো। ‘
পেছনে থেকে রুশানী ধমক দিয়ে বলে-
‘কী হচ্ছেটা কী! নীল দার অফিস আছে। ‘
‘আহা! বকিস না। এমনিতেই বাসায় এলে আমি সময় দিতে পারিনা। কয়দিন থেকে যা এবার। ‘
রুশানী হাসলো। মোলায়েম কন্ঠে বললো-
‘কী করবো বলো, সাহিরের তো কাজ শেষই হয়না। একের পর এক ট্রিপ লেগেই থাকে। দেখলে না নিসা যেদিন হলো সেদিনও সাহির নিউইয়র্কে ছিলো। ‘
‘এ বাবা! রুশু আমি বুঝি চেষ্টা করিনা সময় বের করতে? ‘
সদর দরজা খুলে ঢুকে কথাটা বললো সাহির। দেখতে যথেষ্ট সুদর্শন। হাস্যজ্জ্বল সহজ সরল মানুষ। এক্সপার্টের ব্যবসা করে। তাদের একমাত্র মেয়ে নিসা।
একটু গুলুমুলু দেখতে। বয়স পাঁচ বছর। নীলাংশ আনমনেই ভাবে, ‘পিচ্চি থাকলে আজ আমাদেরও নিসার মতো মেয়ে থাকতো!’ নিসার প্রতি আলাদা টান অনুভব করে নীলাংশ। যেদিন নিসা হয়েছিলো সেদিন
সাহির জরুরি কাজে দেশের বাহিরে ছিলো। যাবতীয় কাজ ওই করেছে। জন্মানোর পর সবার প্রথম সেই কোলে নিয়েছিলো। নার্স তাঁকে বাবা ভেবেই কোলে তুলে দিয়েছিলো৷ নিসার দিকে তাকালেই তার পায়রার কথা মনে পড়ে। ওর মতোই মায়াবী মুখ। খাবার খাওয়ার সময় লাগে পায়রাকেই দেখছে যেনো। এটা হয়তো নীলাংশের দৃষ্টিভ্রম। মানুষের কাজই শূন্যতা ভরাট করার চেষ্টা করা। পায়রা নেই বলে নীলাংশের অবচেতন মন সারাক্ষণ এদিক সেদিক প্রিয় মুখটাকে খুঁজে বেরায়।
রুশানীর পাশে বসলো সাহির। নিসার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো-
‘আমার নিসা মা, কোলে এসো। ‘
নিসা অভিমানে ঠোঁট ফুলায়। টলমল চোখে নীলাংশের বুকে গুটিয়ে থাকে। সাহির হতাশ হয়। মেয়েটাকে সময় দেয়া হয়না। পারিবারিক ব্যবসা টিকিয়ে রাখা বেশ কঠিন। তাঁর বাবা চাচারা তিন ভাই ছিলেন। ভালোভাবেই চলছিলো সব। কিন্তু সাহির বংশে বড় ছেলে। আর সবগুলোই অনেক ছোট ছোট।
দেশ বিদেশে মাসের পর মাস পড়ে থাকতে হয়। কষ্ট লাগে, যখন মনে পড়ে প্রথম সন্তান জন্মানোর সময়ও সে উপস্থিত ছিলোনা। রুশানীর সঙ্গে প্রেমটা কলেজ লাইফের শুরু থেকেই। সেই সময়টা থেকেই নানা কল্পনা জল্পনা ছিলো, বিয়ের পর অনেক জায়গায় ঘুরবে, সন্তানকে নিয়ে ট্যুর করবে। কিন্তু এতো কাজের চাপ সামলিয়ে উঠতে হিমশিম খেতে হয়। রুশানী বলেই হয়তো সবটা মানিয়ে নিচ্ছে। অন্য কেউ হলে সাহিরকে ছেড়ে কথা বলতো না। মনের দিক থেকে অনেক ভালো। রাগটা একটু বেশি। হুটহাট রেগে ছুড়াছুড়ি করার অভ্যেস। তানভীর সাহেবের মৃত্যুর পর রাগী হয়ে গেছে।
রুশানী চোখ গরম করে তাকিয়ে নিসাকে বললো-
‘এটা কী ধরনের বেয়াদবি! বাবা ডাকছে যাচ্ছো না কেনো?’
নিসা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে-
‘আমি যাবো না, বাবা আমাকে ভালোবাসে না। ‘
সাহিরের মন ব্যাথিত হয়। নীলাংশ নিসার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো-
‘এসব কেনো বলছে আমার সুপারগার্ল! ‘
নিসা মুখ ফুলিয়ে বললো-
‘আমার পাশের বাসার সিফাতের বাবা ওকে রোজ কাঁধে করে খেলতে নিয়ে যায়। স্কুলের এশার বাবা ওর সাথে খেলা করে। আমার বাবা কিছু করেনা। ক্লাস রিনা বলে, নিসার বাবা নেই। ‘
নীলাংশের এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় সাত বছর আগের পায়রা তাঁর সাথে অভিমান করে কথা বলছে। অভিযোগ করছে। বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে তপ্ত নিঃশ্বাস। নিসা দৌড়ে নিজের খেলার ঘরে চলে যায়।
সাহিরের চোখের কোণে একটু একটু করে জল জমলো। ভীষণ অপরাধ বোধ জমাট বেঁধে গেলো। নীলাংশ সাহিরের মাঝে নিজেকেই যেনো দেখতে পেলো। ঠিক এমন করেই একদিন অভিমানীনির কথার শিকার হয়েছিলো সে। সাহিরের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘সাহির, প্রিয় মানুষগুলো সময় দাও। শত ব্যস্ততা থাকুক। কিন্তু বিপরীতের মানুষ যেন কখনো অনুভব না করে, তুমি অবহেলা করছো তাকে। যার জন্য এতোটা পরিশ্রম করছো, দেখবে সেই হারিয়ে যাবে। রেখে যাবে একগুচ্ছ অনুশোচনা আর গ্লানি। আর এই বোঝা বয়ে বেড়ানো মৃত্যুসম। ‘
উঠে দাঁড়িয়ে মলিন হাসি ফুটিয়ে বললো –
‘ছোট মানুষ, একটু সময় কাটাও ঠিক হয়ে যাবে। এর চেয়ে বড় অভিমানীর ভুক্তভোগী আমি। ‘
সাহির দ্রুত পদে মেয়ের দিকে এগিয়ে চলে যায়। নীলাংশ একবার তাকিয়ে বের হয় অফিসের জন্য। কথা বলতে বলতে লেট হয়ে গেছে।
অফিসের মিটিং রুমে বসে আছে সবাই। শুধু আসল মানুষটিই অনুপস্থিত। কোম্পানির মালিক এখনও উপস্থিত হননি। পায়রার চোখ মুখ রাগে খিটমিট করছে। আভাস নির্লিপ্ত। পায়রা রেগে বললো-
‘অদ্ভুত তো! যার উদ্দেশ্যে মিটিং সেই এবসেন্ট । সময়ের কোনো দাম নেই আমাদের? ‘
আধা ঘণ্টা যাবৎ বসে থেকে মেজাজ খিচিয়ে আছে। মনে মনে ভেবেই নিয়েছে, লোকটা আসলে ইচ্ছে মতো ঝেড়ে দিবে। কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। আভাস যে কী ভেবে এমন একটা কোম্পানির সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলো! এসব ভেবে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।
মিস্টার আডাম বসে আছেন। তিনিও খানিকটা বিরক্ত। সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আকাঙ্খিত ব্যাক্তিটি ভেতরে আসলেন৷ সবাই সেদিকে তাকালো। নীলাংশ এসেই মৃদু হেসে বললো –
‘সরি, লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যান। এগেইন সরি ফর লেইট। ‘
আওয়াজ শুনেই কান ঝিঝি করে উঠলো পায়রার। রাগে নিচের দিকে মাথা নুইয়ে রেখেছিলো সে। গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। এই কন্ঠস্বর যে পায়রার আত্মস্থ। যে কন্ঠের মানুষটাকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসে ছিলো। যাকে নিজের জীবনের ধ্যান জ্ঞান মেনেছিলো। সাহস জুগিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে।
নীলাংশ সবার দিকে তাকিয়ে বসতে নিয়ে থমকে দাঁড়ালো। তড়িৎ গতিতে সামনে বসা মেয়েটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বজ্রাহত হয়ে গেলো যেনো। তারপরে যা হলো, তা কেউ ভাবতে পারেনি!
চলবে-