“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৫৬
বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লো নীলাংশ। প্রথম দুই মিনিট নিজের চোখ দুটোকে অবিশ্বাস করলো। নিশ্চয়ই এটা কোনো ভ্রম। সত্যি কীভাবে হবে! যাকে কিনা নীলাংশ গত সাতটি বছরে তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। যার আওয়াজ শুনতে রাত বিরেতে ফুপিয়ে কেঁদেছে। যে মেয়েটার জন্য তার নিঃশ্বাস নেয়া দুর্বিষহ হয়ে গেছে। মাথা চক্কর দিচ্ছে। পাশের চেয়ারটা খামচে শক্ত হয়ে দাঁড়ালো।
পায়রার চোখ নিষ্প্রাণ। অনুভূতিহীন হয়ে গেছে যেনো। এত বছর পর মানুষটাকে দেখে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আগের পায়রা যদি হতো, তাহলে কেঁদেকেটে অজ্ঞান হয়ে যেতো। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। মিস্টার আডাম দুজনের ভাবগতি লক্ষ্য করে বললো-
‘ইজ এভরিথিং ওকে?’
নীলাংশের হতভম্বতা ক্রমশ কাঁপুনিতে পরিণত হলো।
ঠোঁট চেপে ধরে রাখলো। এসিতে আচ্ছাদিত রুমটাতেও গলা বেয়ে ঘামের উষ্ণ প্রস্রবণ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে বসা পূর্ণ যুবতী মেয়েটির দিকে। এই কী সে! যে আঁধারে বাড়ি ছেড়েছিলো! গায়ে হালকা ম্যাজেন্ডা রঙের টপস, গলায় একটা স্কার্ফ, হাতের কনুইয়ের একটু উঁচুতে পনিটেইল করা স্ট্রেইট চুল। গায়ের ফর্সা বর্ণ যেনো আরও উজ্জ্বল হয়েছে। মুখের একপাশে দাগটা দেখে যে কারো মনে হবে জোৎস্নার চাঁদ । দাগটা নিতান্তই সৌন্দর্যের প্রতীক।
সামলাতে পারলোনা নিজেকে নীলাংশ। শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসে। দৌড়ে টেবিলের ওপাশে চলে আসে। এক হাতে পায়রাকে টেনে তুলে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দুই হাতে নিজের বুকে সমাহিত করে নেয়। পায়রার কোমল শরীর তুলোর মতো মিলিয়ে যায়। নীলাংশের বাহুডোরে পিষ্ট হলো যেনো। নীলাংশের মনে হয় শুষ্ক মরুভূমির ভিতর গমগমিয়ে বৃষ্টির আগমন হলো। প্রেমিক বুকের তৃষ্ণা মিটলো। জাপটে রেখে মুখ গুঁজে রাখলো ফর্সা কাঁধে। চোখের নোনাজলে ভিজে গেলো পায়রা। নীলাংশ ভাঙা গলায় বললো-
‘তুমি কোথায় ছিলে পিচ্চি! জানো, কত খুঁজেছি তোমাকে? এত নিষ্ঠুর কী করে হতে পারলে! তোমাকে ছাড়া আমি একটুও ভালো নেই পিচ্চি। ‘
পায়রা বুক কাঁপলো। চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে টুপ করে জল পড়লো। হঠাৎ মনে হলো, সব ভুল। সামনের মানুষটা ঠিক। একে ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন নেই। আবেগের স্রোতে ভেসে যেতে ইচ্ছে করলো। কত নির্ঘুম রাত কেটেছে। বাঁধ ভাঙা অশ্রুপাতে মন ভেঙেছে। সুপ্ত প্রেমিকা মনটা জেগে বললো-
‘দুনিয়া গোল্লায় যাক! ভালোবাসা আগে!’
আনমনেই দুই হাতে নীলাংশকে জড়িয়ে ধরতে নিলো। কিন্তু বাঁধ সাধলো আত্মসম্মানী নারীসত্ত্বা। মনের ইচ্ছেকে ধাক্কিয়ে মনে করিয়ে বললো-
‘নাহ, আত্মসম্মান আগে। ভুলে গেলি, সাত বছর আগে কী হয়েছিলো! ‘
পায়রা হাত গুটিয়ে নিলো। শক্ত হয়ে গেলো মনমস্তিষ্ক।
এক বেইমানের বাহুডোরে আছে ভাবতেই রাগে চোখ লাল হলো। এক ধাক্কায় সরিয়ে দিলো নীলাংশকে। নীলাংশ হতভম্ব। এমন আচরণ মেনে নিতে পারলো না। পরমুহূর্তেই ভাবলো তার পিচ্চি বড্ড অভিমানী।
হয়তো অভিমানেই তার এহেন আচরণ। কিন্তু চমকে উঠলো যখন দেখলো, সাত বছর আগ পর্যন্ত যে চোখে তাকালে দেখা যেতো এক সমুদ্র ভালোবাসা,এক আকাশ বিশ্বাস, লজ্জা। সে চোখদুটো এখন ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় পরিপূর্ণ। হাত দিয়ে চোখ মুছে নিলো সে। কোনো ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে ইচ্ছে করছে না।
মিস্টার আডাম, দুজনের সম্পর্কে কিছুটা বুঝতে পারলেও কথোপকথন গুলো বুঝতে পারছেনা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিজের ভাষায় বললো-
‘আপনারা কী পূর্ব পরিচিত? মিস বোস, আপনি কী মিস্টার নীলকে আগে থেকে চেনেন? ‘
কেউ কিছু বলার আগেই পায়রা অগ্নিমূর্তির রূপে তপ্ততা নিয়ে কঠিন কন্ঠে বললো-
‘না। চিনিনা আমি। ইনি সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ। ‘
বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হলো যেনো নীলাংশ। তীরের মতো বুকে এসে লাগলো কথাটা। চোখ বাঁধা মানলো না। পায়রার বাহু আঁকড়ে শক্ত করে বললো –
‘এই মেয়ে এই! চেনো না আমাকে? আমি অপরিচিত! ‘
পায়রা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। দুই হাত দূরে সরে গেলো। রাগে দুঃখে শরীর কাঁপছে তার। এই মানুষটার মুখোমুখি হতে হবে বলেই তো ভিনদেশে পড়েছিলো!
চিৎকার করে বললো –
‘চিনিনা আমি। আমার সামনে দাঁড়ানো বেইমান লোকটাকে চিনিনা আমি। ‘
নীলাংশ অসহায় হয়ে পড়লো। কাছে এসে বললো-
‘বিশ্বাস করো, আমি বেইমান নই। আমি যা ছিলাম , তাই আছি। ‘
পায়রা তাচ্ছিল্য করে বললো-
‘তাই নাকি! বাহ, দুর্দান্ত অভিনেতা আপনি। ‘
নীলাংশ পরবর্তী কথা বলার আগেই কেবিনের দরজায় নক করলো কেউ। দরজা চাপিয়ে রাখাছিলো। খোলা পেতেই নিসা দৌড়ে এসে নীলাংশকে জাপটে ধরলো। নীলাংশ তাকাতেই নিসা খিলখিল করে হেসে বললো –
‘সুপারম্যান, আমি এসে গেছি। ‘
ছোট মেয়েটাকে দেখে স্তব্ধ হলো পায়রা। একমুহূর্তের জন্য খুব করে চাইছিলো, নীলাংশের কথাটা সত্যি হোক। কিন্তু মেয়েটাকে দেখেই মন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। নিষ্ক্রিয় চোখে তাকিয়ে মলিন মুখে বললো-
‘আপনার মেয়ে তাই না?’
নীলাংশ অবাক হয়ে কিছু বলার আগেই পায়রা থামিয়ে চিৎকার করে বললো –
‘ব্যস। আর একটা কথাও না। বিয়ে করে এত বড় মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও আরেকটা নাটক! ‘
এক মুহূর্ত এখানে দাঁড়ালে কান্না করে ফেলবে ভেবেই আভাসের সামনে এসে চিল্লাতে চিল্লাতে বললো-
‘আপনি ইচ্ছে করে এখানে নিয়ে আসলেন তাই না?কেনো করলেন এমন! এই ঠকবাজ লোকটার সামনে কেনো আনলেন?’
আভাস ইচ্ছে করেই পায়রাকে এনেছিলো। নীলাংশের নামটা আগেই দেখেছে সে। কিন্তু, পায়রা এতোটা এগ্রেসিভ হয়ে উঠবে ভাবেনি। আভাস পায়রাকে টেনে বললো-
‘এটা জরুরি ছিলো পায়রা। ‘
পায়রা রাগে ফসফস করছে। চোখের পলক ফেলে কান্না আটকাচ্ছে। কী মনে করে নীলাংশের দিকে তাকিয়ে বললো –
‘আর কোনোদিন আমার সামনে আসবেন না। আমি বিবাহিত। ‘
নীলাংশ বিস্মিত হলো। ‘বিবাহিত ‘ শব্দটা ধারালো ছুরির মতো আঘাত করলো তাকে। নাহ, এটা কোনোদিন হতে পারে না। তাঁর পিচ্চি কী করে অন্য কাউকে বিয়ে করবে! অসম্ভব। কৌতুকের মতো হাসলো। এলোমেলো হয়ে বললো-
‘মিথ্যা বলছো তুমি তাইনা?’
‘যা বলছি তা সত্যি। আমি মিস্টার আভাস বোসের স্ত্রী।’
পায়রা আভাসের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। দুজনের ঘনিষ্ঠতা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো নীলাংশ। এতগুলো বছরের সাজানো ঘরটা নিমিষেই ভেঙে টুকরো হয়ে গেলো। দুই হাতে চুল টেনে বিরবির করে বললো –
‘না না! এ এসব সব মিথ্যা, বানোয়াট। ‘
বুকের তীব্র ব্যাথায় গা গুলিয়ে আসলো। শক্তিহীন হয়ে গেলো। দৌড়ে কেবিন থেকে বের হলো সে। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কোনো কিছুই আর কাজ করছে না। কোম্পানির ছাঁদে এসে পড়লো সে। হাঁটু ভেঙে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আশেপাশের পাখিগুলো কিচির মিচির শব্দে উড়ে গেলো। আকাশও ব্যাথিত হলো। নীলাংশের তীব্র হাহাকারে পরিবেশ বৈরী হলো। এ কী করে সম্ভব! যার জন্য কিনা সে সাতটা বছর একাকীত্বে গুমরে গুমরে মরেছে। সে অন্য কারো! জীবনের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণায় উঠে দাঁড়ালো। কোনো মানেই হয়না বেঁচে থাকার। যে আশায় শ্বাস নিচ্ছিলো সব ঠুনকো। ধর্মজ্ঞান, শিক্ষা, বয়স সব ভুলে গেলো সে। ছাঁদের কিনারায় এসে দাঁড়ালো। নিচের দিকে ঝুঁকল। তেরো তলার সুউচ্চ বিল্ডিং-এর ছাঁদ থেকে একটা লাফ দিলেই শরীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সামনেই মৃত্যু। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই প্রাণপাখি দেহের মায়া ত্যাগ করে চলে যাবে। নীলাংশ ভুলে গেলো, এই পর্যন্ত শুনে আসা সকল নৈতিক বাক্য, পরকালের ভয়াবহ শাস্তি। মুক্তির আশায় চাতক পাখির মতো রেলিঙের উপর উঠে দাঁড়ালো। চোখ বন্ধ করে নিলো। শেষ বারের মতো অশ্রু বিসর্জন হলো। শেষ বারের মতো নিজের বুকে সমাহিত নির্মল প্রেমিকার মুখ চোখ ভাসলো। উল্টো গণনা শুরু করলো। পাঁচ সেকেন্ড পর মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে শরীর। পাঁচ, চার, তিন, দুই…
চলবে-
(এত কষ্ট করে লিখছি,গ্রুপে রিভিউ কোথায়?)